জ্বলদর্চি

আমার জীবনের ঘটনা-৩/ মলয় রায়চৌধুরী


আমার জীবনের ঘটনা : মলয় রায়চৌধুরী

তিন


ডাকাতের আশীর্বাদ পাইয়াছি

বিশ্ববিদ্যালয় হইতে পথে নামিবার পরই, প্রথম যে চাকুরিটিতে যোগ দিয়াছিলাম তাহা, দশটা-পাঁচটা চক্র না হইলেও,  অত্যন্ত বিরক্তিকর ছিল বলিয়া অন্যপ্রকার একটি চাকুরির সুযোগ পাইতেই তাহাতে যোগ দিলাম কেননা আমি একই গৃহে একই পাড়ায় একই শহরে থাকিতে অভ্যস্ত নই ; ভালো লাগে না , অন্যত্র পলাইতে ইচ্ছা করে ।  একই মানুষদের দ্বারা পরিবৃত থাকিবার ফলে জীবন ও জীবনবীক্ষা মামুলি ও  ক্ষুদ্র হইয়া পড়ে । নতুন কিছু ঘটিবার সম্ভাবনা সীমিত বোধ হয় । যদিও আমি রেকলুজ প্রকৃতির, একা থাকিতে পছন্দ করি, কম কথা বলি, কিন্তু আমার চতুর্দিকের মানুষদিগের কথাবার্তা ও জীবনযাত্রায় আগ্রহের কারণে, ওই যে বলিলাম, একই গৃহ-পাড়া-শহরের বৃত্তে পাক খাইয়া সেই একই মানুষদিগের মুখ দেখিয়া ও কথাবার্তা শুনিয়া কিয়ৎকালের ভিতরই ক্লান্ত বোধ করি । হ্যাঁ, ঠিকই, অন্যের জীবনের ঘটনাহীনতা আমার জীবনকেও ঘটনাহীন করিয়া তুলিতে পারে , তোলেও।

          প্রতিটি  ঘরের নিজস্ব উদাসীনতার যন্ত্রণাক্লিষ্ট সুবাস হয়, প্রতিটি গৃহের নিজস্ব নয়নসুখ আলো-বিচ্ছুরণ , প্রতিটি পাড়ার নিজস্ব গুঞ্জনমালা বাতাসকে ভারাক্রান্ত করিয়া ভাসে, প্রতিটি শহরের নিজস্ব কথাপ্রণালীর কাহিনিময় শব্দতরঙ্গ চতুর্দিক মথিত করে । সেকারণে চিরকাল নূতন সুবাস, আলো, গূঞ্জন ও শব্দতরঙ্গের অনুসন্ধানে ক্ষণিক-তীর্থের উদ্দেশ্য-সন্ধানী যাযাবরের ন্যায় চরিয়া বেড়াইবার প্রয়াস করিয়াছি ।

   

       প্রথম চাকুরিটি পাইতে অসুবিধা হয় নাই কেননা আমার পক্ককেশ ইনটারভিউ গ্রহণকারীগণ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলাফল  পর্যাবেক্ষণান্তে  অর্থশাস্ত্রের কয়েকটি তাত্ত্বিক প্রশ্নের  উত্তরে সন্তুষ্ট বোধ করিয়া , যদিও সে-সকল তত্ত্ব বর্তমানে মানবচরিত্রের ব্যাখ্যাহীনতার কারণে খারিজ হ‌ইয়া গিয়াছে, তৎক্ষণাত চাকুরিটিতে যোগ দিতে বলেন । চাকুরিটি খারাপ ও ভালো লাগার কারণটিও একই । প্রতিনিয়ত ট্যুরের চাকুরি হইলেও, এবং ট্যুরজনিত রোজগার মনোরম হইলেও , চাকুরিটি ছিল অন্যের দোষ ও কারচুপি অন্বেষণ সংক্রান্ত । যেথায় যাইতাম, শহরতলি  হউক বা শহর, তথাকার কর্মচারীগণ তটস্হ হইয়া থাকিত। কেহই সন্নিকটে আসিতে চাহিত না । তাহাদের ও আমার বরাত এতই খারাপ যে হাতে কলম তুলিয়া লইতেই কারচুপি খুঁজিয়া পাইতাম । ফিরিয়া প্রতিবেদন জমা দিবার কয়েক মাস পরে শুনিতাম অমুকের চাকুরিটি আমি খাইয়া লইয়াছি অথবা তমুকের পদোন্নতি বিঘ্নিত করিয়াছি। প্রতিনিয়ত নূতন-নূতন স্হানে যাইতে ভালো লাগিত, নূতন জনপদ  ও শহরের জনগণকে শুনিবার , জানিবার , বুঝিবার সুযোগ হইত, নবনব খাদ্যবস্তুর স্বাদ পাইতাম । কিন্তু কাহারও চাকুরি খাইয়া লইতে বা পদোন্নতিতে বাধা সৃষ্টি করিতে একেবারেই ভালো লাগিত না । 

http://www.jaladarchi.com/2023/03/late-sandeep-dutta-in-respect.html


          অন্য চাকুরি খুঁজিতে ছিলাম । দরখাস্ত জমা দিবার পর যথারীতি ইনটারভিউয়ের ডাক পড়িল । এই চাকুরিটি ছিল কৃষি উন্নয়ন সংক্রান্ত । চাষবাস সম্পর্কে আমার কোনো অভিজ্ঞতা তৎপূর্বে  , ছাদের টবে মৌসুমি ফুলে  সীমিত ছিল ।  সুতরাং কৃষি বিষয়ক গ্রন্হাদি সংগ্রহ করিয়া রাত জাগিয়া পড়াশুনা করিলাম । তথ্যাদি মুখস্হ করিলাম । আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকগণের সহিত সাক্ষাৎ করিয়া পরামর্শ লইলাম । ইনটারভিউতে আমাকে কৃষি বিষয়ক  একটিও প্রশ্ন করা হইল না , কেবল সাধারণ জ্ঞান যাচাই করিবার নিমিত্ত কয়েকটি প্রশ্ন করা হইল যেগুলির সঠিক উত্তর দিতে অসুবিধা হইল না । ইনটারভিউ দিবার পর ধন্যবাদ জ্ঞাপন করিয়ে যখন পিছন ফিরিয়াছি, ইনটারভিউ পরিষদের চেয়ারম্যান কহিলেন, একটু দাঁড়ান । পুনরায় তাঁহার মুখোমুখি হইতে, তিনি বলিলেন, ওই ফুলদানিটি দেখিতেছেন, উহাতে কয়েকটি শষ্যের শুকনো শিষ রহিয়াছে, আপনি উহার মধ্য হইতে ধানের শিষটি লইয়া আসুন ।


          নির্দেশ শুনিয়াই বিপদে পড়িলাম । একত্রে এতপ্রকার ফসলের শিষ বা ছড়া দেখি নাই । বস্তুত বাল্যকাল হইতে শহরের ঘিঞ্জি নিম্নবিত্ত পাড়ায়  জীবন যাপন করিবার কারণে, এবং প্রথম চাকুরিটি কেবল নথিপত্র যাচাই করিবার ছিল বলিয়া চাষবাস সম্পর্কে জ্ঞানান্বেষণের সুযোগ হয় নাই । খেতে গিয়া কোন ফসলের শিষ দেখিতে কীরকম তাহা জানিবার সুযোগ হয় নাই । চালের সহিত যে ধানগুলি মিশিয়া থাকে সেই ধান নিকট হইতে দেখিবার সুযোগও হইত না, কেননা ভাত রাঁধিবার পূর্বে মা-জেঠিমা চাল হইতে তাহা বাছিয়া ফেলিয়া দিতেন । সেসময়ে টিভি ইত্যাদি গণমাধ্যম থাকিলে কোনোও না কোনো চ্যানেলে ধানের ছড়ার  সহিত পরিচয় হইত নিশ্চয়, যেরূপ বর্তমানের শিশু-কিশোরদিগের হয় । 

          ফুলদানিটির নিকটে গিয়ে দুইটি অল্প-পরিচিত  শিষ পর্যবেক্ষণ  আঁচ করিলাম যে সেগুলি যব ও গমের । সরস্বতী পুজার পূর্বে আমাদের গৃহের ছাদে টবে গম পুঁতিয়া দিদিগণ পুজার  জন্য শিষ সংগ্রহ করিতেন ।         অন্য শিষগুলি বোতল পরিষ্কারের ব্রাশের ন্যায় দেখিতে এবং সেগুলিতে ধানের  দানা নজরে পড়িল না । কয়েকটি ছড়া দেখিয়া ঘাসের শিষের ন্যায় প্রতিভাত হইল । অগত্যা যে শিষটি অবশিষ্ট তদ্দর্শনে অনুমান করিলাম যে উহা  নিশ্চয়ই ধানের হইবে । সেইটি তুলিয়া আনিয়া চেয়ারম্যানের সন্মুখে রাখিলাম । এক মাসের ভিতর নূতন চাকুরির নিয়োগপত্র পাইলাম, লখনউতে যোগ দিবার নির্দেশসহ ।

          লখনউতে যোগ দিবার প্রথম দিনই আমাকে বলা হইল যে আমার জন্য বুন্দেলখণ্ড এলাকাটির কৃষি-উন্নয়ন পর্যালোচনার ও প্রতিবেদন তৈয়ারির কর্ম বরাদ্দ হইয়াছে এবং কল্যই আমি যেন ইটাওয়া-ললিতপুর-জালাউন ইত্যাদি অঞ্চল পরিদর্শনে যাত্রা করি । অধস্তন আধিকারিকগণের কথা শুনিয়া অনুমান করিলাম যে কার্যালয়ের রাজনীতির খেলায় নূতন অধিকারীদের এই প্রকার প্রত্যন্ত অঞ্চল, কৃষিজ্ঞানের পরীক্ষা লইবার জন্য ,নির্ধারিত হয় । অঞ্চলগুলিতে রাত্রিবাসের জন্য হোটেল , যানবাহন ও খাওয়া-দাওয়ার অভাব সহজেই কাবু করিয়ে তোলে ।   

          সৌভাগ্য যে ইটাওয়ার জেলা কৃষি আধিকারিক শার্দুল মীনাকে আমাদের অফিসের কেহ আগেভাগে, আমি যোগ দিবার পূর্বেই, যেহেতু বুন্দলেখণ্ড আমার জন্য চিহ্ণিত হইয়াছিল, আমার সম্পর্কে বিস্তারিত সংবাদ সরবরাহ করিয়া দিয়াছিল । কথাপ্রসঙ্গে জানিলাম, তিনি আমার স্নাতকস্তরের সহপাঠী অভিমন্যু মীনার অগ্রজ । তাঁহার সরকারি বদান্যতায় অতিথিভবনে রাত্রিবাসের ও খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্হা হইয়া গেল । ক্ষেত্রসমীক্ষায় সহায়তা করিবার নিমিত্ত তিনি তাঁহার বিভাগের একজন বয়স্ক অফিসার, শ্রীসুগ্রীব নিমচকে আমার সঙ্গে দিলেন । ভালোই হইল । সরকারি জিপ ব্যবহারের সুযোগ পাইলাম ।

          তিন দিনের ক্ষেত্রসমীক্ষায় আমার কর্ডুরয় প্যান্ট , ডোরাকাটা শার্ট , চোখের পাতা, মাথার ও ভুরুর চুল গেরুয়া ধুলায় , এবং কাগজপত্র সংখ্যা ও তথ্যে ভরিয়ে উঠিল । গেঞ্জি ও আন্ডারওয়্যার কেবল পরিবর্তন করিতাম , কেননা মাত্র চার দিনের  ভ্রমণ বলিয়া দুইটি সেট শার্ট-প্যান্ট লইয়াছিলাম । 

          অঞ্চলটি বর্ণনাতীত । পথের দুইধারে গভীর ও সঙ্কীর্ণ গিরিখাতের শুষ্ক ও বিমূর্ত ভুলভুলাইয়ার প্রায় জনহীন বিস্তার ধূলা উড়াইয়া সতত  অধঃক্ষিপ্ত জলরাশির প্রত্যাশায় ভূতাত্ত্বিক বৈচিত্র্যকে করিয়া তুলিয়াছে কৌতূহলোদ্দীপক ও দূরভিসন্ধিপূর্ণ । দ্বিপ্রহরের পূর্বেই দিগন্ত আবরিত হয় গেরুয়া কুয়াশায় । পুষ্পিকা ও প্রাণীকুল এতদঞ্চলে ছলনাময় । চতুর্দিকে থম মারিয়া আছে মায়াময় অস্হিরতা । একটিই নদী বহিয়া গেছে যাহা উটের পিঠে বসিয়া পারাপার করিয়া থাকে স্হানীয় গ্রামবাসীগণ ।

          চতুর্থ দিন কিয়দ্দূর রওনা হইবার পর শ্রীনিমচ একটি মন্দিরের নিকট জিপগাড়ি পার্ক করিয়া ভিতরে প্রবেশ করিলে বুঝিতে পারিলাম যে উহা একটি কালীমন্দির । অবাক লাগিল । সাধারণত কয়েকঘর বাঙালি যে অঞ্চলে বসবাস করেন সেখানেই কালীমন্দির গোচরে পড়ে । শ্রীনিমচকে প্রশ্ন করিতে উনি বলিলেন যে মন্দিরটি  শপ্তদশ শতকে প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন  আতেরের মহারাজা  বদন সিংহ। তিনি শক্তির উপাসক ছিলেন । এতদঞ্চলের শক্তি-উপাসকগণ সুকর্ম সমাপনান্তে মন্দিরে ছাগ-বলি দিয়া থাকেন । 

           পুরোহিত শ্রীনিমচকে কহিল, বাবাসাহেব নিকটের একটি গ্রামে আসিয়াছেন । প্রত্যুত্তরে নিমচ কহিল, বহুদিন পর বাবাসাহেব নদীর এই পারে আসিলেন ।  দেখা করিয়া লইব । সেই পরবের সময় আশীর্বাদ লইয়াছিলাম, আর তো দেখা হয় নাই ।

          --বাবাসাহেব ? সাধুসন্ত হ্যাঁয় কেয়া ? জিজ্ঞাসা করিলাম ।

          --জি হাঁ । পঁহুচে হুয়ে আদমি হ্যাঁয় । শ্রীনিমচ প্রত্যুত্তর করিল । অভিব্যক্তিটি অদ্ভুত লাগিল । পৌঁছে-যাওয়া মানুষ ! মহাকাশে, চাঁদে, সমুদ্রগর্ভে  সর্বত্র মানুষ পৌঁছাইয়া গিয়াছে । সাধুসন্তরাও সাধনালব্ধ ক্ষমতার  বলে পৌঁছাইয়া যান হয়তো তাঁদের অভীষ্ট  লক্ষ্যে ।

          কাঁচা রাস্তায় জিপগাড়ি ছুটিল আমার পোশাক ও ত্বকে গেরুয়া  মিহিন ধুলার আস্তরণ  সংগ্রহ করিতে-করিতে । কিছুটা যাইবার পর লালকাঁকরের পথের মাঝখানেই কয়েকজন গ্রামবাসী বসিয়াছিল বলিয়া চালক গাড়ি থামাইল; তাহারা চালককে বলিল যে এই রাস্তাটি খারাপ হইয়া গিয়াছে , আপনারা পাশ্ববর্তী গ্রামের ভিতরের পথ দিয়া চলিয়া যান। বাতাসকে আরও ধুলিধূসরিত করিয়া  সাত-আট কিলোমিটার  যাইবার পর দেখিলাম একটি বিশাল বটবৃক্ষের তলায় প্রায় কুড়ি-পঁচিশজন গ্রামবাসী একজন তামাটে পেটমোটা মোড়লের সন্মুখে বসিয়া, সম্ভবত তাঁহার বাণী শুনিতেছে। তদ্দর্শনে চালক সেই দিকে জিপগাড়িটি লইয়া গিয়া থামাইল । শ্রীনিমচ নামিল, আমিও তাঁহার সহিত নামিলাম । মোড়ল লোকটির বাবরিচুল উস্কোখুস্কো, উর্ধাঙ্গে পোশাক নাই, নিম্নাঙ্গে একটি চাককাটা লুঙ্গি। তিনি বসিয়া আছেন মাটির উঁচু বেদির উপরে ।

          শ্রীনিমচ মোড়লের নিকট গিয়া হাতজোড় করিতে তিনি কোঁচড় হইতে একমুষ্টি মুড়ি দিলেন এবং নিমচ তাহা তৎক্ষণাত ভক্ষণ করিয়া  লইল । মোড়ল আমাকে দেখিয়া শ্রীনিমচকে জিজ্ঞাসা করিল, সরকার বাহাদুর ?

          --জি হাঁ । শ্রীনিমচের বিনয়ী প্রত্যুত্তর ।

          মোড়ল আমাকে ডাকিয়া বলিল, সরকার বাহাদুর, তুম ভি লো । যত্রতত্র ভক্ষণ সম্পর্কে আমার পেট খারাপের  ভীতি আছে । আমি পকেট হইতে রুমাল লইয়া তাঁহার প্রদত্ত মুড়ি বাঁধিয়া লইলাম, পরে ফেলিয়া দিব । আমার আচরণে মোড়ল প্রীত হইলেন, বলিলেন, আও । আমি আরও নিকটে গেলে তিনি আমার মাথার উপর হাত রাখিয়া বলিলেন, জিতে রহো।

          আমরা জিপগাড়িতে  গিয়া বসিলাম । কিয়দ্দূর যাইবার পর শ্রীনিমচ বলিল, আপনি বুন্দেলখণ্ডের চম্বলঘাটিতে যেখানে ইচ্ছা যাইতে পারেন, কেহ আপনার কোনো ক্ষতি করিবে না, বাবার আশীর্বাদ পাইলেন । প্রশ্ন করিলাম, ইনি কি এতদঞ্চলের কোনো ধর্মগুরু ? পোশাক দেখিয়া তো মনে হইল বয়স্ক চাষি । শ্রীনিমচ কহিল, স্যার উনি  ডাকাত সর্দার বাবা মুস্তাকিম, সরকার ওনার মাথার দাম রাখিয়াছে এক লক্ষ টাকা । যাহারা ঘাসের উপর বসিয়াছিল তাহারা ওনার দলের ডাকাত ।


জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇




Post a Comment

1 Comments