জ্বলদর্চি

বসে আছি হে কবে শুনিবো তোমার বাণী /সোমদত্তা

বসে আছি হে কবে শুনিবো তোমার বাণী

সোমদত্তা

টেক ওয়ান 

সে অনেক দিন আগের কথা, ফিরে যাই তেরো বছর আগে। দাঁড়িয়ে আছি উত্তরাখণ্ডের বিনসরে।KMVN র রিসর্টের এক টুকরো  ছাদে। দূরে নীল আকাশের  গা বেয়ে খাড়া দাঁড়িয়ে আছে ত্রিশূল। সকল  আট টার মিঠে রোদে  সে কমলা  সোনালী  রঙের বিচ্ছুরণ  ঘটাচ্ছে। চোখের আরাম, মনের শান্তি। পাশেই এক মধ্যবয়সী  ভদ্রমহিলা।  চোখে কালো  সানগ্লাস।  আমার বাঙালি মন --- পর বিষয়ে  চির কৌতুহলী--- কালো কাঁচের  আড়াল দিয়ে উনি বিশেষ  কি দেখছেন?  যাক গে।  একটু  বাদেই আমার মেয়ে নীচ থেকে  এলো, তখন দুই বছর  ও পুরো  হয়নি।  এসেই প্রশ্ন, "মাম্মাম, ভগবান  কি গো, সবাই ভগবান  দেখতে যাচ্ছে। " অনেক ই সেদিন পাতাল ভুবনেশ্বর  যাচ্ছিলো। কি বোঝাবো ওইটুকু  বাচ্চাকে।  সকাল থেকে  পাহাড়  দেখে  তার আধো বুলিতে  "আসকিলিমের পাবাড় " বলে লাফাচ্ছিল। হাতড়ে নিয়ে  বললাম "তোর আসকিলিমের পাবাড় টা কি সুন্দর  না, " উত্তর , "হা তো ", বললাম , " ওটাই ভগবান , তোর যা কিছু  সুন্দর  লাগবে, সেটাই ভগবান।"

 

জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇


  পাশ থেকে  ভদ্রমহিলা  ঘুরে দাঁড়িয়ে  বললেন, " খুব সুন্দর  বললে,তুমিই বলছি, গলা শুনে  মনে হচ্ছে বেশি বয়স  না " প্রথম বার ঝটকা।  বললেন , "আমি জম্মান্ধ, দিদি, জামাইবাবুর সাথে প্রতিবছর  পাহাড়ে আসি, দেখতে তো পাই না, আমি পাহাড়কে অনুভব  করি । " দ্বিতীয় বার  ঝটকা। পাহাড়কে অনুভব  -- কি প্রসারিত  উপলব্ধির জগৎ , কি অপরিমেয় বিশ্বাস।  আমার প্রথম  ভগবান  দেখা।  শুধু  বললাম , "আপনি  আমার থেকে  অনেক বেশি কাছ থেকে  ভগবান কে দেখেছেন।।

টেক টু
  
ফিরে আসি এখনে।আপনভূমিতে।  কল্যাণী  চরসরাটি গঙ্গার ধারে শীতের বৈকালিক  ভ্রমণ  ছিল বেশ মাঝে মধ্যে ই।  নৌকা  করে গঙ্গা বক্ষে ঘোরে, চরে যাওয়া , পানকৌড়ি র সাথে বাক্যালাপ বেশ জমে যায়। গত বছর  নদী থেকে  একটু দূরে, অপেক্ষাকৃত ফাঁক তে এক অশ্বত্থ  গাছের নীচে আধো অন্ধকারে  দুই ভদ্রমহিলা কে দেখে, আবার অতি কৌতুহল , আবার দৌঁড়।  গিয়ে দেখি ওনারা প্রদীপ  জ্বালিয়ে , ধুপকাঠি দিয়ে গাছের গুঁড়িতে পুজো করছেন, বেশ একটা  মনোরম  পরিবেশ রচনা  করেছেন। ভালো , বেশ ভালো।  
এই বছর  আবার গেছি একই জায়গায় , একই উদ্দেশ্য , একই ঘোরাঘুরি।  হটাৎ  দেখি সেই গাছ টা ঘিরে বেশ ভিড়।  আবার দৌঁড় , এবার অনেক  লোকজন , গাছ তলাটা বাঁধানো।  বেশ কয়েকটি  শিব ঠাকুরের  ছবি , একটা  বেশ বড় কালো পাথর ও জুটে গেছে ।  শাঁক বাজিয়ে, প্রদীপ , আরো ইত্যাদি  সহযোগে পুজো চলছে।  জানতে  চাওয়ায় একজন  বললেন, " এটা বহু পুরানো, জাগ্রত  বাবার থান"।  যে যা চায় বাবা নাকি তার মনোষ্কামনা পূর্ণ  করেন।  বিজাতীয়  পোশাক  দেখে ভাবলেন বোধহয়  বাইরের লোক।  বললেন, সামনের বছর  সংক্রান্তি  তে এসো, বড় করে পুজো  হবে, মেলা হবে।  আমার দ্বিতীয় বার  ঈশ্বর দর্শন।  প্রণাম করে  মনে মনে  বললাম, " বাবা, মাঝে মাঝে  দেখা  দিও, নয় টাকা দিও।"

টেক থ্রি 

এবার কাণ্ড  কল্যাণীতে, সাম্প্রতিক। মেয়ের কল্যাণে।  আমাদের ফ্ল্যাটের  সামনে এক বিশাল করঞ্জা ফুলের গাছ, তার শাখা প্রশাখা ছড়িয়ে সে আমাদের মাথায় ছাতা ধরে  আছে। তার ই একটা  ডাল নীচের দিকে  এমন ভাবে  বেড়েছে যেন গনেশের শুঁড়। কিছু দিন  আগে  ঘর পরিস্কার  করতে গিয়ে কিছু পুরোনো  রঙ আবির মেয়েকে দিলাম নীচে ফেলে আসতে।  তিনি সেটা নিয়ে , আরেক বন্ধু  জুটিয়ে গনেশ কে লাল গোলাপি  রঙে রাঙিয়ে  তুললেন,ছবি  তুললেন --- আমরা  সবাই  দেখলাম, মেয়ের creativity  নিয়ে সবাই দেদার প্রশংসা  করলো, ব্যাস, ভুলে গেলাম।  ওখানে কিছু  তুলসীগাছ  আছে, রোজ ভোরে কয়েক জন  বৃদ্ধা মর্নিং  ওয়াক  সেরে ফেরার পথে  পাতা তোলেন  দেখি।  হটাৎ  দেখি দুজন  সন্ধ্যা বেলা  প্রদীপ  জ্বালাচ্ছেন ওখানে, সাক্ষাৎ  সিদ্ধিদাতা র সামনে।প্রমাদ গুনলাম।  আবার দেব দর্শন। ফ্ল্যাটের সামনে  রাস্তা আটকে  "দেব থান " গড়ে ওঠবে, হৈচৈ  এ শান্তি র বারোটা  বাজবে, এই ভয়ে গার্ড কাকা কে দিয়ে  রাতারাতি  ডাল টা কাটিয়ে  দিলাম আমরা ।  বাবা, দোষ  নিও না।

টেক ফোর 

 আবার গতকাল (শনিবার) । কল্যাণীতে বঙ্গ কুম্ভ মেলা শুরু  হয়েছে। ৭০৪ নাকি ৭২৪, ঠিক বলতে পারবো না, এত বছর  পর কল্যাণী আবার পুণ্য স্থানের মর্যাদা  পেয়েছে ।  অদম্য কৌতুহলে দৌঁড়ালাম।প্রচণ্ড  ভিড়ে চিড়ে চ্যাপ্টা  হয়ে , ধুলোর আস্তরনে গা মাথা ঢেকে , অনেক টা পথ হেঁটে পৌঁছালাম।  গ্রামীণ  পশরা সাজিয়ে  বসেছেন কিছু  মানুষ , কিছু খাবারের দোকান। মেলা জমজমাট।  সব থেকে  বেশি  নাগা সন্ন্যাসীদের তাবু ঘিরে উৎসাহী  ভক্ত দর্শক দের প্রবল ভিড়, সেকী সেলফি  তোলার ধুম।গাঁজার ধোঁয়া য় প্রায় ঢেকে যাওয়া মুখ, ভস্মাচ্ছাদিত  দেহ, এই পুণ্যাত্মা দের দেখে  সাক্ষাৎ দেব দর্শন  হল আমার।  কিছু  চিৎকার  সমৃদ্ধ কীর্তন  শুনে অন্তরাত্মার শুদ্ধিও ঘটলো।
ভিড় ঠেলে এগিয়ে  গেলাম পতিতধারিনী গঙ্গের দিকে। আপাতত  ফাঁকা , সন্ধ্যারতির সময়  ভিড় উপছাবে শুনলাম।পড়ন্ত সূর্যালোকে বিষন্ন ম্লান পুণ্যতোয়া বয়ে চলেছেন,নির্বাক নিশ্চুপ শ্রোতা দর্শক। কয়েক টি নৌকা চলেছে, তাদের অবিরাম  দাঁড়ের শব্দ --- ছপছপ...
এক বৃদ্ধা ভিখারিনী বসে আছেন  বিমর্ষ মুখে নদীর  দিকে  মুখ করে। সবল ভিক্ষুকদের মধ্যে  স্থান জোটেনি তার, ভিক্ষার্জনেও হার মেনেছেন তিনি। তাই তার আশ্রয়  নদীঘাট।গল্প হলো। দেখলাম জীবন যুদ্ধে  লড়তে লড়তে তিনিও আমার মতোই সাধুসঙ্গ  না করে প্রকৃতিকে সাথে নিয়েছেন। 

হে প্রকৃতি মা, হে গঙ্গা -- যুগ কাল মান সব নিয়ে তুমি আমাদের সাথে  থেকো, ধারন করো, পালন করো, বহন করো --আমাদের সত্যিকারের  ভগবান।।



Post a Comment

6 Comments

  1. অসম্ভব সুন্দর লিখেছেন বর্ণিত ঘটনার ঘনঘটায় চাক্ষুস করার মতই অভিজ্ঞতা হল।

    ReplyDelete
  2. সুন্দরকে আমরা স্পর্শ করতে গেলেই পিছনে ভগবান এসে দাঁড়িয়ে পড়েন। এই লেখা ভগবানের হাত ছাড়িয়ে বেরিয়ে এসেছে। লেখা রাঙিয়েছে সুন্দরের ছোঁয়া।

    ReplyDelete
  3. মন ভরে গেল

    ReplyDelete
  4. খুব ভালো লাগল।

    ReplyDelete