জ্বলদর্চি

সবুজ দ্বীপ আন্দামান /নবম পর্ব /দেবীপ্রসাদ ত্রিপাঠী

সবুজ দ্বীপ আন্দামান
নবম পর্ব   

দেবীপ্রসাদ ত্রিপাঠী

পূর্ব প্রকাশিতের পরবর্তী অংশ

এ্যাবারডিনের যুদ্ধের পরে ব্রিটিশরা কয়েদী উপনিবেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থা সুদৃঢ় করে পোর্ট ব্লেয়ারের দুই প্রান্তে দুটি কামান বসায় যাতে পুনরায় আদিম জনজাতির আক্রমণ প্রতিহত করা যায়। অবশ্য এর পিছনে আরও একটি কারণ ছিল যে কয়েদীরা বিদ্রোহ করে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করলে তাদেরকে যাতে সহজেই কামান চালিয়ে দমন করা যায়। এছাড়াও উপনিবেশে যাতে ব্রিটিশরা ভালো ভাবে বসবাস করতে পারে তার জন্য রাস্তাঘাট নির্মাণ এবং ইংরেজ শাসকদের বাংলো ও বাসস্থান নির্মাণ, সৈন্যদের ব্যারাক, সরকারী বাসভবন, চিকিৎসা পরিষেবা কেন্দ্র, হাসপাতাল দ্রুতগতিতে নির্মাণ করে। ভাইপার দ্বীপে ফাঁসির মঞ্চ এবং চাত্থাম দ্বীপে একটি আধুনিক কাঠ চেরাই কল নির্মাণ করে। এছাড়াও আদিম জনজাতির মানুষদের সাথে সুসম্পর্ক স্থাপনের প্রয়াসে জঙ্গল সন্নিহিত বিভিন্ন স্থানে কুটির নির্মাণ করে প্রধানত গেট আন্দামানিজদের জন্য এবং বিভিন্ন কল্যাণ মূলক কার্যক্রম পরিচালিত করে।         
🍂

  পূর্বেই উল্লেখ করেছি দ্বিতীয় দফায় কয়েদী উপনিবেশ চাত্থাম দ্বীপ থেকে জলকষ্টের জন্য রস আইল্যান্ডে স্থানান্তরিত করা হয়েছিল। কিন্তু প্রথম জেলখানা ও ফাঁসির মঞ্চ স্থাপিত হয়েছিল ভাইপার দ্বীপে। ভাইপার দ্বীপের নিচু এলাকা গুলি মাটি ভরাট দিয়ে সমতল করে তার উপরে ইটের দেওয়াল ও কংক্রিটের ছাদ নির্মাণ করে চারটি ছোট জেলখানা এবং একটি বড় জেলখানা তৈরি করা হয়। দ্বীপের সর্বোচ্চ অংশে লাল রং করা ফাঁসির মঞ্চ করা হয়েছিল যাতে ফাঁসির সময় দূর থেকে সকলের দৃষ্টিগোচর হয়। বিদ্রোহী সিপাহিদের অসীম সাহস ও লড়াকু মানসিকতাকে বশে আনার জন্য জেলখানাতে বন্দীদের পায়ে শিকল পরানো থাকতো যাতে তারা পালিয়ে যেতে না পারে। এই শিকলের আওয়াজ বহুদূর থেকে শোনা যেত। সর্বক্ষণ পায়ে শিকল পরিয়ে রাখার জন্য তাদের পায়ে ক্ষতের সৃষ্টি হতো। এই অবস্থাতেও তাদের কঠোর কায়িক পরিশ্রম করানো হতো এবং যে বন্দী সেই অবস্থায় কায়িক পরিশ্রম করতে অস্বীকার করতে তাদের নির্মম ভাবে বেত্রাঘাত করা হতো অথবা অন্যান্যভাবে শাস্তি দেওয়া হতো। এছাড়াও বিনাচিকিৎসায় তাদের পায়ের ক্ষত স্থান বিষাক্ত হয়ে বিকলাঙ্গ হয়ে পড়তো অথবা মৃত্যুমুখে পতিত হত।          
দীর্ঘ চল্লিশ বৎসরে বন্দীর সংখ্যা কয়েকগুণ বৃদ্ধি পাওয়াতে, চিকিৎসার পরিকাঠামো না থাকাতে এবং পুরুষ ও মহিলা বন্দীদের একত্রে রাখা ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বন্দীদের থাকার প্রতিবিধানের নিমিত্তে ১৮৯০ সালে তিন সদস্যের এক কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী বিভিন্ন ব্যবস্থা উপনিবেশ কর্তৃপক্ষ অবলম্বন করে। সুপারিশ অনুযায়ী ১) মহিলা বন্দীদের পোর্ট ব্লেয়ারের এ্যবারডিন এলাকার কাছাকাছি সাউথ পয়েন্ট এলাকাতে টিনের ছাউনি দেওয়া একটি গৃহে বন্দী করে রাখার ব্যবস্থা হয়েছিল। ২) হ্যাডোতে একটি পৃথক জেলখানা স্থাপন করা হয়েছিল ৩) প্রথম ছয় মাস বন্দীদের রস আইল্যান্ডের নিকটস্থ পোর্টব্লেয়ারে রাখার জন্য সেলুলার জেল নামে একটি নূতন জেলখানা স্থাপনের বিশেষ প্রয়োজন অনুভূত হয়। ৪) বন্দীদের তত্ত্বাবধান করার জন্য এই সেলুলার জেলে একজন অভিজ্ঞ ও দক্ষ কারাধ্যক্ষ নিয়োগের সুপারিশ করা হয়। এই কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী ব্রিটিশ সরকার কয়েদি উপনিবেশের অধীক্ষকে ৬০০ কক্ষ বিশিষ্ট সেলুলার জেল নির্মাণের প্রয়োজনীয় স্থান নির্বাচন এবং কারাকক্ষ নির্মাণের পরিকাঠামো তৈরীর আদেশ দেন। দক্ষিণ ভারতের কান্নানোর জেলের সেলের মাপ অনুযায়ী সেলুলার জেলের কক্ষগুলি সাড়ে তেরো ফুট লম্বা ও সাড়ে সাত ফুট চওড়া করা হবে বলে স্থির করা হয়। উচ্চতা ১৫ ফুট এবং বাতাস চলাচলের জন্য মেঝে থেকে ৯ ফুট উঁচুতে এক ফুট চওড়া ও তিন ফুট লম্বা মাপ বিশিষ্ট গবাক্ষ থাকবে। প্রত্যেকটি সেলের সামনে লোহার গরাদের দরজায় একটি 'বোল্ট' কয়েক ইঞ্চি দূরে দেয়ালের মধ্যে এক গর্তের ভিতরে ঢুকিয়ে তালা দেওয়ার ব্যবস্থা থাকবে যাতে বন্দীরা গরাদের ফাঁক দিয়ে কোনভাবে তালার নাগাল না পায়। কারা কক্ষগুলির সামনের দিকে চার ফুট চওড়া একটি বারান্দা থাকবে। সেলুলার জেলে বন্দীদের জন্য ৬৯৬ কক্ষ বিশিষ্ট সাতটি ডানা বা উইং থাকবে এবং এই ডানাগুলি এক কেন্দ্রস্থলে মিলিত হয়ে একটি সেন্ট্রাল টাওয়ারের সাথে যুক্ত থাকবে। তিন তলা বিশিষ্ট সাতটি উইং বা ডানাগুলি যেখানে মিলিত হয়েছে সেখানে একজন রক্ষী সেন্ট্রাল টাওয়ারের প্রতিতলার থেকে সাতটি উইংকে কড়া নজরদারিতে রাখবে। সাতটি উইংয়ের জন্য রাত্রে একজন করে মোট ২১  জন ওয়ার্ডেন তিন ঘন্টা অন্তর পালা করে পাহারাতে নিযুক্ত থাকবে। জেলখানার মূল ফটকের সামনে একজন সশস্ত্র প্রহরী এবং অপর একজন সশস্ত্র রক্ষী সেন্ট্রাল টাওয়ারের সর্বোচ্চ তলায় এবং তৃতীয় জন সশস্ত্র রক্ষী জেলখানার মূল প্রবেশদ্বারের ছাদে থাকবে যাতে সমগ্র জেলখানাটিকে কড়া নজরদারিতে রাখা যায়।     
কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী দুটি স্থান নির্বাচিত হয়েছিল সেলুলার জেল স্থাপনের জন্য প্রথমটি পাহাড় ও পথের আপুর এর মধ্যে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১০০ ফুট উঁচুতে অবস্থিত যার আয়তন দৈর্ঘ্যে ১৩৫০ ফুট এবং প্রস্থে ৩৩০ ফুট। দ্বিতীয় স্থানটি হল পোর্ট ব্লেয়ারের আটলান্টা পয়েন্ট, যার দৈর্ঘ্য ৭৯০ ফুট এবং প্রস্থ ২৩১ ফুট। এই স্থানটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৭৫  ফুট উঁচুতে। উপনিবেশের অধীক্ষক দুটি স্থান পরিদর্শন করে দ্বিতীয় স্থানে সেলুলার জেল স্থাপনের পক্ষে মত প্রকাশ করেন। উপনিবেশের দ্বিতীয় অধীক্ষক কর্নেল এন, এস, হর্সফোর্ড তার মত ব্যক্ত করেছিলেন যে ভূমিকম্প প্রতিরোধে তিনতলাবিশিষ্ট জেলখানার থেকে দ্বিতল বিশিষ্ট কারাকক্ষ উপযোগী। দুজন অধীক্ষকের প্রতিবেদন পাওয়ার পর কমিটির অন্যতম সদস্য ইন্সপেক্টর জেনারেল অব প্রিজন্স, ডাক্ আলফ্রেড সোয়েন লেথব্রিজ তার মতামত ব্যক্ত করে বলেছিলেন - সেলুলার জেলের স্থান নির্বাচনের ব্যাপারে আটলান্টা পয়েন্টের অবস্থান সঠিক। কমপক্ষে ৬০০ কক্ষ বিশিষ্ট বন্দীনিবাস হবে এবং এক ব্লকের বন্দী অন্য বন্দীদের থেকে বিচ্ছিন্ন থাকবে। বন্দীদের দৈনন্দিন কাজকর্ম কড়া নজরদারির মধ্যে প্রত্যেক ব্লকের সামনের মুক্ত এলাকাতে হবে। মূল প্রবেশদ্বারের থেকে সামান্য ভিতরে একটি রান্নার জায়গা থাকবে যেখানে সমস্ত বন্দীদের খাবার প্রস্তুত হবে। জেলের ভিতরে একটি ছোট আকারের হাসপাতাল থাকবে।‍ জটিল ও মুমূর্ষু রোগীদের জেলখানার বাইরে হ্যাডো হাসপাতালে চিকিৎসা হবে। জেলখানার মুখ্য দেয়ালের উচ্চতা কমপক্ষে ১৫ ফুট করা দরকার। মূল প্রবেশদ্বার এ্যবারডিন জেটীর কাছাকাছি থাকবে। উপনিবেশের দ্বিতীয় অধীক্ষক কর্নেল হর্সফোর্ড এবং ডঃ লেথব্রিজের পরামর্শ ও সুপারিশ মেনে ব্রিটিশ সরকার ১৮৯৩ সালে সেলুলার জেল স্থাপনের নির্মাণ কার্যের নির্দেশ দেন। ১৮৯৬ সালে নির্মাণকার্য শুরু হয়ে পরের দশ বৎসরে অর্থাৎ ১৯০৬ সালে এর নির্মাণকার্য শেষ হয়। সেই সময়ে মোট ৫ লক্ষ ১৭ হাজার ৩৪২ টাকা ব্যয় করে সাত ডানাওয়ালা ত্রিতল বিশিষ্ট এই জেলখানা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাসে মাত্র ৩৬ বৎসর পরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপান কর্তৃক আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ দখল করার পরে জেলখানার দুটি ডানাকে ভেঙে সেখানে জাপানি সৈন্যদের থাকার ব্যারাক তৈরি করা হয়েছিল। পরবর্তীকালে ১৯৫৬ সালের পরে আন্দামান প্রশাসন আরও দু'টি ডানাকে ভেঙে সেখানে পন্ডিত গোবিন্দ বল্লভ পন্থের নামানুসারে একটি হাসপাতাল নির্মাণ করেন বর্তমানে সেলুলার জেলের অবশিষ্ট তিনটি ডানার কয়েদী কক্ষগুলি অবশিষ্ট আছে। সাতটি উইংয়ে কিন্তু কারাকক্ষের সংখ্যা সমান ছিল না। একটি উইংয়ে সর্বাধিক কারাকক্ষ ছিল ১৫০ এবং সর্বনিম্ন ৬০টি। জেলখানার মূল প্রবেশদ্বারের ডান দিকে মুক্ত পরিসরে বন্দীদের ফাঁসি দেওয়ার তিনটি মঞ্চ ছিল। প্রত্যেক উইংয়ের সামনের প্রাঙ্গণে ১৫ফুট x ১.৫ ফুট মাপের চৌবাচ্চাতে জেলের বাইরের একটি বড় চৌবাচ্চা থেকে জল এনে ভর্তি করা থাকত বন্দীদের ব্যবহারের জন্য। বড় চৌবাচ্চাটি পাম্পের সাহায্যে সমুদ্রের জলে ভর্তি করে রাখা হতো। প্রতি ছয়জন বন্দীর জন্য একটি করে পায়খানা ছিল যেখানে মলত্যাগের জন্য পাঁচ মিনিট সময় বরাদ্দ ছিল। ফাঁসির মঞ্চের কাছে দুটি পৃথক রান্নাঘর ছিল হিন্দু ও মুসলমানদের জন্য।     
                                                     
(পরবর্তী অংশ দশম পর্বে)

Post a Comment

2 Comments

  1. AnonymousJune 23, 2023

    অনেক নূতন কথা জানতে পারছি।

    ReplyDelete
  2. আশীষ ভট্টাচার্যJune 23, 2023

    আগের পর্ব গুলো কি পেতে পারি তাহলে খুব ভালো লাগতো।

    ReplyDelete