জ্বলদর্চি

দেশান্তরী গল্প-৮ /হিল্লোল রায়


দেশান্তরী গল্প-৮

হিল্লোল রায়

হতাশায় জড়ানো মনপাশপোর্ট এ্যাপ্লিকেশন

মিঃ সিনহার সংগে ২রা জুলাই ১৯৭৪ এর সাক্ষাৎকারে মনটা ভীষণ বিষণ্ণ হয়ে পড়লো বিশেষ করে যদি চল্লিশ বছরের মধ্যে আমেরিকায় না যাওয়া হয়। চল্লিশের পরে আর পয়সা খরচ করে বুড়ো বয়সে 'বানপ্রস্থকরতে আমেরিকা যাবার আমার ইচ্ছা থাকবে না। ঐশ্বরিক প্রার্থনা ও ফর্ম FS 497 এর উত্তরের অপেক্ষায় দিন গোনা আমার নতুন কর্মযোগ শুরু হল ১লা জুলাই চাকরীতে যোগ দেবার পর থেকেই। তখন নিজের করণীয় কিছুই নেই। নিজের ভুলের মাশুল নিজেকেই দিতে হবে।

আমেরিকায় আসা এ জন্মে আর হল না। আগামী জন্মে বড় লোকের বাড়ীতে জন্ম নিলে নতুন করে চেষ্টা করব-এই সব দুশ্চিন্তা মাথায় ঘুরছে। সঞ্চয় ঘোষের “ইউ আর এ লাকি চ্যাপ হিরেডোন্ট বি নার্ভাস” ইত্যাদি কথাগুলো যে মনের মধ্যে উঁকি ঝুঁকি মারছে না এমন নয়। তা হলেও বেশ চিন্তার মধ্যেই দিন কাটাচ্ছিক্ষুণ্ণ মনে অফিস যাওয়া-আসা করি হাবড়া থেকে।


জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇


মানসিক সন্দেহ নিরসনের জন্য আর একটা চিঠি দিলাম ৩রা জুলাই ১৯৭৪ মংগলবার-বাই পোস্ট। চিঠির বক্তব্য একই ২ তারিখের সংগে। কলকাতা জি.পি.ও তেই পোস্ট করলাম দুপুর বারোটায়। এর পরের কাজ পাসপোর্টের এ্যাপ্লিকেশনের নীচের দিকে ডেপুটি সেক্রেটারীর সই জোগাড় করা। এটা করেছিলাম ৩রা জুলাই ১৯৭৪ মংগলবার। বড়মামা শিশির নিয়োগী তখন সি.এম.পি.(ক্যালকাটা মেট্রোপলিটান প্ল্যানিং অরগানাইজেশনএর একজিকিউটিভ মিউনিসিপ্যাল ইঞ্জিনীয়ারপোদ্দার কোর্ট১৮ রবীন্দ্র সরণীকলকাতা -১ এই অফিসে বসতেন । পাসপোর্টের ফর্ম নিয়ে মামার অফিসে হাজির হলাম বেলা সোয়া -এগারোটায়। প্রয়োজনীয় কাগজপত্রও আমার সংগে।

সি.এম.পি.ওর টাউন অ্যান্ড কান্ট্রি প্লানিং সেকশনের ডেপুটি সেক্রেটারি ছিলেন শ্রী পি.সি.ব্যানার্জ্জী। ভদ্রলোকের বাড়ী কল্যাণিতেকর্মসূত্রে কলকাতা আসেন। ভীষণ রাসভারী লোক। কারো কোন উপকার করার ইচ্ছা তাঁর মনে কখনও আসে না। এমনকি ওঁর ডিপার্টমেন্টের কেউ ওঁর হেল্প আশা করতে পারেন না। পাসপোর্ট সংক্রান্ত ব্যাপারে তো কথাই নেই।

কি আশ্চর্যবড়মামার একটা কথায় মিঃ ব্যানার্জ্জী রাজী হয়ে গেলেন।

-আমার ভাগ্নের পাশপোর্ট এ্যাপ্লিকেশন একজন ডেপুটি সেক্রেটারীর সই প্রয়োজন। আপনি করতে পারবেন?

-ঠিক আছেভাগ্নেকে পাঠিয়ে দিনদেখছি।

-আমরা আসছি আপনার চেম্বারে।

-আসুন।

বড়মামার সংগে মিঃ ব্যানার্জ্জীর উপরের কথাবার্তা হল টেলিফোনে। মিঃ ব্যানার্জ্জী পোদ্দার কোর্টের বাড়ীতেই দোতলায় বসেনমামা তিনতলায়। আমার কাগজপত্র ও ফর্মটা নিয়ে বড়মামার সংগে গিয়ে মিঃ ব্যানার্জ্জীর চেম্বারে ঢুকলাম সাড়ে এগারোটা নাগাদ৩ জুলাই ১৯৭৪। ফর্মের আদ্যোপান্ত পড়ে মিঃ ব্যানার্জ্জী বল্লেনঃ

-আপনিই হিল্লোল রায়

-হ্যাঁ

-আমেরিকায় যাচ্ছেন কি উদ্দেশ্যে-পড়াশোনা না চাকরী?

দেশে কবে ফিরবেন ওখান থেকে-ইত্যাদি ইত্যাদি...

আমিও সমস্ত প্রশ্নের উত্তর দিলাম । মামা ঐ ফর্মের একটা কপি কাগজে লিখে মিঃ ব্যানার্জ্জীকে দিলেন। পাসপোর্ট অফিস থেকে কোন ফোন এলে আমার সম্পর্কে জবাব দেবার জন্য। মিঃ ব্যানার্জ্জী কপিটা রেখে দিলেন। ধন্যবাদ জানিয়ে বেরিয়ে এলাম।

পাসপোর্ট ফর্ম-সংক্রান্ত ব্যাপারটাকে নিষ্পত্তি করে নিজেকে একটু হাল্কা লাগছিল। ডেপুটি সেক্রেটারীর সিগনেচারের ব্যাপারে একটু চিন্তিত ছিলাম। আমার FS 497 এর কোন উত্তর আমেরিকান কন্সালেট থেকে তখনও পাই নিএমনকি ডুপ্লিকেট ফর্ম FS 497 যেটা 25 JUN 1974 জমা দিয়েছিলাম তারও কোন সাড়াশব্দ কলকাতা ৩৭ এর ঠিকানায় মেলে নি ৩রা জুলাই ১৯৭৪ পর্য্যন্ত। আমেরিকা আসবার আশা মনে তখন ক্ষীণতর হয়ে দেখা দিচ্ছে। আর আমার ট্র্যাভেল এজেন্ট মিঃ সিনহার কথা যদি ঠিকই হয় তাহলে কথাই নেই। আমার চল্লিশ বছর বয়স না হওয়া পর্য্যন্ত আমেরিকায় আসতে ভিসা পাব না। দুশ্চিন্তা জমাট বাঁধছে মাথায়। কিন্তু নিজেকে সম্পূর্ণ ভাগ্যের হাতে সঁপে দিয়ে অন্যান্য কাজ গুছিয়ে নিচ্ছি তখন। কারো সংগে পরামর্শ করে কিভাবে এগুতে হবে বুঝছি না। আর এ ব্যাপারে ডেফিনিটলী কেউ কিছু বলতেও পারছেন না। পড়লাম মহা ফ্যাসাদে।

নিজের মনে কর্ত্তব্য কর্ম স্থির করে এগুতে লাগলাম। স্থির বিশ্বাস ও আস্থার উপর ভর করে অগ্রসর হওয়ার নীতি তখন মেনে চলছি। আমি ভাবলাম FS 497 এর রিপ্লাই যে কোন ঠিকানায় হয়তো একদিন আসবে -হয় রিগ্রেটনয় পজিটিভ। তখন যে সমস্ত ডকুমেন্টস লাগবে সেগুলো এখন জোগাড় করে নিই। ভেবেছিলাম ইনকাম ট্যাক্স ক্লীয়ারেন্স সার্টিফিকেট এ সময় লাগবে। চঞ্চল সেনগুপ্তের সাথে আলোচনা করে রাখি। এ প্রসংগে অভিযান শুরু হল ৩রা জুলাই ১৯৭৪।

ইনকাম ট্যাক্স ক্লীয়ারেন্স সার্টিফিকেট সংক্রান্ত ব্যাপারে যথেষ্ট সাহায্য করেছেন শান্তিময় চট্ট্যোপাধ্যায়। উক্ত ভদ্রলোক আমার মেজমামার অন্তরঙ্গ বন্ধু এবং হাবড়া হাই স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র। বর্তমানে কর্মসূত্রে ২৯/এ টালিগঞ্জ রোডকলকাতা-২৬ এর বাসিন্দা। ওঁর সংগে আমার পরিচয় ছোটবেলা থেকেই। প্রয়োজনের তাগিদে প্রথম যোগাযোগ করলাম ৩রা জুলাই ১৯৭৪ বুধবার। আমার অফিস থেকে ওঁকে টেলিফোন করি ২৩-২৩৭১সি.আইটিএস্টাব্লিশমেন্ট সেকশন প্লিজ। এ্যাপয়েন্টমেণ্ট করলাম ৪ জুলাই ১৯৭৪ বৃহস্পতিবার বেলা ১১টা থেকে ১২টার মধ্যে। ওঁর অফিসে গিয়ে দেখা করব। গত ৩ তারিখ যখন ওঁর সংগে টেলিফোনে কথা হল তখন আমার খেয়াল হয় নি উনি ইনকাম ট্যাক্সের কোন অফিসে বসেনএন্টালিএসপ্ল্যানেড না হেয়ার স্ট্রীটের নিকটস্থ গভর্মেণ্ট প্লেস নর্থএর অফিসে। কোন ফ্লোর ইত্যাদি... তাও জিজ্ঞাসা করি নি। অথচ এ্যাপয়েন্টমেন্ট করে ফেলেছি। পড়লাম মহা ফ্যাসাদে।

সাত তাড়াতাড়ি সকাল ৮-৩৬ মিনিটের হাবড়া লোকালে কলকাতা ছুটলাম ৪ জুলাই ১৯৭৪। বেশ মনে আছে ডালহৌসী স্কোয়ারে লালদীঘির পাডে নেমে যখন এদিক ওদিক জিজ্ঞাসা করছি ইনকাম ট্যাক্সের অফিসের সন্ধানেতখন হঠাৎ বৃষ্টি নামল। দমকা বাতাস ও ধূলায় মুহূর্ত্তের মধ্যে অন্ধকার হয়ে গেল চারিদিক। ছুটে গিয়ে একটা গাছের নীচে আশ্রয় নিলাম। জামাকাপড় হাতের কাগজপত্র বৃষ্টির হাত থেকে একটুও রেহাই পেল না। জিজ্ঞাসাবাদের পর প্রথম গেলাম গর্ভমেন্ট প্লেস নর্থ অফিসে বেলা এগারোটায়। কিন্তু ওখানে শান্তিময় চ্যাটার্জ্জীর সন্ধান মিলল না। পায়ে হেঁটে এলাম এসপ্ল্যানেডে তখন।

সিক্ত বসনেআয়কর ভুবনেআয়কর ভবনে

সিক্ত বসনে ঝোড়ো কাকের মতো “আয়কর ভবনে” গিয়ে উঠলাম প্রায় বারোটায়। এটা এসপ্ল্যানেডে প্যারাডাইস সিনেমা হলের লাগোয়া। এ্যাপয়েন্টমেণ্ট সময় ১১টা থেকে ১২টা। অফিস মুহূর্তে গিয়ে হাজির হলাম শান্তিময় চ্যাটার্জীর ঘরে। দোতলায়১৪ নং ঘরসি.আই.টি এস্টাব্লিশমেন্ট সেকশন। মামার বন্ধু হিসাবে ওঁকে মামার চোখেই দেখিযথেষ্ট শ্রদ্ধা করি। প্রত্যুত্তরে উক্ত মামার ভাগ্নে সুলভ আচরণ আমার আনন্দাশ্রুর কারণ হয়ে উঠত। বুকে জড়িয়ে ধরে আমার সংগে কথা বলতেন মিঃ চ্যাটার্জ্জী।

তাঁর সন্ধানে আমার পথপরিক্রমার একটা পূর্ণাঙ্গ চিত্র তুলে ধরল আমার সিক্ত বসন ও ঝোড়ো কাকের মত আকুতি। আমি একটু লজ্জায় পড়লাম এই অহেতুক পথপরিক্রমায়কারণ ৩রা জুলাই ফোন করে ওঁর অফিসের ঠিকানা নিতে আমার একটুও খেয়াল ছিল না। যাই হোক শান্তিমামার উষ্ণ অভর্থনা যেন আমার জন্য তৈ্রীই ছিল। স্নেহার্ত্ত হাসি, 'চাএর সংগে 'টাপ্রত্যাশিতভাবে পেয়ে গেলাম। ছোটবেলায় শান্তিমামার সংগে পরিচয়। বড় হয়ে উনি আমাকে ঠিকই মনে রেখেছেন এবং চিনতে পেরেছেন বহুদিন বাদেও দেখে ভীষণ আনন্দ হচ্ছিল। কুশল সংবাদ বিনিময়ের পর আমার আগমনের উদ্দেশ্য শান্তিমামাকে বল্লাম। উনিও যথাসাধ্য হেল্প করবেন বলে আমায় আশ্বাস দিলেন। ইমিগ্র্যাণ্ট ভিসা হোল্ডারদের ইনকাম ট্যাক্স ক্লীয়ারেন্স সার্টিফিকেট সংক্রান্ত ব্যাপারে আয়কর ভবনের ৮ তলায় উনি আমাকে নিয়ে গেলেন 'ফরেন সেকশনেভুতেশদা নামক জনৈক অফিসকর্মীর কাছে। সমস্ত কিছু বল্লাম ভুতেশদাকে।

আলোচনা করে জানলাম পাসপোর্ট এবং ইমিগ্র্যান্ট ভিসা রেডি হয়ে যাওয়ার পর ইনকাম ট্যাক্স ক্লীয়ারেন্স সার্টিফিকেট প্রয়োজন এবং ওগুলো না হলে এটা দেওয়া হয় না। শান্তিমামা ভুতেশদার সংগে আমার পরিচয় করিয়ে দিলেন ঐ দিনই। ভুতেশদা যথাসাধ্য সাহায্য করবেন বলে ঘাড় নাড়লেন। এরপর ভুতেশদার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমি ও শান্তিমামা এলাম আয়কর ভবনের দোতলার অফিস ক্যান্টিনে। আমার পাকস্থলীকে রসগোল্লাভেজিটেবল চপ ও কফি খাইয়ে শান্ত করে দিলাম। শুধুমাত্র চা নিয়ে লোভ সংবরণ করলেন শান্তিমামা। এ গুলো খাওয়া শেষ হবার পর শান্তিমামাকে বিদায় জানালাম বেলা ১১-৩০ টায়। যথারীতি আমার অফিস উপস্থিতি। আমার গতানুগতিক জীবন কাটছে হাবড়া-অফিস-হাবড়া-পাইকপাড়া করে। দিন গুনছিঅফিস থেকে বাড়ী ফিরেই রোজই মাকে জিজ্ঞাসা করি কন্সালেট থেকে কোন চিঠিপত্র এসেছে কিনারোজই শুনি “না”। মনটাও খারাপ হয়ে যায়। আমেরিকা আসা হয়তো এ জীবনে আর হল না এইসব মনে আসে।

শেষ পর্য্যন্ত দুশ্চিন্তার আবসান হল ১৫ জুলাই ১৯৭৪ সোমবার। যথারীতি অফিস থেকে ফিরেছি বাড়ীতে সন্ধ্যা ৭-৩০টা নাগাদ। আমার টেবিলে হলুদ খামে ভরা কন্সালেট অফিসের কাগজপত্র। ঘরে ঢুকতেই দাদুর মুখে ওটার খবর পেয়ে ভীষণ আনন্দ হচ্ছিল। অফিস ফেরৎ ক্লান্তি তখন কোথায় চলে গিয়েছে। খামটা খুলেই সমস্ত কাগজপত্রগুলো পড়ে ফেললাম এক নিঃশ্বাসে। Form 7-50A দুটো কপি ও প্রয়োজনীয় সার্টিফিকেটের বিবরণ জানিয়ে ঐ চিঠিটা পেলাম ১৫ই জুলাই ১৯৭৪ সোমবার।

মরা গাঙে জোয়ার এল। সমস্ত ঝিমিয়ে পড়া চিন্তাধারাগুলোকে ঝেড়ে মুছে নতুন করে গুছিয়ে নিলাম ফর্ম 7-50 A পাবার পর থেকেই। আবার নতুন কর্ম্মোন্মাদনা শুরু হল। আমার বড়মামা শিশির নিয়োগীর বন্ধু এবং সি.এম.পি.ও র একজিকিউটিভ মিউনিসিপ্যাল এঞ্জিনীয়র মিঃ অজিত ভুইঞ্যাঁ অবশ্য 7-50 A ফর্ম পেয়েছিলেন ১লা জুলাই ১৯৭৪ অর্থাৎ আমার দুসপ্তাহ আগে। মেজমামা প্রদ্যোৎ নিয়োগীর বি..কলেজ ক্লাস-মেট ও কর্মসূত্রে বড়মামার বন্ধু হওয়ায় মিঃ ভুইঞ্যাঁকে আরো কাছে পাবার সুযোগ হল এবং অন্যান্য ফর্ম পূরণ করবার আগে ওঁর সংগে পরামর্শ ও খোঁজ খবর করবার সুবিধা হল আমার পক্ষে।

বেশ মনে আচ্ছে১৬ই জুলাই ১৯৭৪ মংগলবার 7-50 A ফর্ম ও অন্যান্য সার্টিফিকেট সংক্রান্ত পরামর্শর জন্য আমার ট্রাভেল এজেন্ট মিঃ এস পি সিনহার “আয়োনা ট্র্যাভেলস” অফিসে দেখা করি বেলা ১১-৩০টা নাগাদ। হঠাৎ মিঃ ভুইঞ্যাঁও সেখানে উপস্থিত। আলোচনাটা বেশ জমে উঠল মিঃ সিনহামিঃ ভুইঞ্যাঁ ও আমার মধ্যে। আধঘন্টার আলোচনায় বিরতি ঘটিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম নিজেদের কাজে অর্থাৎ অফিসের হাজিরা দিতে। কিন্তু মিঃ সিনহার সংগে আলোচনাটা ফলপ্রসূ মনে না হওয়ায় কন্সালেট অফিসে কারও সংগে যোগাযোগ করব ঠিক করলাম আমি ও মিঃ ভুইঞ্যাঁ। দিন ঠিক হল ১৮ জুলাই'৭৪ বেলা ১০-৩০টা।

ইমিগ্রেশ্যান সংক্রান্ত ব্যাপারে দেখছি অনেকের সংগেই যোগাযোগ হচ্ছে যেমন অনুপম বোসচঞ্চল সেনগুপ্তঅজিত ভুইঞ্যাঁ। যোগাযোগের ঘনত্বটা বেশী হয়ে যাওয়ার ফলে ওঁরা বয়োজ্যেষ্ঠ্ হলেও বন্ধুর পর্য্যায়ে এসে গিয়েছিল। কারণ এ ব্যাপারে তখন সবাই 'নভিস'। কাজেই সবাই সবার উপর নির্ভর করছিল। শেষ পর্য্যন্ত অবশ্য অনুপম বোসের সংগে আমার যোগাযোগ ছিল নাকারণ ওঁর বাড়ী থেকেই ওঁকে আমেরিকা আসতে দিতে নারাজ।

রণে ভঙ্গ দিয়ে ও ক্ষান্ত হল 7-50A ফর্ম পেয়েই। এখন রইল বাকী দুই মিঃ সেনগুপ্ত মিঃ ভুইঞ্যাঁ। 7-50A ফর্মের সংগে সমস্ত সার্টিফিকেটের ফোটোস্ট্যাট কপি কোথায় করা যাবে তাই নিয়ে একটু ভাবছিলাম। অবশেষে চঞ্চলদার পরামর্শ অনুযায়ী চাইল্ড এ্যান্ড কোং৮ চৌ্রঙ্গী রোডকলকাতা-১৩ থেকেই প্রয়োজনীয় ফোটোস্ট্যাট কপি (চার খানাচার টাকা বারো আনা প্রতি কপি হিসাবে 4x4.75=19.00) করিয়ে নিলাম ১৭ই জুলাই ১৯৭৪ বুধবার।

এর পরের কাজ পাসপোর্টের জন্য ছবি তোলা। কোথায় ভাল হয় এ নিয়েও বেশ ভাবছি বন্ধু সঞ্চয় ঘোষের সংগে। ওঁর অফিসের অনেককেও দেখলাম আমার ব্যাপারে যথেষ্ট উৎসাহী। কেউ বলছে চৌ্রঙ্গী রোডের “হ্যারিকো”আবার কেউ বা হ্যারিসন রোডের “চৌধুরী স্টুডিও”। এই ছবি তুলতে গিয়ে বেশ মজা হয়েছিল বিশেষ করে নেকটাই বাঁধতে গিয়ে। সেটাই বলছি এখন

ধার করা “টাই” গলায় পরাই

আমার পাসপোর্টের ছবি তুললাম শেষপর্য্যন্ত হ্যারিসন রোডস্থ চৌধুরী স্টুডিওতেপূরবী সিনেমা হলের কাছে ১৭ ই জুলাই১৯৭৪। নেকটাই এর 'নটসম্পর্কে আমার ঠিক পরিস্কার আইডিয়া ছিল না। বেশ কিছুদিন থেকেই ভাবছিলাম সঞ্চয় ঘোষের কাছে তালিম নেবো। কারণ ও এসব ব্যাপারে আমার থেকে একটু এ্যাডভানসড। মুখের পাইপটাকে কত ডিগ্রী এ্যাঙ্গেলে ঘুরিয়ে 'রিংছাড়লে বেশী স্মার্ট দেখা যায়টাই এর সিংগল নটডাবল নট ইত্যাদি আরো অনেক কিছুই ওর ঠোঁটস্থ । আর এসব আমার কাছে একেবারেই আনকোরা।

কিন্তু সময়াভাবে সঞ্চয়ের কাছে টাই 'নটএর ট্রেনিং একটুও নিতে পারছিলাম না। অথচ ফটো তুলতে দেরী হয়ে যাচ্ছে 'নটবাঁধতে না জানায়। “স্টেজে মেরে দেব” ধারণা নিয়েই একা গিয়ে হাজির হলাম ঐ চৌধুরী স্টুডিওতে বেলা ১১-১৫ মিঃ নাগাদ। কলকাতায় তখন ঘন ঘন লোড-সেডিং চলছে। বিদ্যুৎ-বিভ্রাটে বিভিন্ন কাজকর্মে ভীষণ বিঘ্ন ঘটছিল। দিনটা মনে আছে ভালভাবেই জুলাই ১৭১৯৭৪ বুধবার। ঘর্মাক্ত দেহে হাজির হয়েছি চৌধুরী স্টুডিওতে। “মেক আপ” নিতেই (সমস্তটা নিজে নিজেমিনিট পনেরো কেটে গেল। তখনও টাই পরা বাকিপরব না ভাবছি। “যা হয় হবে” মনে করেই টাই এ 'নটবাঁধছিসে আর কিছুতেই হচ্ছে না। স্টুডিও কর্মচারীদের সহায়তা চাইলাম একটু সংকোচের সংগে। 'না দাদাআমরাও ঠিক জানি না টাই বাঁধতে। পড়লাম মহা মুস্কিলে। টাই অবশ্য আমার নিজের সংগে ছিল না। দোকানে ঝোলানো ছিল-সেটাকেই নিলাম লজ্জায়। “তাড়াতাড়ি করুননা হলে এক্ষুণি কারেণ্ট চলে যাবে” বলে জনৈক কর্মীর কথা শুনে আমিও ব্যস্ত হলাম ছবি তুলতে।

কি আশ্চর্যআমিও ছবি তুললামলোড শেডিং শুরু হল। অর্থাৎ আমিই সেদিনের ফটো তোলার ব্যাপারে লাস্ট ম্যান কারণ ঐ দিনের মধ্যে আর কারেন্ট আসবে না। যাই হোক পাসপোর্টের ছবি তুললাম বটে কিন্তু মনে কেমন যেন একটা সংকোচ রয়ে গেল ছবি কেমন হবে ভেবে। খারাপ হলে আবার আমাকে নতুন করে তুলতে হবে-আর তুলতেই যদি হয়কাউকে বলব না প্রথম ছবির কথাইত্যাদি প্ল্যান এঁটে রেখেছি। ছ'কপিছবি ছ টাকা। এ্যাডভান্স চার টাকা দিয়ে চলে এলাম ১৮ ই জুলাই ১৯৭৪ ডেলিভারী নেব বলে। “আচ্ছা আসুন” উত্তর এল।

এদিকে মিঃ অজিত ভুইঞ্যাঁর সংগে আমার এ্যাপয়েন্টমেন্ট রয়েছে ১৮ই জুলাই ১৯৭৪ বেলা সাড়ে দশটায় আমেরিকান কন্সালেটে। সকাল ৮-৩০ এর হাবড়া লোকাল ধরে রওনা হলাম। বেলা ১০টায় শিয়ালদায়১০-৪৫ এ কনসালেটে। একটু ঘোরাঘুরি করতেই বড়মামা ও মিঃ ভুইঞ্যাঁ অফিসের গাড়ীতে এসে হাজির। আমরা তিনজনে তখন কন্সালেটের রিসেপ্সনিস্ট এর কাছে মিস্টার হিতব্রত রায়ের সংগে দেখা করবার অনুমতি চাইলাম। মিঃ ভুইঞ্যাঁ অবশ্য আগে থেকেই হিতব্রত রায়ের সংগে যোগাযোগ করে রেখেছিলেন দেখা করবার ব্যাপারে।

-মিঃ রেইউ হ্যাভ থ্রি ভিজিটরস মিঃ অজিত ভুইঞ্যাঁমিঃ শিশির নিয়োগী ও মিঃ হিল্লোল রে।

সেন্ড দেম ইমিডীয়েটলী।

রিসেপ্সানিস্ট এর সংগে হিতব্রত রায়ের কথোপকথনের পর আমাদের অনুমতি মিলল। “ আপ স্টেয়ারসসেকেন্ড ফ্লোরএ্যন্ড আস্ক ফর মিঃ রে”। “ওকে থ্যাঙ্ক ইউ” বলে আমরা তিনজনে হিতব্রত রায়ের চেম্বারে ঢুকলাম ১০-৫৫ মিঃ। হিতব্রত রায়ের সম্পর্কে একটু বলে রাখি আলোচনার ফাঁকে।

নীতি দিয়েই আলোচনা শুরু। কথাবার্ত্তার ঢং দেখেই মনে হচ্ছিল মিঃ ভুইঞ্যাঁ হিতব্রত রায়কে 'লাইনে আনবার ব্যাপারে “লাগে তো তুকনা হলে ফাঁক” নীতি দিয়েই আলোচনা শুরু করতে চাইছেন। আমাদের চারজনের আলোচনার সারাংশ এ সম্পর্কে কিছুটা আভাস দিতে পারে। প্লেন 'উইলসএর মুখাগ্নি করে হিতব্রত রায় আলোচনাটাকে ধোঁয়াশা (ধোঁয়া কুয়াশা=ধোঁয়াশাকরতে চেয়েছিলেন বোধ হয়। আমরা নেগেটিভ করলাম।

-ইউ আর মিঃ হিতব্রত রয়বাচ্চুদা?

-য়্যা

-ইউ নো মিঃ প্রসূন মিত্রইস হি ইওর ফ্রেন্ড?

-য়্যাঁহি ইজ নট মাই ফ্রেন্ডএ্যাকচ্যুয়ালী আই লাভ হিম ভেরি মাচ।

-মিঃ মিত্র এ্যাডভাইজড মি টু মিট উইথ ইউ রিগার্ডিং ইমিগ্র্যান্ট ভিসা প্রসিডিওরস। এ্যাম মিঃ অজিত ভুইঞ্যাঁ। দে আর মিঃ শিশির নিয়োগী এ্যান্ড মিঃ হিল্লোল রয়।

-হোয়াটস ইওর প্রফেসন?

-(আঙ্গুল দেখিয়েউই টুআর একজিকিউটিভ মিউনিসিপ্যাল ইঞ্জিনিয়ারস অব ক্যালাকাটা মেট্রোপলিটন প্ল্যানিং অর্গানাইজেশন(সি.এম.পি.), এ্যান্ড হি ইজ এ ফ্রেস সিভিল ইনজিনিয়ারস গ্র্যাজুয়েট।

-ও কেদেন হোয়াটস ইওর প্রব্লেমবেশ তোবলুন আপনাকে আমি কিভাবে হেল্প করতে পারি।

আমরা তখন 7-50A ফর্ম এর যে যে পয়েন্টস গুলো সম্পর্কে জানবার প্রয়োজন ছিল সেগুলো বাচ্চুদার কাছ থেকে জেনে নিলাম। ঠিক বারোটার সময় বাচ্চুদাকে বিদায় জানিয়ে আমরা কন্সালেট ত্যাগ করলাম। তারপর অফিসের জীপে করে চলে এলাম সি.এম.পি.ওর ১ নং গার্স্টিন প্লেসে।

সি.এম.পি ওর অফিসে বসে 7-50Aফর্মের প্রয়োজনীয় সার্টিফিকেট ও কাগজপত্র গুছিয়ে নিলাম ১৮ই জুলাই ১৯৭৪। আমার নিজের অফিসে আর যাওয়া হলো না সেদিনের মতো। বিকাল ৩-১৫ নাগাদ সি.এম.পি.ও থেকে বেরিয়ে প্রথম গেলাম চঞ্চলদার অফিসে ক্যালকাটা স্টেট ট্র্যান্সপোর্ট বিল্ডিংএ কিন্তু সে অনুপস্থিত। এরপর আয়কর ভবনে শান্তিময় চ্যাটার্জ্জীর কাছে। সেখানে দেড় ঘন্টা(৪টে-থেকে ৫-৩০ পর্য্যন্তগল্পগুজব করে চলে এলাম পায়ে হেঁটে ভারতীয় মানক সংস্থাকলকাতা শাখার বন্ধুবর সঞ্চয় ঘোষের কাছে। সঞ্চয়কে সংগে নিয়ে চৌধুরী স্টুডিও থেকে আমার পাশপোর্টের ছবিগুলো সব ডেলিভারী নিলাম ১৮ই জুলাই ১৯৭৪। যতটা ভেবেছিলাম ফটো সম্পর্কেতার সম্পূর্ণ উলটো ফল পেলাম। ভীষণ ভাল ছবি হয়েছে। টাই বাঁধার অঞ্জতা কিছুই প্রকাশ পারছিলাম না ছবি দেখে। সঞ্চয় ও বেশ প্রশংসা করল। এরপর হাবড়ায় ফিরলাম সেদিনের মতো।

আগেই বলেছি আমার পাসপোর্ট অ্যাপ্লিকেশন ফর্মে ডেপুটি সেক্রেটারি মিঃ পিসিব্যানার্জ্জীসি.এম.পি.ও (টাউন এ্যান্ড কান্ট্রি প্ল্যানিংসই করে দিয়েছেন গত ৩রা জুলাই ১৯৭৪ মংগলবার। কাজেই পাসপোর্টের ফটো রেডি হলেই পাসপোর্ট অ্যাপ্লিকেশন জমা দিতে পারব। আবার একটা মজার ঘটনা ঘটল। যিনি পাসপোর্ট অ্যাপ্লিকেশন সই করবেন তিনিই যে ফটো এ্যাটাস্ট করেনএ ধারণা আমার ছিল না। এ্যাটেস্টেড (attested) ফটো হলেই চলবে এই ধারণা নিয়ে ছ কপি ফটো এ্যাটেস্ট করালাম ১৯ জুলাই১৯৭৪ নীলরতন সরকার হাস্পাতালের চক্ষু বিভাগের ডাক্তার মনি সামন্তকে দিয়ে।

(ক্রমশ)

ক্লিক করে পড়ে দেখতে পারেন 👇

হে, কবি হে... /ঋত্বিক ত্রিপাঠী


Post a Comment

0 Comments