জ্বলদর্চি

একমুঠো ভিয়েতনাম/চতুর্থ পর্ব/স্বপন কুমার দাস

একমুঠো ভিয়েতনাম
(চতুর্থ পর্ব)
 স্বপন কুমার দাস

লিস্টের প্রথম দিকেই আমাদের নাম থাকায় ড্রাইভারের ঠিক পিছনের লাইনেই বসার সুযোগ হয়েছিল আমার। সেই সুবাদে প্রথম থেকেই চোখের ক্ষিদে মিটিয়ে নিচ্ছিলাম আমি।বলতে ইচ্ছে করছিল, “ আহা! কী দেখিলাম! জন্মজন্মান্তরেও ভুলিব না”। চলতি পথে হঠাৎ এগিয়ে এলো দু’টি সদৃশ সবুজ পাহাড়। ঠিক যেন পটে আঁকা নিখুঁত  তুলি চিত্র। বিশ্বস্রষ্টার কী অনির্বচনীয় সৃষ্টি! মনে হলো রূপকথার স্বর্গের তোরণদ্বারে প্রবেশ করছি।
তিরতির করে স্পিড বোট এগিয়েই চলেছে। যাত্রাপথে বিপরীতে এগিয়ে আসছে ছোট, বড়, সবুজ, ধূসর, ছিটকাবরা, বিভিন্ন আকৃতির পাহাড়। এ যেন, “এক পলকের একটু দেখা, আরও একটু বেশি হলে ক্ষতি কী?”
অল্পক্ষণের মধ্যেই আমরা পৌঁছে গেলাম সেখানে, যেখানে নোঙ্গর করে আমাদের জন্য প্রতীক্ষা করছে ক্রুজ অ্যাডেলা। 
মন্থর গতিতে আমাদের স্পিড বোট গিয়ে আ্যাডেলার গায়ে ঠেকা মাত্রই ইউনিফর্ম পরা ক্রুজ-স্টাফ এগিয়ে এসে, অভ্যর্থনা করে আমাদের  জাহাজে চড়তে সাহায্য  করলো।
আমাদের কেবিন বুক করা ছিল দোতলায়। সামনের সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় ওঠা মাত্রই ওরা আমাদের নিয়ে গেল সুসজ্জিত ডাইনিং হলে।  ওদের প্রথামতো আপ্যায়ন পর্ব শেষ করে আমরা চলে গেলাম যে যার কেবিনে। 
সুন্দর বিলাসবহুল কেবিন। যেন পাঁচ তারা হোটেলের সংক্ষিপ্ত সংস্করণ। সবই আছে এখানে। সুসজ্জিত বেড এবং এ্যাটাচ বাথরুমটি মোটেই ছোট নয়। সাদা ধবধবে মার্বেলের বাথ টাবও আছে। আছে গরম ঠাণ্ডা জলের ব্যবস্থা। এক কথায়, অসুবিধা বিন্দুমাত্র নাই।
আমার শ্রীমতী নিয়মিত প্রাতঃস্নান করেন। আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি। সুতরাং তার স্নানের প্রশ্নই নাই। শুধুমাত্র একটু ফ্রেস হয়ে নেওয়া। তারপর আমি গেলাম স্নানে।
অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই সবাই তৈরী হয়ে গেলাম লাঞ্চ করতে। 
একটি বড় টেবিলে বসলাম সপরিবারে। মেনু লিস্ট দেখে অর্ডার করলো বৌমা। এখানে অপশন বেশি নাই। তবে, ভেজ,নন্-ভেজ দু’রকমই আছে। যে যার পছন্দ মতো খাওয়া দাওয়া করে ফিরে এলাম কেবিনে। তারপর একটু বিশ্রাম। 
সবে চোখগুলো একটু লেগেছে, হঠাৎ বেজে উঠলো কলিং বেল। তড়িঘড়ি উঠে গিয়ে দেখি; ছেলে, বৌমা, নাতি  দরজায় এসে হাজির। প্রোগ্রাম অনুযায়ী এখন সব্বাইকে যেতে হবে সমুদ্রে মাছ ধরতে। একটা বিচিত্র অভিজ্ঞতার হাতছানি। দেখাই যাক্, কী আছে কপালে?
গ্রাম বাংলায় কেটেছে শৈশব, কৈশোর এবং যৌবনের বেশ কিছুটা সময়। পুকুর, নদী, নালা,  খাল, বিলে মাছ ধরার বিচিত্র অভিজ্ঞতা থাকলেও সমুদ্রে মাছ ধরার কোন অভিজ্ঞতা আমার নেই। এমন কল্পনা স্বপ্নেও করিনি কোন দিন। এ ব্যাপারে অবশ্য আমার বৌমার উৎসাহ সর্বাধিক। আমাকে ব্যাপারটা আগেই বলে রেখেছিল সে।
যাই হোক্ , সব্বাইকে সেফটি কস্টিউম পরিয়ে, ছোটো ছোটো বোটে চড়িয়ে ওরা নিয়ে গেল মাছ ধরতে। হাতে একটি করে ছিপ দিয়ে মাথায় পরিয়ে দিল ভিয়েতনামি টুপি। বড্ড রোদ্দুর!
মাঝ সমুদ্রে কোন ঢেউ ছিল না। ভয় পাওয়ার কোন প্রশ্নই ওঠে না। বরং বেশ মজাই হলো সবার। কিন্তু প্রশ্ন, মাছ কি উঠবে ছিপে?
হ্যাঁ, সত্যিই মাছ উঠলো অনেকের ছিপেই। অবশ্যই সামুদ্রিক মাছ। আমার বৌমার ছিপেও উঠলো একটা স্কুইড। 
ঘণ্টা খানিক পরে নৌকোগুলো সব্বাইকে নিয়ে ফিরলো ক্রুজে। তারপর আরও গভীর সমুদ্রের পথে অভিযাত্রী  হলাম আমরা। 
ছোট্ট ব্যালকনিতে পাতা দু’টি চেয়ারে বসে আমরা দু’টি প্রাণি অপলকে তাকিয়ে আছি সামনে থেকে দূরে। ক্ষণিকের অতিথি হয়ে এগিয়ে আসছে পাহাড়ের পর পাহাড়। বাই-বাই করে চলেও যাচ্ছে তারা। যেন দাঁড়াবার সময় নেই তাদের। আমি বসে, দাঁড়িয়ে তাদের ফটো নিচ্ছি মনের সুখে।
সমুদ্র প্রেম আমার আশৈশব। জীবনে অনেক সমুদ্র দেখেছি আমি। কিন্তু সমুদ্রের এ অপরূপ রূপ আমি কোনদিন দেখিনি। নীল সমুদ্রের বুকে অজস্র সবুজ পাহাড়ের শোভা। সবুজ পাহাড়ের ছায়ায় সমুদ্রের জলের রং এখানে ফিরোজা অর্থাৎ নীল ও সবুজ রঙের মিশ্রণ। এ এক প্রকৃতির বিস্ময়। যেন পটে আঁকা ছবি।
প্রকৃতির নিয়মে পশ্চিম দিগন্তে সূর্যদেব অস্তাচল গামী। সারি সারি পাহাড়ের গলি পথ দিয়ে সমুদ্রের বুকে ঝরে পড়ছে সোনা-রোদ। আর নীল নয়, এখন সোনানী ঢেউ তুলে এগিয়ে চলেছে আমাদের ক্রুজ অ্যাডেলা।
হ্যা লং উপসাগরের বুকে সূর্যদেব ডুব দিতে চলেছেন। সে দৃশ্য চাক্ষুস করতে হলে জাহাজের ডেকে চড়া জরুরী। সুতরাং কাল বিলম্ব না করেই আমরা সিঁড়ি বেয়ে গেলাম ডেকে। দেখতে দেখতে জাহাজ খালি করে সব্বাই ডেকে গিয়ে হাজির। অনেকে অবশ্য আগের থেকেই সেখানে চেয়ার দখল করে বসে আছে। 
সমুদ্রের শীতল সান্ধ্য হাওয়ায়  শরীর যেন জুড়িয়ে দিচ্ছে।আমি মাঝ সমুদ্রে দাঁড়িয়ে, চোখে চাতকের তৃষা নিয়ে দেখছি সূর্যাস্তের অদৃষ্টপূর্ব মনোরম দৃশ্য। সে দৃশ্য তৎক্ষণাৎ শুধু আমার ক্যামেরায় বন্দি করিনি, সারা জীবনের জন্য বন্দি করেছি আমার মন-ক্যামেরায়।
বিষুবরেখা অঞ্চলের দেশ বলেই এ দেশে সন্ধ্যা নামে একটু দেরিতে। প্রায় সাতটায় সন্ধ্যা নামলো হ্যা লং উপসাগরের বুকে। একটা আলো-আঁধারের খেলা। তার পরেই সে এক অদ্ভুত দৃশ্য। সামনে, দূরে এসে জুটেছে এক দল জাহাজ। সব্বাই সেজে উঠেছে আলোর সাজে। চারি দিকে শুধুই আলোর মেলা। এ যেন চন্দননগরে জগদ্ধাত্রী পূজার আলোক সজ্জাকেও হার মানায়। চোখ ফেরানো মুশকিল।
এদিকে ডিনার পর্ব শুরু হয়ে গেছে। বিদেশে সবাই ডিনার একটু তাড়াতাড়িই করে। আমরাও গিয়ে বসলাম সাজানো ডিনার টেবিলে। মাঝ সমুদ্রে আলোক সজ্জিত জাহাজের ডেকে বসে ডিনারের এক অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা হলো আমার। ঠিক যেন ক্যাণ্ডেল লাইট ডিনার।
খাদ্য তালিকায় ছিল সমুদ্র ফসলের বিপুল সম্ভার। স্কুইড, অক্টোপাস, জেলিফিস, ওয়েস্টার, কাঁকড়া, ইত্যাদি ইত্যাদি।এ ছাড়াও ছিল ভিয়েতনামের স্পেশাল পুঁই শাকের একটা অসাধারণ স্যুপ। নানা রকম লতা-পাতা সেদ্ধ তো ছিলই। স্টিকি রাইসও ছিল।
তৃপ্তি করে ডিনার সেরে কেবিনে ফিরে এলাম রাত্রি ৯টার পরে পরেই। তারপর এক ঘুমেই ভোর ৫টা।
ঘুম ভাঙার সঙ্গে সঙ্গেই ধড়পড়িয়ে উঠে পড়লাম বিছানা থেকে। মিসেসের ঘুম বড্ড পাতলা। তারও ঘুম ভেঙে গেল। তারপর সকালের কাজ সেরে দু’জনে চলে এলাম ডেকে। ডেক শুনসান। সকালের ফুরফুরে ঠাণ্ডা হাওয়া একাই খেলে বেড়াচ্ছে ক্রুজ-এর ডেকে। কিন্তু একি! আমরা এখন কোথায় দাঁড়িয়ে? কে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের সামনে?
সে আর কেউ নয়, ছবিতে দেখা লুয়ন কেভ। বহু কাঙ্ক্ষিত সেই লুয়ন কেভ। কেভের ভিতরেই আছে সবুজ হ্রদ। সারা বিশ্বের সৌন্দর্য পিয়াসী লোকেরা এই লুয়ন কেভের সৌন্দর্য দেখার জন্যই আসেন এখানে। আর আসেন কায়াকিং করতে। জুটি বেঁধে প্লাস্টিক কায়াকে করে, বৈঠা বেয়ে ঘুরে বেড়াতে হয় সিক্রেট লেগুনে। হ্রদের সবুজ জলের উপর ভাসমান কায়াকে শুয়ে নীল আকাশকে দু’চোখ ভরে দেখার দুর্লভ সুযোগ আছে এখানে।

কায়াকিং করতে শরীরের শক্তি লাগে। তাই খাওয়া দাওয়া করেই সবাই কায়াকিং করতে নামে সমুদ্রে। বয়সের কারণে আমি সে সুযোগ থেকে বঞ্চিত। তবে এখানে এসে সে সুযোগ নেওয়ার জন্য সব্বাই এক পায়ে খাড়া।
সৈকত থেকে প্রায় ১৪ কিলোমিটার দূরের এই গুহাটি বো হন্ আইল্যাণ্ডের একটি অংশ। লুয়ন কেভের সামনেই দাঁড়িয়ে আছে আরও একটি দ্বীপ। তার নাম কন্ রুয়া আইল্যাণ্ড। এটির আর এক নাম টাটল আইল্যাণ্ড বা কচ্ছপ দ্বীপ। এটি নাকি সামুদ্রিক কচ্ছপদের আস্তানা।              
 (ক্রমশ……)



জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇



Post a Comment

1 Comments

  1. ভালো লাগছে ভিয়েতনাম ভ্রমণের কথা।

    ReplyDelete