জ্বলদর্চি

বিস্মৃতপ্রায় কবি রমেন্দ্রকুমার আচার্য চৌধুরী /নির্মল বর্মন

বিস্মৃতপ্রায় কবি রমেন্দ্রকুমার আচার্য চৌধুরী

নির্মল বর্মন

"কী খিস্তি করছেন আপনারা? পড়ুন শ্রীকৃষ্ণকীর্তন
কিংবা এক হাজার শতাব্দীতে পিছু হেঁটে চলে যান সোজা"
    (চৌষট্টি পাপড়ির পদ্ম-রমেন্দ্রকুমার আচার্য চৌধুরী)

এই মননশীল , শব্দ সচেতন কবিতা কবির জাত চিনিয়ে ছেড়ে দেয়।  এহেন কবি অধ্যাপক রমেন্দ্রকুমার আচার্য চৌধুরী কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতি ছাত্র, ইংরেজি সাহিত্যে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে এম.এ পাস করেন। ১৯২২ সালের অধুনা বাংলাদেশের ময়মনসিংহ মুক্তাগাছা, রাজবাড়ীর পিতা কৃষ্ণদাস আচার্য চৌধুরী ও মাতা বিভাবতী দেবীর কোল আলো করে ভূমিষ্ঠ হয়েছিলেন রমেন্দ্রকুমার। দেশবন্ধু গার্লস কলেজ, আশুতোষ কলেজ ও কৃষ্ণনগর সরকারি কলেজে দীর্ঘদিন ধরে তিনি অধ্যাপনা করেছিলেন। রমেন্দ্রকুমার  আচার্য চৌধুরী আধুনিক বাংলা কবিতা রচনায় চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত "কবিতা" পত্রিকায় রমেন্দ্রকুমারের প্রথম কবিতা "রূপালোক" প্রকাশিত হয়েছিল ।পরবর্তীকালে ১৯৬৬ তে বুদ্ধদেব বসু এই কবিতাটিকে "That   Mirror Town " নামে অনুবাদ করেছিলেন!
কবি ,অধ্যাপক রমেন্দ্রকুমার আচার্য চৌধুরী উল্লেখযোগ্য প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ গুলি হল "আরশিনগর " (১৯৬১), "ব্রহ্ম ও পুঁতির মউরি " (১৯৮৫)এই কাব্যগ্ৰন্থের জন্য ১৯৮৭তে "রবীন্দ্র পুরস্কার" এ ভূষিত হয়েছিলেন। ,"অলংকৃত তীর"  (১৯৮৫),"পুরোহিত দর্পণ ও পোড়াজল"(১৯৮৫)।৫ই জুন ২০০৯ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেও বিস্মৃতপ্রায় কবির দলে থেকেই গেছেন।শেষ জীবনে নৈহাটির বাসিন্দা ছিলেন।

জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇



মননশীল প্রাবন্ধিক, ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক রমেন্দ্র কুমার আচার্য চৌধুরী স্বতন্ত্র কবিভাষা বিনির্মাণের ক্ষেত্রে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। সেই অনন্যতা  ভাষার ব্যঞ্জনা ও তীক্ষ্ণতায় পরিপূর্ণ ‌। কবি রমেন্দ্রকুমারের কবিতায় এক সার্বিক অখন্ড হৃদয় নিংড়ানো জীবনবোধ ও সুঠাম বিন্যাস পাঠককে আপ্লুত করে। তিনি প্রায়ই কবিতাকে 'কল্পকাহিনী' বলতেন, সুতরাং কবিতার সঙ্গে কবিকে হরিহর আত্মা করার পক্ষপাতি কখনোই ছিলেন না। তাঁর কবিতায় সুন্দরের পাশাপাশি অসুন্দরকেও রেখেছেন। এক কথায় তাঁর কবিতায় রয়েছে বৈচিত্রের মধ্যে একতা।
কবি রমেন্দ্রকুমার আচার্য চৌধুরী'র  কবিতায় প্রেম ও নারীর সহাবস্থান বিরাজমান। নারীকে শক্তির আধার ও রহস্যময়ী কল্পনার অবতার রূপে অঙ্কন করেছেন। "অলংকৃত তীর" কাব্যগ্রন্থের "আর একটি জন্ম " কবিতায় নারী শক্তির রহস্যময়ী কল্পরূপ পরিষ্কার ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন---
"শস্যস্তূপ চারিদিকে,
মধ্যমণি নারী , নগ্নবুকে ভোরের রক্তিমা, আজানু বাকল,
কাঁখে শিশু , সুস্পষ্ট স্তনের বোঁটা মুখে পুরে। তারপর প্রেমিক একদিন
চোখ রগড়ে বুঝে ফ্যালে যে মেয়ের পরিচ্ছন্ন মুখের করুণা
পরমার্থ ভেবেছিলো--- আসলে সে আপেক্ষিক, নদীর অধীন"।
বর্তমান সময় ও সমাজে মধ্যমণি নারী অলিখিত শাসক। আধুনিক নারীর হৃদয়কে ছুঁতে হলে অবশ্যই রমেন্দ্র কুমারের কবিতা পড়তেই হবে।
আবার কবি রমেন্দ্রকুমার নারীকে সর্পিনীর র দেহসৌষ্ঠব রূপে সেকেন্ডারি ইমাজিনেসানে নিয়ে গেছেন-- দৃষ্টান্ত স্বরূপ--
"সাপ!
ফুলের ফাঁসটি নরম- নিটোল দু - বাহু তোমার সাপ !
সোনার পুচ্ছে জবাব আগুন,বেনেখোঁপা, তা-ও সাপ!
শান্ত পুকুরে ,পদ্মপাতায় ,লাল ঠোঁটে আর পিঙ্গল চোখে,
হিমাক্ত এক সাপ"!( একটি শোকান্তিক নাটকঃ আরশিনগর)
কবি রমেন্দ্রকুমার নাগরিক জীবনের কৃত্রিমতা, যান্ত্রিকতা ও কদর্যতা তাঁর কবিতায় উপস্থাপিত করে সাধারণ মানুষের জীবন যন্ত্রণার দিকটিকে ফুটিয়ে তোলবার চেষ্টা করেছেন। এই প্রসঙ্গে সমর সেনের কথা মনে পড়ে। সমর সেন ও রমেন্দ্রকুমার নাগরিক জীবনের কবি হিসাবে জগত জোড়া নাম।
"আরশিনগর" কাব্যগ্রন্থে 'আরশিনগর' কবিতায় নাগরিক জীবনের যান্ত্রিকতার  সঙ্গে নিরন্ন মানুষের হাহাকার সুচারুভাবে ফুটিয়ে তোলেছেন---
উদাহরণস্বরূপ--
"আরশি - নগরে পড়শি বসত করে।
ধান ভেসে গেছে , মানুষ মড়কে মরে "।
আবার বৈপরীত্যের দোটানায় আধুনিক সভ্যতার কৃত্রিম আভিজাত্যের সুবিন্যস্ত বর্ণনা---
"লতাপাতা জামা, চিত্রিত দুটি ভুরু,
সূর্য হাসায় শুপুরির গরিমাকে,
শাঁখের শব্দে আলিপুরে ফেরে হাঁস,
পড়শি আমার উঠলো পন্টিয়াকে"।
ভয়ংকর বন্যায় ভেসে যাওয়ার বাস্তব চিত্রলিপি এভাবেই অঙ্কন করেছেন---
"ডুবে গেছে কত শান্তির সংসার।
ত্রস্ত গোরুর দুটি চোখ দেখে ভয় ,
ধরে আছে লোকে উঁচু বাড়িটির চূড়ো,
সাহায্য দরকার"!
কবি রমেন্দ্রকুমার আচার্য চৌধুরী শুধু এভাবেই থেমে না থেকে বন্যা বিধ্বস্ত মানুষের কী প্রয়োজন তাও সুন্দরভাবে উপস্থাপিত করেছেন---দৃষ্টান্ত---
"জলে ভাসে ঘর- সান্তনা দরকার ।
কাপড় অন্ন নিয়ে উড়ে যায় প্লেন,
তারায় - তারায় অনন্ত শাদা রোদ,
শুনতে পারিনে আর।
গণক প্রেমিক ভিক্ষুকে গুলজার
রূপসী শহর --কোথায় আরশি তার "?

কবি বৈপরীত্যের মেলবন্ধনে সমাজ ব্যবস্থা বাস্তব রূপটিকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে শিল্পনৈপুণ্যকে "আরশিনগর" কবিতায় পরিষ্কারভাবে ফুটিয়ে তোলেছেন---
অধ্যাপক রমেন্দ্রকুমার আচার্য চৌধুরী রোমান্টিক কবির মতো অতীতচারী। বস্তুতঃ  কবি জন্মভূমির সঙ্গে জড়িত স্মৃতি রোমন্থনে উৎসাহী বোধ করেন --"পুরোহিত দর্পণ ও পোড়াজল" কাব্যগ্রন্থে 'একাত্তরের যুদ্ধ',' অলস্টার' কবিতায় স্বপ্নময়তা পরিচ্ছন্নভাবে প্রকাশিত। যেমন -- 'একাত্তরের যুদ্ধ' কবিতায় কবির স্বতঃস্ফূর্ত উচ্ছ্বাস-+-
"একবার পৌষের সকালে আমি যষ্টিমধু রোদে
সারা গায়ে মৃদু আঁচ, নির্মক্ষিক সোনালি আলোয়
একটা শাদা ভেড়ার বাচ্চাকে দেখি ,সবিস্ময়ে, বাড়ির হাতায়
লনে ঘাস খেতে ,ধোবোধোবো মুখটিকে নিচু করে"!--

কবি রমেন্দ্রকুমার প্রকৃতির নিসর্গ বিচিত্র রূপের চিত্র , প্রকৃতির চালচিত্র কে অনুষঙ্গ হিসেবে গ্রহণ করে পাঠককে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন । এদিক দিয়ে তার কবিতার ছায়ায় কায়ায় জীবনানন্দের প্রকৃতিতন্ময়তা প্রচ্ছন্ন মদতপুষ্ট। উদাহরণ---
"হলুদরঙের রোদ,
জুঁইলতা, বিদ্যুৎ জড়ানো মেঘ , নদীজল"--
     ('মাছের চোখ' -  অলংকৃত তীর)
কবি,অধ্যাপক রমেন্দ্রকুমার আচার্য চৌধুরী সচেতনভাবে তাঁর কবিতায় প্রকৃত প্রকৃতি ইমপ্রেশনধর্মী ও মগ্নচৈতন্যের স্বরূপে আচ্ছন্ন ,তাঁর শব্দ ব্যবহারে, উপমা, চিত্র প্রকল্পের দ্যোতনা কবিতাগুলোকে সমৃদ্ধ করেছে।
শব্দসম্পদের দৃষ্টান্ত স্বরূপ---
"সবুজ পাতার নিচে সুরক্ষিত চতুর কার্তুজ" , "বারুদের ঘুমন্ত অগ্নিকে" , "রাধা - কৃষ্ণ দুই -ই পং "ইত্যাদি !অসাধারণ চিত্রকল্প। চমৎকার চিত্রকল্প। ছোট্ট উদাহরণ-
"মোহিনী এ শহরের অনেক ঝনকাঠঃ
কুকুর, ভিক্ষুক ,মাছি।
কাউন্টারে পিটার খোঁপায়
কামড় দিতেই
জীভ পুড়ে যায়
তীক্ষ্ণ চুন";
কবি রমেন্দ্রকুমার আচার্য চৌধুরীর "বালার্ক গাছ ও মৌমাছি" কবিতাটিও পাঠকের হৃদয়ে ধাক্কা মারে, উদাহরণস্বরূপ---
"হাতের কুরুশ কাঁটা বিঁধেছিল নরম আঙুলে
ফুলের প্যাগোডা ভেঙে জেগে ওঠে ঘুমন্ত মৌমাছি।
এখন ঠোঁটের নিচে আবছা পায়ে ঘুরে ফিরে হাঁটে"।

কবি, প্রাবন্ধিক ,অধ্যাপক রামেন্দ্রকুমার আচার্য চৌধুরী 'র কাছে কবিতা সন্তানতুল্য । জীবনবোধের গভীরতা , সমাজ মনস্কতা, শিব সত্য সুন্দরের প্রতি গভীরতম আসক্তি এবং সর্বোপরি আঙ্গিকসচেতনতা তাঁর কবিতাগুলোকে স্বাতন্ত্র্য মাত্রা দান করেছেন।


Post a Comment

1 Comments

  1. অসাধারণ লেখা। ভালো লাগলো

    ReplyDelete