জ্বলদর্চি

মনের বিকার /মিলি ঘোষ

মনের বিকার
মিলি ঘোষ

বেশ কয়েক বছর আগের কথা। যারা যারা শুনেছেন, সে যে মাধ্যম থেকেই হোক ভুলে যাবার কথা নয়।

 একটি বাচ্চা বাবার সাথে সার্কাস দেখতে গিয়েছিল। একদম প্রথম সারিতেই বাবার পাশে বসেছিল সে। সার্কাস চলছিল সার্কাসের মতোই। বাঘের খেলা চলছিল তখন। হঠাৎ একটি বাঘ রিং মাস্টারের চাবুককে তোয়াক্কা না করে ঝাঁপিয়ে পড়ে সেই ছেলেটির ওপর। বাবার কোল থেকে ছিনিয়ে নিয়ে যায় শিশুটিকে। 
ততক্ষণে সার্কাসের তাবুতে হৈ হৈ তাণ্ডব শুরু হয়ে গেছে। প্রাণ বাঁচাতে দর্শকদের পড়িমরি ছুট। রিং মাস্টারও হয়ত বাঘটিকে কব্জা করেছেন। শিশুটিকে বাঘের মুখ থেকে উদ্ধারও করা হয়েছে। কিন্তু সে বাঁচেনি।

শুনেছিলাম এরপর সার্কাসে হিংস্র ( যদিও হিংস্র শব্দটিতে আমার আপত্তি আছে ) জন্তু নিয়ে খেলা দেখানো বন্ধ করার একটা প্রস্তাব এসেছিল। পরে সেটা কতটা কার্যকরী হয়েছে জানি না। দর্শকশূন্য গ্যালারিতে একা সেই হতভাগ্য বাবা কী করেছিলেন সে খবর আমরা পাইনি। শিশুটির বাবা, মা বা বাড়ির অন্য সদস্যরা বাকি জীবনটা কীভাবে পার করছেন তাও আর খবরে আসেনি। শিশু মৃত্যু এ দেশে নতুন কিছু নয়। তাই বলে এইভাবে ? পুরো বিষয়টাকে একটা ভয়ঙ্কর অ্যাকসিডেন্ট বলা গেলেও আসলে সেটা ছিল ইনসিডেন্ট। সব অ্যাকসিডেন্টই ইনসিডেন্ট। সব ঘটনাই মনুষ্যসৃষ্ট।
🍂

মনুষ্যসৃষ্টই যখন, দোষ তো কারোর আছেই। দোষী সাব্যস্ত করার সহজতম জায়গা হোল শিশুটির বাবা। নানারকম প্রশ্ন চারদিক থেকে ধেয়ে আসতে পারে। এসেওছে হয়তো। সান্ত্বনার বাণী উজাড় করতে এসে উপদেশ দিয়ে গেছে বিনা পয়সায়। 
কী দরকার ছিল একেবারে প্রথম সারিতে বসে সার্কাস দেখার। অথবা জানোই যখন বাঘ ভাল্লুকে খেলা দেখাবে, একটু পেছনের দিকে বসলেই হতো ইত্যাদি ইত্যাদি।
 
চেয়ার তো আর খালি থাকত না, ওই টিকিটে কেউ না কেউ বসতই। তখন প্রাণ যেত অন্য একটি বাচ্চার। কারণ সার্কাস দেখতে ছোটরাই যায়, বড়রা তাদেরকে সঙ্গে করে নিয়ে যায়। তাহলে কি দোষ রিং মাস্টারের ? গালাগাল তাকেও কম খেতে হয়নি। মালিক থেকে চেনা পরিচিত সকলেই তার সঙ্গে গলায় মধু ঢেলে কথা বলেছেন নিশ্চয়ই। চাকরিটাও গেছে কি না কে জানে! অভিযোগের তীর তাঁর দিকেও ছুটে এসেছে। 
দায়িত্বজ্ঞানহীন। বাঘ নিয়ে খেলা দেখান আর ঠিক মতো ট্রেনিং দিতে পারেননি ? বা হয়তো আরও মধুর কিছু। 
কিন্তু তিনি তো রোজই খেলা দেখান, কোনওদিন তো এরকম হয়নি। তাহলে ম্যানেজার নিশ্চয়ই কম খাবার দিয়েছে বাঘকে। ক্ষুধার্থ বাঘ পেটের জ্বালায় এ কাজ করেছে। সুতরাং দোষ ম্যানেজারের। তাঁর চাকরি নিয়ে টানাটানি হওয়ারও একটা সম্ভবনা থেকে যাচ্ছে। যদি খবর নিয়ে জানা যায় ম্যানেজার অন্যদিন যা খাবারের ব্যবস্থা করেন, সেদিনও তাই করেছেন তাহলে কি বুঝতে হবে, দোষ বাঘের ? 
এমন হিংস্র প্রাণী, একটা দুধের শিশুকে নিয়ে গেল মুখে করে! একটু মায়া দয়া নেই ?
 
বাঘ তো আর মানুষের মতো কথা বলতে পারে না। আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য কোনও যুক্তিও দেখাতে পারে না। 
পারলে হয়তো বলত, 
        জঙ্গলে জন্ম আমার। খাদ্য খাদক সম্পর্কের জেরে অন্য প্রাণী মেরেই খাই। আমাকে জোর করে যেখানে আটকে রেখেছ, সেটা জঙ্গল নয় ? এখানে রিং মাস্টার কখোনো আমাকে টুলে উঠতে বলে। কখনো দু'পায়ে দাঁড়াতে বলে, হাঁটতে বলে। চাবুক মেরে জ্বলন্ত রিংয়ের মধ্যে জাম্প করতে বাধ্য করে। আমাকে বেছে নিতে হয় যে কোনও একটা। হয় জ্বলন্ত রিং। নয়তো চাবুক। আগুন নেভে, তবু চাবুক থামে না। বিনিময়ে আমি কী পাই ? পেটের টানে আমি এ কাজ করি। আমরা বাঘের জাত। শিকার করে খেতে জানি। তোমাদের এই জঙ্গল থেকে আমি শুধু আমার শিকারটুকু খুঁজে নিয়েছি।

কী উত্তর দেব আমরা বাঘকে ? নাকি কাব্যি করব ? "বন্যেরা বনে সুন্দর। শিশুরা মাতৃক্রোড়ে।"

বাঘ, সিংহের কথা ছেড়েই দিন। পাখিকে খাঁচায় বন্দী করে দানা আর জল খাওয়াচ্ছেন। পাখির খিদে মেটে। তৃষ্ণা নিবারণ হয়। কিন্তু স্বাধীনতা ? পাখির ডানাদুটো কি ছোট্ট খাঁচার মধ্যে জীবন কাটানোর জন্য ? সেলুলার জেলে বন্দী একজন মানুষের সঙ্গে পাখির তাহলে তফাৎ কোথায় ? মানুষ, পাখি হওয়ার স্বপ্ন দেখে। আবার মানুষই পাখিকে খাঁচায় আটকে রাখে। কোনওদিন দেখেছেন, রাস্তা দিয়ে পাখি হেঁটে হেঁটে যাচ্ছে ? কারণ, রাস্তাটা পাখিদের হাঁটার জন্য তৈরি হয়নি। ওদের জন্য আছে অন্তহীন আকাশ। সেটা ওদের থেকে কেড়ে নেবার অধিকার আমাদের নেই। অথচ আমরা বুদ্ধি আর শারীরিক বল প্রয়োগ করে পাখিদের খাঁচায় ধরে রাখি। কেন না, তা আমাদের আনন্দ দেয়। আমাদের চোখের আরাম, মনের সুখ। আপনারা, যারা পাখি পুষে তৃপ্ত হন, তাঁদের পা দুটো যদি এমন ভাবে বেঁধে রাখা হয়, যাতে তাঁরা হাজার চেষ্টা করেও হাঁটতে না পারেন। তাহলে কেমন হয় ? ভেবে দেখেছেন ? হ্যাঁ, আপনার খাদ্য পানীয়ের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা থাকবে। শুধু হাঁটতে দেওয়া হবে না। একটু ভাবুন তো চোখ বন্ধ করে। 
বন্যেরা বনে সুন্দর। পাখিও আকাশে সুন্দর। আর শিশু? সে তো মাতৃক্রোড়ে!
পেটের সঙ্গে যাদের প্রত্যক্ষ লড়াই, সেই সব শ্রমজীবি মা'দের কথায় আসি। সামনে থেকে বা ছবিতে অনেক সময়ই দেখা যায়, পিঠে নয়তো বুকে বাচ্চাকে বেঁধে মা মাঠে, ঘাটে কাজ করে চলেছে। বাচ্চাটি হয় ঘুমিয়ে থাকে, নয় চুপ করে থাকে। কখনও ঘ্যান ঘ্যান করতে দেখা যায় না। এই বাচ্চা যদি কন্যা সন্তান হয়, তাহলে সে'ও মা হয়ে তার বাচ্চাকে পিঠে বেঁধেই মাথায় ইট বইবে। চাষের কাজ করবে। 
এদের নিয়ে গল্প উপন্যাস লেখা হবে। সিনেমা তৈরি হবে। লেখক, পরিচালক, অভিনেতারা প্রাইজ পাবেন। আমরা বই পড়ে, সিনেমা দেখে ধন্য হব। ফেসবুকে রিভিউ দেব। আমাদের রিভিউ পড়ে বই পড়ার জন্য বা সিনেমা দেখার জন্য মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়বে। ব্যবসা দাঁড়িয়ে যাবে। 
শিশু দিবসে এই ধরনের ছবির কাটতি খুব বেশি। মায়ের পিঠে ঘুমন্ত শিশুর ছবি পোস্টালে লাইক, কমেন্ট বাড়ে। কারণ, শিশুরা সুন্দর মাতৃক্রোড়ে! এই সৌন্দর্যের পেছনে কত ঘাম ঝরেছে, কত রক্ত জল হয়েছে, হয়ে চলেছে তার হিসেব কিন্তু আমরা রাখি না। কেউ রাখি না। সংসার, সমাজ, রাষ্ট্র কেউ না। এই দৃশ্য কি সত্যিই আমাদের চোখকে আরাম দেয় ?

শুরুতে বলেছিলাম, বন্য জন্তুকে হিংস্র জন্তু বলাতে আমার আপত্তি আছে। মানুষ ছাড়া বাদ বাকি কোনও প্রাণী হিংস্র হতে পারে না। প্রত্যেক জীব অন্য জীবের ওপর নির্ভরশীল। এখানে হিংস্রতার কী আছে ? বাঘ সিংহ অন্য প্রাণীকে মেরে খাবে, এটাই স্বাভাবিক। 
হিংস্র তো মানুষ। তার মনের মধ্যেই তো যাবতীয় হিংসা জমা থাকে। যারা সংযমী, তাদের ওপর থেকে বোঝা যায় না। কিন্তু যাদের হিংসা মাত্রা ছাড়ায় তাদেরটা প্রকাশ পায় ভালো রকম। এই হিংসার জেরে মানুষ, মানুষের অনেক ক্ষতি করে। এমন কি খুন পর্যন্ত করতে পারে। এই উগ্রতা যাদের মধ্যে আছে, হিংস্র তারাই। বাঘ, সিংহ নয়।

Post a Comment

2 Comments

  1. AnonymousJune 15, 2023

    ভালো লিখেছেন।

    ReplyDelete
  2. AnonymousJune 15, 2023

    একদম সত‍্যি কথা। পড়ে খুব ভালো লাগলো।

    ReplyDelete