মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ৮৫
অনাথবন্ধু পাঁজা (স্বাধীনতা সংগ্রামী, সবং)
ভাস্করব্রত পতি
"মেদিনীপুরের জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট মিঃ বার্জ খেলার মাঠে গুলীর আঘাতে নিহত।"...
৩ সেপ্টেম্বর ১৯৩৩, ১৮ ভাদ্র ১৩৪০, রবিবার সকালে 'আনন্দবাজার পত্রিকা'য় হেডলাইন হয়েছিল এটাই। এখানে সেদিন লেখা হয় একটি বৈপ্লবিক হত্যাকাণ্ডের বিবরণ -- "খেলা আরম্ভ হয় হয়, এই সময় তিনটী বাঙ্গালী যুবক মিঃ বার্জের দিকে আগাইয়া যায় এবং মারাত্মকভাবে কয়েকটী গুলীবর্ষণ করে - তৎক্ষণাৎ মিঃ বার্জের মৃত্যু হয়। তাঁহার দেহের ৬ টী স্থানে গুলীবিদ্ধ হইয়াছিল"। এখানে আরও লেখা হয়েছিল "ওই দলে তিনজন ছিলেন। উহাদের। উহাদের একজন গুলীর আঘাতে নিহত হইয়াছে, দ্বিতীয়জন আহত হইয়াছে এবং তৃতীয়জন গ্রেপ্তার হইয়াছে। তবে এই তৃতীয়জনের নাম জানতে পারা যায় না। বাকি দু জন সম্পর্কে যতদূর জানিতে পারা গিয়াছে, তাহাতে প্রকাশ যে, উহাদের নাম অমর পাঁজা ও মৃগেন্দ্র দত্ত"।
এই অমর পাঁজা আর কেউ নয়। তিনিই অনাথবন্ধু পাঁজা। আর "আহত ব্যক্তিটী 'আমাকে মারিয়া ফেল- আমাকে মারিয়া ফেল' বলিয়া চিৎকার করিতেছিল। তাকে হাসপাতালে লইয়া যাওয়া হইয়াছে, অবস্থা আশঙ্কাজনক"।
তবে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ যে কথাটি সেদিন আনন্দবাজার পত্রিকায় লেখা হয়েছিল, তা হল- "এযাবৎ যতগুলি বৈপ্লবিক অনাচার হইয়াছে তন্মধ্যে মিঃ বার্জ্জকে গুলী করাই বৈপ্লবিকদের পক্ষে সহব্বাপেক্ষা দুঃসাহসিক কাণ্ড, কেননা প্রকাশ্য দিবালোকে ফুটবল ম্যাচ দেখিবার জন্য সমবেত বহু লোকের সমক্ষে এই ঘটনা সঙ্ঘটিত হইয়াছে"।
মেদিনীপুরের জেলাশাসক বার্জকে গুলি করে হত্যা করেছিলেন অনাথবন্ধু পাঁজা ও তাঁর সহযোগী মৃগেন দত্ত। ১৯৩৩ এর ২ রা সেপ্টেম্বর টাউন ক্লাবের সাথে স্থানীয় মোহামেডান (মহম্মদিয়া) ক্লাবের খেলা ছিল পুলিশ প্যারেড গ্রাউন্ডে ( বর্তমান তেঁতুলতলা মাঠ)। ইতিমধ্যে চলে এসেছেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপারিনটেনডেন্ট মিস্টার জোন্স, সিভিল সার্জন মিস্টার লিটন, রিজার্ভ ইন্সপেক্টর মিস্টার স্মিথ প্রমুখ। সেখানেই বিকেল ৫.১৫ নাগাদ বি ই বার্জ এলে দুদিক থেকে দুজনে গুলি করে তাঁকে। মাত্র ২ - ৩ গজ দূর থেকে গুলি করার ফলে প্রতিটি গুলিই বার্জের বুক ভেদ করে যায়। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় বার্জের। সঙ্গে সঙ্গে বার্জের দেহরক্ষী মৃগেনকে গুলি করে এবং রিজার্ভ ইন্সপেক্টর মিস্টার স্মিথ অনাথবন্ধুকে গুলি করে। অনাথবন্ধু নিজেও একটা গুলি খেয়ে ঘটনাস্থলে মারা যান। আর গুরুতর আহত মৃগেন দত্ত পরদিন সকাল ৮.৩০ এ হাসপাতালে মারা যান।
এর আগে ১৯৩১ এর ৭ ই এপ্রিল প্রথম ম্যাজিস্ট্রেট জেমস পেডীকে হত্যা করে মেদিনীপুরের বিপ্লবী রা। তারপর দ্বিতীয় ম্যাজিস্ট্রেট ডগলাসকে ১৯৩২ এর ৩০ শে এপ্রিল হত্যা করা হয়। ডগলাসের মৃত্যুর পর মেদিনীপুরের ম্যাজিস্ট্রেট হয়ে আসেন বি ই জে বার্জ। সেই বার্জকে হত্যার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকায় ধরা পড়লেন -- কামাখ্যা ঘোষ, ব্রজকিশোর চক্রবর্তী, রামকৃষ্ণ রায়, নির্মলজীবন ঘোষ, সনাতন রায়, নন্দদুলাল সিংহ, সুকুমার সেনগুপ্ত, শৈলেনচন্দ্র ঘোষ, বিনয়কৃষ্ণ ঘোষ, পূর্ণানন্দ সান্যাল, ফনীন্দ্রনাথ চৌধুরী, সরোজরঞ্জন দাস কানুনগো এবং শান্তিগোপাল সেন। ১৯৩৪ এর ১০ ই ফেব্রুয়ারি সোশ্যাল ট্রাইব্যুনালের রায় বোরোলো। তাতে বার্জ হত্যার ষড়যন্ত্রে লীপ্ত থাকার দরুন রামকৃষ্ণ রায়, ব্রজকিশোর চক্রবর্তী এবং নির্মলজীবন ঘোষের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। আর যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর হয় সুকুমার সেনগুপ্ত, সনাতন রায়, নন্দদুলাল সিংহ এবং কামাখ্যা ঘোষের। বাকিরা বেকসুর খালাস পেয়ে যায়।
এই অনাথবন্ধু পাঁজা ১৯১১ সালের ২৯ শে অক্টোবর (১৩৯৮ এর ১২ ই কার্তিক) সবংয়ের জলবিন্দু গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম সুরেন্দ্রলাল পাঁজা এবং মা কুমুদিনী দেবী। তিনি খড়গপুরের সীতাপুর গ্রামের পাল পরিবারের কন্যা ছিলেন। গ্রামের ভূবন পালের পাঠশালায় পড়াশোনা শেষ করে ম্যালেরিয়ার হাত থেকে বাঁচাতে দুই পুত্র অনাথবন্ধু ও ভববন্ধুকে নিয়ে কুমুদিনী মেদিনীপুরের সুজাগঞ্জে চলে যান। সেখানেই হিন্দু স্কুলের ফোর্থ ক্লাসে পড়তে পড়তে বেঙ্গল ভল্যান্টিয়ার্স দলের সংস্পর্শে আসেন অনাথবন্ধু পাঁজা। আলাপ হয় হরিপদ ভৌমিকের সঙ্গে। এরপর কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি করা হয় তাঁকে। সেখানে তাঁর সাথে আলাপ হয় ব্রজকিশোর চক্রবর্তী, অমর চ্যাটার্জী প্রমুখদের সাথে। তবে তিনি গান্ধীজীর অসহযোগ আন্দোলনকে মেনে নিতে পারেননি। তাঁর বিশ্বাস ছিল -- 'মার কা বদলা মার'!
0 Comments