এই যে আলোর আকুলতা
আবীর ভট্টাচার্য
(চতুর্থ অধ্যায়)
স্বপ্নলগ্ন কোন কোন কুয়াশালীন ভোরে, মায়ের বানানো নক্সী-কাঁথার ওম-আদর গায়ে জড়িয়ে পুজোর ঢাক বাজে পুজোতলায়; হয়তো মনে মনেও। বেলবরণতলায় শিউলীর ঘনসুবাসখানি, ভরা আশ্বিনের শিশিরমাখা শারদবাতাসের ডানায় ভর করে কবেকার প্রিয়গন্ধী আকুলতায়, মায়াময়তায় আধো ঘুম, আধো জাগরণে আগমনী গান শুনিয়ে যায়; গ্রামাঞ্চলের রেডিওতে বাজে, 'যাও গিরি,আনিতে গৌরী'....পথে পথে ঘুরে ঘুরে গান গেয়ে সিধে তুলে বেড়ায় তাম্বুল-রস-রাগ-সিক্ত অলক্ত-অধরা, রসকলি-চর্চিত হাসিমুখের বোষ্টুমী দিদি। হাঁস-চৈ-চৈ পুকুরপাড়ে, কাদা-পিছল দূর্বাবনে, আবছায়া অপরাজিতা ঝোপের উজ্জ্বল নীলকান্তমনি আকাশের রঙটি আপন করে নেওয়া ফুলের কৃতাঞ্জলিপুটে পুজো আসে। সম্বৎসরের পুজো আসে আপন আনন্দে, চিরায়ত পথে। আমাদের লাভ-ক্ষতি-টানাটানির দীর্ণ সংসারে এনে দেয় দুঃহহরা আলোর অমর্ত্য-বিভা। ধরণীর আকাশে বাতাসে বাজে আলোক-মঞ্জীর, 'আজ প্রভাতে সে সুর শুনে খুলে দিনু দ্বার…'
আজ বিধিমতে,ষষ্টী, সন্ধ্যায় বেলবরন হবে দেবীর। ঘুমঘুম চোখে মনে পড়ছিলো অরণির, ছোটবেলায় এইসব দিনে, ভোর থেকেই চলে যেতেন পুজোতলায়,কাজ কি কম! সারা গ্রাম ঘুরে ঘুরে ফুল,বেলপাতা তোলা, দিদিদের মালা গাঁথার শিউলিফুল যুগিয়ে দেওয়া, ঠাকুর-পুকুরে কলাবৌ স্নানযাত্রায় ঢং ঢং করে কাঁসরঘন্টা বাজানো, রোগা ছিলেন হয়তো, কিন্তু তাঁর মতন জোরে ঘন্টা বন্ধুদের মধ্যে কেউ বাজাতে পারতো না। কব্জির জোর চিরকালই তাঁর বেশী। সাধে কি আর বিশ্বকর্মার আশীর্বাদ তাঁর ওপরে ঝরে পড়েছে! এসব ভাবতে ভাবতেই ব্যস্তসমস্ত রূপার প্রবেশ;
-এ বাবা! তুমি এখনও ওঠোনি! সাতটা বাজলো।নটায় বেরোনো; সবাই কিন্তু তৈরী হতে শুরু করে দিয়েছেন।
সত্যি তো, ভুলেই গিয়েছিলেন,আজ তাঁদের বেড়াতে যাওয়ার কথা বেলপাহাড়ির জলজঙ্গল হয়ে কাঁকড়াঝোড়; ওখানে রাত্রিবাস, তারও পরে কয়েকদিন গোপীবল্লভপুর সংলগ্ন রাজবাড়ীগুলি। তিনিই হোষ্ট, তাই আর গড়িমসি না করে উঠে পড়লেন, স্বপ্ন থেকে একবারে মাটির বাস্তবে।
বারান্দা থেকেই দেখলেন,কাকা-জেঠুর বাড়ির বাচ্চা-কাচ্চারা সব পুজোতলায় যাবার জন্য সাজগোজ করে তৈরী; সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে ভাবলেন, আজ তো হলো না, একদিন ঠিক ওদের সঙ্গে যাবেন পুজোতলায়। কে জানে! যদি দেখা হয়ে যায় পুরনো বন্ধুদের সাথে, হয়তো অনেক দিন আগে ফেলে আসা নিজের সাথেও…
নীচে নামতেই ভুরভুর লুচি-পায়েসের গন্ধে প্রাণমন আকুলিত। অরণি লুচি খেতে খুব ভালোবাসেন; মা-বৌদি ঠিক মনে রেখেছেন। এখন শরীরের কথা ভেবে খাওয়াদাওয়ায় নিয়ন্ত্রণ এনেছেন ঠিকই, তবে আজ খাবেন, প্রাণভরে খাবেন মায়ের হাতের লুচি, সেই ছোটবেলার মতই।
সময়মতো সবাই তৈরী হয়ে নীচে নামতে শুরু করেছেন দেখে তাড়াতাড়ি তিনিও স্নান-সাজুগুজু সেরে এসে বসলেন টেবিলে; কাঁসার সোনালী ঝকমকে রেকাবে সাদা গোলাপের পাপড়ির মতো ধোঁওয়া ওঠা ফুল ফুল লুচি, বোঁটাসহ মুক্তকেশী বেগুন ভাজা, কাজু-কিসমিস ছড়ানো ঘী-গরমমশলা সুবাসিত আলুরদম আর পরমান্ন। এসব দেবভোগ্য খাবার সামনে থাকলে কথা বলতে নেই, কারণ, কথা বলা ছাড়াও মুখ-ঠোঁটের আরো একটি জরুরী কাজ আছে, সেই কাজটি কবিতা বলা বা গান গাওয়ার চাইতে যে কোন অংশেই খাটো নয়, বুদ্ধিমান মানুষেরা তা জানেন।
যাহোক,এসব উত্তম খাওয়া-দাওয়ার শেষে,সবাই গাড়ির দিকে যাত্রা করলো, বৌদি ব্যস্ত-সমস্ত হয়ে লাঞ্চপ্যাক, জলের বড়ো কন্টেনার এদিয়ে দিলেন, এমন প্রাণঢালা আন্তরিকতার আতিশয্যে বন্ধুপত্নীরা যে ভীষন লজ্জিত ও বিব্রত বোধ করছিলেন, অরণি-রূপা বুঝতে পারছিলেন, কিন্তু ভীষণ কৃতজ্ঞ আর ভালোও লাগছিলো তাঁদের; এই প্রথম বোধহয়, রূপার চোখে বৌদির জন্য নিখাদ শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা দেখলেন অরণি, খুব ভালো লাগলো তাঁর।
যাত্রা শুরু হোল, বেলপাহাড়ি থেকে একটু এগিয়ে,
তামাজুড়ি পেরিয়ে বাঁশপাহাড়ি যাওয়ার পথে যাঁতিহারা খাল পেরিয়ে জামতলগড়া, সিংলহর পাহাড়, আরও একটু এগিয়ে পাহাড়ছায়ায় লালজল গ্রাম; তাকে ঘিরে দেওপাহাড়, দূরে কখনও দৃশ্যমান কখনও অদৃশ্য ছায়া-আবছায়ায় রানীপাহাড়। শিল্পীর তুলিতে আঁকা দৃশ্যপটের মতো একে একে এইসব দৃশ্যাবলী দেখতে দেখতে এগিয়ে চলেছে 'ক্যারাভ্যান'-যেন চাঁদের দেশে চন্দ্রমুখী মানুষজনের আমন্ত্রণ।
খানিক এগিয়ে গাড়ি থামাতে বললেন অরণি; এলাকার মানুষ তিনি, জমিয়ে গল্প শুরু করলেন,
-এই দেওপাহাড়ের চূড়াতেই আছে আদি মানবের গুহা; আর তার মধ্যের দেওয়াল-গাত্রে আঁকা সেযুগের মানুষের হাসিকান্নার ছবি। আমাদের জন্মেরও আগে, সম্ভবতঃ ১৯৬০ সালে রাজ্য পূরাতত্ত্ব বিভাগের অনুসন্ধানে এখান থেকেই পাওয়া গিয়েছিল নব্যপ্রস্তরযুগের তীরের ফলা, ত্রিভূজাকৃতি প্রস্তরায়ুধ, তাম্র প্রস্তরযুগের তামার কুঠার, নীলগাইয়ের অস্হি-ফসিল। চারিদিকে ধূম্রপাহাড়বেষ্টিত দিগন্তছোঁয়া আকাশতলীর ঝোপঝাড়ময় কাঁকুরে মাটিতে দাঁড়িয়ে, এসব গল্প শুনে সবাই যেন শিহরিত; বাচ্চারা তো বটেই, মধ্যবয়সিনী তিন স্বল্প-পৃথুলাও হাঁটুব্যথা, কোমরব্যথার ওজর ছাপিয়ে কোমরে আঁচল জড়িয়ে প্রস্তুত; এতদূর এসে এমন এক প্রাগৈতিহাসিক সৌন্দর্য্যের চাক্ষুষ সুখলাভ থেকে কেউই বঞ্চিত হতে চায়না।
অতঃপর,শুরু হোল,একদল অনভিজ্ঞ মানুষের পর্বতারোহণ। আগ্রহভরে উঠলেন, দেখলেন গুহামুখ, আবছা আলোয় গুহাচিত্র। একদঙ্গল বাদুড়, নেউলের দাপাদাপি আরও এগোতে বাধা দিলো, সাপের ভয়ও ছিলো; চারিদিক নিঝুম, শব্দহীন; কেমন যেন একটু গা-ছমছমে অনুভূতি নিয়ে ফিরে চললেন সদলে। এতদিন আরও অনেক পাহাড় ভ্রমণে গেছেন তাঁরা, কিন্তু সেক্ষেত্রে গাইড, দিকনির্দেশনা,এসব ছিলো; এক্ষেত্রে তো 'আমরা সবাই রাজা', তাই আনন্দও লাগামছাড়া...
এর পরের গন্তব্য তামাজুড়ি; ধারনা করা হয়, এটি ছিলো তাম্রযুগের তাম্র-নিস্কাশনকেন্দ্র। গাড়ি এসে দাঁড়ালো ওখানকার কড়েলতা খালের পারে চল্লাবনে।এখানে এখনো ভাঙ্গা ভাঙ্গা অবস্হায় পড়ে আছে সুপ্রাচীন পরিত্যক্ত চুল্লির নিদর্শন, ইতস্ততঃ ছড়িয়ে থাকা ধাতুমল,হয়তো অনেক অনেক দিন আগে, এই ধাতুআকরিক থেকে নিস্কাশিত তাম্রপণ্য তাম্রলিপ্ত বন্দর হয়ে পৌঁছে গিয়েছিলো অন্য কোন দেশের শিল্পনির্মানে। অনেক, অনেকদিন আগের কথা, খানিক কল্পনা, খানিক বাস্তবতা মিশিয়ে এই ভ্রমণ যে ক্রমশঃ উপভোগ্য হয়ে উঠছে বন্ধুজনের কাছে,এটি ভেবে অরণির খুব গর্ব হতে লাগলো।
ইতিমধ্যে হাঁটাহাঁটির জন্য হোক,জঙ্গলের নির্মল হজমী জলহাওয়ার জন্যেই হোক, পেটের ভেতর ইঁদুর ছোটাছুটি শুরু করেছে সবারই। কাছাকাছি একটি পরিস্কার জায়গা দেখে সতরঞ্জি বিছিয়ে বৌদির দেওয়া খাবারগুলির সদ্ব্যবহার হোল। ভাগ্যিস এগুলো ছিলো,তা নইলে, আবার বেলপাহাড়ি ফিরতে হোত খাওয়ার জন্যই।
ইতিমধ্যে সূর্য তখন মধ্যগগনে,যদিও মাসটি অক্টোবর,সকাল-সন্ধ্যায় একটু হালকা মেদুর শীতের পরশ লাগে, দুপুরটুকু বেশ গরম। সবসময়েই এয়ারকন্ডশ্যনে থাকা মানুষজনের অস্বস্তি হচ্ছিল ঠিকই, কিন্তু কেউই গাড়ির জানালা বন্ধ করতে রাজি নয়,ছোটো-বড়ো সবাই যেন পূর্ণমনে দুহাত পেতে গ্রহণ করতে চাইছিলো আদি ও অকৃত্রিম প্রকৃতির এই নিবিড় আলিঙ্গন।
এর পরে,দক্ষিন-পশ্চিমে আরও এগিয়ে এই অভিযাত্রীদল পৌঁছে গেল কাঁকড়াঝোড়ে। এই গ্রামের পাশবর্তী ঘন-বনমধ্যে কাঁকড়াসিনির জাহের থান; একপাশে একখানা ছোট্ট মন্দির আছে বটে, সেখানে ডিম,দেশীয়মদ আর কালো মুরগী বলি দিয়ে আদিবাসীরা পুজোআচ্চা করেন; কিন্তু এর মূল আকর্ষণ বিশাল বিশাল শালগাছ ঘেরা বন। এই বনের গাছগুলিতে নাকি দেবতার বাস। এই জাহেরথানের কাছেই স্হানীয় ঝর্ণার জল বড়বড় পাথরের মধ্যে দিয়ে অপুর্ব এক প্রাগৈতিহাসিক সৌন্দর্যের আভাস ছড়িয়ে দেয় সকলের মনে, যেন কোন চিরকাঙ্খিত আনপুরুষের বিস্তৃত বক্ষে আছড়ে পড়ছে প্রিয়-সঙ্গ-কামনাতুর নারীর বাঁধ-না-মানা অশ্রুবন্যাদল..'আমি পথের কাঁটা করবো চয়ন…'
কেমন যেন একটু উন্মনা লাগছিলো,ঘোর ভাঙলো সামনে একনারী-অবয়বের টলোমলো ছায়াভঙ্গীতে। কেউ হয়তো ঝর্ণা পার হতে গিয়ে টাল হারিয়েছেন, এগিয়ে গেলেন অরণি, নারীর রক্ষাকর্তা পুরুষ হয়ে, পূর্ণ কর্তব্যবোধে শালপ্রাংশু বাহু মেলে আশ্রয় দিলেন কম্পমান দেহলতা, কোমর জড়িয়ে এক নবনীকোমল দেহ কাঁপতে লাগলো বুকে, ওপক্ষের তিতিরডানার কাঁপন এপক্ষের 'লাব্-ডুবে'...
'এ ক্ষণকাল চিরস্হায়ী হলে,বলো কোন ক্ষতি হোত!'
নারী তাকালেন তাঁর দিকে,এমন পূর্ণ-চন্দ্র-কলা-জোছনা-দৃষ্টিপাত অযুত রমনসুখের চাইতেও কামনাতৃপ্তি আনে; লক্ষবছরের সাধনার পরেও হয়তো কোনো কোনো পুরুষ একবারই এসুখ পায় জীবনে, কারো হয়তো পাওয়াই হয়না, তারা জানেও না কি তারা পেলনা জীবনভ'র!
ঘোর ভাঙলো বন্ধুজনের কোলাহলে…'তুমি ঠিক আছো তো?', 'যদি ও ছুটে না যেত,কি হোত বলোতো!', 'কি যে ছেলেমানুষী করো এখনও!'...এসব কথা ভেসে আসতে লাগলো চারিদিকে; নারী সসঙ্কোচে সরে গেলেন নিরাপদ দূরত্বে; বেশ খানিকক্ষণ পরে অরণি অনুভব করলেন যা ঘটেছিলো, তা কল্পবাস্তব নয়, সত্য। অরূন্ধতী অতি-উৎসাহী হয়ে একলা ঝর্ণা পার হতে গিয়ে বিপদ বাধাচ্ছিলেন!
এরপরে,আর বেশী কিই বা কথা থাকতে পারে! পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য সবাই মিলে গেলেন পাশের চা-দোকানে। সেখানকার অতিউৎসাহী এক পুঁচকে অকাতরে জ্ঞান দিয়ে চললো, হড়কা বান এলে কিভাবে জান বাঁচিয়ে নদী পার হতে হয়, সে কতজনকে পার করেছে... ইত্যাদি ইত্যাদি। হাসি-গল্পে-রসিকতায় পরিবেশ হালকা হয়ে এলো;
দিনটিও এদিকে শেষ হয়ে এলো, গোধূলির লালে আকাশ মায়াময়, পাখিরা ফিরছে ঘরে, তাঁরাও পৌঁছলেন কাঁকড়াঝোরের বনবাংলোয়, সেদিনের রাত্রিবাসের জন্য।
চিত্র- লেখিকা
জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন
1 Comments
দারুণ দারুণ!!!...❤️❤️❤️❤️
ReplyDelete