বুথের গল্প
সৌমেন রায়
ভুতের গল্প তো ছোটবেলায় অনেক শুনেছেন একটু বুথের গল্প শুনুন, খারাপ লাগবে না। ইলেকশন কমিশন না বরাবরই আমায় খুব স্নেহ করে। প্রতিটি ছোট বড় অনুষ্ঠানে আমার ডাক পড়বেই।এই তো এবার পঞ্চায়েত ভোটে কোন ফাঁক গলে বাদ পড়ে গিয়েছিলাম। তারপর ট্রেনিং এর আগের দিন মেসেজ, হোয়াটসঅ্যাপ, মেল, ফোন কত ভাবে যে দুঃখ প্রকাশ করে ডাকলো সে আর কি বলব! আমি বললাম নিমন্ত্রণ পত্র তো পাইনি। বলল মেনু কার্ডের সঙ্গে দিয়ে দেবো আপনি আসুন না। অগত্যা ট্রেনিং। এখন ইউটিউবে 'কিভাবে শৌচ করতে হয়' থেকে 'কিভাবে ব্যালট বাক্স সিলিং করতে হয়' সব পাওয়া যায়। তাই ট্রেনিংয়ে আর কেউ শোনে না। সই করে, পঞ্চায়েত সমিতির বাক্সের ফুটোতে মধ্যমা গুঁজে খানিক টানাটানি করে( বাক্স খোলার পদ্ধতি) ফিরে এলাম।অভিযানে যাওয়ার আগের দিন কতো করে মা কালীকে বললাম চোখে জয়বাংলা করে দাও মা।শুনলে না।জানি শুনতে দেরি হবে।ফিরে এলে হবে।যাইহোক এবার একটু কাছে ডিউটি পড়ায় দুটো ভাত খেয়ে যেতে পেরেছিলাম। সব বার তেমন সৌভাগ্য হয় না। বউ আবার দুটো পরোটা করে দিল দুপুরের জন্য। এই দিনগুলোতে বউকে যে কি ভালো লাগে না! গিয়ে দেখি ফার্স্ট পোলিং এসে গেছে। থার্ড পোলিং এলো একটু পরেই। মালপত্র সব নিয়ে বাকি দুজনকে ফোন করলাম। সেকেন্ড পোলিং বলল এই স্যার বের হচ্ছি।ফোর্থ পোলিং বললো খাচ্ছি। বারো কিমি দূর থেকে সেকেন্ড পোলিং দু ঘন্টা পরে যখন হাজির হলেন বুঝলাম তিনি তখন বাথরুম থেকে বেরোচ্ছিলেন। সে যাই হোক বারোটার মধ্যে সবাইকে পেয়ে যাওয়া মানে পরম সৌভাগ্য। একজন কেউ না এলে ট্যাগাট্যাগি করতেই বিকেল। ট্রেনিং মোতাবেক কিছু মেটেরিয়ালস না পেয়ে কাউন্টারে গিয়ে বললাম।এক গোঁফ দাড়ি মুন্ডিত ব্যাক্তি বললেন যা আছে তাই নিয়ে কাজ চালিয়ে নেন। বুঝলাম এটিই এবার পঞ্চায়েতের ট্যাগলাইন।যেভাবে হোক বাক্স জমা করলেই হবে।কিন্তু কথা বলার সময় স্পষ্ট দেখলাম লোকটার ইয়া বড় গোঁফ।চোখের ভুল বোধহয়!
এরপর পুলিশ ট্যাগিং। এটা একটা পারফেক্ট লটারি। রোদে গরমে পাঁচশ মিটার হেঁটে পঞ্চাশ মিনিট লাইনের দাঁড়িয়ে কাকে পাবেন তা দেবতাও জানে না। একবার এক বন্দুকধারীকে বলেছিলাম আপনার ভরসাতেই বুথে যাচ্ছি। তিনি বললেন আমি কাশীপুরে গান ফ্যাক্টরির স্টাফ। জয়নিং এর সময় সাত দিনের একটা আর্টিলারি ট্রেনিং হয়েছিল। আর জীবনে কোনদিন বন্দুক ধরিনি।প্রবলেম হলে আমি প্রথমে পালাবো। খানিকক্ষণ তার মুখের দিকে নিঃশব্দে তাকিয়ে বলেছিলাম,' যাওয়ার আগে একবার ডাকবেন’।আর একবার পেলাম এক সদ্যবিবাহিত মহিলা । পৌঁছানোর পর মস্ত এনফিল্ড নিয়ে ভটভট করে এক তাগড়া যুবক হাজির। পুলিশ বোনটি বলল স্যার আমি বাড়ি যাবো। বললাম যাচ্ছেন যান কিন্তু রাত জাগবেন না, সকাল সকাল আসবেন। সব বার অবশ্য তেমন হয় না। কেশপুরে সেবার খানিক গোলমালের আভাস পেয়ে সেন্ট্রাল ফোর্স এর চারজন এসে বলল, 'স্যার আপ আপনা কাম কিজিয়ে। হাম চার আদমি চারশো কা পাঙ্গা লে সাকতা হে’। চারশোর পাঙ্গা নিতে হয়নি, তাদের পজিশন নেওয়া দেখে সব হাওয়া।মাওবাদীদের রমরমার সময়ে আমার এক সহকর্মীর পড়েছিল মাওবাদী এলাকায়। সকালে ' খালি ' করার সময় দশ ফুট দূরে তাকে ঘিরে রেখেছিল চোদ্দ জন সিআরপিএফ জওয়ান। তার কথা অনুযায়ী,' স্পষ্ট বুঝতে পারছি জিনিসটা বৃহৎ অন্ত্র বেয়ে নিচে না নেমে ক্ষুদ্র অন্ত্র বেয়ে উপরে উঠে যাচ্ছে’।আমরা এবার পেলাম এক যুবক পুলিশ।ভয়, ভরসা কিছুই পেলাম না। আমরা এই দুদিনের জন্য যোগী। সুখে ,দুঃখে বিগতস্পৃহ।নিজেদের ব্যাগ, চারটে বক্স, দুটো বস্তা( পোলিং মেটেরিয়াল) নিয়ে ছোট গাড়ি- বড় গাড়ি - হন্টন করে পৌছালাম বুথে। দেখেই মনটা দমে গেল। একটা ছোট বদ্ধ ঘর, চারিদিক নোংরা। দুটো দিন কাটাবো কি করে এটাই বড় কথা, আর ছোট কথাটা হলো এখানে বাচ্চারা ক্লাস করে কি করে? এই পরিবেশে মানসিক বিকাশ সম্ভব? রুমে ঢুকে বিদ্যাসাগরের অবস্থা দেখে মনটা একটু শান্ত হল। ওনার যদি এই অবস্থা হয় তাহলে আর আমার এমনকি, ঠিকই আছে। সত্যি কথা বলতে কি এতো করুন অবস্থা আগের কোনো ভোটে দেখিনি।স্কুল বিল্ডিং গুলির এখন খুব খারাপ অবস্থা নয়।রুমে লাইট টিমটিম করছে কিন্তু ফ্যান চলছে পন পন্ করে। হাওয়া হোক না হোক এখনের ফ্যান গুলো ঘুরে বেশ জোরে,যুগধর্ম মনে হয়। উপস্থিত হলেন মাথায় ছয় ইঞ্চি কাটার দাগ নিয়ে লাল বাবু।কিসের কাটা জিজ্ঞেস করার সাহস হয়নি। সহৃদয় ব্যাক্তি,জল টলের ব্যাবস্থা করলেন। দুটো মুড়ি, চিড়া পেটে ফেলে কাজ চলছে। অজস্র সই সাবুদ, অনাবশ্যক ফর্ম পূরণ। এগিয়ে না রাখলে সম্ভব নয়। সকলেই সহযোগিতা করছেন, এ এক বিরাট পাওনা। সববার এমনটা হয় না। মাঝে মাঝে পোলিং এজেন্টরা আসছেন, দেখা করছেন। বলছেন ,'খুব শান্তিপূর্ণ জায়গা স্যার। কোন গোল হবেনা ‘। এনারা ভোটের প্রচারে মাইক ব্যবহার করেছিলেন কিনা জানিনা এখন তো সকলকে অমায়িক লাগছে।ভোট কর্মী মাত্রই জানেন এসব সম্পর্কই fragile, handle with care। ভোটের গতি প্রকৃতির উপর নির্ভর করে এদের চোখ মুখের ভাষা পাল্টে যাবে। তেমন তেমন জায়গা হলে 'এক ছোবলে রাজকুমার’! রাতে এলো বিরিয়ানির অফার। এসব সবিনয়ে প্রত্যাখ্যানই নিয়ম। মাঝে সেক্টর অফিসার দেখা করে বলে গেলেন কাল চার জন সেন্ট্রাল ফোর্স আসবে আর একটা বাড়তি ভোটিং কম্পার্টমেন্ট দিয়ে যাবেন ।এসব কথা আমরা শুনে শুনে অভ্যস্ত। ফিসফিস করে বললাম ,'ডিলা গ্রান্ডি ম্যাফিস্টোফিলিস ইয়াক ইয়াক!' সেক্টর অফিসার বললেন ,'কি?' আমি বললাম , 'ওই সেন্ট্রাল ফোর্স পাঠিয়ে ফোনটা করবেন'।সে ফোন আসেনি। আমরা কেউ কিছু মনেও করিনি। একান্ন বছর কাটলো কেউ কথা রাখেনি, আর সেক্টর অফিসার! আদালতে তো বলেছিল সব বুথে সেন্ট্রাল ফোর্স দিতে হবে। কে কার কথা শুনে। আমরা সবাই রাজা, কারো কথা শুনতে অভ্যস্ত নই। কাজ গুছিয়ে যাহোক কিছু পেটে দিয়ে শোওয়া।তার আগে মশারি খাটানো। সে এক মজাদার পর্ব। এর দড়ি ওর দড়িতে, ওর দড়ি তার দড়িতে, শেষে একপ্রান্ত ইটে জড়িয়ে। মশারির জ্যামিতি সাধারণ সমতলীয় জ্যামিতি দিয়ে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়,লাগবে ডিফারেনশিয়াল জ্যামিতি। মশারি খাটিয়ে প্রতিবার দরজা লাগাতে গিয়ে দেখি দরজায় ছিটকিনি নেই। স্কুল বাড়িতে তা থাকার কথাও নয়। অগত্যা দরজায় চেয়ার ঠেকিয়ে অতিমুল্যবান সব গণতন্ত্রের দলিল নিয়ে 'কঠোর নিরাপত্তার' মধ্যে শুয়ে পড়া। কিন্তু শুলেই তো তো আর ঘুম হবে না। প্রতি সাড়ে সাত মিনিটে সাড়ে তিনবার টর্চ জ্বেলে দেখি গৃহকর্তা আপ্যায়নে বের হল কিনা। মানে ওই কালাচ, কেউটে, চন্দ্রবড়া আরকি। আসলে তো ওদেরই ঘর আমরা একদিনের অতিথি মাত্র।বহুক্ষণ চাঁদ সওদাগর কে গাল দিতে দিতে কখন জানিনা ঘুম ধরে গেছে। বেশ একটু মৃদু মন্দ হাওয়া বইছে।বাইরে মোরগের ডাক, ভোর হলো মনে হয়! ঘুম ঘোরে পাশ ফিরে জড়িয়ে ধরতে গিয়ে দেখি হায় বাবা এ তো ফোর্থ পোলিং! বেচারি মশারি আনেনি। মশার জ্বালায় ঢুকে পড়েছে আমার মশারিতে। এমন রাতে দুরাগত ‘ বোমধ্বনি' আর পোড়া সালফারের গন্ধ অনেকেই পান। সেই সৌভাগ্য আমার এখনো হয়নি। ঘড়িতে দেখলাম সাড়ে চারটা। ওঠার সময় হয়ে গেছে। উঠে অগ্রসর হলাম বাথরুমের দিকে। ভাবলাম শুকনো প্যানে কাজটা সারবো। পাস থেকে সাৎ করে বেন জনসন এর মতো বিট করে কেউ একটা বালতির দখল নিল।ফার্স্ট পোলিং। ওনার হলে ভিতরে ঢুকে টর্চ টিপলাম ( আলো তো কোথাও থাকে না)। দেখি 'মাল' যায়নি। টর্চ বন্ধ করে বসে পড়লাম। চোখ এড়ানো গেলে কি হবে নাক বললো ফার্স্ট পোলিং এর অম্বল করেছে । নিজের মাল খালাস করে জল দিয়ে টর্চ ফেলে দেখি একই অবস্থা। মাল যাবার রাস্তা বন্ধ। তারমানে স্যান্ডউইচটি বেশ পুরু হবে। মোট ছয় জন আছে তো! স্নান করে সাড়ে পাঁচটায় মুড়িতে জল ঢাললাম। মেদিনীপুরের ছেলেদের এটা একটা সুবিধা। মুড়িতে জল ঢেলে খেতে পারে। অন্যরা কি করে জানিনা। এখানে আরো সুবিধা হল কিছু কিছু স্থান ছাড়া ‘নকুলদানা’, 'গুড়বাতাসা’ র চল কম। মহামান্য এজেন্টরা দয়া করে যখন এলেন তখন ঘেমে নেয়ে আধ ঘন্টা ধরে চলল সিলিং পর্ব। সিলিং হচ্ছে কাঠের বেড়ায় গোদরেজের তালা দেওয়ার ব্যবস্থা। ভোট চলল আপন গতিতে। শুধুমাত্র নিজের দক্ষতায় নাকি এখন চাকরি জোটানো খুব মুশকিল, তেমনি ভোটের গতি বাড়ানোও মুশকিল। ভোটার তিনটি কাগজে তিনবার ছাপ মেরে, তিনটি আলাদা বাক্সে ফেলতে সময় নেয়। কিন্তু দোষ হয় 'শালা ভোটকর্মী র ', রামের বুথ স্লিপ শ্যাম নিয়ে এসে ভোট দেয়, (কমিশনের পরিচয় পত্র দেখে চিনতে গেলে আশি শতাংশ বাতিল হয়ে যাবে) দোষ হয় 'শালা ভোটকর্মী র’। আগের দিন রাতে গিয়ে আমাদের উচিত ছিল বুথের আটশো ভোটার কে চিনে নেওয়া, হয়ে ওঠেনি। আমাদেরই দোষ। এক বুড়ি টরটর করে হেঁটে এসে বললেন আমি দেখতে পাই না, আমার ভোটটা ও দেবে।। 'হাইলি সাস্পিসাস’, 'কালটিভেট' করার ইচ্ছে হলেও ‘ অন্তরে আজ দেখবো এমন সময় নাহি রে '। এক একটা বুথে তো মনে হয় গোটা গ্রামটাই অন্ধ ও অশক্ত। প্যারালাইসিস রোগীও ভোট দিতে আসে, গণতন্ত্রের কি মহিমা! সত্যি সব অন্ধ ও অশক্ত কিনা বোঝার দক্ষতা আমার নেই। বেশি বুঝতে গেলেও সমস্যা। জল বন্ধ হয়ে যাবে। প্রশাসনকে বললে জল নিশ্চয়ই দেবে তবে সন্ধে হতে পারে। ততক্ষণ নিজ শিবাম্বুই ভরসা। বহু মানুষ ভোট দিতেই জানেনা, ব্যালট বাড়িয়ে বলে দেখিয়ে দে । কেউ ভাজ করা কাগজের উপরেই ছাপ দেয়, ফেলে ভুল বাক্সে। সকালেই কিছু তুরীয় অবস্থাপ্রাপ্ত ভোটার আসে। আসলে আগের রাতের নেশা কাটার আগেই তাদের ভোটটা দিয়ে দিতে হয়। নেশা কেটে গেলে কি করবে জানা নেই। এরপরও আমরা সফল বৃহত্তম গণতন্ত্র। জয় গণতন্ত্র মায়ের জয়।মহামান্য কমিশন ভোট কর্মীদের খাওয়া দাওয়া টাকে অতিরিক্ত বলে মনে করেন। তাই ভোটের দিন খাওয়ার কোন সময় নেই। শুধু মধ্যাহ্নভোজটুকু একজন একজন করে নাকে মুখে গুঁজে আসতে হয়, ভোট কিন্তু চলতে থাকে। ওই রকম নাকে মুখে গুঁজতে গিয়ে আশায় থাকি যে কোনদিন এক সাংবাদিক ভাই আসবেন। তার পরের দিন কাগজ আমার ছবি বেরোবে।' জমিয়ে মাংস ভাত খাচ্ছেন প্রিজাইডিং'( পাতে যদিও আলু সেদ্ধ)। উপায় নেই রাজনৈতিক কর্মীরা যেমন 'ভোট করেন' এরাও তেমন 'খবর করেন’। এগুলি কোন জাতীয় ক্রিয়াপদ জানিনা, কিন্তু করতেই হয়। কখন খবর 'হবে' সে আশায় বসে থাকলে তো আর পেট চলে না। আর ঐ ছোটো বাইরে যাওয়ার খুব একটা দরকার হয়না বরজোর একবার। কারণ ইনপুটের সময় পেলে তবে তো আউটপুট । পঞ্চায়েত ভোটে যাদের কপালে বারোশ ভোটার পড়ে তাদের হাগিজ দেওয়া উচিত।কিন্তু ঐযে কেউ কারো কথা শোনেনা,অন্তত আমার কথা তো কেউ শোনেনা।কি আর করা যাবে!হঠাৎ কখনো হয়তো বাইরে শোনা যায় গোলমাল, চেঁচামেচি দৌড়াদৌড়ি। সহকর্মীরা আমার দিকে তাকান। আমি রামদেবীয় কায়দায় চোখ বন্ধ করে গভীর শ্বাস নিই। ভাবি তবুও তো আমি বাসন্তী, কুলতলী, ভাঙড়, নানুর, রানীনগর, সিতাই এর প্রিজাইডিং নই। গোলমাল আস্তে আস্তে কমে আসে। জানি প্রাণায়ামের জোরে নয়। নিশ্চয়ই আশেপাশে শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ আছেন। এমন সব দিনের আগে মানে আসার আগে বউয়ের সঙ্গে যদি খুব জমিয়ে ঝগড়া করা যায়, যাতে করে জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা এসে যায় তাহলে এসব আর খুব একটা গায়ে লাগে না। কিন্তু মুশকিল হলো বউরা ঝগড়ার জন্য সারাবছর মুখিয়ে থাকলেও এই ভোটের আগের দিন কেমন যেন পিছিয়ে আসে।যতসব কানারী ( কাপুরুষের স্ত্রীলিঙ্গ)। অগত্যা চাকরি পাওয়ার মাসুল দিতেই হয়। বিকেল পাঁচটায় কিউ স্লিপ দেওয়ার সময় গোটা গ্রাম লাইনে দাঁড়িয়ে যায়। সারাদিনে তাদের ভোট দেওয়ার সময় হয়নি।এজেন্টরা বলে গোটা চারেক করে বেশি দেবেন। দিতেই হয়, আরো চার ঘন্টা বুথে থাকতে হবে তো! শেষে কাগজপত্র দুবার তিনবার করে তৈরি করে( শুধু ১৮ নম্বর ফর্ম ই কম করে ১৫ টি করতে হয়), পুনরায় ঘেমে নেয়ে সিল করে বাসে ওঠা। সেটা অবশ্য আবার পাশের বুথ গুলোর উপর নির্ভর করে যদি তাদের কাজ শেষ না হয় তাহলে আবার অনন্ত প্রতীক্ষা। তবে এসব সমস্যা অনেকটাই মিটে যায় যদি মহামান্য কেউ এসে যদি বলে,' মাস্টারমশাই আপনি কিন্তু কিছুই দেখেননি’। বাস সব কাজ সহজ। আপনি হয়তো ভাবছেন যে আমাকে পাঠানো হয়েছে ভোট নিতে এটা কি বলছি? তার উত্তর আনন্দমঠেই আছে।' জীবন দিলে যদি রনজয় হইত, জীবন দিতাম। বৃথা জীবন দেওয়া বীরের ধর্ম নহে।‘
রিসিভিং সেন্টারে এসে আবার লাইন, কাগজের পর কাগজ। বলতে ইচ্ছে করে ,'শুধু কাগজ আর কাগজ তোমার মন নাই কুসুম?' কাগজ জমা দিলে আবার সিলিং, কাগজপত্রের সিলিং। এটা অনেকটা পিছনের কাপড় তুলে মাথায় ঘোমটা দেওয়ার মত।খামের নিচের দিক ফেটে কাগজ বেরিয়ে যেতে পারে কিন্তু মুখ সিল থাকতেই হবে।নিয়ম ইস নিয়ম। আমার তখন ফটিকের মত অবস্থা ।জিজ্ঞেস করি ,'মামা, আমার কি ছুটি হয়েছে?' মামা বলে, ‘হ্যাঁ’। 'আহা! কি আনন্দ আকাশে বাতাসে'। 'ফুরায় এই ইলেকশনের সব লেনদেন থাকে শুধু 'খাইবার পাস' আর বাড়ি ফেরার বাস'। সেই মধ্যাহ্ন ভোজের পর আর খাবার জোটেনি । কিন্তু খিদে নেই। কারন এত দ্রুত খেয়েছি যে পাকস্থলী বুঝতেই পারেনি ভাত খেয়েছি না ব্যালট খেয়েছি! তাই খাইবার পাস থাকলেও তখন আর খাওয়ার ইচ্ছা থাকে না।নিয়মরক্ষার জন্য ব্যাগের বিস্কুট খেয়ে বাস খোঁজা। সেও এক পর্ব। যে বাস যাবে বলে ঘোষণা করা হয় সে বাসকে খুঁজে পাওয়া যায় না। যদিও বা পাওয়া যায় তার ড্রাইভারকে পাওয়া যায় না। আবার বাস এলেও সে তো আর বাড়িতে নামায় না।বাস স্ট্যান্ড থেকে হেঁটে বাড়ি।মাঝে আবার কুকুরের ঝামেলা।কমিশনের মতো রাতের কুকুরও ভোটকর্মীদের মানুষ মনে করেনা। এইসব সেরে বাড়ি ফিরতে কখনো কখনো পরের দিনের অরুণোদয় দেখা যায়।বাড়ি ফিরে বাড়ির বিছানা আর বৌ ,বাচ্চার মুখ দেখে যা আনন্দ হয় ফুলসজ্জার রাতেও অমন আনন্দ হয়না,এই ব্যালট বক্সের দিব্বি বলছি।
তবে কিছু দুর্লভ চিত্রও যে থাকে না তেমন নয়। মূল্য মানের অতিরিক্ত খাবার দেয় রাধুনী, শুধুমাত্র ভালোবেসে। খাবার সময় বাড়ির খোঁজ নেয়।ভোটের আগের দিন বিকেলে স্কুলেরই বাচ্চা ছেলেরা বিকেলবেলা গল্প করে যায়। বৃদ্ধ জীবন প্রেমিক গান শুনিয়ে যায়,’ আমার সাধ না মিটিল, আশা না পুরিল --- '। বয়স্ক মাসীমা আশীর্বাদ করে যান। যাওয়ার সময় সমবেত ধন্যবাদ জানায় বাইরের জটলা। ভিন্ন পার্টির পোলিং এজেন্টরা খাবার ভাগ করে খায় ( আজকের দিনে অস্বাভাবিক বলেই চোখে পড়ে)। লাইনে দাঁড়ানো মহিলা হঠাৎ বলে ওঠে ,'স্যার আপনি?’। মহিলা তখন বালিকা হয়ে ওঠে,স্যার কে প্রণাম করে । বিকেলে আবার ছেলেকে নিয়ে আসে। বলে, 'স্যার মাথায় একটু হাত দিয়ে আশীর্বাদ করে দেন’। প্রাণান্তকর দম বন্ধ করা অবস্থাতেও চোখে জল আসে,আনন্দাশ্রু। কেউ কেউ আর সি পর্যন্ত বাইক নিয়ে পিছনে পিছনে আসে। বলে ,’ স্যার, আবার আসবেন’। কমিশনের হিসাব বহির্ভূত এগুলোই বার বার টেনে আনে ডিউটিতে।
🍂
2 Comments
এবার ফেইসবুকে অনেকেই নিজের নিজের অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছেন। আমাদের বোধ হয় ধৈর্য চ্যুতি হচ্ছে। হলে কি হবে! ঐ যে বলে ' যে যায় লঙ্কায় সেই হয় রাবন ' গোছের ব্যাপার। কিন্তু, আপনার লেখা অতি মনোজ্ঞ। খুব ভালো লাগলো। হোয়াতে শেয়ার করার জন্য নিলাম।
ReplyDeleteধন্যবাদ নেবেন। মনোজ্ঞ পাঠক পাওয়াও কম সৌভাগ্যের নয়।🙏
Delete