মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ৪৮
ভুতু ডাক্তার ওরফে প্রমথনাথ অধিকারী (তমলুক)
ভাস্করব্রত পতি
মহিষাদল রাজবাড়ির পর্দানশীন অন্তঃপুর। চারিদিকে চাপা উত্তেজনা। মহিলাদের ফিসফাস, গুজগাজ। রাজা সতীপ্রসাদ গর্গ বাহাদুরের অন্তস্বত্ত্বা স্ত্রী প্রসব যন্ত্রণায় কাতর। কি হবে উপায়? তখনকার দিনে বিখ্যাত ইংরেজ ডাক্তার কর্নেল ব্রাউন এসে তিনদিন থেকেও কিছুই করতে পারছিলেন না। এলেন আর এক বিখ্যাত ডাক্তার নীলরতন সরকার। এসেই শুনলেন রাজবাড়ির নিজস্ব 'ভূতু ডাক্তার'-এর নাম। এই গণ্ডগ্রামে ডাক্তার? কেমন সেই ডাক্তার? তাঁকে না দেখলে, তাঁর সাথে কথা না বললে রোগীর গায়ে হাতই দেবেন না তিনি -- পণ করে বসলেন ডাঃ নীলরতন সরকার। রাজবাড়ি থেকে ফিটন গাড়িতে লোক গেল তমলুকের পার্বতীপুরে অধিকারী পাড়ায় (তাম্রলিপ্ত পৌরসভা)। মূল কথা, ভুতু ডাক্তার প্রমথনাথ অধিকারীকে ডেকে আনতে হবে মহিষাদল রাজবাড়িতে। এদিকে নীলরতন সরকার শুনেছেন সেই ডাক্তারের হুলিয়া। এ ডাক্তার কোমরে গামছা পরেন। ঘোড়ায় চেপে আসেন। হাঁটুর ওপর মালকোঁচা মারা ধুতি পরেন। গৃহ চিকিৎসক হলেও সাধারণ হাঁচি সর্দির চিকিৎসা করেন।
যথারীতি ভুতু ডাক্তার রাজবাড়িতে এলেন নিজের ঘোড়ায় চেপে। দূর থেকে তাঁকে দেখেই নীলরতন সরকারের মনে হলো এ পরিচিত মুখ। চিনতে পারলেন হাঁচি সর্দির চিকিৎসা করা ভুতু ডাক্তারকে। জড়িয়ে ধরলেন তাঁকে। "আরে ভুতুদা তুমি এখানে। তোমার মতো শ্রেষ্ঠ ডাক্তার মিড ওয়াইফারিতে ফার্স্ট হয়ে গোল্ড মেডেল নিয়ে পাস করেছিলে। আর সেই তুমি কিনা কলকাতা ছেড়ে চলে এলে এই গণ্ডগ্রামে? তুমি থাকতে আমি ডেলিভারি ক'রব? প্রসব যন্ত্রণায় কাতর রাজমাতার চিকিৎসা শুরু করলেন ভুতু ডাক্তার। জন্ম নিলেন সতীপ্রসাদ গর্গ বাহাদুরের জ্যেষ্ঠ সন্তান দেবপ্রসাদ গর্গ বাহাদুর।
এই ভুতু ডাক্তারের জন্ম ১৮৫৪ সালের এক ফেব্রুয়ারি মাসে তমলুক শহরে। রমানাথ অধিকারীর চতুর্থ সন্তান। আসল নাম প্রমথনাথ অধিকারী। কিন্তু লোকে ডাকতো 'ভুতু' নামে। মোট সাত ভাই এবং দুই বোন। কষ্টের সংসার। স্রেফ পয়সার অভাবে রমানাথ তাঁর এই মেধাবী ছেলেকে লাগিয়ে দেন ব্রাহ্মণ্য বৃত্তিতে। অথচ প্রমথনাথ ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত বৃত্তি পরীক্ষায় জলপানি পেয়েছিলেন। প্রমথনাথের জন্মের দু'বছর আগে স্থাপিত হয় হ্যামিলটন স্কুল। বাংলা ভাষার এই স্কুলেই ভর্তি হন তিনি। এদিকে ব্রাহ্মণ্য বৃত্তির পাশাপাশি তিনি স্থানীয় চতুষ্পাঠী টোলে তারকনাথ চক্রবর্তীর কাছে সংস্কৃত ভাষায় আদ্য, মধ্য, কাব্য এবং ব্যাকরণ পাশ করেন। চরক এবং শুশ্রুতের বইটি তিনি পড়ে ফেলেন। শুরু করেন কবিরাজী চিকিৎসা। কিন্তু পরবর্তীকালে যে অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসক হয়ে উঠবেন— তা তিনি স্বপ্নেও ভাবেননি।
কলকাতায় তখন ক্যাম্পবেল মেডিক্যাল স্কুল হয়েছে। যার আগের নাম ছিল পপার হাসপাতাল। ১৭৮৭ তে প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তীকালে এর নাম হয় নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল। রামকমল সেনের উদ্যোগে ইংরেজরা এখানে ১৮৫২ র ১৫ ই জুন বাংলা ভাষায় চিকিৎসাবিদ্যা শেখানো শুরু করে। যথারীতি সেখানে হাজির দুই বন্ধু। সঙ্গে নিজেদের তৈরি একটা কঙ্কাল। ইংরেজ ডাক্তাররা তাঁদের ডাক্তারী পড়বার সেই কাহিনী শুনলেন। হতবাক ইংরেজরা এখানে ডাক্তারী পড়তে আসা ছাত্রদের ডেকে মন্তব্য করলেন, 'এদেশের কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজের বিরুদ্ধে লড়াই করে যে কাজ এঁরা করেছে তা অত্যন্ত দুঃসাহসের পরিচয়। অত্যন্ত প্রশংসার যোগ্য। বর্তমানকালের ছাত্ররাও এ বিষয়ে কল্পনা করতে পারবে না মনে করছি। হত দরিদ্র পরিবারের এই দুই বন্ধু ডাক্তারী পড়তে ভর্তি হলেন ক্যাম্পবেল মেডিক্যাল স্কুলে। ১৮৯১ তে ৩৭ বছর বয়সে ডাক্তারী পাস করলেন প্রমথনাথ । পেলেন সার্টিফিকেট। হেম অধিকারী সরকারী হাসপাতালের ডাক্তার হলেন। আর প্রমথনাথ ওরফে ভুতু ডাক্তার ফিরে এলেন গ্রামে। তমলুকে। এরপর একটানা ৬০ বছর ধরে মানবদরদী এই ডাক্তার জনগণের সেবায় নিয়োজিত থেকেছেন। প্রায় অনালোচিত এবং অনালোকিত এই গেঁয়ো ডাক্তারবাবু হয়ে উঠেছেন মেদিনীপুরের মানুষ রতন। আলোকিত করেছেন মেদিনীপুরের মাটি। আলোচিত করেছেন চিকিৎসা বিদ্যার মতো মহান পেশাকে। আর আলুলায়িত করেছেন তৎকালীন নাক উঁচু মানুষজনের মানসিকতাকে।
ভুতু ডাক্তার তমলুকে এসেই শুরু করলেন ডাক্তার, কম্পাউন্ডারসহ সধবা ও বিধবা মহিলাদের ধাত্রী বিদ্যায় পারদর্শী করার কাজ। ডাঃ বারাণসী অধিকারী (বারুবাবু), ডাঃ পূর্ণ চক্রবর্তী, ডাঃ সতীশ প্রসাদ ভৌমিকরা ভুতু ডাক্তারের সুযোগ্য ছাত্র। কম্পাউন্ডার হিসেবে নাম করেন গুণধর মাইতি, বিজয় পাঠক, বরেন্দ্রনাথ আচার্য (ইনি কলকাতার মেয়ো হাসপাতালে হেড কম্পাউন্ডার হয়েছিলেন) প্রমুখ। ডাক্তার হিসেবে ভুতুবাবুর নাম ছড়িয়ে পড়ে সারা মেদিনীপুর জেলা এবং উলুবেড়িয়া মহকুমায়।
ভুতু ডাক্তারের নাতি প্রয়াত সুধীর অধিকারীর (গিধু অধিকারী) কথায় এই বিস্মৃতপ্রায় ডাক্তারের জীবনের নানা দিক প্রস্ফুটিত। ভূতুবাবু বলতেন, রোগীকে বাড়িতে আনা চলে না। রোগীর বাড়িই আমার চেম্বার। ডাঙ্গায় যাওয়া আসার জন্য তিনি ঘোড়া রেখেছিলেন। আর জলপথে নৌকায় চেপেই যেতেন। ডাক্তারের ব্যাগ বয়ে নিয়ে যেতেন সহযোগী চিন্তামণি জানা। ব্রিটিশ ফার্মাকোপিয়ার কেমিক্যাল দিয়ে নিজেই বানাতেন নানা ওষুধ। কামারশালা থেকে নিজেই তৈরি করতেন অপারেশনের জন্য প্রয়োজনীয় চুরি কাঁচি। তবে ফরসেপ ডেলিভারির বদলে হ্যান্ড ডেলিভারিতেই পছন্দ করতেন তিনি। এভাবেই হ্যান্ড ডেলিভারি করছিলেন হাওড়ার শ্যামপুরের এক ভিখিরি মহিলার পচে যাওয়া মৃত সন্তানকে। ভিখিরি বেঁচে উঠেছিল মৃত্যুর মুখ থেকে। কিন্তু যে কোনও কারণেই ভুতু ডাক্তারের ডান হাতের মধ্যমা আঙুল বিষাক্ত হয়ে যায়। ডাঃ কার্তিকচন্দ্র বসু এই আঙুলের রগ কেটে বাদ দেন। আর কোনওদিন সেই আঙুল বাঁকানো যায়নি।
তখন মানুষজন বাড়িতে অতিথি এলে তাঁর পা ধোয়া জল খেত। আর সেই ভুতু ডাক্তার শীত গ্রীষ্ম বর্ষা সবসময় পায়ে মোজা পরে থাকতেন। ফলে পা ধোয়া জল দিতে হত না কাউকে। এই বিশাল মনের মানুষটি বলতেন, 'প্লেন লিভিং বাট হাই থিঙ্কিং'। তা তিনি আজীবনই মেনে চলেছেন। নেফ্রাইটিস, ডাবল নিউমোনিয়া, টাইফয়েড, ম্যালেরিয়া, কলেরা, কার্বাঞ্চল ইত্যাদি রোগের হাত থেকে সে যুগে যে তিনি কত রোগীর প্রাণ বাঁচিয়েছেন — তার ইয়ত্তা নেই। চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নয়নও হয়নি তখনও। তবুও ভুতু ডাক্তার ছিলেন সাক্ষাৎ ধন্বন্তরী।
সেদিন ১৯৫১ সালের ৩০ শে নভেম্বর। শুক্রবার। ভোর পাঁচটা। সারা মেদিনীপুর জেলা ও রূপানারায়ণ পেরিয়ে হাওড়া জেলায় ছড়িয়ে পড়ল দুঃসংবাদ। ভুতু ডাক্তার আর নেই। কাতারে কাতারে মানুষের ভিড় অধিকারী পাড়ায়। সেদিন তমলুক শহরের সরকারী, বেসরকারী অফিস, আদালত, দোকান, বিদ্যালয় বন্ধ। চারিদিকে একটা থমথমে ভাব। মানুষের মুখে কথা নেই। যেন কিছুর অভাববোধ তাঁদের গ্রাস করেছে। তমলুক হারিয়ে ফেলেছে তাঁর কোলের সন্তানকে। যে কিনা তাঁর কর্মজীবনে নিজের কৃত চিকিৎসাবিদ্যার দৌলতে বহু দম্পতির কোলে তুলে দিয়েছেন তাঁদের স্বপ্নসন্তানকে। আজ সেই রতনটিই আর নেই। আজ দেবী বর্গভীমা মন্দিরের সামনে তিন মাথার মোড়ে রয়েছে তমলুকের ভুতু ডাক্তারের আবক্ষ মূর্তি। গলায় স্টেথোস্কোপ ঝুলছে। গত ২০০৪ এর ২২ শে ফেব্রুয়ারি এটির উদ্বোধন করেন তৎকালীন পারিষদীয় মন্ত্রী প্রবোধ চন্দ্র সিনহা। ভুতু ডাক্তারের জন্মের ১৫০ তম বর্ষে এভাবেই শ্রদ্ধার্ঘ্য জানিয়েছিল তাম্রলিপ্ত শহর। তবে আজকের প্রজন্মের কাছে ভুতু ডাক্তারের মতো ডাক্তারদের অসাধারণ কীর্তিগুলো অপ্রকাশিত, অপ্রচারিত এবং অজানা রয়েই গিয়েছে।
[তথ্যঋণ -- তমলুকের সেই আশ্চর্য ডাক্তার, ভাস্করব্রত পতি, গণশক্তি (সাতসকাল বিভাগ), ৬ ই মার্চ, ২০০৪]
জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇
2 Comments
সশ্রদ্ধ নিবেদন, ভালো লাগল।
ReplyDeleteআপনার এই সিরিজটা একসঙ্গে বই হিসেবে চাই ভবিষ্যতে
ReplyDelete