অচেনা পথিক
মিলি ঘোষ
শিল্পীরা কী নিপুণ দক্ষতায় ছৌনাচের মুখোশগুলো তৈরি করছেন, তাতে নিখুঁত তুলির টান। দাঁড়িয়ে দেখছিল ওরা। তখনই একটা গান ভেসে আসে। ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। কিছুটা যেন পরিচিত সুর।
তূর্য এক শিল্পীকেই জিজ্ঞাসা করল, "কে গাইছে,ভাই?"
"রঘু পাগলা।"মুখ না তুলেই বলল ছেলেটি।
গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছে দু'জনে। লক্ষ্য অযোধ্যা পাহাড়। গাড়িটা আরুসের বাবার।
বেরোনোর সময় বলেছিলেন, "অক্ষত ফিরো।"
"হ্যাঁ, বাবা। নিশ্চয়ই।
"শুধু তোমরা না। আমার গাড়িটাকেও ফিরিও।"
আরুস হাসতে হাসতে গাড়ি স্টার্ট দেয়।
অযোধ্যা পাহাড়ে হিল টপে ঘর বুক করে দুই বন্ধু আপার ড্যামে এসে দাঁড়াল। রাত আটটা হবে। নির্জন চরাচর তখন জ্যোৎস্নায় ভরপুর। নিশ্ছিদ্র চাঁদের আলোয় পৃথিবী ভাসমান। সৌন্দর্যের ওই ভয়াবহ রূপ নিঃশব্দে দু'চোখ দিয়ে গিলছিল ওরা। আশঙ্কাও ছিল।
বিশ্ব কি তার রূপ বদলাবে ? হারিয়ে যাবে দু'কূল ছাপানো স্বর্গসুখ ? তারই মাঝে আবার কানে এল গানের সুর। কোথা থেকে আসছে এ গান ? শব্দকে অনুসরণ করে এগোনো অসম্ভব। যেদিকে ওরা মুখ ঘোরাচ্ছে, যেন সেদিক থেকেই আসছে ওই সুর। অবশেষে সে সুর নিজেই ধরা দিল।
জিনসের ওপর পাঞ্জাবী পরিহিত একটি মানুষ দু'হাত প্রসারিত করে গাইছে,
তোমার অসীমে প্রাণমন লয়ে
যত দূরে আমি ধাই ...
কাছে আসতেই বোঝা গেল লোকটির পরনের পোশাক বেশ মলিন। এক মুখ দাঁড়ি গোঁফ। আর পিঠে একটা ব্যাগ।
তূর্য, ঠোঁট সামান্য ফাঁক করে বলল, "রঘু।"
রঘু নিজেও যেন এই অবিশ্বাস্য প্রকৃতির একটা অংশ।
রঘু গান থামাল।
আরুসকে জিজ্ঞাসা করল, "কলকাতার লোক ?"
"হ্যাঁ। হিল টপে আছি। আপনি বোধহয় এদিকেরই।"
লোকটা এমনভাবে ঘাড় নাড়ল, বোঝা গেল না কী বলতে চায়।
আরুস তাও বলল, "কাল দুপুরের পরে আসুন না একবার। গান শোনা যাবে। গল্প করা যাবে।"
রঘু ঘাড় কাত করে বলল, "আপনি না। তুমি।"
পরদিন সকালে উঠেই আরুস আর তূর্য গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। পুরুলিয়ার বল্গাহীন রূপে গা ভাসিয়ে ফিরতে ফিরতে দুপুর।
খেতে বসে তূর্য বলল, "দুপুরটা একটু রেস্ট না নিলেই নয়। টায়ার্ড লাগছে।"
"হ্যাঁ। ছোটো করে একটা ভাত ঘুম দিতেই হবে।"
খাওয়া শেষ করে বেরোতেই রঘুকে দেখতে পেল ওরা।
আরুস বলল, "রঘু না ? আসতে বলেছিলাম তো দুপুরে।"
"কী করবি, পরে আসতে বলবি ?"
"দাঁড়া, দেখি কথা বলে।"
তূর্য গিয়ে জিজ্ঞাসা করল, "রঘু কিছু খেয়েছ ?"
"হ্যাঁ। মুড়ি-বাতাসা।"
"মুড়ি বাতাসায় তো পেট ভরবে না। চলো আমাদের সঙ্গে। ভাত খেয়ে নাও।"
রঘুকে কিছুতেই খেতে রাজি করানো গেল না। কথা বলে বোঝা গেল রঘুর আত্মসম্মান বোধ বেশ উচ্চ মার্গের। রঘু নিজের খেয়ালেই গান গায়। নিজের খেয়ালেই মৌন থাকে।
ওর সঙ্গে কথা বলে যা জানা গেল, রঘুর বাড়ি রাজচন্দ্রপুরে। ছেলের জন্ম দিতে গিয়ে স্ত্রী মারা যায়। কিন্তু মায়ের ইচ্ছাতেই দ্বিতীয় বিবাহে রাজি হয় রঘু। স্ত্রীর নাম পায়েল। বছর খানেকের মধ্যে একটি পুত্র সন্তানও হয়। মানব ধর্মের নিয়ম মেনেই সৎ মায়ের চক্ষুশূল হলো রঘুর প্রথম সন্তান। মা বেঁচে থাকতে প্রথম ছেলের কোনও অনাদর হয়নি। কিন্তু তিনি চোখ বুজতেই সংসারের রূপ গেল পাল্টে। তবে পায়েল রঘুকে চটাত না। যা করত বুদ্ধি করেই। মাঝেমাঝে অতি মাত্রায় ভালো মানুষ সাজত। ন্যাকামো করত। রঘু সহজ সরল। বেশি গভীরে যাবার প্রবণতা ওর নেই।
এরপর একদিন রঘুকে নানাভাবে খুশি করে পায়েল প্রায় আবদারের সুরেই জানাল সে বাবার বাড়ি যেতে চায়। ছেলেদেরও নিয়ে যাবার ইচ্ছা প্রকাশ করল। রঘুও ভাবল, যাক বউয়ের যখন মন হয়েছে, ছেলেরাও ঘুরে আসুক। ক'দিন নিজের রান্না ও নিজেই করে নিতে পারবে।
বাগনানে গিয়ে পায়েল রোজই ফোন করে রঘুকে। গান শোনাবার জন্য গলায় মধু ঢেলে রঘুর কাছে বায়না করে। রঘু যখন গান ধরে, ফোনের ওধারে নিঃশব্দে হাই তোলে পায়েল। বরফ গলেই ছিল। প্রতি রাতের সোহাগী কথায় সেই বরফ গলা জলের ঘনত্ব আরও কমতে লাগল। রঘু রান্না করে, অফিসে যায়। কিন্তু কাজে যেন মন লাগে না। আশ্চর্যের বিষয়, দুটো ছেলেই রঘুর। তবু স্ত্রীর প্রতি আসক্তি সন্তান স্নেহকেও ছাপিয়ে গেল।
দিন কয়েক পরেই পায়েলের দাদার ফোন পেল রঘু, "বড়ো ভাগ্নাকে পাওয়া যাচ্ছে না। খেলতে বেরিয়ে আর ফেরেনি।"
পড়িমরি করে ছুটল রঘু বাগনানে। গল্প সাজানোই ছিল। যাওয়া মাত্র শাশুড়ি, শালারা সব কেঁদে কঁকিয়ে জানাল, কোন্ এক জঙ্গলের মধ্যে ছেলের মৃতদেহ পাওয়া গেছে । কারা ওকে মেরে ফেলেছে কিছুই বুঝতে পারছে না। রঘুর শালাদের ওই অঞ্চলে ভালোই নামডাক। তাই শাবলও জোগাড় হলো না, কেঁচোও খোঁড়া হলো না। সাপ রয়ে গেল মাটির তলাতেই। রঘুর মনের মধ্যে কী হয়েছিল কে জানে। স্ত্রীকে বারবার জ্ঞান হারাতে দেখেও সেদিকে ফিরে তাকায়নি রঘু।
সেই থেকে রঘু ভবঘুরে। রাস্তাঘাটে ওর গান শুনে যে যা দেয় তা'ই দিয়ে চালায়। নাহলে না খেয়েই থাকে।
কথা থামিয়ে রঘু গান ধরল,
আমার হাত বানধিবি পা বানধিবি
মন বানধিবি কেমনে ...
হৈমন্তিক হাওয়ায় শরৎ বিদায়ের যে বিষণ্ণতা মিশে থাকে অযোধ্যা পাহাড়ের সোনালী বিকেলে রঘুর গান তারই আবেশ ছড়িয়ে দিল।
এক রকম জোর করেই রঘুর হাতে কিছু টাকা দিয়ে আরুস বলল, "শুধু মুড়ি বাতাসা খেয়ে থেকো না রঘু। মাঝেমাঝে ভাত, রুটি যা হয় খেও।"
ওঠার সময় রঘু ওর ব্যাগটা দেখিয়ে বলল, "দাদারা, এই ব্যাগটা একটু রাখবেন আপনাদের ঘরে। আমি কাল খুব সকালে এসে নিয়ে যাব।"
ব্যাগের চেহারাও তথৈবচ। এতে যে বিশাল কিছু ধনরত্ন থাকবে না, তা না বললেও চলে।
তূর্য বলল, "কিন্তু, আমরা যে কাল খুব ভোরে বেরিয়ে পড়ব। এদিকে আর হয়তো ফিরব না।"
"তাহলে দাদা, আজ রাতের দিকে এসে নিয়ে যাব।"
ঘরের এক পাশে নিজেই ব্যাগটাকে রেখে দিল রঘু।
কিন্তু রঘু এল না। রাতেও না। পরদিন ভোরেও না। আরুস আর তূর্য ঠিক করল, বেরোনোর সময় রিসেপশনে দিয়ে বলে যাবে, রঘু এলে যেন দিয়ে দেয়। রঘুকে এক বাক্যে এখানে সবাই চেনে। অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।
রিসেপশনে বলা মাত্র ছেলেটি প্রায় ছিটকে সরে গেল।
বলল, "ক্ষেপেছেন নাকি মশাই ? রঘু একটা খুনের আসামী। আবার কাল রাতে পুলিশ ওকে অ্যারেস্ট করেছে। ওর জিনিসপত্র রেখে কেস খাব নাকি ?"
রঘু সেদিন ওদের অর্ধেক গল্প বলেছিল। বাকি অর্ধেক রিসেপশনের ছেলেটি বলল।
রঘুর দ্বিতীয় বউয়ের গড়ন লম্বাটে। চুল লালচে প্রকৃতির। সন্তানকে হারিয়ে পাগল প্রায় রঘু এই ধরনের চেহারার কোনও মহিলাকে দেখলেই তাকে খুন করার ছক কষে। তারপর সুযোগ পেলেই শেষ করে দেয়। তবে কোনোবারই রঘুকে পুরো সময় জেল খাটতে হয়নি। ওর ব্যবহার এবং বোনাস পয়েন্ট হিসেবে গানের গলার জন্য শাস্তি কিছুটা মকুব হয়েছে প্রতিবারই। জনশ্রুতি আছে, রঘুর বউ নাকি চূড়ান্ত অনুশোচনায় আত্মহত্যা করেছে। রিসেপশনে থাকা ছেলেটিই ওদের বুদ্ধি দিল, রঘুর ব্যাগ থানায় জমা করে দিতে।
রঘুকে জামিনে ছাড়িয়ে এনে লাভ নেই। ও আবার খুন করবে। আবার জেলে যাবে এবং আবার গান গাইবে। সে চিন্তা অবশ্য করেওনি আরুস, তূর্যরা। শুধু থানায় যাবার সময় গাড়িতে বসেই রঘুর ব্যাগটা একবার খুলল তূর্য, নিতান্ত কৌতূহল বশেই।
আরুস গাড়ি চালাতে চালাতে ঘাড় ঘুরিয়ে বলল, "খুনের আসামীর ব্যাগ খুলছিস। ভেতরে কী আছে তার ঠিক নেই।"
ব্যাগ খুলে ওরা একেবারে হাঁ। ওপরে আর এক সেট মলিন জামা প্যান্ট। আর তলায় ভর্তি বই। বাংলা ইংরেজি মিলিয়ে প্রায় পনেরো ষোলোখানা।
থানায় বড়োবাবুকে ব্যাগ জমা দিতেই ভদ্রলোক হাসলেন।
বললেন, "পুলিশে চাকরি করি। লোক তো কম দেখলাম না। কিন্তু, রঘুর মতো দু'টো মানুষ আমি পাইনি আজ পর্যন্ত। রঘুর আসল নাম রাঘব গুহ। এম.কম. পাশ। একটি কোম্পানির অ্যাকাউন্টেন্ট ছিল। জেলে যতদিন থাকে বই পড়েই কাটায়।"
বড়োবাবু আরুসদের রঘুর কাছে নিয়ে গেলেন। ওদের দেখে মাথা নামাল রঘু।
আরুসই নীরবতা ভাঙল।
বলল, "তোমার ব্যাগ আমরা বড়োবাবুর কাছে রেখে গেলাম। আর একটা অন্যায় আমরা করেছি। তোমার পারমিশন ছাড়াই ব্যাগটা আমরা খুলেছি।"
রঘু মুখ তুলে আরুসের দিকে তাকাল।
তূর্য বলল, "তুমি তো পড়তে ভালোবাসো, রঘু। তোমার যখন যে বই পড়তে মন চাইবে, বড়োবাবুকে বোলো। আমরা কলকাতা থেকে পাঠিয়ে দেব। বড়োবাবুর কাছে আমাদের নাম্বার দেওয়া আছে।"
রঘু মাথা নিচু করে রইল,ওর কৃতজ্ঞ দৃষ্টি অপ্রকাশিত রেখেই। কিন্তু ওর শরীরী ভাষা বুঝিয়ে দিল, রঘু আসলে কতটা নম্র।
ভগ্ন হৃদয় নিয়েই বাকি ট্যুর সমাপ্ত করল দুই বন্ধুতে। মাঠে মাঠে হেমন্তের পাকা ধান তখন হলুদে হলুদ। ধরিত্রী যেন 'গায় হলুদে'র আসরে আদরের কন্যাটি। গাড়িতে বসে সোনার ফসলের সে রূপ দেখতে দেখতে ওরা রঘুর কথাই ভাবছিল। রঘু আসলে কে ? সঙ্গীত, পুস্তক-প্রেম যার শিরায় শিরায়, সেই কিনা মানুষ খুন করে জেলে যায়! আর জেলের বাইরে থাকা আপাত সুস্থ, সচেতন মানুষরা রঘুর থেকে কিছু কি শিখতে পেরেছে ? পাল্টেছে কি নিজেদেরকে ? এমন হাজারো প্রশ্নে নিজেদেরকে জর্জরিত করছিল আরুস আর তূর্য। হয়তো আর কখনও রঘুর সঙ্গে ওদের দেখা হবে না। দিন যাপনের সঙ্গে সঙ্গে আরুস, তূর্যরাও নিশ্চয়ই পরিবর্তিত হবে। শুধু রঘুর কোনও পরিবর্তন নেই। স্ত্রীর বিশ্বাসঘাতকতা, সন্তানের জন্য বুকফাটা হাহাকার রঘুকে এক ভিন্ন জীবন দিয়েছে। জীবনের যে কঠিন রূপ রঘু দেখেছে, তার সঙ্গে ও হাত মেলাতে পারেনি। তাই চলার পথে কয়েদখানাই ওর বিশ্রামাগার। কয়েদখানাই ওর সাময়িক শান্তির নীড়।
-----------×----------
0 Comments