জ্বলদর্চি

আধুনিক বিজ্ঞানের জনক গ্যালিলিও গ্যালিলেই (১৫৬৪―১৬৪২)/পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যা

বিজ্ঞানের অন্তরালে বিজ্ঞানী ।। পর্ব ― ১৯

আধুনিক বিজ্ঞানের জনক গ্যালিলিও গ্যালিলেই (১৫৬৪―১৬৪২)
পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যা

ধর্মের শাসনে বিজ্ঞানের ট্রায়াল : 'Eppur Si Muova'

টাইবার নদীর কিনারে লাৎসিও অঞ্চলে অবস্থিত ছবির মতো শহর রোম। যেন রঙ-তুলিতে আঁকা, ঝকঝকে-তকতকে। অভূতপূর্ব স্থাপত্য শৈলী আর চমৎকার শিল্পকলার নৈপুণ্যে মোড়া প্রাচীন শহর। আভিজাত্য আর সংস্কৃতির যূগলবন্দী তার পরতে পরতে। জমজমাট রসনাতৃপ্তির ভুরিভোজ― স্পাগেটি, পাস্তা আর পিজ্জা'র আধুনিক সম্ভারের প্রাণকেন্দ্র। এখানেই আছে ঐতিহাসিক কলোসিয়াম। উপবৃত্তাকার ছাদবিহীন এক বিরাট খোলামঞ্চ। রাতের অন্ধকারে সেই ঐতিহাসিক জীর্ণ পৌরাণিক প্রদর্শনী মঞ্চে যেন একসঙ্গে নেমে আসে ঝাঁক ঝাঁক গ্ল্যাডিয়েটর; মল্লযুদ্ধের প্রস্তুতি চলে। কে জানে, কখন ডাক আসে! হয়তো রাষ্ট্রের সুরক্ষায় অথবা ধর্ম সংস্থাপনায়। আর রোম শহরের একেবারে কেন্দ্রে রয়েছে স্বাধীন এক ক্ষুদ্র রাষ্ট্র― ভ্যাটিকান সিটি। কোরানের যেমন মক্কা; বাইবেলের তেমনি ভ্যাটিকান সিটি। ক্যাথলিক চার্চের উৎস-মুখ। হর্তা-কর্তা-বিধাতা। সে উৎস-মুখ থেকে উৎসারিত এক একটি বাক্য যেন অমোঘ বাণী। তার পবিত্রতা রক্ষায় সদা তৎপর ধর্মের ব্যাপারীরা। আর সেসব অন্ধের মত অনুসরণ করা-ই দস্তুর মত নিয়ম। তা মান্য করে নিয়েছে সকলে। কিন্তু নাহ, একজন বশ্যতা স্বীকার করল না। বরং প্রমাণ করল, যুক্তি দিয়ে দেখাল তাঁর কথা সত্য। বাইবেল ভুল। সব বুজরুকি।
     
রোমের ভাটিকান সিটি খুব জোর উত্তাল তখন। উত্তাল বাইবেলের সকল ব্যাপারী। আর অত্যুৎসাহী আমজনতা। কী আস্পর্ধা লোকটার! বাইবেলের বিরুদ্ধে কথা বলে। খ্রিস্টান সমাজের মুখে কলঙ্কের দাগ! এতটুকু ভয় নেই! এত সাহস পায় কোত্থেকে? স্বধর্মের বিরোধিতা করতে বুক এতটুকু কেঁপে উঠল না! নাহ, এ দুঃসাহস বরদাস্ত করা যায় না। যেন-তেন-প্রকারেণ দমিয়ে দেওয়া দরকার তাঁর এই সব ভুলভাল তথ্য। তার বদলে তাঁর ফুসফুসে-মজ্জায় ঢুকিয়ে দিতে হবে ধর্মের বিষবৃক্ষ। না-হলে মুক্তি নেই বাইবেলের। পরিত্রাণ পাবে না খ্রিস্টান সম্প্রদায়, প্রভু যিশুর নেকনজর থেকে।

ডাক পড়ল তাঁর, সুদূর রোম থেকে। সেখান থেকে পত্রদূত এল। রোমে বসবে বিচারশালা। পবিত্র হোলি অফিসের প্যালেসে। খ্রিস্টান ধর্মের তাবড় তাবড় যাজকেরা অলংকৃত করবে বিচারকের আসন। ফাদার ম্যাকুলানো কোমিসারি জেনারেল হবেন প্রধান বিচারপতি আর ফাদার সিনসারি, প্রসিকিউটর। আসামির কাঠগড়ায় সে-ই লোকটা, যে কি-না স্বধর্মের অপপ্রচার হেতু উঠে পড়ে লেগেছে। যে-সে লোক নয়, তিনি আধুনিক ইতালির যোগ্যতম পুরুষ। বিশ্ববিশ্রুত এক বৈজ্ঞানিক। তিনি গ্যালিলিও গ্যালিলেই। আধুনিক বিজ্ঞানের পথপ্রদর্শক। আধুনিক পদার্থবিজ্ঞান তাঁর হাত ধরে সবে হাঁটা শুরু করেছে। আর তখনই হোঁচট খেল তার গতি। 

তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগটা ঠিক কী? কী তাঁর অপরাধ? অভিযোগ প্রমাণ হওয়ার আগে সবাই কেন দোষী সাব্যস্ত করে বসল তাঁকে? 
     
ফ্লোরেন্স থেকে রোমে এলেন শ্রদ্ধেয় বৈজ্ঞানিক। সেটা ১৬৩৩ খ্রিস্টাব্দ। এই নিয়ে আটবার রোমের পু্ণ্যভূমিতে পা রাখলেন তিনি। সে-বার রোমে পদার্পণ করে টের পেলেন প্রতিকূল পরিস্থিতির আঁচ। আকাশে বাতাসে ক্যাফে গলির মোড়ে সর্বত্র একটা আলোচনা। আলোচনা তাকে নিয়ে। তাঁর মতবাদ প্রসঙ্গে। তাঁর স্পর্ধা নিয়ে। বোঝা গেল, পরিবেশ বেশ গরম এখন। কী শাস্তি অপেক্ষা করে আছে তাঁর কপালে, একমাত্র প্রভু-ই জানেন। বিচার সভা বসল এপ্রিল মাসের বারো তারিখে। রাজপ্রাসাদে। লোকে লোকারণ্য। অগণিত দর্শকে কানায় কানায় পরিপূর্ণ বিচারশালা। বহু শতক ধরে বিজ্ঞান ধর্মের দাসত্ব করে আসছে। অনেক কাল যাবৎ বিজ্ঞানের স্বাধীন সত্তা কুক্ষিগত করে রেখেছে ধর্ম। বিজ্ঞানের উপর ধর্মের ছড়ি ঘোরানোর দিন বোধহয় এবার শেষ হতে চলেছে। এটাই সম্ভবত অন্তিম দক্ষযজ্ঞ। এমনই বিশ্বাস বৈজ্ঞানিকের। সে-হেতু বিশাল তার আয়োজন। সূচনা হল শতাব্দীর শেষ ধিকৃত ধর্ম-বিজ্ঞান বিচারসভা।

বিচারক : আপনি কি লিখেছেন, সূর্য স্থির আর পৃথিবী ঘোরে?
গ্যালিলিও : মসিঁয়ে ধর্মাবতার, আমার বিরুদ্ধে তোলা সমস্ত অভিযোগ একদম মিথ্যে। আমি কখনও বলিনি যে সূর্য স্থির এবং পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘোরে।
বিচারক : তবে কে বলেছে সে-কথা?
গ্যালিলিও : আমি বলিনি, আমি বলিনি হুজুর। কোপারনিকাস নামে একজন জগদ্বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক বলেছিলেন ওসব কথা।
বিচারক : কোপারনিকাস! কে সে? আর কী বলেছিলেন তিনি?
গ্যালিলিও : আজ্ঞে, মসিয়েঁ মান্যবতার; কোপারনিকাস (১৪৭৩―১৫৪৩) ছিলেন পোল্যান্ডের অধিবাসী। একাধারে বৈজ্ঞানিক, দার্শনিক ও গণিতজ্ঞ। উনিই তো বলেছিলেন যে সূর্য স্থির আর পৃথিবী সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে।
বিচারক : কোপারনিকাসের যুক্তি প্রসঙ্গে আপনার বক্তব্য কী? পরিষ্কার করে বলুন।
গ্যালিলিও : মঁসিয়ে ফাদার, আমি দেখিয়েছি, পৃথিবী স্থির, সূর্য সর্বক্ষণ ঘোরাঘুরি করে। আরও দেখিয়েছি কোপারনিকাসের যুক্তি সম্পূর্ণ ভ্রান্ত ও দুর্বল। টলেমি-ই সঠিক।
বিচারক : আজকের মতো শুনানি শেষ। তিনদিন পর পুনরায় শুনানি হবে।

গ্যালিলিও-র কথা শুনে বিস্মিত উপস্থিত দর্শকমণ্ডলী। এ-ওর মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে সকলে। কারও মুখে রা'টি নেই। ইতালির শ্রেষ্ঠ সন্তানের বিচার চলছে। ইনি সেই বিজ্ঞানী যিনি দূরবীক্ষণ যন্ত্র আবিষ্কার করে সকলকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। মহাকাশকে আপন করে নিতে শিখিয়েছেন। দূর আকাশের গ্রহ নক্ষত্র ধরা দিয়েছে মানুষের চৌহদ্দির মধ্যে। সোনায় খাদ বের করার পদ্ধতি বের করেছিলেন আর্কিমিডিস (২৮৭ BC ― ২১২ BC)। আর সে-পদ্ধতির যান্ত্রিক রূপ দেন গ্যালিলিও। হাইড্রোস্ট্যাটিক তুলাযন্ত্রের সাহায্যে। কঠিন পদার্থের ভারকেন্দ্র সম্পর্কে তাঁর কাজ প্রশংসার দাবি রাখে। চৌম্বকত্ব নিয়ে তাঁর গবেষণা সত্যিই অসাধারণ। অথচ তিনি খামোকা মিথ্যা বললেন কেন? কেন এড়িয়ে গেলেন সত্য কথা? নিজের বিরুদ্ধে ওঠা সব অভিযোগ অস্বীকার করলেন!
       
পৃথিবী নিজ অক্ষের সাপেক্ষে আবর্তিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সূর্যের চারপাশে প্রদক্ষিণ করে― এ তো গ্যালিলিও'র নিজের আবিষ্কার। তাহলে তিনি সত্য গোপন করলেন কেন? প্রাণের ভয়, নাকি অধোগামী বুদ্ধি? চক্ষুর সম্মুখে আছে বাইবেলের বিরুদ্ধে প্রচারের হাতে গরম যথেষ্ট উদাহরণ। ব্রুনো (১৫৪৮―১৬০০)-কে পুড়িয়ে মারার ঘৃণ্য চক্রান্ত।

বাসায় ফিরে এসে মর্মযন্ত্রণার আগুনে দগ্ধ হতে শুরু করলেন গ্যালিলিও। আত্মগ্লানি কুরে কুরে খায়। বিবেক দংশনে অসহনীয় হয়ে ওঠে তাঁর জীবন দর্শন। আয়নায় নিজেকে নিজে দোষারোপ চলে রাতভর। এ কী করেছেন তিনি? শাস্তির হাত থেকে বাঁচতে শেষে কি-না ছলনার আশ্রয় নিতে হল? কয়েকজন মুর্খ ধর্মান্ধ যাজকের হাতে তাঁর বৈজ্ঞানিক প্রতিভা জলাঞ্জলি দিয়ে এলেন তিনি? কে বড়― বিজ্ঞান, না ধর্ম? কে মহৎ― সত্য, নাকি শাস্তি? কে অমোঘ― প্রাকৃতিক সত্য ঘটনা, না ধর্মান্ধ পোপ? মনে মনে দৃঢ় সংকল্প করেন― প্রায়শ্চিত্ত করবেন। হার মানবে না সে। বিজ্ঞানের জয় হবেই।

অন্যদিকে গ্যালিলিও-র বিরুদ্ধে অভিযোগের দলিল দস্তাবেজের তাড়া নিয়ে বসেছে ধর্মযাজকেরা। বেহুলার লোহার বাসরঘরে ক্ষুদ্র ছিদ্রের অন্বেষণের ন্যায় সূচাগ্র পরিমাণ তথ্য-বিচ্যুতি খোঁজ করে চলেছে তারা। অবশেষে মিলল ছিদ্রের সন্ধান। ষোল বছর আগে এ হেন বৈজ্ঞানিক সৌরজগতের ব্যাখ্যা দিয়ে স্পষ্ট প্রমাণ করেছেন তাঁর তত্ত্ব। তারস্বরে ঘোষণা করে জগৎকে অবহিত করেছেন― সূর্য স্থির, চন্দ্র পৃথিবী গ্রহ তারা গতিশীল। যখন তিনি এমন ঘোষণা করেন ১৬১৬ সালে; তখনকার শ্রেষ্ঠ খ্রিস্টান ধর্মযাজক পঞ্চম পোপ পল গ্যালিলিও'কে ডেকে পাঠিয়ে চরম হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন। পরের বছরই শক্তিশালী গির্জা আবার গর্জে ওঠে― খবরদার! কক্ষনো বলবে না সূর্য স্থির, পৃথিবী ঘোরে। বাইবেল মতে উল্টোটা বরং সত্যি। অর্থাৎ পৃথিবী স্থির আর সূর্য অনবরত ঘুরছে। সুতরাং বাইবেলের বিরুদ্ধ মতবাদ প্রকাশ করা ঘোরতর অন্যায়। নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হল গ্যালিলিও-র মতবাদ। তবু দমবার পাত্র নন তিনি। ষোল বছর ধরে তিল তিল গড়ে তুলেছেন সাধের ইমারত― সায়েন্টিফিক নিরীক্ষণ। একাকী গবেষণা চালিয়ে প্রকাশ করেছেন গ্রন্থ― 'বিশ্বের দুটি প্রধান প্রণালীর আলোচনা'। এ হেন দুটি প্রণালীর প্রথমত  টলেমি (১০০ AD ― ১৭০ AD)-এর মতবাদ― স্বর্গবাসী ঈশ্বরের অঙ্গুলিহেলনে পৃথিবীর চারপাশে চক্রাকারে আবর্তিত হচ্ছে গ্রহ-নক্ষত্ররা। টলেমি-কথিত এই গ্রিক বিশ্বাস চালু ছিল শত শত বছর। আর দ্বিতীয় কোপারনিকাসের ভাবনা― সূর্য স্থির, পৃথিবী ঘূর্ণনশীল। দুই পদ্ধতির গভীর পর্যালোচনা করে এই স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন গ্যালিলিও― সূর্য স্থির, পৃথিবী সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে। অত্যন্ত সহজ সরল সাবলীল মার্জিত ভাষায় ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দিয়েছেন তাঁর গ্রন্থে। ১৬১৬ সালের নিষেধাজ্ঞাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে। বিচারকের হাতের নাগালে রয়েছে সে-বই। তাই বিচারকরাও দারুণ অবাক। বিস্মিত এই কারণে যে, যে-লোক এত সব কাণ্ড করে বেড়িয়েছেন এত বছর ধরে; সেই লোক এক কথায় সব উড়িয়ে দিচ্ছে কী করে? সন্দেহ পুরোপুরি যায়নি। সেজন্য আবার জেরা। চলল চুলচেরা বিশ্লেষণ। তিনদিন পরেই শুরু হল শুনানি। উৎকণ্ঠায় প্রহর গুনছে রোমের মানুষ। গ্যালিলিও দৃঢ় প্রতিজ্ঞ― ধর্মের কাছে বিজ্ঞানকে পরাজিত হতে দেবেন না। কোনও মতে ধর্মের কালো হাত যেন মজবুত না হয়। বিজ্ঞান নতজানু হবে না। তাঁর ভাগ্যে যা ঘটে, ঘটুক। 

কঠোর থেকে কঠোরতর শাস্তি যা হয়, হোক। তিনি প্রমাণ করে ছাড়বেন ধর্ম ভুল; বিজ্ঞান অকাট্য, অমোঘ। সূক্ষ্ম কথার জাল বিছিয়ে শুরু হল জেরা। ধর্মের বড় প্রত্যাশা― শিকার ফাঁদে ফেলা। তারপর বড়সড় দণ্ড প্রদান।
    
বিচারক : আপনার গ্রন্থে আপনি পরিস্কার বলেছেন সূর্য স্থির, পৃথিবী সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে। এ কথা আপনি নিশ্চয়ই মানেন? 
গ্যালিলিও : হ্যাঁ, গ্রন্থে যা আছে, সবই সঠিক। আমি যা লিখেছি, তার প্রতিটা অক্ষর-শব্দ-কথা অক্ষরে অক্ষরে ঠিক। কারণ তা বৈজ্ঞানিক উপায়ে পরীক্ষিত সত্য ঘটনা।
বিচারক : মঁসিয়ে গ্যালিলিও, আপনি বাইবেলের অপমান করেছেন। খ্রিস্টান জাতির বিদ্রুপ করেছেন। খ্রিস্টানদের ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত হেনেছেন। 
গ্যালিলিও : আজ্ঞে, সব আমি সচেতন ভাবে করেছি। বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে প্রাকৃতিক সত্য ঘটনার কারণ উদ্ঘাটন, বাইবেলের চোখে, যদি অন্যায় হয়ে থাকে; তবে আমি সঠিক অন্যায়ই করেছি।

এত আস্পর্ধা! এত ঔধত্য! এত বড় অপরাধের ক্ষমা নেই। দোষী সাব্যস্ত করা হল গ্যালিলিও-কে। জনাকীর্ণ বিচারশালায় ঘোষণা করা হল শাস্তি। আজীবন বন্দী দশার খাঁড়া নেমে এল তাঁর উপর। লাটে উঠল তাঁর বিজ্ঞান চর্চা। কারাগারের অন্ধকার খুপরিতে কাটবে বাকি জীবন। হাতের নাগালের মধ্যে থাকবে না টেলিস্কোপ কিংবা কোনও বৈজ্ঞানিক সরঞ্জাম। মাথা পেতে নিলেন দণ্ড। শালা থেকে বের হবার সময় একবাই বিড়বিড় করে বলে উঠলেন― 'Eppur Si Muova'। অর্থাৎ, 'কিন্তু পৃথিবী ঘুরছে, ঠিক একই ভাবে'।

বিচারকদের মধ্যে একমাত্র বেলারমিন কিঞ্চিৎ সহানুভূতিশীল ছিলেন বৈজ্ঞানিকের প্রতি। মূলত তার প্রচেষ্টায় শাস্তি কিছুটা কমল। আর্কেত্রী-তে গ্যালিলিও-কে তাঁর নিজ বাতায়নে গৃহবন্দি হয়ে বাকি জীবদ্দশা অতিবাহিত করতে হবে। নিঃসঙ্গ, একাকী। শুভ সূচনা হল একাকীত্ব ভরা তাঁর অভিশপ্ত জীবন যাপন। এ সময় তাঁর সবচেয়ে প্রিয় কণ্যাকে হারালেন গ্যালিলিও। শোকে দুঃখে জর্জরিত হয়ে একেবারে ভেঙে পড়লেন তিনি। অধিকন্তু, গবেষণার অধিকার কেড়ে নেওয়ায় প্রায় নিঃস্ব বৈজ্ঞানিক। সারা দিন-রাত কেবল দূরবীনের লেন্সে দূরের গ্রহ-নক্ষত্র-তারা'র দিনপঞ্জি হিসাব করে চলেছেন। লিখে রাখছেন খাতায়, কলমে। বন্দি জীবন শুরুর চার বছর পরে ১৬৩৬ খ্রিস্টাব্দে একখানা বই লিখলেন― "নতুন বিজ্ঞানের উপর আলোচনা"। পরের বছর তিনি অঙ্ক কষে বের করলেন চন্দ্রগোলকের ঘূর্ণনের ফলে পর্যায়ক্রমে চন্দ্রপৃষ্ঠের একাংশের দৃষ্টিপথে আগমন এবং দৃষ্টিপথ থেকে অপসারণ। এই তাৎপর্যপূর্ণ আবিষ্কারের কয়েক মাস পরে তাঁর দৃষ্টিশক্তি সম্পূর্ণ লোপ পায়। চিরতরে অন্ধ বনে গেলেন তিনি। বন্ধ হয়ে গেল সরাসরি বিজ্ঞান গবেষণা। 
       
হৃদয় ভারাক্রান্ত। মন অবসন্ন। এ সময় এক বন্ধুকে লিখলেন― 
'আমি সম্পূর্ণ অন্ধ এখন। দৃষ্টিশক্তি আর কোনদিন ফিরে পাব না। এই পৃথিবী,  এই বিশ্বজগৎ, এই মহাকাশকে আশ্চর্য নিরীক্ষণে আমি হাজার গুণ বড়ো করে তুলেছি যা ছিল অতীত যুগে বিশ্বাসের অগম্য। সেই পৃথিবী, সেই বিশ্বজগৎ, সেই মহাকাল এখন থেকে আমার দৃষ্টিতে ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হতে হতে দাঁড়িয়েছে এক ফালি ক্ষুদ্র জায়গায়, যার ওপর আমি নিজেই বসে আছি। কাজেই এটা 'গড'কে তুষ্ট করে, এটা সেজন্যে আমাকেও তুষ্ট করে।'
নিয়তির কী অপরূপ পরিহাস! গ্যালিলিও'র সেই অন্তরঙ্গ বন্ধু একজন খ্রিস্টান ধর্মযাজক। নাম ফাদার কাস্টেলি। রিটার্ন চিঠিতে কাস্টেলি অশ্রু ছলছল নয়নে বন্ধুর উদ্দেশ্যে লিখলেন― 
'এ যাবৎ কালের প্রকৃতির সৃষ্ট মহত্তম দৃষ্টির সম্মুখে নেমে এল চির-অন্ধকার।'

আসলে এ চির-অন্ধকার কেবল প্রিয় বৈজ্ঞানিকের সুগভীর দুই নয়নে নেমে আসেনি, বরং নেমে এল আধুনিক বিজ্ঞানের চলার পথে। ফলে অনেকাংশে হোঁচট খেল, গতি অবরুদ্ধ হল মডার্ন বিজ্ঞানের। গ্যালিলিও (১৫ ফেব্রুয়ারি ১৫৬৪ ― ০৮ জানুয়ারি ১৬৪২)-এর বৈপ্লবিক বিজ্ঞান-চেতনার মাঝে অন্তরায় হয়ে দণ্ডায়মান হল তাঁর চোখের মণি। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অনাবিষ্কৃত রহস্যময় জাল পুনরায় রহস্যের ঘেরাটোপে পড়ে বিজ্ঞান গবেষণাকে বেশ কয়েক ধাপ, বছর পিছিয়ে দিল।

তথ্য সহায়তা :
বিজ্ঞানে স্মরণীয় যাঁরা ― মৃদুল দে
বিশ্ব মনীষী শতক ―পৃথ্বীরাজ সেন
উইকিপিডিয়া সহ বিভিন্ন ওয়েবসাইট

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন

Post a Comment

0 Comments