জ্বলদর্চি

গ্রামের শহুরে রূপকথা--১/ সুরশ্রী ঘোষ সাহা

গ্রামের শহুরে রূপকথা 
প্রথম পর্ব: 

সুরশ্রী ঘোষ সাহা 

অতীতের গ্রাম

আমার গ্রামের জেঠিমার একটা স্মার্টফোন হয়েছে, ট্রিপল ক্যামেরাওলা। বাড়িতে এটা ষোলো নম্বর স্মার্ট ফোন। ছোট বাচ্চাগুলোকে বাদ দিয়ে সকলেরই মুঠো আলো করে আছে এই অভিনব বস্তুটি। অবাক হচ্ছেন, জেঠিমার স্মার্টফোন হওয়া নিয়ে হঠাৎ লিখতে বসলাম কেন? কারণ, জেঠিমা জন্মে ছিল সেই উনিশো সাত চল্লিশের বৈশাখ মাসে, একেবারে অজ পাড়াগাঁয়ে। ভারতবর্ষ তখনও পরাধীন। চারিদিকে আবহাওয়া গরম। তার পরপরই দেশ স্বাধীন হল অগস্টের পনেরোতে। পুকুরে বিছিয়ে দেওয়া জালকে গোটাতে যেমন সময় লাগে, তেমনি ভারতের মাটির চারিদিক থেকে নিজেদের আলগা করে গুটিয়ে তুলে চিরকালের মত চলে যেতে ইংরেজের সময় লেগেছিল। পুকুরের জল থেকে কি শুধুমাত্র মাছ ওঠে? তার সাথে তো উঠে আসে গাছের পাতা, কাঠি, প্লাস্টিকের টুকরো, ইঁটের ঢ্যালা, ছোট ছোট কাঁকড়া, শামুক কত কিছু। তেমনি অনেক কিছুকেই নিজেদের জীবন থেকে আলাদা করতে সময় লেগেছিল ইংরেজের। গ্রাম তখন ছিল সম্পূর্ণ অন্ধকারে ঢাকা। শুধু আলো আসেনি বলেই নয়। সবদিক থেকে পিছিয়ে ছিল বহু বহু দূরে। অথচ আজ সেই গ্রাম অতি আধুনিক শহুরে জীবন কাটাচ্ছে। মানুষ যেমন বদলায়। বদলায় প্রকৃতির রূপ। তেমনইভাবে গ্রামও একটু একটু করে বদলে ভিতরে ভিতরে শহর হয়ে উঠেছে। গ্রামের সেই শহুরে রূপকথাকেই আজ আমি লিখতে বসলাম। কিছুটা নিজের চোখে দেখা। কিছুটা নানা প্রশ্ন করে গ্রামের জেঠিমার কাছ থেকে শোনা। আর কিছুটা বহু গ্রামে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আত্মীয় - পরিজন ও বন্ধুদের কাছ থেকে জানা। সেই সেদিনের গ্রাম ও তার বিবর্তনের ঘটনাই কলমের মুখে শোনাই।  

জেঠিমা মাথার সাদা চুলগুলোয় চিরুন বোলাতে বোলাতে বলছিল —

আমি হলাম বাড়ির প্রথম সন্তান। বোধ হওয়ার পর প্রথম যে মানুষদুটোকে চিনলাম, তারা আমার বাবা মা। বাবা ছিল চাষি ও গ্রামের পাঠশালার মাস্টারমশাই। মা আমার শুধুই মা। যে উঠোন নিকোয়, রান্না করে, আমাকে মানুষ করে। 

আমাদের একটা মাটির ছোট্ট বাড়ি ছিল। বর্ষায় জল ঢুকত ঘরে। আর শীতের রাতে হু হু করে ঢুকত ঠান্ডা। যেদিন খড়ের ছাদ সরিয়ে বাবা টালি লাগালো, আনন্দে নেচেছিলাম। একদিন মা আর ঠাকুমা একসাথে দুটো আলাদা ঘরে ঢুকল। বড় হয়ে জেনেছিলাম তাকে আঁতুর ঘর বলে। মায়ের হল একটা প্রতিবন্ধী মেয়ে, সম্পর্কে যে আমার বোন। আর ঠাকুমার হল একটা ফুটফুটে ছেলে, সম্পর্কে যে আমার কাকা। এমনইভাবে সংসার ও সম্পর্ক বড় হতে থাকল। 

বাবার কাছে মা বায়না করল মেয়েকে লেখাপড়া শেখাতে চায়। মা যা শেখেনি, জানেনি, মেয়ে তা জানবে। খালি পায়ে ফ্রক পরে বাবার হাত ধরে গ্রামের প্রথম মেয়ে আমি পাঠশালা গেলাম। একমাত্র ছাত্রী। বাকি সব ছাত্র। বই বলতে কিছু নেই। খাতা বলতে স্লেট আর পেনসিল। কিছু মাস পর পাশের গ্রামের আরো একটি মেয়েকে বন্ধু পেলাম। স্কুলে ছাত্রী এক থেকে দুই হলাম। 

আমি যখন বিনুনি দুলিয়ে পাঠশালা যেতাম, বোন উঠোনে উপুড় হয়ে শুয়ে মাটি খুঁটে মুখে তুলত। মুখ থেকে তার লালা ঝরে পড়ত। মুছে দেওয়ার কেউ নেই। ঠাকুমা হয়ত কাকাকে দুষ্টুমির জন্য জানালার সাথে বেঁধে পুকুরে গেছে বাসন মাজতে। মা সেই পুকুরের উপরের সর সরিয়ে জল তুলে আনছে রান্না করার জন্য। তখন গ্রামে পুকুর বা নদীর জলই রান্না করতে, কাচাকুচি করতে অথবা বাসন মাজতে ব্যবহার করা হত। আর বাড়িতে বাড়িতে যে ইদারা বা কুয়ো থাকত, তার ঠান্ডা জল খাওয়া হত। 

আমি যখন আলু মাখা ও কলমি শাক ভাজা দিয়ে লাল বগড়া চালের ভাত মেখে গোগ্রাসে খেয়ে পাঠশালা যাওয়ার প্রস্তুতি নিতাম, গোয়ালে তখন গরুগুলো খিদেতে খুব চ্যাঁচাত। তাদেরও মুখ থেকে লালার রেখা মাটিতে পড়ে আঁকিবুকি কাটত। পাঠশালায় ছেলেগুলোর আগে পৌঁছনোর খুব তাড়া থাকত। যাতে মাটিতে পাতা শতরঞ্চির সামনের দিকে বসতে পারি। যদিও ধুতি পাঞ্জাবি পরা, হাতে বেত ধরা শিক্ষকদের তখন খুব ভয় পেত দুষ্টু ছেলেগুলো। আমার আর শান্তির তেমন ভয় নেই। শান্তি, আমার সেই একমাত্র বান্ধবী। পাঠশালার শিক্ষকের কথায় বুঝতাম, তখনও ব্রিটিশ আমলের ছায়া সরেনি আমাদের জীবন থেকে। তখনও পরাধীনতার গ্লানি এতটুকু মোছেনি। 

আমাদের সকাল হত ভোর চারটেয়। আর রাত হত আটটায়। দিনের আলোটুকুকে আমরা যতখানি পারতাম শুষে নিতে চাইতাম। কারণ, সন্ধ্যা গড়ালেই যে নিঝুম অন্ধকার। একটা কী দুটো কেরোসিনের লম্ফ বা কুপি বাতি ঘরে। যার আলোয় পড়াশোনা ও খাওয়া চলত। দাদু, ঠাকুমা সারাদিনের খাটুনি শেষে দাওয়ায় বসে ঝিমোত। আর পথ থেকে কেউ হেঁটে গেলে চাঁদের আলোয় ছায়া ছায়া দেখে জিজ্ঞেস করত, 'কে যায়?' ছায়া মানুষ দাঁড়িয়ে পড়ে উত্তর দিত, 'আমি, রহিম গো। ছেলেটার বড় অসুখ। গ্রামের বিশু ডাক্তারের খোঁজ করতে গেসলাম।' 'হল কী, তর পোলাটার? কী অসুখ বাঁধসে?' হয়ত উত্তর আসত, ভেদ বমি করছে, কিংবা খুব জ্বর। জ্বর-জ্বালা তখন আমাদের জীবনের নিত্য দিনের সঙ্গী। দিনের পর দিন সাবু আর বার্লি খাইয়ে রোগীকে শুইয়ে রাখা চলত। গোটা গ্রামে একটাই হোমিওপ্যাথি ডাক্তার ছিল। ডাকলেই যে পাওয়া যেত, তাও নয়। অজানা জ্বরে ভুগে ভুগে কখনো রোগী পাঁচ-সাতদিন পর মারা যেত। পরিবারে বেশিদিন তাকে নিয়ে শোক পালনও চলত না। মৃত সন্তানের মা আবার পোয়াতি হয়ে, আবার সন্তানের জন্ম দিয়ে বাচ্চা মানুষ করতে লেগে যেত ... 

বাবা ভোরে উঠে জমিতে চাষ করত। আমাদের সারা বছরের মরশুমি ফসল যে জমি থেকেই আসত। কিছু তার খেতাম কিছু বাজারে হাটে বিক্রি করা হত। একদিন আমার মা আবার আঁতুর ঘরে ঢুকল। এবারে ভাই হল। তবে বোনের মতন নয়, সুস্থ। বাবার মুখে আলো চমকালো। আমি ন্যাকড়ায় করে চিপে চিপে ভাইকে দুধ খাওয়াতে শিখলাম। বোন ওদিকে হামাই টানে শুধু। হাঁটতে আর পারে না। তখনও ভুঁই থেকে কুড়িয়ে মাটি-বালি মুখে দেয় আর লালা ঝরায়। মা কাজের ফাঁকে দৌড়ে এসে ভাই আর বোনকে কোলে বসিয়ে দুদিকের দুটো স্তন মুখে পুরে দেয়। 

আমি পাঠশালায় শ্রেণী বদল করতে থাকি। পাশাপাশি মায়ের দেখে দেখে শিখি — রান্না করা, উঠোন ঝাঁট দেওয়া, দেওয়ালে ঘুটে দেওয়া, সেই ঘুটে শুকিয়ে গেলে পেড়ে ওলোট পালোট করে আরও রোদ খাওয়ানো। তারপর কিছু ঘরের জ্বালানির জন্য রেখে বাকি দড়ি বেঁধে সরিয়ে রাখা। এক বুড়ি আসত, যে ওগুলো নিয়ে গিয়ে গ্রামের বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেচত। তারপর ফেরার পথে মায়ের হাতে এনে তুলে দিত কয়েক আনা। মা পয়সাগুলো কাপড়ের পুঁটলি করে সরিয়ে রাখত চৌকির নিচে অ্যালুমিনিয়ামের বাক্সের মধ্যে। 

একদিন আমাদের ঘর বাড়ল। ভাঙা টালি বদলে নতুন টালি বসল। তখন গোটা গ্রামে কোন পায়খানা ছিল না। কি দিন - কি রাত, কি মহিলা - কি পুরুষ সকলেই বদনা গাড়ুতে করে জল নিয়ে মাঠে গিয়ে বসতাম। শেয়াল কুকুরের ভয়ে ছোট মেয়েদের সাথে তাদের মায়েরাও পিছনে গিয়ে বসে থাকত। বাবা অনেক পরে একদিন শুনল, শহরে খাটা পায়খানায় লোকে পায়খানা করে। আর বাড়িতেই এক ধারে সেই ব্যবস্থা করা যায়। পঞ্চায়েত প্রধানকে জানিয়ে বাবা আমাদের বাসায় খাটা পায়খানার ব্যবস্থা করল। যার মাটিতে দু-পা ছড়িয়ে উবু হয়ে বসতে হত, নিচে একটা গর্ত করা। যে গর্তের মধ্যে বসানো থাকত একটা মাটির পাত্র। সেই পাত্রে মল জমত। গ্রামের দলিত সম্প্রদায়ের কিছু মানুষ একদিন করে এসে সেই মল তুলে নিয়ে যেত। 

আমাদের মধ্যে ছেলে-মেয়ে বলে কোন ভেদাভেদ ছিল না। বিকেল হলেই মাঠে ছুটতাম খেলতে। কিৎকিৎ, কবাডি কবাডি, ছোঁয়াছুঁয়ি, ডাংগুলি এমন কত খেলা। খাবার জল আনতে, বাসন মাজতে, কাপড় কাচতে আমাদের বাড়ির সামনে যে একটাই মাত্র পুকুর ছিল, তার জলে নেমে কাজ করতে করতে কীভাবে কবে যেন সাঁতার কাটতেও শিখে গেলাম। তারপর পুকুর এপার-ওপার করা, আঁজলা - কোঁচড়ে করে মাছ ধরাটাও হয়ে গেল জীবনের এক খেলা। 

(ছবি : লেখিকা)          
ক্রমশ...

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇



Post a Comment

1 Comments