জ্বলদর্চি

আফ্রিকা (তানজানিয়া)-র লোকগল্প / চিন্ময় দাশ

দূরদেশের লোকগল্প-- আফ্রিকা (তানজানিয়া)
চিন্ময় দাশ 

এক আকাশের দুই পাখি

একবার কাক-রাজার মনে হোল, সেনাবাহিনীটা একটু বাড়ানো দরকার। কাক-সেনাদের দিয়ে বড়-সড় লড়াই লড়া যায় না। এ কাজে চিল-সেনারা বেশি চৌকশ হবে।
যেমন ভাবনা, তেমন কাজ। চিল-রাজাকে একটা চিঠি পাঠান হোল। একেবারে ছোট্ট একটি বয়ান-- আমি চাই, সব চিলকে নিয়ে, তুমি আমার বাহিনীতে এসে যোগ দাও।
চিরকুটটা পেয়ে, চিল-রাজার তো মাথা গরম হয়ে গেল। এত আস্পর্ধা ওই কেলে-কুষ্মান্ডটার ! উচিত শিক্ষা দিতে হবে হতভাগাকে। মন্ত্রী পাশেই ছিল। রাজার রাগ দেখে, সে বলল-- মাথা গরম করা রাজার কাজ নয়। যা করবেন, ঠান্ডা মাথায়।
সেই মতো চিল-রাজা জবাব দিল আরও ছোট্ট বয়ানে-- সেটি হচ্ছে না।
পরদিনই কাক-রাজ্য থেকে উত্তর এসে গেল-- হুকুম মানবে না? তাহলে লড়াইর জন্য তৈরী থাকো। 
চিল-রাজা জানাল-- সেটাই আমার পক্ষে মর্যাদাকর। তবে, একটা শর্তেই লড়ব আমরা। যদি আমরা হারি, তোমার বাহিনীতে যোগ দেব। আর যদি উল্টোটা হয়, মানে তোমরা হারো, চাকর হয়ে খাটতে হবে আমার জন্য। সাহস থাকলে, জানাবে।
চিঠি চালাচালি থেমে গেল। দু'পক্ষই তৈরী হতে থাকল যুদ্ধের জন্য। শুধু কি তানজানিয়া? আশেপাশে যত এলাকা ছিল, খবর গেল সকলের কানে। মান-মর্যাদার লড়াই। ঘরে তো আর লুকিয়ে বসে থাকা যায় না। যেখানে যত কাক আর চিল ছিল, সবাই এসে যোগ দিতে থাকল নিজের নিজের বাহিনীতে। 
লড়াই শুরু হল একদিন। সে এক মহাযুদ্ধ। পৃথিবীতে পাখ-পাখালির এত বড় যুদ্ধ কেউ কোনদিন দেখেনি। এমনকি, শোনেওনি কোনদিন।
সূর্যের আলো পড়তে পারল না মাটিতে। সারা আকাশ ঢেকে গেল পাখির ডানায় ডানায়। কেউ যেন বিশাল একখানা ছাতা মেলে আকাশ ঢেকে দিয়েছে। কাক আর চিলে সারা আকাশ ছয়লাপ। যুদ্ধটা হোল ভয়ানক। তবে সেই মহাযুদ্ধ সময় নেয়নি বেশি। কিছু সময় না কাটতেই লড়াই শেষ। যাকে বলে, একেবারে গো-হারা হয়ে গেল কাক-বাহিনী। ছিঁড়ে-খুঁড়ে নাস্তানাবুদ করে দিয়েছে চিলেরা।
এখুনি এ লড়াই না থামালে, সবাইকে মারা পড়তে হবে। কাক জাতিটাই মুছে যাবে দুনিয়া থেকে। এই ভেবে, এক বুড়ো কাক রাজার কানে কানে কী যেন বলে এল। অমনি অন্য ছবি। লড়াইর ময়দান ছেড়ে পালাতে লাগল কাকেরা।
 পালানো মানে পালানোই। লড়াইর ময়দান শুধু নয়। নিজেদের ঘরবাড়ি, এলাকা ছেড়েও পালাতে লাগল কাকেরা। উড়তে উড়তে, সবুজে ঢাকা গোটা আফ্রিকা মহাদেশ পেরিয়ে এল যখন, ডানার তলায় তখন নীল সমুদ্র। কুল কিনারা নাই সে সমুদ্রের। বুড়োকাক বলল-- পালাও, রাজা। নইলে প্রাণ বেঁচেছে, এবার মান যাবে। উড়তে থাকো আরও।
কোথায় চলেছে, জানা নাই কিছু। প্রাণের ভয়ে লড়াই ছেড়েছে। এবার দেশ ছাড়ছে কাকেরা মানের ভয়ে। ধরা পড়লেই, চাকর হয়ে থাকতে হবে চিলেদের, সেই ভয়। পুরো আটলান্টিক পার হয়ে, আমেরিকায় এসে পড়ল যখন, রাজা বলল-- এবার থামো হে, বুড়ো। আর পারা যাচ্ছে না।
সেখানে ডানা গুটিয়ে নেমে পড়ল কাকেরা। হাজার হাজার কাক। আকাশ কালো করে উড়ছিল সবাই। এবার নেমে এল মাটিতে। গাছের ডালপালা, টিলা-ডুঙরি, মাটিতে-- যে যেখানে পারল বসে পড়ে, দম নিতে থাকল। জনপ্রাণী নাই এলাকাতে। বেশ পছন্দ হয়ে গেল সকলের। বাপ-ঠাকুরদার এলাকা ছেড়ে, নতুন এই দেশে আস্তানা গড়ে তুলল  কাকেরা। ( KFC নাম আজ সারা বিশ্বে পরিচিত-- কেন্টাকি ফ্রায়েড চিকেন। আমেরিকার সেই কেন্টাকি প্রদেশের খুব প্রত্যন্ত একটা এলাকায় এসে নেমেছিল কাকেরা। নতুন করে নিজেদের ডেরা গড়ে তুলেছিল। তখন থেকে এলাকার নাম হয়ে উঠেছিল-- CROWTOWN . ৩৭.১২৭৮ উত্তর, ৮৭.৮৯৩৬ পশ্চিম। আমেরিকার মানচিত্র খুঁজলে, পাওয়া যাবে শহরটিকে। )
নতুন দেশ। নতুন ঘর-বাড়ি সকলের। চিল-শকুনের উৎপাত নাই এখানে। বেশ সুখেই জীবন কাটছে কাকেদের। কিন্তু রাজার মনে সুখ নাই। লড়াই ছেড়ে, নিজের এলাকা ছেড়ে পালিয়ে আসতে হয়েছে, এই অপমানটা বড্ড খচখচ করে মনের মধ্যে। প্রতিশোধ নেবার একটা উপায় বের করল রাজা।
বুড়ো কাককে ডেকে বলল-- আমি একটু বাইরে যাব কিছুদিন। পাঁচজন যুবক কাককেও সাথে নেব। তুমি ততদিন সবাইকে দেখভাল করবে। আর কিছু না বলে, কাকরাজা বেরিয়ে চলে গেল। 
যে পথে নিজেদের ঘরবাড়ি ছেড়ে চলেএসেছিল, সেই পথ ধরে এসে, চিলেদের আস্তানার কাছে দলবল নিয়ে উপস্থিত হল কাকরাজা। রাজার হুকুম পেয়ে, পাঁচ সঙ্গী ঠোঁট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে রাজার পেটের দিকের কিছু পালক ছিঁড়ে ফেলল। ডানার পালক দু'চারটেও এলোমেলো করে ফেলল টেনে মুচড়ে। একেবারে বিধ্বস্ত অবস্থা হল কাকের। যে কেউ দেখলেই চমকে যাবে। 
ভোর না হতেই চিলেদের পাড়ায় গিয়ে হাজির হল কাক।  রাস্তার উপর পড়ে রইল চিৎপটাং হয়ে। ডানা ঝাপটে বেশ করে ধুলো মেখে নিল সারা গায়ে। চিৎ হয়ে শুয়েছে। পা দু'খানা ছড়িয়ে আছে পেটের উপর। মাথাটা কাত করে একদিকেএলানো। চোখ খোলা রেখেছে, যাতে মারা গেছে ভেবে, ভুল না করে কেউ।
সকাল হয়েছে।  চিলেরা বাইরে বেরিয়ে কাকটাকে দেখতে পেল। - -আরে, এই তো সেই হতভাগা। হেরে গিয়ে, শর্ত না মেনে, পালিয়ে গিয়েছিল। 
বুড়োমতন একজন বলল-- তোমার এই অবস্থা হল কী করে হে?
এটাই চাইছিল কাকরাজা। গলা পাল্টে, মিনমিন করে বলল-- আমার নিজের লোকেরাই এই হাল করেছে আমার।
-- কেন, কেন? প্রজারা রাজার এমন দশা কেন করল? 
-- ভুল বলো, অপরাধ বলো, লড়াই হেরে যাওয়ার পর, আমি বলেছিলাম-- চলো, সবাইকে চিলরাজার কাছে যেতে হবে। শর্ত তেমনই আছে। কিছুতেই রাজি হল না কেউ। আমি তখন হুকুম করতে গেলাম যেই, অমনি সবাই মিলে ঝাঁপিয়ে পড়ল আমার উপর। কোন রকমে মরতে মরতে বেঁচে গেছি।
ধরাধরি করে কাককে রাজার কাছে নিয়ে এল চিলেরা। চিলরাজা সব শুনল। কাক বলল-- উড়তে পারি না। ভর দিয়ে দাঁড়াতে পারি না নিজের পায়ে। কোন রকমে ঘষটে ঘষটে আসছিলাম রাজার দরবারে। কথার খেলাপ করতে শিখিনি আমি।
রাজা ভারী খুশি। বলল-- তুমি তো বেশ ভালো লোক হে। ঠিক আছে। কোথায় আর যাবে। থাকো আমাদের সাথেই।
কাক থাকে চিলেদের সাথে। যতক্ষণ চিলেরা থাকে, কাক তখন ভারি অসুস্থ লোক। উঠতে পারে না। বসতে পারে না। চিলেরাই তাকে খাবার এনে দেয়। চিলরা বেরিয়ে গেলেই, কাক তখন আবার সুস্থ। ঘুরে বেড়ায়, শুয়ে-বসে থাকে। আর ভাবতে থাকে, কী করে অনিষ্ট করা যায় এদের। 
একদিন বুড়োমতন সেই চিল বলল-- শোন হে, তিন দিন বাদে চার্চে যাব আমরা। তোমাকেও নিয়ে যাবো। 
কাক জানতে চাইল-- কোথায় তোমাদের চার্চ? 
চিলবুড়ো পথের হদিশ বুঝিয়ে বলে দিল কাককে। সবাই বেরিয়ে গেল যেই, চুপি চুপি তার পাঁচজন সঙ্গীর কাছে গিয়ে হাজির হল কাকরাজা। পথের হদিশ দিয়ে বলল-- এখনই একবার গিয়ে দেখে আয় ঘরটা। তারপর বনের শুকনো কাঠকুটো কুড়িয়ে, সাজিয়ে রাখবি ঘরটার তিন দিকে। সামনের দিকটায় যাবি না। কিছু ডালপালা আশেপাশে কোথাও লুকিয়ে রাখবি। দেখবি, তিন দিন সময় আছে। কাজ যেন ঠিকঠাক হয়। ভুলচুক না হয় কিছু।
সব কাজ হয়ে গেল সাজানো ছক অনুযায়ী। চার্চে যাওয়ার দিন পেটের ব্যথার বাহানা করে, শুয়ে রইল কাক। বাইরে বের হল না। চুপি চুপি গিয়ে হাজির হল সঙ্গীদের কাছে। তাদের নিয়ে চুপিসারে চার্চে এসে হাজির হল। দরজার পাল্লা পুরো ভেজানো। ভিতর থেকে ট্যাঁ-ট্যাঁ সুরের মৃদু কিন্তু গমগমে আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। প্রার্থনা করছে চিলেরা।
এমন মওকা বহু ভাগ্যের ব্যাপার। বাড়িটার তিন দিকে শুকনো ডালপালা বিছানোই ছিল। চটপট লুকানো ডালপালা দরজার সামনে এনে জড়ো করতে লাগল কেউ। কেউ আগুন ধরাতে লাগল। চারদিকেই যখন আগুন জ্বলে উঠল দাউদাউ করে, সঙ্গীদের নিয়ে সরে পড়ল কাকরাজা।
চিলেরা যখন টের পেল, অনেক দেরি হয়ে গেছে। দরজা-জানালার কাঠে আগুন ধরে, ধোঁয়ায় ভর্তি হয়ে গেল ঘরটা। হুড়োহুড়ি করে বের হতে গিয়ে, সে এক হুলুস্থূল কান্ড। কতজন মারা পড়ল লেখাজোখা নাই তার। পেছনের দিকের কয়েকজনই বেরুতে পেরেছিল। বাকিরা ধোঁয়ায় দম আটকে, আগুনে পুড়ে ছটফট করতে করতে সেখানেই মরে পড়ে রইল।
ঘরটার ভিতরে রাজা ছিল সকলের সামনে। বের হতে গিয়ে সে পড়ে গিয়েছিল সবার পিছনে। ঠেলাঠেলি চেঁচামেচি করেও, কিছু সুবিধা করতে পারেনি বেচারা। দম আটকে মারা পড়েছিল সেখানেই।
কাকরাজার এই দুষ্কর্ম কিন্তু পুরো গোপন থাকেনি। একেবারে পিছনের দিকে ছিল যে চিলেরা, তাদের কেউ কেউ বের হতে পেরেছিল আগুনের বৃত্ত থেকে। তাদের চোখে পড়েছিল, সঙ্গীদের নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে কাকরাজা। 
সেই থেকে আজও, কাকেদের সাথে চিলেদের সদ্ভাব নাই, বরং বেশ রেষারেষি। গায়ে জোর থাকলেও, চিল কখনও কাককে ঘাঁটাতে যায় না। বরং একটা কাক চিলকে তাড়া করে যাচ্ছে, এমন দৃশ্যই কখনও কখনও দেখা যায় আকাশে।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন 

Post a Comment

1 Comments