জ্বলদর্চি

পথে পথে পাথর ছড়ানো /সালেহা খাতুন

স্মৃতি গদ্য


পথে পথে পাথর ছড়ানো 

সালেহা খাতুন


একুশে আইনের কবলে পড়ে  ছোটোরা যখন স্কুলে যেতে পারছিল না তখন থেকেই আমার মনে বারবার হানা দিচ্ছিল আমার স্কুলের যাত্রাপথ। সে গল্পই আজ করবো। বন্ধুদের সঙ্গে গ্রামের পথ ধরে স্কুলে যেতাম। যাত্রাপথে প্রথমে পড়তো মানিকতলা কবরস্থান,তারপর ঘোষবাড়ি,তারপর বিরাট এক ভাগাড়,কিছুটা এগিয়ে শ্মশান,এরপর ব্যাঙ্ক অফিসার রহমাতুল্লা সাহেবের বাড়ির বিশাল প্রাচীর। আমি এই প্রাচীরকে তুলনা করতাম চীনের মহাপ্রাচীরের সঙ্গে। রাস্তা বরাবর ছিল বিরাট এক খাল। অনেকটা পথ গিয়ে খালের ওপর একটা ঢালু ব্রিজ পেরিয়ে কিছুটা গিয়ে তবে স্কুল। এই দীর্ঘ যাত্রাপথে আমি যখন একা যেতাম আর মুশকিলে পড়তাম, বহুবার মাকে গল্প করে শুনিয়েছি। আমার স্মৃতিতে সেগুলো ছবির মতো ভেসে ওঠে।

    প্রথমত, মানিকতলার কবরস্থান; একদম ছোট্টবেলায় যেদিকে যেতে বড়োরা বারণ করতো। কিন্তু বড়ো হয়ে ঐ রাস্তা দিয়েই রোজ স্কুলে যেতাম। জায়গাটাকে বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘেরা সুন্দর একটা বাগান বলেই মনে হয়। কর্মক্লান্ত মানুষজন পার্থিব জীবন অবসানের পর একটা নিরাপদ নিভৃত আশ্রয়ে বসুন্ধরার কোলের ভিতর সুখে নিদ্রারত।


জ্বলদর্চি তিরিশ পেরিয়ে... 

দ্বিতীয়ত, ঘোষবাড়ি। আমাদের ছোটোবেলাটা কেটেছে ঘোষেদের জমিদারবাড়ি আর বাঁশবাগানে। বদ্রিনাথ জ্যেঠু, শিবনারায়ণ জ্যেঠু, অষ্টকাকু এঁরা স্কুলে যাওয়ার পথে আমাকে ভীষণ উৎসাহিত করতেন। বলতেন পড়াশোনাই একমাত্র মুক্তির উপায়। ঘোষবাড়ির মানুদা আমাকে অঙ্ক করাত। আমি একবার অঙ্ক ভুল করেছিলাম বলে খাতা এমন ছুঁড়ে দিয়েছিলো যে তা জমিদার বাড়ির সীমানা প্রায় অতিক্রম করে গিয়েছিল। রাগে-দুঃখে-লজ্জায় আমি সেদিন কিছু না বললেও ফাইনাল পরীক্ষায় অঙ্কে প্রায় 100% স্কোর করেছিলাম। মানুদা তো এই রেজাল্টে বেজায় খুশি। কে জানে মনে মনে হয়তো আমার খাতা ছুঁড়ে ফেলে দেওয়ায় মানুদার মনটা খারাপ হয়েই গেছিল।

   আর ভাগাড় ধারে আমার সঙ্গে যেসব  কাণ্ড হয়েছিল তা যথেষ্ট লোমহর্ষক। এখনও রাতের দিকে এসব মনে পড়লে গায়ে কাঁটা দেয়। একবার ভাগাড়ে ফেলে দেওয়া মৃত ছাগলদের ঘেরাটোপে আমি আটকে পড়েছিলাম। অদ্ভুত অবস্থা। চারদিকে নির্জনতা, কাছাকাছি কোনো লোকালয় নেই তবুও এখানে কী করে এতো ছাগল এলো! বাপরে সে এক বিন্যাস। প্রথমে শিংঅলা একটা বড়ো ছাগল আমাকে তেড়ে এলো কামড়াবে বলে। তারপর তার থেকে মুক্তি পেতেই চলে এলো দশ বারোটা বাচ্চা ছাগল। এরা আমাকে গোল করে ঘিরে ধরলো। লাফ মেরে এদের পেরোতেই আর এক শিংঅলা ছাগলের খপ্পরে। যা জীবনে এর আগে কখনো ঘটেনি, আমার তো আত্মারাম খাঁচা ছাড়া। লম্বা এক লাফ দিয়ে রাস্তা থেকে আমি ঝাঁপিয়ে পড়ি মাঠের মধ্যে। যে মাঠ ধান কাটা হয়ে যাওয়ার পর কর্দমাক্ত হয়ে আছে। ছুটতে ছুটতে কিছুটা এসে আবার পড়ি বিশাল ফণাধারী এক সাপের মুখে। আমি সেদিন বেঁচে ফিরেছিলাম সে আমার দুর্দান্ত সাহসের জোরে। এমন সময়ে নার্ভ ঠিক রাখাই বড়ো দায়।

     যাত্রাপথের আর এক বড়ো  বিভীষিকা রহমাতুল্লা সাহেবের বাড়ির দীর্ঘ প্রাচীর। প্রাচীর জুড়ে লেজ ঝুলিয়ে শখানেক হনুমান প্রায়দিনই বসে থাকতো। পথচারী কোন সাইকেল আরোহীর পিছন পিছন ছুটে এ রাস্তা পেরোতে হতো। কিন্তু রোজই তো আর সবাইকে পাওয়া যেতো না। এক একদিন হনুমানের ভয়ে রাস্তার ধারে খালে ঝাঁপিয়ে পড়ে আমার স্কুলড্রেস যেতো ভিজে। ভিজে স্কুল ড্রেসেই ছুটতে ছুটতে আমার কল্পনার চীনের প্রাচীর পেরিয়ে খালের ওপরকার ঢালু ব্রিজে পৌঁছে সে আর এক দৃশ্য। পাড়ার লোকজন মাছ ধরার জন্য ব্রিজের নীচে ঘুনি আটল সব বসিয়ে রেখেছে। বোকা মাছেরা তার ছোট্ট দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে আর বেরোতে পারত না। রোজ রোজ এমনই ঘটত কিন্তু একদিন এক ভয়ংকর দৃশ্য। মাছ ধরার ঐ খাঁচাগুলো পূর্ণ হয়ে আছে বিষাক্ত সব সাপে। মানুষের মতো সাপও মাছ খায়। তবে রান্না করে নয়। মাছের লোভে খাঁচায় ঢুকে নিজেরাও আর বেরোতে পারে না।  খুব ভয় পেয়েছিলাম। শেষ পর্যন্ত সাপগুলোর কী হয় এটা দেখার জন্য তখন আর অপেক্ষা করা যায় না কেননা স্কুলে যেতে দেরি হয়ে যাবে। দেরি হলে দিদিমণি ও স্যারেরা বকবেন। গরমের দিনে ক্লাসরুমেই প্রার্থনা হতো। আমার বন্ধুরা এতো দুষ্টু ছিল যে যারা পিছনে থাকত তারা প্রার্থনা চলাকালীন সীট বেঞ্চ সরিয়ে নিত আর প্রার্থনা শেষ হলে বন্ধুরা বসতে গিয়ে হুড়মুড়িয়ে পড়ত। একেবারে ভূমিকম্পের মতো। এখনও হয়তো হয়তো এ দুষ্টুমি চলে....
এখন তো চলি শহরের পথে পথে তবুও গ্রাম হানা দেয় বারে বারে।

পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

1 Comments

  1. খুব সুন্দর স্মৃতি। দারুন লাগলো

    ReplyDelete