জ্বলদর্চি

বার্লিনের ডায়েরি /৮ পর্ব /চিত্রা ভট্টাচার্য্য

বার্লিন টাওয়ার

বার্লিনের ডায়েরি   
৮ পর্ব  
চিত্রা ভট্টাচার্য্য     
                                     
উৎসবের বার্লিন        

প্রতিদিনের মত সাত সকালেই ঘুম ভেঙে যাওয়ায় কাইজার স্ট্রীটের এপার্টমেন্টের রাস্তার ধারের জানলায় গরম কফির মগ হাতে শ্রীময়ী এসে দাঁড়ালো। চারতলার ওপর দেওয়াল জোড়া  এই জানলা টি   থেকে মাথার ওপরে উন্মুক্ত আকাশ আর নীচের দিকে কর্মব্যস্ত রাজপথ দুই ই দেখা যায়। নীরবে সময় কেটে চলেছে বাইরের পৃথিবীর এক চলমান জীবন কে বন্ধ কাঁচের ভিতর থেকে নিবিড় ভাবে অনুভব করার সুযোগে। যেমন সন্ধ্যে থেকে রাত কাটে এখানে বসেই আলোক মালায় সজ্জিত রাতের বার্লিন কে দেখে। প্রকৃতি তে পরিবর্তন এলে ,পলে পলে সে রূপের রানী তার নিজের খেয়ালের সাজে আত্মপ্রকাশ করে। সেদিন এখানে বসেই ও প্রথম অবাক হয়ে দেখেছিল আকাশ ময় কালো বরণ মেঘ থেকে পেঁজা তুলোর মত স্নোফল --যেন মুঠো মুঠো জুঁই ফুল ঝরে পড়ছিল। নিত্যদিনের কুয়াশাচ্ছন্ন খেয়ালীপনার দূর্ভেদ্য জাল ছিন্ন করে শিশু সূর্যের প্রথম প্রকাশে ঝলমল করে ওঠা দিনের শুরু। কিম্বা রাতের আঁধারে ঝিলমিলি তারায় ভরা আকাশ ,ইশারায় ইশারায় পথ দেখিয়ে নিয়ে চলে অদেখা কোন অনন্ত লোকে। শ্রী অন্তহীন খুশিতে ঋষভ কে ডেকে দেখায়, ওর কল্পনার শুকতারা সন্ধ্যাতারা , স্বাতী ,পুষ্যা ,ফাল্গুনী সব যেন সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মেঘ মুক্ত কালো আকাশের গায়ে।  
দেওয়ালের ভাস্কর্য

 আজ খেয়ালী রোদের প্লাবনের উজ্জ্বল আলোর ছোঁয়ায় এখানের শীতে জর্জড়িত জন জীবনে উৎসবের ছোঁয়া লেগেছে। চার তলার ওপর থেকে দেখা যায় জনসমুদ্রের উত্তাল ঢেউ।  হলদে ফর্সা লম্বাস্মার্ট মানুষ গুলো বেশীর ভাগ  লাল নীল হলুদ সবুজ নানা রঙের গরম পোশাকের সাথে পালক ওয়ালা বাহারী টুপিতে সেজে রৌদ্রে রাঙা পথের ডাকে বেরিয়ে পরেছে। উৎসবের মেজাজে ফুটপাত জুড়ে চলেছে রঙের শোভাযাত্রা। চার দেওয়ালের ঘেরা টোপ থেকে বেরিয়ে মুক্তির আনন্দে জীবনের প্রতি পলকে আস্বাদন করার এমন বাঙময় প্রকাশ দেখে ঋষভ অবাক হয়ে ,--তিতির ,ও শ্রী কে বলে অচেনা ঐ দূরের পৃথিবীর হাতছানিতে,চলো আমরা ও বেরিয়ে পড়ি।  ফুটপাত জুড়ে চলেছে নানা রঙের শোভা যাত্রা।এখন থাঙ্কসগিভিং এর মরশুম তার ওপর খ্রীষ্ট মাস ও আসন্নপ্রায়। জীবন বোধের আবেগ মিলেমিশে বাতাসে গুনগুনিয়ে ভেসে বেড়ায় সজীব প্রাণের বার্তা। সবার রঙে রঙ মেলাতে অজানা খুশিতে তাল মিলিয়ে বার্লিনের পথে ওরাও আনন্দের সামিল হতে পথে বেরিয়েছে।                  রাইসট্যাগ বিল্ডিঙের সামনে।                                                                                                  
ইউরোপীয়ানদের নদী গুলোর নাম বেশ মিষ্টি। জার্মানির পূর্ব দিকে গড়ে উঠেছে বার্লিন শহর টি এবং তার ওপর দিয়ে অক্লান্ত বেগে প্রবাহিত হয়ে চলেছে চঞ্চলা স্রোতস্বীনি হ্যাভেল, ঢাহমে এবং স্প্রী, রাইন ইত্যাদি কত নদ ,নদী উপনদীর শাখা। ট্যুর ম্যাগাজিনের পাতায় নদীর ছবি গুলো দেখে শ্রী র সাথে তিতিরের মন ভারী ব্যাকুল,খুব ইচ্ছে করে সেদিনের মত কোনো নদীর ধারে আজ সারাদিন বসে কাটাবে। স্মৃতি চারণায় মশগুল শ্রী বলে ,স্প্রী নদীর তীরে বার্লিন ,এলবে নদী কে কেন্দ্র করে ড্রেসডেন ,টেমস নদীর তীরে লন্ডন। ঢাহমে ,দানিউব ,স্প্রী, হ্যাভেল রাইন কি সুন্দর সব নদী গুলোর নাম। তাদের সুললিত ছন্দে বাঁকা তলোয়ারের মত নিরবধি বয়ে গিয়ে দেশ দেশান্তরে উদভ্রান্তের মত ছুটে চলা। খুব ইচ্ছে করে এমন সোনালী সকালের আলোয় ,কাঁচের মত স্বচ্ছ নীল জলের স্রোতে ভরা টলমলে নদীর বাঁধানো ধার দিয়ে হেঁটে যেতে অথবা নদী তীরে যত খুশি সময় রোয়াকের ওপর ক্লান্ত পা দুটি ঝুলিয়ে বসে থাকতে। 
সামনেই নদীর বাঁকে শান বাঁধানো ভারী নির্জন স্থানটি খুঁজে উঁচু এক রোয়াকের কোণে বসে গভীর মনোযোগে কান পাতে জল তরঙ্গের ছল ছল শব্দে।  সাদা পাল উড়িয়ে জলে উচ্ছাস তুলে ভেসে যায় কত সওদাগরী জাহাজ  ,বিলাসী ক্র্রুজ ,ফেরীবোট, ট্রলার। ভ্রমণ চলেছে জলজানে । আকাশের ছায়া পরেছে জলে , অন্যদিকে গাছে দের নিবিড় সবুজ পাতার আড়ালে কত রকমের বিদেশী নাম না জানা পাখি দের কাকলি। রূপালী পরিযায়ী মাছেরা ঝাঁক বেঁধে ভেসে যায়।  নদীতীরে গড়ে ওঠা নব নির্মিত বিলডিং গুলোর ছবি প্রতিবিম্বিত হয়ে কেঁপে ওঠে 'কাকচক্ষু ' জল। রোমান্টিক শ্রীময়ী তখন স্বপ্ন ময় অচীনপুরে। মেঘলা দিনে নদীর দুকুল মেঘে ঢেকে যায় ছায়ার ঘোমটা টেনে বিষাদে মুখ লুকোয় শহর।  

  অপরূপ প্রকৃতির নিবিড় রূপ ডেকে নিয়ে যায় আরো সুদূরে। নভেম্বর মাসের শুরু থেকেই শীত বেশ জাঁকিয়ে নেমেছে। এতো হীম শীতল হাওয়া ,হাত পা দুটো অবশ হয়ে আসে ,ঠান্ডা যেন এক অদৃশ্য লোক থেকে কড়া চোখে তাকিয়ে থেকে শুধুই চাবুক কষায়। অদ্রিজা বলে বার্লিনে বেড়ানোর জন্য জুন -জুলাই মাস আদর্শ সময়। তখন গরম কালের আবহাওয়ায় প্রকৃতিতে অপরূপ রূপের লাবণ্য আসে। এমন বিরক্তিকর তীক্ষ্ন শীতল হাওয়ার দংশন থাকেনা। সেই সময় প্রকৃতির সাথে তাল মিলিয়ে  জনমানব মাতে বার্লিন উৎসবে। বিশ্বখ্যাত বিশাল আয়োজনের বার্লিন কার্নিভাল ও বার্লিন প্রাইড    এখানে অনুষ্ঠিত হয়। সারা শহরবাসী বিভিন্ন রকম বাহারি পোশাকে নানা সাজে সজ্জিত হয়ে এই কার্নিভালে যোগদান করে রাজপথ মাতিয়ে তোলে। অন্তহীন আনন্দের আতিশয্যের এরা যেন পাগল পারা। এমনকি বহির্বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে বহু মানুষ তখন এই উৎসব উপভোগ করতে বার্লিনে উপস্থিত হয়।
অটো রিক্সা

কিন্তু এখন তো উৎসবের সময় নয় তবুও পুরো শহরটি মুখর। নদীর ধারে বাঁধানো কিনারা জুড়ে   কনসার্ট ,থিয়েটার অপেরা পথসংগীত চলছে। রয়েছে  কফি পাব ,  বিদেশী রেস্তোরাঁ পিৎজা পাস্তা ,স্প্যাগেটি ,নুডুলসের নানা রকম কায়দার সাথে ওয়াইন, বিয়ার আরো কত শত পানীয়। সেখানে আড্ডায়  নারী পুরুষের অবাধ মিলন ,সবাই সমান খুশিতে যে যার মত আনন্দে মেতে আছে। বাঁধা বাঁধন হীন , শূন্যে ওড়া মুক্ত পাখির মতন স্বাধীন সুখী জীবন। মেলার ভীড়ে হাঁটতে হাঁটতে একটু দূরে এক খোলামেলা রেস্তোরাঁ দেখে সেখানে দারুণ ডিম ভাজার গন্ধে মোহিত হয়ে দাঁড়ালে ,আলাপ জমে ওঠে  ভিয়েত নামী দুই বন্ধুর সাথে। ওরা  ভারতীয় বন্ধুদের পরামর্শে খাবারের দোকান খুলেছে। মনে আছে চিকেন স্যুপ আর বেশ বড়ো  এক আটার রুটির ভিতরে ডিমের ওমলেট দিয়ে তাতে নানা সব্জি,বা মাংসের কিমা স্টাফ করে রোলের মত এক খাবার বানিয়েছে যা  এক টা খেলেই যথেষ্ট  ,তবে সে কলকাতার স্ট্রীট ফুড এগরোল বা চিকেন রোলের মত অত সুস্বাদু নয়।  
                                                                                                                                                                    
বার্লিন নগরীর ভিতরে  ৪৬ কিলোমিটার লম্বা স্প্রী নদীর যে মনোমুগ্ধ কর স্বচ্ছ ধারা বয়ে চলেছে তার দুই ধারে পার্লামেন্ট ভবন সরকারি দপ্তর প্রধান রেলষ্টেশন সাবেক পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানীর সীমান্ত মিউজিয়াম আইল্যান্ড গড়ে উঠেছে । পুরোনো স্থাপত্য শিল্প কে যথা সম্ভব সুরক্ষিত রেখেই নতুন নগর পরিকল্পনা করা হয়েছে। স্প্রী নদীর এক ধার ঘেঁষেই রয়েছে বার্লিনের প্রাচীর আর এক পাশে পূর্ব বার্লিন ট্রেন ষ্টেশন এবং তার পাশেই স্প্রী নদীর বুকে নির্মিত বিশাল কারুকার্য্য মন্ডিত ব্রিজ টি এক কালজয়ী ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে।  অগণিত স্থাপত্য শৈলী শিল্প দিয়ে সাজানো এই মহানগরী মাত্র দুই  তিন দিনের বেড়ানোয় দেখা সম্পূর্ণ হয় না। ঋষভ বলে মেয়ের কাছে আছি তাই এমনি করে দেখা নইলে বুড়ি ছুঁয়ে ফিরতে হতো। শ্রীময়ীর মনে ইতিহাসের প্রাচীন তথ্যের অনুসন্ধানের নেশা ,ওর মন ছুটে চলেছে প্রতিটি দেওয়ালের রন্ধ্রে রন্ধ্রে স্থাপত্য শিল্পের আশ্চর্য্য শৈলী তে। দেখার আনন্দে সারা দিন পথে কাটাতে পারবে ভেবেই খুশি মন। ঘরে ফেরার তাড়া নেই ,এখানে সারা রাত ট্রাম বাস ট্রেন চলে। 

 দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের করাল ধ্বংসের গ্রাসে ক্ষয় প্রাপ্ত এ  মহানগরীর সর্বত্রই করুন ইতিহাস বিজড়িত তবুও সবুজ সতেজ আনন্দে জীবন বোধে প্রাণ চঞ্চল এ নগরী তে কত জায়গা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সর্বত্র যা ভ্রমণ পিপাসু মানুষ কে অহর্নিশি আকর্ষণ করে। বিধ্বংসী যুদ্ধের পরে আবার নতুন করে নিপুন শিল্প কুশলতায় এ দেশ এবং নিজেদের কে এরা সুসংঘঠিত করে গড়ে তুলেছে গভীর আস্থায়। শহরের ভিতর ঘোরার জন্য অদ্রিজা তিনচাকার অটোরিক্সো ভ্যান দুই ঘন্টার জন্য ভাড়া নিয়েছে। বছর বাইশের ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ফোর্থ ইয়ারের রাশিয়ান ছাত্র ইউভান ,অফটাইমে এই সাধের ভ্যান টি চার বছর ধরে প্রায় প্রতিদিন ই চালিয়ে তার বিদেশে পড়ার ও থাকার খরচ তুলে নেয় । অবাক লাগে ওদের self respect এবং  ছোটোর থেকেই বিশেষ স্বাবলম্বী হওয়ার অর্জিত  শিক্ষা দেখে  ।   নদীর ধারে

 স্প্রী নদীর তীরে ঘুরে Reichstag Building  ওরা এসে পৌঁছলো। ইতিহাসের করুন ভগ্ন স্তূপ থেকে এক রোমহর্ষক অনুভূতি শ্ৰীময়ীর কানে  রেকর্ডকৃত এয়ারফোনে ধারা বিবরণীবেজে চলেছে। ভবনটির আশেপাশের সব ঐতিহাসিক স্থাপনার বিস্তারিত বিবরণ। এটি জার্মানির আগের সংসদ ভবন ছিল এবং  বিখ্যাত একটি স্থাপত্য শিল্প বিদ্যার অসাধারণ  নিদর্শন । ১৮৯৪ থেকে ১৯৩৩ সাল পর্যন্ত এটি জার্মান এম্পায়ারের পার্লামেন্ট ভবন হিসেবে ব্যবহৃত হয়। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পর খুব বেশি পরিমানে  ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল যা পরে সারিয়ে  সম্পূর্ণ আগের অবস্থায় ফিরিয়ে এনে ডয়েশেন আইনহাইট বা German reunification এর পর। বর্তমানে এর বাইরের অংশ ও অন্দরের আংশিক সবার জন্য উন্মুক্ত।  ভিতরে রেজিস্ট্রেশন করে ঢুকতে হবে। অন্দরে প্রবেশের পরে ওরা বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে যায়। এই ভবন টির ছাদের ওপরের কাঁচের তৈরী বিশালাকৃতির এক গম্বুজ আছে ,এই অংশ টুকু বাইরে থেকে দেখতে ছোট মনে হলে ও আসলে তা যথেষ্ট  বড়ো  এবং ,গোলাকার এক দীর্ঘ পথ বেয়ে ভবন টির একদম উঁচু ছাতে অদ্রিজা ,ঋষভ উঠে যাওয়ায় শ্রী ও ওদের পিছু নিয়েছিল। ঘুরে ঘুরে  ভবন টির ওপরের দিকে উঠতে শুরু বেশ কয়েক তলা ওপরে এসে  শহরের গুরুত্ব পূর্ণ অংশের অনেকটা   এক অপরূপ মন মুগ্ধ কর দৃশ্যাবলী যা সম্পূর্ণ শহর টাকে রূপকথার মায়া জালে জড়িয়ে রেখেছে।  

এককথায় বলাযায় ভবন টি নিউ রেনেসাঁ  ধাঁচে নির্মিত এবং এর কোনো প্রবেশ মূল্য নেই। অবাক নেত্রে শ্রী সব স্পর্শ করে চলেছে । বেশ কিছু বিদেশী ভ্রমণার্থী রাশিয়ান স্টুডেন্টরা নিজেদের ভাষায় এর ইতিহাস এর স্থাপত্য সম্পর্কে আলোচনায় রত । শ্রীময়ী কান পেতে শোনার চেষ্টা করলো কিন্তু ওদের  মাতৃভাষা বোঝার আশায় জলাঞ্জলি দিয়ে তিতিরের দিকে কৌতূহলে তাকায়। ঋষভ মজা করে বলে কি  বুঝলে এবারে বলো ? অদ্রিজা হতাশ হয়ে তাকায় , ওরা যে রাশিয়ান বলছে ! প্রবল হাওয়ায়  টুপি মোজা সোয়েটার গরম কোটের ওপর দিয়েও সমানে শৈত্য প্রবাহ পাগল করে দিচ্ছে।  তরতরিয়ে টাওয়ার থেকে নীচে নামার প্রতিযোগিতা চলে। এ বারে টোটো ছেড়ে আবার  ট্রেনে বাসে চড়ে ঘোরার গল্প। স্টেশনে নেমে  সহজ ছন্দে হেঁটে চলেছে ওরা, হাসি আনন্দে আপাততঃ পথ শ্রমের চলার ক্লান্তি উধাও।                                                                                 ক্রমশঃ

Post a Comment

0 Comments