জ্বলদর্চি

যেতে যেতে পথে-৩১/রোশেনারা খান

যেতে যেতে পথে

রোশেনারা খান

পর্ব ৩১

সিঙ্গুরে চাকরির মেয়াদ শেষ হয়ে যেতে বাবলি  বরাকরে পার্মানেন্ট চাকরিতে  যোগ না দিয়ে বেহালায় বাসাভাড়া নিয়ে কলকাতা চলে যায়। ওখানেই সময় কাটানোর জন্য একটি প্রাইভেট স্কুলে কাজ নেয়। ‘এম আর সি ও জি’ ডিগ্রি লাভের জন্য বিশেষ  পরীক্ষার পাশ করে  দীপ ২০০৪ এর অক্টোবরে একা ইংল্যান্ড পাড়ি দিল। বাবলি এয়ারপোর্টে পৌছাতে গেল। বেহালার বাড়িতে আমি একা একা কেঁদেই চলেছি, ভীষণ মনখারাপ। এদেশ থেকে ওদেশ নয়, এক মহাদেশ থেকে আর এক মহাদেশ, ইউরোপের দেশগুলিতে জীবনযাত্রা খুবই ব্যয়বহুল। একটা অনিশ্চয়তার মধ্যে কোথায় থাকবে? কী খাবে? কী ভাবে কাজ জোগাড় করবে?

      দীপ একা নয়, ওরা কয়েকজন বন্ধু মিলে গেছে। প্রথমে পরীক্ষার জন্য লন্ডনে একমাস ছিল। ওখান থেকে নরউইচ। এখানে ওর মত আরও কয়েকজন কলকাতার এক দাদার বাড়িতে থাকত। পরবর্তী কালে আমিও ওদেশে থেকে দেখেছি, সাম্প্রদায়িকতা, জাতি বৈষম্য, ঘৃণা ইত্যাদি দেশেই বেশি দেখা যায়। এর জন্য রাজনৈতিক সামাজিক পরিস্থিতি অনেকাংশে দায়ি। এখনে সবাই এক, এবং হেল্পফুল। এখানে দেশ থেকে নতুন ছাত্ররা এলে, আগে আসা দাদা দিদিরা বিভিন্নভাবে সাহায্য করে। নিজেদের অসুবিধা করেও বাড়িতে থাকতে, খেতে দেয়। কে পাকিস্তানি কে বাংলাদেশি ,কে ভারতীয়? এসব কেউ দেখেনা। এই প্রসঙ্গে দীপ একটা কথা বলেছিল, ‘ছোট থেকে একটা জিনিস জেনে বড় হয়েছিলাম, খাঁটি দেশপ্রেমিক হতে হলে পাকিস্তানকে ঘৃণা করতে হবে’। এখানে এসে সেসব ধারণা  ওলটপালট হয়ে গেছে। পাকিস্তানি বন্ধু ও তাঁদের পরিবারের অন্যান্যদের ব্যবহার  সব বদলে দিয়েছে।

    যাইহোক, ৮ মার্চ বিশ্ব নারীদিবস। দুপুরে তারা বাংলার ‘প্রিয় বান্ধবী’ অনুষ্ঠানে আমার আমন্ত্রণ আছে, তাই আগেরদিন কলকাতা চলে এসেছি। পরদিন সকালে শর্মিষ্ঠার ফোন, দিদি আপনি কথায়?- আমি কলকাতায়, দুপুরে তারা বাংলায় প্রোগ্রাম আছে। শুনে বলল, বাঁচালেন দিদি, গতকাল রাত দশটায় দূরদর্শন থেকে ফোন করে বলেছে, আগামীকাল নারীদিবস। তাই এমন ৫ জন মহিলাকে নিয়ে প্রোগ্রাম করতে হবে, যারা খুব লড়াই করে ওপরে উঠেছেন। আমার তো প্রথমেই আপনার নাম মনে পড়ল। দূরদর্শনের অনুষ্ঠান রাতে, তাই অসুবিধা হল না। বেসরকারি চ্যানেল থেকে গাড়ি নিতে আসে, আজকেও এসেছিল। অনুষ্ঠানে  আমার সঙ্গে ছিলেন জ্যোতি বসুর প্রাক্তন বৌমা ডলি বসু, সঞ্চালনায় ছিলেন অপরাজিতা। ডলির সঙ্গে আলাপ হয়ে খুব ভাল লাগল।

    রাতে বকুল আর ওর এক বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে ট্যাক্সিতে দূরদর্শন পৌঁছালাম। এরা যেহেতু নির্দিষ্ট অঙ্কের একটা চেক দেয়, তাই সরকারি চ্যানেল গাড়ি পাঠায় না। স্টুডিওতে পৌঁছে  আমার মত কাউকে দেখতে পেলাম না। এসেছেন, অভিনেত্রী বৈশাখী মার্জিত, লেখিকা লীনা চাকী, পউলমি ঘটক, সঞ্চিতা কুশারি (গ্রুমিং করে), আর আমি। অনুষ্ঠান শেষে দূরদর্শনের ডিরেক্টর পঙ্কজ সাহা মহাশয় আমাদের সঙ্গে বাইরে বেরিয়ে এসে বৈশাখীকে ধমক দিয়ে বললেন, বাংলা অনুষ্ঠানে  এত ইংরেজি শব্দ ব্যবহার কর কেন? আমাকে বললেন, আপনি তো খুব ভাল বলেন, পরে অন্য কোনও অনুষ্ঠানে ডাকলে আসবেন? আমি যথারীতি একই উত্তর দিলাম, অনেক দূরে থাকি, আগে থেকে না বললে আশা সম্ভব হবে না। এই অনুষ্ঠানটি পর পর তিন বছর দূরদর্শনে প্রচারিত হয়েছিল।
    ৯/০৫/২০০৫, আজ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিন। এই দিন নোবেল পদক দুটি জনসাধারণকে দেখার সুযোগ করে দেওয়া হয়। কিন্তু এবার পদক বের করে দেখা লেছে, এটি আসল ন্য়। আসল পদকে ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর’ লেখা ছিল। এই পদকে লেখা আছে ‘আর এন টেগোর’। এর পর সারা দেশ জুড়ে তোলপাড় শুরু হয়ে গেল। আজও তার খোঁজ মেলেনি।

    যাইহোক, শুনলাম এবার দীপের চাকরি হয়ে যাবে। কিন্তু কোনো কারণে হলনা। ও মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়ল। আমরা সান্ত্বনা দিচ্ছি, কিন্তু আমাদেরও তো  ভীষণ মন খারাপ। মেয়েটার মুখের দিকে তাকাতে পারছি না। ঠিক এই সময়(১২/০৫/২০০৫) আনন্দবাজার পত্রিকার প্রথম পাতায় ছবিসহ আমার ছোট্ট একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হল। পুরুষের একাধিক বিবাহের বিরোধিতা করেছি।  সকাল থেকে দুটো ফোন বেজেই চলেছে।সকলেই যে সমর্থন করছেন এমনটা নয়। খবর পেলাম আমার শ্বশুর বাড়ির গ্রামে কিছু ছেলে মিছিল বের করেছে। আমি নাকি শরিয়ত বিরোধী কথা বলেছি। মেদিনীপুরেই আমার এক খুড়তুতো ননদের শ্বশুরবাড়ি, সে খবর পাঠিয়েছে, আমাদের পাড়ার লোক নাকি পাড়াছাড়া করবে বলেছে।আরও অনেক কথা রটাতে লাগল।ইয়াসিনদা (পাথান) পুলিশ প্রটেকশনের কথা বলতেন। যিনি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন(মিলন দত্ত)তিনি বললেন, থানায় একটা জি ডি করে নাম্বারটা যেন ওনাকে পাঠিয়েদি। আমি এর কোনটাই করিনি। কেউ আমার সামনে এসে কিছু বলার সাহস দেখায়নি। মন  খারাপ বলে বাবলিকে এ সব কিছু জানাইনি। স্কুলে যেতে ওর কলিগরা বলেছেন, বাসায় ফিরতে ওর  ল্যান্ডলেডি সীমাদি বলেছেন। তখন ও আমাকে ফোন করে জিজ্ঞেস করল, মা আনন্দবাজারে তোমার ইন্টারভিউ বেরিয়েছে,আমাকে বলনি কেন?
      তখন বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে ও অন্যান্য অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার জন্য প্রায় আমাকে কলকাতা যেতে হত। এই সুযোগে কয়েকদিন ছেলে-মেয়ের কাছে থাকাও হত। বকুল ও তখন দিদির কাছে থাকত। সবে ‘বি টেক’ কমপ্লিট করে চাকুরির সন্ধান করছে। ছেলেটার আমার বরাবরই কপাল খারাপ। ভাল রেজাল্ট করেও ক্যাম্পাসিং এ সিলেক্ট হতে পারল না স্টাডি ব্রেকের জন্য। এর কারণ যে  মেয়েটিকে পছন্দ করত, বাড়িথেকে তার বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়। মেয়েটির বিয়ের দিন ও আমাকে ফোনে বলল, আমার একটুকুও কষ্ট হচ্ছেনা। কিন্তু আমি তো  মা, বুঝতে পেরেছিলাম ও ভিতরে ভিতরে ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে যাচ্ছে। আমার কিছু করার ছিলনা। এ বিয়ে মেয়ের বাড়ি মেনে নিত না,ঝামেলা হত।

    দীপ নরউইচে থেকে ভলেণ্টারি সার্ভিস দিচ্ছে, চাকরি পাইনি। মেয়েটা মাঝে মাঝে কেমন উদাস হয়ে পড়ছে। ছেলেটারও কিছু হচ্ছে না। এক কঠিন পরিস্থিতির ওপর দিয়ে চলেছি। দীপের জন্য বেশি চিন্তা হচ্ছে, ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে  আসছে, টাকা ফুরিয়ে আসছে। টাকার ব্যবস্থা হয়ে যাবে, কিন্তু কাজ না পেলে ভিসার সময় তো বাড়ানো যাবে না।

    অগাস্টে দীপ ২ মাসের জন্য নরউইচের সমুদ্রের তীরবর্তী শহর গ্রেটইয়ার মাউথে চাকরি পেল। এতে দুটো কাজ হল, ভিসা ৬ মাস বেড়ে গেল। দুমাসের মাইনেও(প্রায় ৮ লাখ)অনেকগুলো টাকা হাতে আসবে। খুশির খবর, আবার মনও খারাপ করছে। দীপ বাবলিকে তাড়াতাড়ি ভিসা আর টিকিটের ব্যবস্থা করতে বলেছে। মেয়েটাও চলে যাবে, কী করে থাকব? ভিসা টিকিট, শপিং সবই একা করতে শুরু করল। মাঝে মাঝে আমি সঙ্গে থাকছি।

    ৩/০৮/২০০৫ এ কলকাতা দূরদর্শনে মহিলাদের অনুষ্ঠান ‘আনন্যা’ তে যোগ দেওয়ার ডাক পেলাম। বিষয় ‘মা মেয়ের সম্পর্কের নানা দিক’। সাড়ে সাতটা থেকে সাড়ে আটটা লাইভ অনুষ্ঠান। এবারেও ছেলেকে নিয়ে গেলাম, অনুষ্ঠানে আরও একজন অতিথি ছিলেন মনোবিদ পুস্প মিশ্র। সঞ্চালনায় ছিলেন হৈমন্তী। এটা ওর দূরদর্শনে শেষ কাজ ছিল। ও এখানের চাকরি ছেড়ে ওর স্বামীর কাছে ভাইজাগ চলে যাবে। অনুষ্ঠান শুরুর আগে নিজেদের মধ্যে আলোচনার সময় আমি একটি কবিতা শুনিয়েছিলাম। হৈমন্তী বললেন আপনার এই কবিতাটি দিয়ে অনুষ্ঠান শেষ করব। এই অনুষ্ঠানটিতেও দর্শকরা ফোনে আমাদের প্রশ্ন করছিলেন।  আগে এই লাইভ অনুষ্ঠানে একজন অতিথি থাকতেন। কিন্তু পৌঁছাতে দেরি হলে বা কোনও কারণে আসতে না পারলে অনুষ্ঠান বাতিল করতে হত। তাই দুজনকে ডাকা হয়।
    ২৮/০৮/২০০৫ এ বাবলি একা ইংল্যেনড রওনা দিল। ওর বাপি আর আমি এয়ারপোর্ট পৌঁছাতে গেলাম। আমার ছোট্ট পাখি উড়ে গেল দমদম থেকে হিথরো। মন ভীষণ খারাপ। অফিস থাকায় খান সাহেব পরের দিনই বাড়ি ফিরে গেলেন। সব গুছিয়ে রাখার জন্য আমি থেকে গেলাম। একা একদম ভাল লাগছে না। মাঝে মাঝে মা মেয়ের দ্বৈত ভূমিকায় অভিনয় করে চলেছি। ওর মৌরির কৌট, ওর কোলবালিশ, ওর জামাকাপড় সবই ওর অনুপস্থিতি মনে করিয়ে দিচ্ছে। দুদিন থেকে বাড়ি ফিরে এলাম।

      ১৬/০৯/২০০৫ এ তারার রেডিওতে পুজোর আড্ডায় যোগ দেবার ডাক পেলাম। যথারীতি গাড়ি এল আমাকে নিতে। আমাকে তুলে শ্রাবণী সেনকে তুলল। আমরা স্টুডিওতে পৌঁছানর পর শ্রীরাধা বন্দ্যোপাধ্যায় এলেন। তারপর এলেন বনশ্রী সেনগুপ্ত ও ওনার স্বামী। সঞ্চালনায় ছিলেন অজন্তা। আমার কবিতা,আর অনাদের গানে আড্ডা বেশ জমে উঠেছিল। অনুষ্ঠান শুরুর আগেও আমরা নিজেদের মধ্যে আড্ডা দিচ্ছিলাম। বনশ্রীদি বললেন, একবার ভিড়ের মধ্যে স্বামীকে ভেবে অন্য এক জনের টাকে চাঁটি মেরে দিয়েছিলেন। ‘আজ বিকেলের ডাকে তোমার চিঠি পেলাম’, গানটি নিয়েও অনেক কথা হল।

আরও পড়ুন

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments