জ্বলদর্চি

নির্জনতার কবি সুনীল বসু // ঈশিতা ভাদুড়ী

স্মৃতি ডট কম ২১ 
নির্জনতার কবি সুনীল বসু // ঈশিতা ভাদুড়ী

‘আমার মৃত্যুর পর কেটে যাবে কতকাল / স্মৃতির সমুদ্র ভরে অশান্ত জোয়ার ভাঁটা / কতবার দোলা দেবে মানুষের প্রাচীন হৃদয়। / পৃথিবীর রাত্রি দিন পরিক্রমি সময়ের কাঁটা / মানুষের কাঁদা হাসা আলোছায়া বিদায় প্রণয় / সবই জড়াবে প্রেমে— জ্বেলে মর্ত্যের মশাল! / যদিও রব না আমি সেদিন মর্ত্যের পরে / তোমাদের হাসি গান পুতুলের খেলাঘরে / তথাপি আমার স্মৃতি স্বাক্ষরের লিপি / তাই আমিও বেসেছি ভাল আমার হৃদয় ভরে,…’ – কতকাল কেটে গেল, সুনীল বসুর লেখা এইসব লাইন রয়ে গেল তবু পাঁজরের গভীরে।
একেকজন মানুষ থাকেন এমন, আত্মভোলা, নিজের মনে হেঁটে যান পথ। সুনীল বসু এমনই একজন ব্যক্তি ছিলেন। তাঁর আর আমার অফিস উল্টোউল্টি ছিল। তিনি আনন্দবাজারে দেশ পত্রিকায় ছিলেন, আমি হিন্দুস্তান বিল্ডিং-এ এল আই সি অফিসে। অফিস ছুটির পর আমরা মুখোমুখি রাস্তা পার হয়ে যে যার বাড়ির দিকে যেতাম। সুনীলদা আমার অফিসের পাশ দিয়ে হেঁটে শিয়ালদহ যেতেন। কোন্‌ অজানার দিকে তাকিয়ে হাঁটতেন, আমি আজও ভাবি। 
তখন দেশ পত্রিকায় সুনীল বসু ছিলেন, কবিতার পৃষ্ঠা দেখতেন। আমি তখন দেশ পত্রিকায় লিখতে আরম্ভ করেছি, ডাকযোগে লেখা পাঠাতাম। একবার ফোন করে আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন দেশ পত্রিকার দপ্তরে। আমি একটি কবিতা লিখেছিলাম, যার শেষ দুটি লাইন ছিল – ‘মৃত জননীর মুখও তো কত অনায়াসে / ভুলে যায় মানুষ’। আমাকে ডেকে পাশে বসিয়ে ভারী কন্ঠস্বরে মৃদু ভাবে আমাকে বকলেন, বললেন ‘মায়ের মুখ কেউ কখনও ভুলতে পারে?’ তাঁর নিজের মাতৃবিয়োগের কারণে তাঁর কন্ঠ অতিরিক্ত আবেগ-ভেজা ছিল। আমি তখন সবেমাত্র লিখতে আরম্ভ করেছি কবিতা, আমি বুঝেছি পরে আমার ভুলই হয়েছিল সেরকম লেখা। সুনীলদা বললেন ‘মায়ের মুখ কেউ কোনোদিন ভোলে না, তবু কবিতার প্রয়োজনে যদি লিখতে চাও অন্যভাবে লেখো’। আমি ওই কবিতার শেষ লাইন বদল করে লিখেছিলাম ‘ভুলে যায় দু’চারজন’। সেই কবিতা দেশ পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। সেইদিন থেকে সুনীল বসু আমার কাছে সুনীলদা হয়ে গেলেন।
কত সব আশ্চর্য কবিতা সুনীল বসু লিখে গেছেন। সেই যে ‘আমি এই’ কবিতায় লিখেছেন – ‘…তুমি কী করছ ভূতনাথ? লিখছ-টিখছ?'/ ‘হ্যাঁ সত্যিই শুভাশিস, আমি গাড়ি কিনতে পারিনি, না করেছি বাড়ি, / জননেতা তো কোন দূর, জনতার দৈত্যের হাত থেকে পালিয়ে গিয়েছি / কলকাতা থেকে কিছু দূরে আধা পাড়াগাঁয়ে, রাত ভোর হলে কলাগাছের / পাতায় শিশির ঝরা দেখি, ওতেই শিহরন খেলে যায় / সেই কবে এক রুগ্ন কবিতার নারীর সঙ্গে বিয়ে হয়ে অবধি / খরচের আর শেষ নেই, রাত্রে গিয়ে ঠায় বসে থাকি তারার বাগানে, / গুড়গুড় করে মেঘ ডেকে উঠলে বুকের মধ্যে হইহই করে শুনি / ভাস্কো-দা-গামার পালতোলা জাহাজের কামানগর্জন, / বিদ্যুৎ চমকালে দেখি শেকসপিয়রের নাটকের বীভৎস বুড়ি ডাইনিদের চুল- /  ছেঁড়াছিড়ি, লম্বা লম্বা নখের বাহার / ঘরে বসে জানি না আকাশকে কেন দেখি ভূমধ্যসাগর, এক একদিন / মাঘী পূর্ণিমায় দেখি সাদা ফেনায়িত প্রকাণ্ড আকাশব্যাপী রাজহাঁস / ফেলে যায় নিটোল টলটলে সোনার ডিম, / শুভাশিস, গাড়ি কিনতে পারিনি, করতে পারিনি বাড়ি, জননেতা হওয়া / অসম্ভব, শুধু ছোট ছোট কল্পনার লাল ইট গাঁথি, / আর চুরমার করি, কিছুই হওয়া হয়নি, ট্রেনে করে আসি আর যাই, / রুগ্ন কবিতার নারীর চিকিৎসায় আমি ফতুর হয়ে গেলাম, / হয়তো জীবনই চলে যাবে.... / তোমরা বেশ আছ! শুভাশিস, সুনন্দ, আশুতোষ .../ আমি এই!’ সুনীল বসু প্রকৃত অর্থেই ছিলেন নির্জন কবি। এবং তাঁর কাব্যভাষা ছিল স্বতন্ত্র। গভীরতম বোধকে কত অনায়াসে সরলভাবে লিখে ফেলতে পারতেন। কবিতার প্রতি ছিল তাঁর আন্তরিক ভালোবাসা ও মনোযোগ! 
তিনি যতই কম কথা বলা মানুষ হোন না কেন, তরুণ কবিদের কিন্তু খুব সহজেই হৃদয়ের কাছে টেনে নিতে পারতেন। কম কথা বলা লম্বা আত্মভোলা এই মানুষের প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয় টের পেতাম আমি। তাঁর এই প্রশ্রয় শুধু যে আমার প্রতি  ছিল তা নয়, তরুণ কবিদের সকলের প্রতিই তিনি খুব মনোযোগী ছিলেন। আমি খুব একটা কবিতার অনুষ্ঠানে যেতে পারতাম না, যে দু-একটি অনুষ্ঠানে আমি গিয়েছি, সেই সব অনুষ্ঠানে সুনীলদাকে আমি কখনও দেখিনি। আসলে তিনি নিজেকে কখনও জাহির করতেন না। আজকে যখন ইন্টারনেটের যুগে সবাই জ্বলজ্বল করে, সেখানেও তিনি অনুপস্থিত। তিনি এতটাই নির্জনে থাকা কবি। প্রকৃত অর্থেই কবিতার প্রেমিক ছিলেন। তাঁর উচ্চারণ ছিল শুদ্ধ। তিনি স্বপ্ন দেখতেন। সেই স্বপ্নের মধ্যে দিয়ে হেঁটে যেতেন গভীরতায়, লিখতেন আশ্চর্য সব লাইন – 'ঘুমের মধ্যে একটি নরম স্বপ্ন-নদী আছে / গোলাপ বাগান / সোনার চুলে জাফরানের রুমাল-বাঁধা / ঘুমের মধ্যে লুকিয়ে আছে বৃষ্টি-ভেজা / অগাধ ঝাউবন, ঘুমের মধ্যে কখনো জ্বলে খটখটে দিন / ঝিরিঝিরি এক পাহাড়-ছেঁড়া নদী, / হলুদ-ফুল মুনিয়া পাখি, / ঘুমের মধ্যে লুকিয়ে আছে বুকের কাছে / ফাঁকি দেওয়া আলোর মতো / কাচের মতো জলের মতো শায়ায় ঘেরা নারী।' 
সমালোচনা ও সম্পাদনায় যে রমাপদ চৌধুরী ছিলেন অত্যন্ত কঠোর, সেই তিনিই বারংবার সুনীল বসুর স্বতন্ত্র লেখনীর কথা বলেছেন, আমরা প্রমোদ বসুর স্মৃতিচারণা থেকে জানতে পারি। স্বগতোক্তির মধ্যে দিয়ে ঠাট্টা-পরিহাসও করতেন অবলীলায়,  তীব্রভাবে শ্লেষকে এঁকে ফেলতে পারতেন শাণিত কলমে, এরকম কবিতা তিনি বহু লিখেছেন। 'হৃৎপিণ্ডে দারুণ দামামা' বইতে তিনি লিখেছিলেন – 'পৃথিবীকে খুবলে খাবলে খাওয়া চলছে! / গোটা পৃথিবীটাই আমার ভক্ষণে লাগছে – / আমার অহোরাত্রির ভোজে আর ভোজনে; / কেননা আমার পাঁচ পাঁচটা ইন্দ্রিয়ময় অসহ্য অসম্ভব / আদেখলে চূড়ান্ত দাউদাউ খিদে!...' অথবা 'বয়সটাই বড় পাজি হে / বয়সটাই বড় পাজি / চল্লিশোর্ধ্বে আমার লাল নীল হলদে / বেলুন কিনতে ইচ্ছে করলে – / লোকে বলে, হে হে হে হে / ব্যাটা বুড়ো খোকা!'
সুনীলদার কবিতা দিয়েই শেষ করি – ‘যখন রব না আমি প্রাচীন পৃথিবী তীরে / হয়ত তখন আর কোনো হৃদয় – গভীরে – / আমারই স্মৃতির সুর ঘুরে ঘুরে পাবে প্রাণ – / হাজার বছর পরে কারো কান হবে গান।’
🍂

Post a Comment

4 Comments

  1. অসাধারণ একটি লেখা। সুনীল বসুর লেখা নিয়ে কেউ আলোচনা করেন না। কেন, কে জানে! অথচ ওঁর লেখার মধ্যে সহজভাবে গভীরতা ও কৌতুক যেভাবে ধরা দিয়েছে, তা ঈর্ষণীয়। ওঁর 'ডিগবাজি' কবিতাটি আমার খুব প্রিয় --- একটি স্বতন্ত্র প্রেমের কবিতা।

    ReplyDelete
  2. তন্ময় মিত্র।September 05, 2023

    খুব ভালো লাগলো অনেক দিন বাদে এই নির্জন কবির কথা। আড়ালে থাকতে ভালোবাসতেন রয়ে গেলেন সারা জীবন ই। একসময় আরেক সুনীল ও শরৎকুমার এর পাশাপাশি ওঁর কবিতাও ছুঁয়েছে মানুষকে। এমন আরো লিখুন।

    ReplyDelete
  3. তন্ময় মিত্র ও সৌমিত্র নন্দী, অনেক ধন্যবাদ। সুনীল বসু খুব গভীর কবিতা লিখতেন। তিনি বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বল নক্ষত্র ছিলেন, আমার মতে। তাঁকে নিয়ে আলোচনা হয় না, সেটা আমাদেরই লজ্জা।

    ReplyDelete
  4. ঈশিতা ভাদুড়ীNovember 18, 2023

    তন্ময় মিত্র ও সৌমিত্র নন্দী, অনেক ধন্যবাদ। সুনীল বসু খুব গভীর কবিতা লিখতেন। তিনি বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বল নক্ষত্র ছিলেন, আমার মতে। তাঁকে নিয়ে আলোচনা হয় না, সেটা আমাদেরই লজ্জা।

    ReplyDelete