জ্বলদর্চি

আবৃত্তির পাঠশালা-১৯/শুভদীপ বসু

আবৃত্তির পাঠশালা-১৯

শুভদীপ বসু

বিষয়-কবিতার নির্বাচন

একজন আবৃত্তিকার নিজের অন্তরালে অধ্যয়ন ও অনুশীলনের মধ্য দিয়ে নিজেকে প্রস্তুত করবেন প্রত্যেকটি সময় কিন্তু তার মূল কাজটা জনতার দরবারে। তাই মঞ্চে কবিতার নির্বাচনের ব্যাপারটা অত্যন্ত জরুরী আবৃত্তিকারের পক্ষে। জনগণের সাথে সহজেই আপন করে নিয়ে যদি আবৃত্তিকার কোন চটুল মনোরঞ্জনপূর্বক, সস্তা বিষয় নিয়ে উত্তেজনা সৃষ্টি করতে চান তা যেমন দায়িত্বশীল শিল্পীর পক্ষে অপমানজনক ঠিক তেমনি সৎ সাহিত্য বা গভীর কবিতার প্রচার করার জন্য যদি শ্রোতার সঙ্গে সংযোগ না করতে পারেন তবেও আবৃত্তি শিল্পীর কাছে তা চরম ব্যর্থতা। তাই যে কোন শিল্পীর মতোই আবৃত্তিকারকেও দায়িত্ব নিয়ে কবিতার গভীরে দর্শকদের যেমন টেনে নিয়ে যেতে হবে ঠিক তেমনি শ্রোতাদের সাথে সংযোগ রাখতে হবে তবেই মঞ্চে আবৃত্তিকার জিতে যাবেন।

অনুশীলন: একজন আবৃত্তিকারের অনুশীলনের ক্ষেত্রে কোন সীমারেখা থাকা উচিত নয়। সবরকম বিষয়ে যাতে তিনি আবৃত্তি করার যোগ্যতা অর্জন করতে পারেন ঠিক সেভাবেই তাকে অনুশীলন করতে হবে। অর্থাৎ একজন আবৃত্তিকার যেমন প্রেমের কবিতা বলবেন ঠিক তেমনি প্রতিবাদের কবিতাও বলবেন। তার কণ্ঠ প্রয়োজনে যেমন নরম হবে ঠিক তেমনই প্রয়োজনে গর্জে উঠবে। স্বর ও সরগ্রাম সম্বন্ধীয় চর্চা,উচ্চারণ, ব্যাকরণ এর জটিল বিষয়,ছন্দ, অলংকার, অভিব্যক্তি, কবির পরিচয়, কাব্য সাহিত্যের ইতিহাস ইত্যাদি সম্পর্কে আবৃত্তিকারকে সম্যক জ্ঞান লাভ করতে হবে।

অনুষ্ঠানের পরিবেশ: একজন আবৃত্তিকার যে অনুষ্ঠান করতে যাচ্ছেন সেখানের পরিবেশ স্থান-কাল-পাত্র সম্পর্কে আগে থেকে ওয়াকিবহাল হওয়া দরকার।কারণ যে বিষয়ে পঁচিশ জনের মধ্যে পরিবেশন করা চলে সেই একই বিষয়ে পাঁচ হাজার জনসমাবেশে চলেনা। এই দুই পরিবেশে পরিবেশগত কারণে শ্রোতার মনসংযোগ একই রকম থাকে না। আবার একই কবিতার যে আবৃত্তির রূপ ঘনিষ্ঠ পরিবেশে পরিবেশন করা চলে, বিক্ষিপ্ত মানসিকতার শ্রোতাদের কাছে সেই কবিতার আবৃত্তিরূপের উত্থান-পতন, ছন্দের ঘাত-প্রতিঘাত, অভিব্যক্তির মাত্রা অনেক বাড়িয়ে তুলতে হয়।তবেই যথার্থ সংযোগ ঘটতে পারে। সেক্ষেত্রেও সঠিক নির্বাচনের কথা আবৃত্তিকারকে ভাবতে হবে।

আবৃত্তিকার একজন সৎ শিল্পী: সমস্ত কিছুর ঊর্ধ্বে যে কথাটা বলতে চাই তা হল, আবৃত্তিকার একজন সৎ শিল্পী। তাই তিনি যা কিছু সত্য বলি উপলব্ধি করবেন কেবল সেটুকুই বলবেন জনতার কাছে। যে ব্যক্তি রাজনীতি থেকে বহুদূরে মিটিং-মিছিল পছন্দ করেন না, স্লোগান বলেন না, তিনি যখন জেহাদের স্লোগান কবিতায় বলেন, যিনি ঈশ্বরে বিশ্বাসী নয় তিনি যখন আধ্যাত্ম চেতনার কবিতা বলেন, যে আবৃত্তিকার প্রকৃতিপ্রেমী নয় বর্ষার ঝড়ো বাতাস অথবা বসন্তের পেলব প্রকৃতি যাকে উদ্বেল করে না, তিনি যখন সেরকম প্রকৃতি বিষয়ক কবিতা উপস্থাপন করতে যান তখন নির্বাচনের অন্য সমস্ত শর্তই অক্ষুন্ন থাকলেও সে আবৃত্তি শিল্পের নন্দন বিন্দুকে স্পর্শ করতে পারে না। এরূপ যান্ত্রিক আবৃত্তি শুনে কান যদিও ভরে মন ভরে না।

কবিতা নির্বাচন:সচরাচর আমরা যা দেখি একজন আবৃত্তিকার তার স্মৃতির ঝুলি থেকে নির্দিষ্ট দশ-পনেরটি কবিতা বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন মঞ্চে বলে থাকেন। এক্ষেত্রে অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে বহু কবিতা স্মৃতিতে না থাকলে নির্বাচনের ক্ষেত্রে বড় অসুবিধায় পড়তে হয় আবৃত্তিকারকে। ধরুন আপনি বাড়ি থেকে ঠিক করে গেছেন অমুক নির্দিষ্ট দু-তিনটি কবিতা আপনি বলবেন। কিন্তু দেখলেন আপনার আগেই কোন শিল্পী আপনার পছন্দের কবিতাগুলি বলে দিয়েছে তখন আপনি পড়বেন খুব মুশকিলে। সচরাচর কোনও বিষয়কেন্দ্রিক অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে এরকম অসুবিধেতে শিল্পীরা পড়তে পারেন। তাই এসব ক্ষেত্রে আপনার ঝুলিতে থাকা অসংখ্য কবিতা আপনাকে সাহায্য করবে মঞ্চে অন্যরকম স্বাদ এনে দেওয়ার ক্ষেত্রে। তাই মঞ্চে ওঠার আগে অবশ্যই আপনি ভেবে নিতে পারেন কোন কোন কবিতাগুলি আপনি উক্ত দিনের অনুষ্ঠানে আবৃত্তি করবেন তবে সেই নির্বাচিত কবিতার সংখ্যাটা একটু বেশি থাকাই ভালো।
সাউন্ড সিস্টেম: শিল্পী যেখানে অনুষ্ঠান করতে যাচ্ছেন সেখানের সাউন্ড সিস্টেম সম্পর্কে যদি আগে থেকে জানা থাকে তাহলে ভালো হয়। প্রথমত অনুষ্ঠানটি খোলা জায়গায় হবে না কোনো প্রেক্ষাগৃহে হবে এই সম্পর্কে জ্ঞাত হলে কবিতার নির্বাচন সে রকম হতে পারে। যে জায়গায় অনুষ্ঠানটি হচ্ছে সেখানে কোনও সাউন্ড সিস্টেম আছে কিনা নাকি খালি গলাতেই অনুষ্ঠান করতে হবে সে সম্পর্কে শিল্পী আগে থেকে জানলে নির্বাচনের ক্ষেত্রে তার সুবিধা হয়। যদি কোন স্টুডিও প্রোগ্রাম হয় তবে সে ক্ষেত্রে শিল্পীর স্বরগ্রাম যেরকম হবে তা কখনোই খালি গলায় অথবা দর্শক আসনসম্পূর্ণ প্রেক্ষাগৃহে এক হবে না।

দর্শকের মন: একজন শিল্পী যদি দর্শকের মন বুঝতে পারে তবে কবিতা নির্বাচনের ক্ষেত্রে সে অনেকটাই সুবিধা পেতে পারে। ধরুন কোনও বিদ্যালয়ের অনুষ্ঠানে একজন আবৃত্তিকার যদি ছোটদের উপযোগী কোন কবিতা বলেন সে ক্ষেত্রে সেই শিল্পী ছোটদের কাছে মান্যতা পায়। কিছু জনপ্রিয় কবিতা বলার পর সে ক্ষেত্রে সে আনকমন কবিতার দিকে যেতে পারে। যে সমস্ত অনুষ্ঠানের প্রচুর দর্শক রয়েছে যারা প্রত্যেকেই কবিতার বোদ্ধা নয়, এমন ক্ষেত্রে খুব সহজ-সরল বিষয়কে নিয়েই কবিতা নির্বাচন করা উচিত। যদি এক্ষেত্রে কোনও জনপ্রিয় কবিতা দর্শকের সাথে সাথে উচ্চারণ করা যায় তবে তা সফল মঞ্চায়ন হতে পারে। মঞ্চে উঠেই আবৃত্তিকার মঞ্চ থেকেই দর্শকাসনে অমনোযোগী দর্শকদের সাথে যদি চোখে চোখ রেখে অর্থাৎ আই কন্টাক্ট করে কবিতা বলেন তবে অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় সেই সমস্ত অমনোযোগী দর্শকরা স্রোতের বিপরীতে না গিয়ে কবিতার সহযাত্রী হয়ে পড়ছেন।

অনুষ্ঠানের বিষয়: যে অনুষ্ঠানে আবৃত্তিকার ডাক পেয়েছেন সেই অনুষ্ঠানের বিষয়টি কি সে সম্পর্কে আবৃত্তিকার আগে থেকেই জানবেন। অনুষ্ঠানটি কোনও শোকসভার নাকি কোন জন্মদিনের নাকি কোন বিদ্যালয়ের বার্ষিক অনুষ্ঠান অথবা দেশাত্মবোধক কিংবা রবীন্দ্র-নজরুল জয়ন্তী মূলক অনুষ্ঠান উক্ত বিষয় সম্পর্কে আগে থেকেই সতর্ক থাকা উচিত।বিষয় সম্পর্কিত কবিতা না হলে অনুষ্ঠানটি খেই হারিয়ে ফেলে।

সঠিক কবিতার নির্বাচনই একজন আবৃত্তিকারকে পরিপূর্ণ শিল্পী করে তুলতে পারে।

পেজ-এ লাইক দিন👇
আরও পড়ুন 

Post a Comment

1 Comments

  1. আনেক সুন্দর একটা পোস্ট , অনেক কিছু জানতে পারলাম ! Ajker Bangla Newspaper

    ReplyDelete