জ্বলদর্চি

শব্দে গাঁথা মনি-মালা : ২ /সালেহা খাতুন

শব্দে গাঁথা মনি-মালা : ২ 
সালেহা খাতুন 

রাত বারোটায় মায়ের কোল আলো করে এলো আমাদের একমাত্র ভাই। ভাইকে দেখানোর জন্য আমাদের ঘুম থেকে তুলে নিয়ে গেল সবাই। একটা ভাই দেখে বোন তো হাত পা ছুঁড়ে কাঁদতে লাগলো। কাঁদতেই থাকলো। আমাদের দু বোনের তো দুটো ভাই হওয়ার কথা। কেন একটা ! কেন একটা? শেষে বড়ো দাদুর মেয়ে মোতি মাসি পেশায় রাজ্য সরকারি নার্স, আমাদের বোঝালেন “আচ্ছা আচ্ছা  এটা টুকুরই ভাই অর্থাৎ তোমার ভাই। মনির ভাই পরে হবে।” প্রসঙ্গক্রমে জানিয়ে রাখি মোতি মাসি এখন অবসরপ্রাপ্ত এবং কোমর ভেঙে শয্যাশায়ী হয়ে আছেন।
 পরে যখন আমরা তিন ভাইবোনে মারামারি করতাম বা ভাইয়ের সঙ্গে মারপিটে পেরে উঠতাম না তখন আমি বোনকে বলতাম এটা তো তোরই ভাই। তুই সামলা। বড়ো বলে আমাকে ওই ছোটো বয়সেও কত কিছু মেনে নিতে হতো। তবে আমার সৌভাগ্য যে আমার ভাই বোন আছে। ওরাও ওদের দিদিকে খুব ভালোবাসে। ভাইবোন নিয়ে মেতে তো আছি। কিন্তু এদিকে আমার ছবছর বয়স হয়ে গেছে। স্কুলের পড়াশোনা ছেড়ে মায়ের সঙ্গে মামার বাড়িতেই আছি। মা সদ্যোজাত ভাইকে নিয়ে ব্যস্ত থাকায় পড়াশুনা লাটে উঠে গেছে। মামার বাড়ির বিরাট উঠোন জুড়ে শুধুই খেলে বেড়াই। মা চিৎকার করতে থাকে “গায়ে জুতো পায়ে জামা দিয়ে নে”। আমিও বাধ্য মেয়ে! হাওয়াই চটি জোড়া দুহাতে গলিয়ে ফ্রকটা দুপায়ে আটকে পা জোড়া জোড়া করে হেঁটে বেড়াচ্ছি। মাতৃ আদেশ অলঙ্ঘনীয়। পরে মা হেসে ফেলেন বোঝেন কী ভুল উচ্চারণই করে ফেলেছেন। আমরা বড় হয়ে স্কুল কলেজেও যখন পড়ছি তখনও মা এমন উল্টো নির্দেশ দিয়ে দিতেন। কখনো বলতেন “জানলা ঘরের রান্নাটা দিয়ে দে” আবার কখনো বা বলতেন “মশা টাঙিয়ে শো মশারি কামড়াবে”। তখন হেসে লুটোপুটি খেলেও এখন নিজেও যখন এমন উচ্চারণ করে ফেলি ভাবি কাজের চাপেই মায়ের চিন্তা এমন এলোমেলোভাবে প্রকাশ পেত। মায়ের কথায় হাসার শাস্তি এম.এ পরীক্ষায় বেশ ভাল রকমই পাই। প্রাবন্ধিক রূপে প্রমথ চৌধুরীর মূল্যায়ন প্রসঙ্গে আমিও লিখে ফেলি -  “জুতো পাঠ থেকে চন্ডী সেলাই”। আজও ভুল করে বলে ফেললাম -  চোখে ফোন দিলেই ওষুধ আসে”। ক্লাস ওয়ানের পড়ার কথা এখনো হলো না চলে এসেছি এম.এ. ক্লাসে। স্ট্রিম অফ কনসাসনেশ বা চেতনাপ্রবাহ মনে হয় একেই বলে। সরাসরি টু তে ভর্তি হয়ে যাই। মা ভালো করে লক্ষ্য রাখতে পারেননি । আমিও পড়াশোনা করিনি। আমি হাফ ইয়ারলি পরীক্ষায় অঙ্কে একশোয় একশো পাই।কিন্তু  বাংলায় জিরো। বাবা আমার রেজাল্ট নিয়ে মামার বাড়িতে এসেছেন। কী লজ্জা কী লজ্জা। কিন্তু নরম তুলতুলে একটা ভাই পেয়েছি। ওসব লজ্জার কাঁথায় আগুন। খবর পেলাম দাদীমা অর্থাৎ ঠাকুমা আর আমার এক অত্যন্ত প্রিয় দাদু গণিদাদু আমাদের বাড়ি থেকে বাগনানে এসে গেছেন মা ও ভাইকে দেখতে। আমতলায় পৌঁছে গেছেন। মামার বাড়ির একটা বিখ্যাত জায়গা ওটা। কী মায়া জড়ানো জায়গা। কোল থেকে ভাইকে ফেলে ছুট ছুট। গণি সাহেব আমাকে ডাকতেন মনু বলে। মনু দাদুভাই বলে আমাদের বাড়িতে ঢুকতেন। মা মামার বাড়িতে শুধু স্কুল কলেজের শিক্ষাই গ্রহণ করেছেন ধর্মীয় শিক্ষা সেরকম হয়নি। আমাদের সাহাপুরের বাড়িতে এসে গণি মোল্লা দাদুর কাছে কোরআন শরীফ পড়া শিখেছেন। মাকে যখন পড়াতেন আমি তখন তাঁর কোলে বসে থাকতাম। শিক্ষাদাতা কে যে কতটা শ্রদ্ধা করতে হয় মায়ের কাছ থেকেই শিখেছিলাম। গণি দাদুর নিজের বৌমার থেকেও মা তাঁর অনেক বেশি যত্ন করতেন। এলেই এক গ্লাস গরম গরম দুধ খেতে দিতেন। পড়ার শেষে তাঁর চাদর টাদর সব কেচে দিতেন। আমার জীবনে দেখা প্রথম মৃত্যু এই গণিদাদুর। থ্রিতে যখন পড়ি, একদিন স্কুল থেকে ফিরেছি, মা বললেন “যা তোর সালাম বাবুর বাড়ি যা”।সালাম বাবুর বাবা মানে গণিদাদু খুব অসুস্থ। মৃত্যুশয্যায়। ঘর জুড়ে বহু মানুষের মাঝে মৃত্যুর প্রতীক্ষায় রত মানুষটাকে দেখে কষ্ট পেলাম। সবুজ রঙের বমি করছিলেন উনি। ছেলে ব্যাঙ্কের ম্যানেজার। প্রাসাদোপম  বাড়ি। সব ফেলে চলে গেলেন তিনি। সালাম বাবু বাবার বন্ধু। তাঁর এক বোন আঙ্গুরা দিল্লিতে থাকতেন। ওঁরা যখন গ্রামে ফিরতেন আমাদের বাড়ি আসতেন প্রচুর মজা হতো। ছোটো বয়সে রাজধানীর গল্প শুনতে ভালো লাগতো। বাড়িতেও কী কম মজা! বাবারা পাঁচ ভাই। জ্যাঠামশাই বাউড়িয়া কটন মিলে চাকরি করতেন। বাবা মেজো হাইস্কুলে শিক্ষকতা করতেন। বিষয় ইতিহাস। সেজো কাকা কানোরিয়া জুট মিলে ক্লার্ক ছিলেন। নকাকা  ইলেকট্রিশিয়ান। ছোটো কাকার কলকাতায় ব্যবসা। একই বাড়িতে তখন আমরা থাকতাম। জ্যাঠামশাই আর আমাদের পাশাপাশি দুটো ঘর ছিল। বড়োমা বড়োবাবুর আদর এজন্য বেশি পাওয়া যেতো। আমাদের বাড়ির বড়ো মেয়ে হালিমা বুবু। বড়োবাবুর মেয়ে। আমার বাবার স্কুলেই পড়াশোনা করতো। আমার বাবার বাড়িতে মেয়েদের মধ্যে সেই প্রথম মাধ্যমিক পাশ করে। বুবু মানে দিদিও অত্যন্ত সুন্দরী। ধার্মিক। সংসারী। ছোটোবেলায় ওদের কোলেপিঠেই মানুষ হয়েছি। ওই দিদির বিয়ের কথা মনে নেই। তবে সাবেরা বুবু অর্থাৎ জ্যাঠামশাইয়ের ছোটো  মেয়ের বিয়ের কথা মনে আছে। মা আমাদের খুব সুন্দর করে সাজিয়ে দিয়েছিলেন। খুব মনে আছে সাবেরা  বুবুর বিয়ের দিন বরপক্ষ কনের চুল দেখতে চাইছিল তখন আমার চতুর ছোটো পিসিমা নিজের লম্বা চুল খুলে দিয়ে দেখিয়ে বলেছিলেন কনের ফুফুর যদি এতো লম্বা চুল হয় তাহলে ভাইঝিরও তাই।কিন্তু সাবেরা বুবুর চুল তো আমার মতোই। খুব বেশি লম্বা নয় । দুই দিদির বরই আমাদের বেড়াতে নিয়ে যেতে চাইতেন। কিন্তু বাবার অনুমতি ছিল না। অন্যরা কত মজা করত বেড়িয়ে এসে গল্প করত। কিন্তু আমাদের মন খারাপ করা ছাড়া উপায় ছিল না।বড়োবাবুর  তিন ছেলে।প্রথম দুইজন আমার দাদা, ওই দাদাদের জন্য ছোটোবেলাটা অত্যন্ত মধুর ছিল। দাদার সঙ্গে স্কুলে যেতাম। দাদা তখন ক্লাস টেন আমি তখন ক্লাস ফাইভ। দুজনেই বাবার স্কুল বেলডুবি  হাইস্কুলে পড়তাম। এক দাদা আমার থেকে মাত্র দেড় বছরের বড়ো। আমার খেলার সঙ্গী ছিল ওই। গ্রামের বাড়িতে আলাদা করে আমরা কলাপাতা দিয়ে নিজেদের খেলার ঘর বানাতাম। দোকান করতাম। আরো কত কী! 
জ্বলদর্চি অ্যাপ ডাউনলোড করে নিন।👇
আম কুড়ানো  খেজুর কুড়ানো জামরুল পাড়া জ্বালানি সংগ্রহ সব ঐ দেড় বছরের বড়ো দাদার সাথেই হতো। মারপিট করতাম। কিছু গালিগালাজের পেটেন্টও  নেওয়া ছিল।দেড় বছরের বড়ো দাদা হাকিম কে নাম ধরেই ডাকি। বাগানে বাগানে ঘুরে ছুটে ফেরার সময় একদিন রাস্তা পেরোতে গিয়ে খুব ছোটোবেলায় ও একবার সাইকেল চাপা পড়ে যায়। যেহেতু  আমি ওর সর্বক্ষণের সঙ্গী ছিলাম, ওর পেছনেই আসছিলাম। দেখলাম সাইকেল এর চাকাটা ওর মাথার উপর দিয়ে চলে যেতে ওর দুচোখের কোলে সাদা মতো একটা জিনিস অনেকটা বেরিয়ে এলো। দৌড়ে গিয়ে বাড়িতে এসে খবর দিলাম। নকাকা ওকে নিয়ে উলুবেড়িয়া ই এস আই হাসপাতালে চলে গেল। অনেকদিন ভর্তি ছিল। আমার ছোট বোন টুকু তখন দোলনায় দুলতে দুলতে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করত “আমার হাকিম দাদাকে ভালো করে দাও আল্লাহ”। এই হাকিম দাদাই পরে আমাকে একদিন জলে ডোবার হাত থেকে বাঁচায়। ও তখন সাঁতার শিখে গেছে কিন্তু আমি সাঁতার জানিনা। পুকুরের পাড় দিয়ে যেতে যেতে হড়কে এক গলা জলে পড়ে গেছি। ও সাঁতার দিয়ে আমাকে তুলে আনে।  এই ঘটনার পর মা আমাকে সাঁতার শেখানোর চেষ্টা করেন। পাড়ার রুশি বুবু আমাকে সাঁতার শিখিয়ে দেয়। রুশিবুবুর জন্য  খুব মন খারাপ হয়। সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে রুশিবুবুর  আর ফেরা হয় না। আর ওই সাইকেলের অ্যাক্সিডেন্টের পর হাকিমেরও মেধা শক্তি কিছুটা কমে যাওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন ডাক্তাররা। জ্যাঠামশাই অর্থাৎ হাকিম দাদার বাবা উত্তম কুমারের সিনেমার ভক্ত ছিলেন কিশোর কুমারের গানেরও অন্ধ ভক্ত। বাউড়িয়া কটন মিলে ডিউটি আওয়ার শেষ হলে রেডিওতে গান শুনতেন। অবসর সময় চাষাবাদ করতেন। তাঁর প্রিয় রেডিওটি তিনি শুধুমাত্র একদিন হাতছাড়া করতেন। সেটি মহালয়ার দিন। বড়োবাবুর বন্ধু মানিক জ্যেঠু সেদিন ওটি ধার নিয়ে যেতেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কণ্ঠে মহালয়া শোনার জন্য। বড়োবাবু বন্ধুকে ডাকতেন মানকে বলে। মানকে মাইনকিয়া আরও কত আদরের নাম ছিল তাঁর। হুমরা বেদের ছোটো ভাই মাইনকিয়ার প্রসঙ্গ বলতে গেলে আজও ছোটোবেলার সেই মহালয়ার দিন আর বড়োবাবুকে মনে পড়ে। বড়োবাবু অষ্টমীর দিন বাড়িতে লুচি বানানো মাস্ট করে দেন। বড়োবাবুর ধূমপানের নেশা ছিল। আমরা ছোটোরা তাঁকে নকল করতাম। লাউডাঁটা শুকনো করে তাতে আগুন দিয়ে একইভাবে ধূমপানের চেষ্টা চলতো আমাদের। ছোটো থেকেই চুল আঁচড়ানোয় আমার অনন্ত অনীহা ছিল। মা জোর করে বিকেলে চুল বেঁধে দিতেন। চুলের গোড়ায় ব্যথা লাগলে যন্ত্রণায় চিৎকার করতাম।মা দুমদাম মার দিতেন। এমন মারতেন  যে পাঁচটা আঙুলের দাগ বসে যেত। আমার কান্না ভোলানোর জন্য বড়োবাবু কোলে নিয়ে দশ পয়সা কুড়ি পয়সা দিতেন আর সেটা দিয়ে পাড়ার দোকান থেকে কিছু কিনে দিলে কান্না যেতে থেমে, পরে বড়ো হয়ে দেখেছি বড়োবাবু আমার বাবাকে খুব শ্রদ্ধা করতেন। বয়সে ছোটো ভাইয়ের প্রতি এত শ্রদ্ধা অবাক হতাম। আসলে আমার দূরদর্শী বাবা বড়োবাবুকে পরামর্শ দিয়েছিলেন “দাদা তুমি আটান্ন হওয়ার আগেই রিটায়ারমেন্ট নিয়ে নাও। আর দুবছর অপেক্ষা করো না। দিনকাল ভালো না। কখন মিল বন্ধ হয়ে যাবে তুমি কানা কড়িও পাবে না”। একই পরামর্শ বড়োবাবুর বন্ধু আমাদেরই পাড়ার দামোদর জ্যেঠুকেও বাবা দিয়েছিলেন কিন্তু তিনি শোনেননি। বড়োবাবু বাবার কথামতো কাজ করেছিলেন। ছমাসের মধ্যেই বাউড়িয়া কটন মিল বন্ধ হয়ে যায়। বড়োবাবু তাঁর প্রাপ্য সব পেলেও অন্যরা তা পেলেন না। বড়ো বাবু বলতেন “আমার ওদুদ বিচক্ষণ মানুষ”।আমার দাদীমাও বাবার সম্পর্কে বলতেন “আকাশে পাখি উড়ে যাবে আমার ওদুদ তার পালক গুণে নেবে”।
 বাউড়িয়া কটন মিল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আমাদের এলাকার অনেক মানুষের রুজি রোজগার শেষ হয়ে যায়। শিল্পাঞ্চল হওয়ায় ছোটোবেলায় বাউড়িয়ার যে রমরমা দেখেছিলাম একের পর এক কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এলাকাটা যেন ভুতুড়ে হয়ে যায়। গঙ্গা তীরবর্তী নিউমিল নর্থমিল বাউড়িয়া কটন মিল, ফোর্টগ্লস্টার কেবল ফ্যাক্টরি সব বন্ধ হয়ে যায়। আমাদের পরিবারের এবং এলাকার অনেক মানুষ বিত্তহীন হয়ে পড়েন। যাঁরা কারখানায় কাজ করতেন শুধু তাঁরাই নন এলাকার বাজার হাট ব্যবসা বাণিজ্য সবই ধুঁকতে থাকে। নিউমিল নর্থমিল অবশ্য এখনো খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে। এই নিউমিলের সঙ্গেও আমার একটা প্রাণের যোগ ছিল। বড়ো দাদুর ছেলে আমান মামা ওখানে চাকরি করতেন।

(ক্রমশ)


Post a Comment

3 Comments

  1. খুব ভালো লাগছে।পরের পর্বের আশায় রইলাম।

    ReplyDelete

  2. খুব ভালো লাগছে।পরের পর্বের আশায় রইলাম।আগের টায় নাম যায়নি তাই আবার লিখলাম।

    ReplyDelete
    Replies
    1. সালেহাMay 11, 2023 at 6:10 PM

      অনুপ্রেরণা পাচ্ছি। অনেক ধন্যবাদ

      Delete