বাঁশী ছেড়ে দণ্ড হাতে
দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী
প্রথম ভাগ - বৃন্দাবন পর্ব
ত্রয়োদশ পর্ব
আরেক হোলি হলো লাড্ডু হোলি। এটি লাঠমার হোলির আগের দিনে হয়। বলা হয় এই দিনে শ্রীকৃষ্ণ নন্দগাঁও থেকে বর্ষাণাতে শ্রীরাধার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এসেছিলেন। তখন বর্ষাণার গোপীরা কৃষ্ণ ও তার সখাদের লাড্ডু বিতরণ করেছিলেন। সেই কথা স্মরণ করে আজও শ্রীজি মন্দির থেকে লাড্ডু বিতরণ করা হয়। এই লাড্ডু ব্রজবাসীর কাছে খুব পবিত্র। পরদিন খেলা হয় নন্দগাঁওয়ে। সেদিন বর্ষাণার সখীরা যায় নন্দগাঁওয়ে। এমনিভাবে ঘুরে ঘুরে খেলা চলে। এখান থেকে দোল পূর্ণিমার চার দিন আগে হোলি উৎসব পৌঁছে যায় মথুরাতে। বর্ষানা গ্রাম থেকে মথুরা নগরীতে। মথুরা থেকে হোলি উৎসব বৃন্দাবনে এসে পৌঁছায় দোলযাত্রার দিনে। বর্ষানা, নন্দগাঁও, মথুরা হয়ে হোলির রং এসে লেগেছে বৃন্দাবনে।
দোলের দিন সকাল থেকেই চারিদিকে 'রাধা রাধা' ধ্বনিতে মুখর হয়ে উঠেছে। দোল পূর্ণিমার চার পাঁচ দিন আগের থেকেই বৃন্দাবন জুড়ে হোলি খেলা শুরু হয়ে যায়। তবে সেই হোলি সীমাবদ্ধ থাকে মন্দির প্রাঙ্গনে। নগর জুড়ে আরম্ভ হয় প্রস্তুতি। আগের দিন সকাল থেকেই দেখেছি কাতারে কাতারে লোকে মন্দিরগুলির উদ্দেশ্যে যাচ্ছেন এবং প্রত্যেকেই রঙ এবং গুলালে মাখামাখি। দোল পূর্ণিমার দিন ভোর থেকে কাতারে কাতারে মানুষ আসতে শুরু করেছেন মন্দিরে মন্দিরে। কেউ আসছেন আশেপাশের গ্রাম থেকে। এছাড়াও ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এমন কি বিদেশ থেকেও আসছেন ভক্তজন। গ্রাম থেকে শহরে মানুষ, দিন-দরিদ্র থেকে ধনী, সব বয়সের নারী পুরুষ এসেছেন। আজ আর কোন ভেদাভেদ নেই। মেয়েদের মাথায় ঘোমটা নয়তো ওড়না। প্রতিটি মন্দিরের বাইরে রাস্তায় শত শত মানুষের ভিড়। বিভিন্ন মন্দিরে যাবার প্রতিটি রাস্তার পাশের বাড়িগুলির বারান্দাতে বস্তা বস্তা আবির রয়েছে। মুঠো মুঠো আবির ভেসে আসছে বাতাসে। তার সঙ্গে সমবেত উল্লাস ‘হোলি হ্যায় হোলি হ্যায়’। যদিও সকালে রৌদ্রের তাপ বেশি ছিল তথাপি আমরা বাঁকেবিহারী মন্দিরে দোল উৎসবের উন্মাদনা প্রত্যক্ষ করার উদ্দেশ্যে বাঁকেবিহারী রোড দিয়ে রওনা হলাম।
গতকাল গাইড আমাদের বলেছিলেন নিধুবনে বাঁকেবিহারীজির যে মন্দির আছে তা নতুন ভাবে নিধুবনের বাইরে নির্মাণ করা হয়েছে। নির্মাণ করা হলেও তার ইতিহাস পরিবর্তন হয়নি। হরিদাস স্বামী নামে এক কৃষ্ণ সাধক ষোড়শ শতাব্দীর প্রথম দশকে বৃন্দাবনের এই নিধুবনে বাস করতেন। শ্রীকৃষ্ণ সাধনার সঙ্গে সঙ্গে তিনি প্রাচীন ভারতীয় সঙ্গীতের পুনরুদ্ধারে মনোনিবেশ করেন, কারণ সেই সময়ে ইসলামী প্রভাবে প্রাচীন ভারতীয় সঙ্গীত প্রায় অবলুপ্তির পথে চলে গিয়েছিল। হরিদাস স্বামীর উপাস্য দেবতা ছিলেন কুঞ্জবিহারী। নিধুবনে কুঞ্জবিহারীর মন্দির প্রতিষ্ঠা করে তিনি প্রত্যহ সেখানে সেবা পূজা করতেন এবং তাঁর সঙ্গীত সাধনা করতেন। সম্ভবত এই মন্দিরটিই বৃন্দাবনের প্রথম মন্দির। আজ থেকে প্রায় ১২৫ বৎসর আগে হরিদাস স্বামীর শিষ্যগন এই নতুন মন্দির তৈরী করেন যা বর্তমানে বাঁকেবিহারী মন্দির বা বিহারীজির মন্দির নামে খ্যাত। ১৫৭৩ খ্রিস্টাব্দে নাদব্রহ্মযোগী সরস্বতীর বরপুত্র হরিদাস স্বামীর এই নিধুবনেই দেহাবসান হয় এবং এখানেই তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়। শ্রীরাধিকার অষ্টসখীর অন্যতম ললিতা দেবীর অবতার বলে তাঁকে বলা হয়।
ফুলের সৌরভের মতো ভক্ত হরিদাসের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল দেশে দেশে। একদিন সুদূর লাহোর থেকে এসেছেন এক বনিক। সুগন্ধি আতরের কারবার তার। ভক্ত হরিদাসের কথা শুনে বণিকের ইচ্ছে হলো তাকে দর্শন করবেন। কিন্তু এমন এক মানুষের কাছে কি উপহার নিয়ে যাবেন ভাবনায় পড়ে গেলেন বনিক। হঠাৎ মনে পড়ল তার কাছে বহু মূল্য এক শিশি আতর রয়েছে। এই আতর উপহার দেবেন সাধক হরিদাসকে। সন্ধান করতে করতে বনিক এলেন যমুনার তীরে। তার অল্প দিন পরেই হোলি উৎসব। হরিদাস তখন বালির উপর বসে ভাবনেত্রে তাঁর আরাধ্য দেবতার নিত্যলীলা দর্শন করছেন। তিনি দেখতে পাচ্ছেন গোপীদের নিয়ে হোলি খেলছেন ভগবান কৃষ্ণ। আত্মমগ্ন হরিদাসকে দেখে তাকে ডেকে বিব্রত করতে মন চাইছিল না বণিকের। প্রণাম করে আতরের শিশি হরিদাসের পায়ের সামনে রেখে দিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলেন, কখন হরিদাসের ধ্যান ভাঙে। এদিকে হরিদাস বিভোর হয়ে দেখছেন শ্রীকৃষ্ণ দোল খেলছেন। সবাই তাঁর গায়ে রং দিচ্ছে আর তিনি শুধু দেখছেন। হঠাৎ আতরের শিশিটা তাঁর পায়ে ঠেকে যেতে তিনি তাড়াতাড়ি সেই শিশির মুখ খুলে সব আতর ছুড়ে দিলেন শূন্যে। বহুমূল্য সেই আতর ছড়িয়ে পড়ল নদীর জলে। মুহূর্তে হায় হায় করে উঠলেন বনিক। তার মূল্যবান উপহার নষ্ট করে দিলেন ভক্ত হরিদাস। এর চেয়ে তিনি যদি মন্দিরে যেয়ে ভগবান কৃষ্ণকে এই উপহার দিতেন তিনি হয়তো অনেক বেশি খুশি হতেন। বিষন্ন মনে সেখান থেকে বণিক ফিরে এলেন বাঁকেবিহারী মন্দিরে। বণিক মন্দিরে ঢুকে বিগ্রহের কাছে যেয়ে চমকে উঠলেন। আতরের সুগন্ধে ভরে উঠেছে চারিদিক। পুরোহিতকে জিজ্ঞেস করতে তিনি বললেন অল্পক্ষণ আগে হঠাৎ কৃষ্ণের শরীর থেকে এই সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে সমস্ত মন্দিরে। কি করে এই সুগন্ধ এল জানিনা। মুহূর্তের মধ্যে সব বুঝতে পারলেন বনিক, আবার নদীতীরে ছুটে গিয়ে হরিদাসকে প্রণাম করে তাঁর পায়ে হাত দিয়ে বলল গিরিধারী গোপাল আপনার হাত দিয়ে আমার আতর গ্রহণ করেছেন।
আরও একজন কৃষ্ণভক্তের জীবন কথা একাত্ম হয়ে রয়েছে ব্রজভূমিতে। তাঁর নাম ছিল রসখান। ১৫৪৮ খ্রিস্টাব্দে তাঁর জন্ম। কিশোর বয়সেই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়েন। পরিচয় হয় গোস্বামী বিঠ্ঠলদাসের সঙ্গে। ধীরে ধীরে পরম কৃষ্ণভক্ত হয়ে ওঠেন। নিধুবনের কাছে ছিল তাঁর সাধনক্ষেত্র। কৃষ্ণকে নিয়ে রচনা করেছেন অসংখ্য গান। তার মধ্যে একটি হলো
"আয় খেলি হোরি ব্রজগোরী বনোয়ারী সঙ্গ, অঙ্গ অঙ্গ রঙনী অনঙ্গ সরসইগো। কুমকুম কি মার বাপৈ রঙনী ও ছার ওড়ে, বুক্কা ওউ গুলাল ললি ললি হর সাই গো"। অর্থাৎ ব্রজের গোপীরা কৃষ্ণের সঙ্গে হোলি খেলছে। তাঁদের সারা দেহে রঙ লেগেছে। কুমকুম আর আবিরের রং ব্রজের আকাশ বাতাস জুড়ে ছড়িয়ে আছে।
সমস্ত ব্রজভূমি জুড়েই এমনি কত কাহিনী ছড়িয়ে আছে। অবিশ্বাসীরা যুক্তি খুঁজে, যারা বিশ্বাস করে তাদের কাছে পরম সত্য হয়ে ধরা দেয়। শুধু ভক্ত হরিদাস বা রসখান নয় মথুরা বৃন্দাবন জুড়ে এসেছেন আরো কত ভক্ত সাধক। ১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারী মাসের শেষ সপ্তাহে মথুরবাবুর সঙ্গে শ্রীরামকৃষ্ণদেব কাশী হয়ে বৃন্দাবনে আসেন। সেখানে নিধুবনের কাছে এক বাড়িতে এসে উঠেন। এখানে তিনি যমুনা তীরে রাখাল বালকদের দেখে 'কৃষ্ণ কোথায়, কৃষ্ণ কোথায়' বলে কাঁদতেন। শ্রীরামকৃষ্ণদেব বৃন্দাবনে এসে বৈষ্ণবের মালা তুলসী নিয়ে গোঁসাই হয়েছিলেন। গভীরভাবে কৃষ্ণ লীলাভূমিতে এসে মাঝে মাঝে সমাধিস্থ হয়ে যেতেন। শোনা যায় তিনি আত্মহারা হয়ে বাঁকেবিহারীজীর বিগ্রহকে আলিঙ্গন করতে ছুটে গিয়েছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন চিরকালের মত বৃন্দাবনে থেকে যেতে। কিন্তু দক্ষিণেশ্বরের মায়ের কথা ভেবে তিনি আবার ফিরে যান। বৃন্দাবন থেকে ফিরে আসবার সময় এক মুঠো মাটি নিয়ে এসেছিলেন। সেই মাটি তাঁর সাধনক্ষেত্র পঞ্চবটিতে ছড়িয়ে দিয়ে বলেছিলেন ‘আজ থেকে এই স্থান বৃন্দাবনের মতোই পবিত্র হয়ে গেল’।
পরবর্তী অংশ চতুর্দশ পর্বে
0 Comments