এই যে আলোর আকুলতা
আবীর ভট্টাচার্য
(একাদশ অধ্যায়)
কাল অনেক রাত হয়ে গিয়েছিলো বাড়ি ফিরতে। কথা ছিলো, ফেরার পথে, নতুন জন্মানো বেলপাহাড়ির একটি রেষ্টুরেন্টে রাতের খাবার খেয়েই ফিরবেন সবাই। বর্ষাশেষের এই সময়টায় খুব ভালো মেষ-মাংস পাওয়া যায় এই এলাকায়, ভীষন সুস্বাদু। মা ছোটবেলায় রান্না করতেন, ঈষদুষ্ণ দুধে ভিজিয়ে,কখনও কখনও। এখনও তুলতুলে মাংসের সেই স্বাদ যেন মুখে লেগে আছে। বন্ধুদের মুখে শুনেছিলেন, এই নতুন ঘরোয়া রেষ্টুরেন্টটিতে সেই বিশেষ খাদ্যটির আনাগোনা আছে; রান্নাও দারুন। সেইমতো আগে থেকেই ব্যবস্হাপত্র ছিলো; পৌঁছলেন সবাই; যদিও একেবারেই সাধারণ হোটেল, আয়োজনও স্বল্প, লোকজনের ভীড়ও তেমন নেই; তবু মুখোমুখি বসে এই যে স্বজনপরিবৃত খাওয়াদাওয়ার মাধ্যমে ভাবের আদানপ্রদান, খুব পছন্দসই অরণির। কোথায় যেন পড়েছিলেন, পৃথিবীর সব বড়ো মানুষেরাই নাকি খাদ্যরসিক!
পরিবেশিত হলো খাদ্যসম্ভার। বড়ো বড়ো হলুদ বাল্বের আলোর নীচে, কাঠের বাহারি চেয়ার-ওয়ালা লম্বা শ্বেতপাথরের টেবিলে, শালপাতার থালায় চৈত্র-বৈশাখের ভোরে ছড়িয়ে পড়া কুর্চিফুলের পাপড়ির মতো ধোঁয়া ওঠা সুগন্ধী দুধেশ্বর চালের ভাত, একমাত্র এই সময়েই বনজঙ্গলে জন্মানো,প্রাকৃতিক পার্বণী ছাতুর ঝাল-চচ্চড়ি, আর চর্বিলালিত জাফরানরঙা মাংস; শেষপাতে লাল টুকটুকে করমচার চাটনী।
ভীষণ উপাদেয়, কিন্তু দুপুরের তৃপ্তিদায়ী গুরুভোজনের পরে, এটুকুও ছিলো যেন অতিরিক্ত। তবু অতিথি নারায়ন; তাঁদের খুশি করতেই হয়তো ভ্রমণশেষে এই রেষ্টুরেন্টে খাওয়ানোর আয়োজন।
অজান্তেই মুখে হাসি এসে গিয়েছিলো, অবচেতনেই লক্ষ্য করলেন, অরুন্ধতী সবাইকে পরিবেশন করে দিচ্ছেন মাংস-বাটি, তাঁর বাটিটিতে উপস্থিত পছন্দসই টুকরো।
বৌদি বলে উঠলো,
-ছোটবেলায় ঠাকুরপো এই রাঙের মাংস খুব ভালোবাসতো।
অরুন্ধতী মৃদু কন্ঠে বলে উঠলেন,
-এখনও বাসেন।
তিনি বিস্ময়াবিষ্ট হয়ে জানতে চাইলেন,
-আপনি কি করে জানলেন?
-সেদিন খাওয়ার সময়ে লক্ষ্য করেছিলাম।
রূপা একটু অসন্তুষ্ট, কিছুটা ঈর্শান্বিতও হলেন হয়তো; তবু প্রিয় দুই নারীর তাঁর প্রতি যত্ন সবিশেষ উপভোগ্য মনে হলো অরণির;
খাবার ফেলে বাইরের অস্পষ্ট অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে তিনি উপলব্ধি করলেন, মরমীয়া নারী মাত্রেই জানেন, পুরুষের মন সেতারের মতো, দক্ষ আঙুলের বন্দিসে তা অনুপম বেজে ওঠে। বিশেষ মুহূর্তে সৃষ্ট সেই সব ঝঙ্কারে ছড়িয়ে পড়া আলাপে অথবা আদরে যে সুরমুর্ছনার জন্ম হয়, তা তুলনারহিত। জাগতিক এই সব ছোট ছোট চাওয়া-পাওয়ায় যে মুগ্ধতার রেশ জড়িয়ে থাকে, তাই হয়তো তৃপ্ত করে রাখে সামান্য জীবনের পরম অসামান্যতাকে।
যাহোক, খাওয়া দাওয়া সেরে বাড়ি ফিরলেন সবাই। ফেরার পথে, লৌকিক-অলৌকিকতার মায়াজাল নিজস্ব ভঙ্গিতে আবার প্রত্যেকের মনে মনে ছায়া বিছিয়ে চলেছিলো; তাতে সঙ্গত দিচ্ছিলো রাস্তার দুই ধারে ফুটে থাকা পদ্ম শালুকের বন, ছোট্ট ছোট্ট ঢেউ তোলা ঝোরার জলে উথলে পড়া চন্দ্রালোকের ছায়া। ব্যস্তজীবনের বাইরে যেন কোন এক মায়ালোকের ইশারায় ডাকছিলো এরা সবাই, 'যেতে নাহি দিব';'যেতে নাহি দিব'...
তবু যেতে দিতে হয়, যেতে হয়তো হবেও।
শুধু অরণি নয়, সবাইকার মনে মনেই প্রকৃতির নিবিড় সান্নিধ্যে এমন পরালৌকিক ঘটনাবলীর ছায়া এমন স্হায়ী প্রভাব বিস্তার করেছিলো, যে মনে হচ্ছিল, এখান থেকে ফিরে গিয়েও এই আবেশিত মুগ্ধতা কাউকেও ছেড়ে যাবেনা। প্রিয় গানটির মতো, ফেলে আসা প্রথম অসফল প্রেমের মতো, কোন বিশেষ মুহূর্তে পরিচিত মুখের চাহনি, কথনভঙ্গী, খাবার পরিবেশন অথবা গানের অবয়বে ভেসে আসবে ফেলে যাওয়া কোন প্রিয় মুহূর্তধন; তবু জীবন স্রোতস্বিনীর মতো বয়ে যাবে; এগিয়ে যাবে উৎস থেকে মোহনা-সন্ধানে...
মনে পড়ছিলো সদ্যপ্রয়াত বুদ্ধদেব গুহর কথা, যিনি বলেছিলেন, অরণ্যের মতো সুন্দরী নারী ত্রিভূবণেও নেই। আজ অরণির মনে হো'ল, প্রিয়ংবদা নারীর মতো দুর্জ্ঞেয় হয়তো অরণ্যও নয়।
দিন এগিয়েছে, সভ্যমানুষ গুহা ছেড়ে নাগরিক জীবনের দিকে মুখ ফিরিয়েছে, সভ্যতায়, প্রযুক্তিতে, সে আজ দূরপথের যাত্রী, তবু, কখনও কখনও কোন এক অনাক্রম্য আকর্ষণে প্রকৃতি ডাকে তাকে কুহকমায়ায়। মানুষ আসে, আসতে বাধ্য হয়। কারণ, মানুষ আজন্ম ভ্রমণপিপাসু; পথ তার ফুরোয়না, তাই বলে ঘরের মায়াও সে এড়ায় না। মানুষ জন্মায় ঘরে, জীবনভ'র হাঁটে পথে, পথ হয়তো তাকে ডাকে অনতিক্রম্য মায়ায়, তবু ঘর সে ভোলেনা।
তাই উচ্চ প্রতিষ্ঠার স্কাই স্ক্র্যাপারে বসেও কবেকার ফেলে আসা বুড়োশিবতলা, বাল্যবন্ধুদল, কুবোডাকা ভোর হোষ্টেলবেলায় টিফিনবক্সে পাঠানো মায়ের হাতের নাড়ুর মতো মনে সুখাবগাহী ব্যথাসঞ্চার করে।
আবার কবে আসা হবে জানা নেই, তবে অনেক অনেক দিন পরে, নিশুতিরাতে প্রিয় জায়গায় কাটিয়ে যাওয়া শেষ রাতটিতে নিদ্রাহারা মধ্যবয়সী মানুষটির মনে পড়ছিলো, অনেক দিন আগের এক ভোরবেলাকার দৃশ্য।
চৈত্রের শেষ, একটি তরুণ দলচ্যূত হাতির অত্যাচারে জনজীবন হয়ে পড়েছিলো ব্যতিব্যস্ত; তৎকালীন ফরেস্ট অফিসারের কৃতিত্বে ধরা হয় তাকে, জলপাইগুড়ির প্রশিক্ষনকেন্দ্রে পাঠাবার আগে বন্দী করে রাখা হয় স্হানীয় পুকুরিয়ার মহুল জঙ্গলে।ওনারা বন্ধু সমভিব্যহারে গিয়েছিলেন দেখতে।
আজও মনে পড়ে, ভোরের ঝুঁজকো অন্ধকারে, গাছের তলায় শিশিরকণার মতো টুপটাপ ঝরে পড়ছে মহুল, মোটা মোটা শালবল্লীর বদ্ধ ঘেরাটোপে আবদ্ধ তরুন গজরাজ উদাসনয়নে তাকিয়ে আছেন আকাশের দিকে, চোখে জল...
কি ভাবছিলেন তিনি? অধিকতর সমর্থ যুথপতির সঙ্গে মরনপণ প্রণয়-দ্বৈরথে পরাজিত এবং বিতাড়িত নায়কের মনে কি ভাসছিলো প্রিয়াসঙ্গে কাটিয়ে আসা দিন-রাত-ভোরগুলির স্মৃতি! তাঁর এই দুর্মর একাকীত্বের গহনেও মনেমনে কি ভাবছিলেন, প্রিয় হস্তিনীর শরীর এবং মন জুড়ে অনেকগুলি ছোট্ট ছোট্ট আপনার উপস্থিতির ছায়া!...'আপনারে তুমি দেখিছ মধুররসে, আমার মাঝারে নিজেরে করিয়া দান!'
পশু বা মানুষ..যে কোন জীবনই যে বড়ো একা; যাপনে বা উদযাপনে কখনও কখনও দেখা হয়, খেলা হয় কারও সঙ্গে; এমন সব অলৌকিক চাঁদের রাতে, শ্রাবণপাতে অথবা প্রখর সূর্যালোকে …
ক্রমে খেলা ভাঙে, রয়ে যায় অনন্ত একাকীত্বের সঞ্চয়...মনে বাজে সুচিত্রা মিত্রের মর্মস্পর্শী নিবেদনে মধ্য-মাঘেও বর্ষা-ডাকা দেশরাগে রচিত একাদশী তালবদ্ধ বেদনগানখানি... 'দুয়ারে দাও মোরে রাখিয়া নিত্য কল্যাণ-কাজে হে..'- যেন বহুযুগের ওপার থেকে জাগতিক সমস্ত মোহপাশ ছিন্ন করে আনন্দময় চিরসুন্দরের পায়ে জন্মভ'র হৃদয়ার্ঘ্য নিবেদন করে চলে।
এমন আধোঘুমে আধো জাগরণে তিনি শুনতে পেলেন, ভোর হচ্ছে, পাখি ডাকছে। সব সকাল তো আনন্দ নিয়ে আসেনা; এক গভীর মনকেমনিয়ার আছন্নতায় কুয়াশালীন হৈমন্তী সকালে সবাই প্রস্তুত হলেন ফেরার পথে। প্রিয়জনের অশ্রুসিক্ত নয়নপথগামী প্রত্যাবর্তন-পথে যথারীতি বিদায় জানালো বন-জঙ্গল-ঝোরা; তিতির-মা একদল ছানাপোনা নিয়ে রাস্তা পেরিয়ে গেল সাবধানে, শালের বনে অনাগত শীতের প্রতীক্ষা… তবু মন ভালো নেই, মন ভালো নেই কারও। এমনকি যে বাচ্চাগুলো দিনরাত কিচিরমিচির করে চলে, তারাও চূপ।
মাঝে কোথাও থামতে ইচ্ছে করলো না, কথা বলতেও না। সবাই যেন নিজের মতো করেই এই কয়দিনের স্মৃতিরোমন্হনে ব্যস্ত, গাড়ির মিউজিক সিস্টেমে একা একাই বাজিয়ে চলেছেন নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়; কলাবতীর বর্ণময়তায়,মারোয়ার বিষন্নতায়, মনোমঞ্জরী।
ক্রমে মাঠ-ঘাট-বন-কারখানা পেরিয়ে সুর, না না গাড়ি পৌঁছলো দ্বিতীয় হুগলীসেতু পেরিয়ে মহানগরীর উপকন্ঠে, তাঁরা পৌঁছে গেলেন পরিচিত বৃত্তে। সেই 'খাওয়ার পরে রাঁধা,আর রাঁধার পরে খাওয়া'র প্রাত্যহিকতায়।
দিন আসবে,দিন যাবে আপন খেয়ালেই। তবু গহনরাতের নিঃশব্দ প্রহরে,অফিসের কাজে ব্যস্ত আঙ্গুলে কম্পিউটারের কীপ্যাড সঞ্চালনের শব্দেও কান পাতলে হয়তো শোনা যাবে শমীবৃক্ষান্তরালে নাইটরূপী তৎকালীন সশস্ত্র পাইকবাহিনীর অশ্বখুর ধ্বনি, চাঁদনী রাতে মাদলের দ্রিমিকি-দ্রিমিকি-ধ্বনিতে জীবন-সমিধ-সংগ্রহেচ্ছায় সম্মিলিত নৃত্যোল্লাস; রান্নাঘরের জানলায় এসে বসা শালিখ-ঠোঁটের ইশারায়, না-দেখা কোন মীরাবাঈয়ের গভীর তত্ত্ব জিজ্ঞাসায়, নদীপারের বাউলানীর ঘর-ভাঙানিয়া সুরে, ভাটিয়ালির নিঃসঙ্গ আকুল নিবেদনে খুঁজে ফিরতে ইচ্ছে হবে সেই অন্যকালে হারিয়ে যাওয়া আপনজনের ঠিকানা...
হয়তো, কোন এক বিকল্প সম্ভাবনাময় বিশ্বে আমরা কেউ ছিলাম কারো একান্ত স্বজন;
হে চিরসুন্দর! লৌকিক শতব্যস্ততার বহুতর সংশয়ের মাঝেও যে মানুষ তথাকথিত ব্যর্থজীবনের লাজ সরিয়ে, সাজিয়ে আনে তার মুগ্ধতার অর্ঘ্য, গ্রহণ করো, ধন্য করো তাকে...শুভমস্তু।( সমাপ্ত)
চিত্র- লেখিকা।
আরও পড়ুন
1 Comments
কি এক মুগ্ধতায় হারিয়ে গেল মন!
ReplyDelete