দূরদেশের লোকগল্প— জর্জিয়া (এশিয়া)
সাপের শিক্ষা
চিন্ময় দাশ
দেশের রাজা ভারি সুশাসক। প্রজারা বেশ সুখে আছে। সবাই ভালবাসে রাজাকে। রাজাও ভারি সুখী।
একদিন রাতে একটা স্বপ্ন দেখল রাজা। রাজা দেখল, তার মাথার উপর একটা শেয়াল ঝুলে আছে ছাদ থেকে। সকাল থেকে রাজার মুখ ভার। মনে চিন্তা। এমন স্বপ্নের মানে কী।
রাজা দরবারে বসেছে। উজির বলল—মুখ ভার কেন?
নাজির বলল—মন খারাপ কেন?
শান্ত্রী বলল—কীসের চিন্তা মাথায়?
রাজা সবাইকে বলল তার রাতের স্বপ্নের কথা। জানতে চাইল—বলো তোমরা, এই স্বপ্নের মানে টা কী?
উজির মাথা চুলকাল—মাথায় কিছু আসছে না।
নাজির মাথা নাড়ল এদিকে ওদিকে—কিছুই বুঝতে পারছি না।
শান্ত্রীর মাথা পাথরের মতো স্থির—স্বপ্ন নিয়ে তার কাজ-কারবার নয়।
রাজা বলল—আজ যাক। কাল যাক। পরশু রাজের সব জ্ঞানী-গুণী পণ্ডিতদের ডাকো। তার কেউ এসে বলুক। পারলে, পুরষ্কার পাবে।
দু’দিন গেল। পরশুর দিন এলো। রাজ্যের যত জ্ঞানী-গুণী-পণ্ডিত হাজির হোল রাজার দরবারে। রাজা স্বপ্নের কথা বলল সবাইকে। কিন্তু সঠিক উত্তর যোগাল না কারও মুখে। এমন উদ্ভট স্বপ্নের কথা, তাদের বাপ-ঠাকুর্দা তো দূরের কথা, সাতপুরুষে কেউ শোনেনি কোনদিন।
পুরষ্কারের আশায় ঘর থেকে রওণা দিয়েছিল লোকগুলো। এখন ঘরে ফিরছে মুখ গোমড়া করে। সেই দূপুরবেলায় এক চাষিও ঘরে ফিরছিল খেতের কাজ সেরে। তার তো ভিরমি খাওয়ার জোগাড়! একসাথে এতজন পণ্ডিত মানুষ পথে কেন? কোথায় কী হোল আবার?
পণ্ডিতদের মুখে রাজার স্বপ্নের কথা শুনে, ভারি লোভ হোল চাষির। একবার দেখবে না কি চেষ্টা করে? পারবে না, সেটা ঠিক। কিন্তু এই মওকায় রাজার বাড়িটা তো দেখে নেওয়া যাবে। উল্টোমুখে রাজবাড়ির পথে হাঁটা শুরু করল চাষি।
কিছু দূর গিয়েছে। একটা সাপ রাস্তার উপর আড়াআড়ি শুয়ে আছে। ঈশ্বরের জীব। টপকে যাওয়া ঠিক নয়। এদিকে সাপ ব্যটার নড়বার কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। বিরক্ত হয়ে চাষি বলল—এ কেমন ধারা ব্যাপার, বাপু? রাস্তা ছাড়ো। দেরি হয়ে যায় যে।
সাপ নড়ল না। সাপ চড়ল না। হাসি হাসি মুখে বলল—কীসের তাড়া। কোথায় চললে?
চাষি তাকে রাজার স্বপ্নের কথা সব খুলে বলল। সাপের গলায় তাচ্ছিল্য—অতগুলো পণ্ডিত কেউ পারল না ব্যাখ্যা করতে?
চাষি বলল—কেন হে? তুমি পারবে না কি বলতে?
সাপ বলল—পারি। কিন্তু বলব কেন? রাজা তোমায় যে ধন দেবে, আমাকে তার অর্ধেক দেবে?
শুনে চাষির চোখ চকচক। মন উশখুশ। তর সয় না। বলল—দেব না কেন? আলবাৎ দেব।
সাপ বলল— শেয়াল মানে বোঝ না? মহা ধূর্ত। রাজাকে সতর্ক হতে বলো। দেশের অবস্থা ভালো নয়।
চাষি আনন্দে নাচতে নাচতে রাজবাড়িতে হাজির। এলো তো। ঢোকা কি আর মুখের কথা? দেউড়ির পাহারাদার তাকে যেতে দেবে কেন? বলল— তোমাকে তো ডাকা হয়নি, বাপু। চলে যাও এখান থেকে।
চাষি বলল—ঠিক আছে, ফিরেই যাই তাহলে। পরে, তোমাকে কিন্তু শূলে চড়তে হবে, রাজার কানে গেলে।
শূলের কথায় কে না ডরায়? পাহারাদার বলল—চলো, চলো। ভেতরেই পৌঁছে দিই তোমাকে।
চাষিকে দরবারে দেখে উজির হাসে। নাজির হাসে। শান্ত্রী তড়পে উঠল-- পণ্ডিতরা সব গেল ঘর। চাষি বলে আমাকে ধর। ভাগো এখান থেকে।
রাজা তো ভালোমানুষ। বলল—গরীব দেখে অচ্ছেদ্দা কোর না হে। বলতেও তো পারে। কত কিছু দেখেছে জীবনে। শুনেওছে কত কিছু। বলো তুমি, আমার স্বপ্নের মানে কী?
অনুমতি পেয়ে, চষি ভারি খুশি। ইয়াব্বড় একটা কুর্নিশ ঠুকে দিল রাজাকে। বলল—দেশের রাজা ভালো। তাই বলে, সব প্রজা কি আর ভালো? কতই ধুর্ত, কপট, বিশ্বাসঘাত। রাজ্য তোমার দেবে নিপাত। মানুষ চেনা এতোই সোজা? বাইরে থেকে যায় না বোঝা।
রাজার মুখ গম্ভীর। রাজা উজিরের দিকে চাইল। মাথা নাড়ল উজির—এক্কেবারে ঠিক কথাই বলেছে। ধূর্ত শেয়ালের স্বপ্নই তার প্রমাণ। সাবধান হতে হবে আমাদের।
আনন্দে লাফিয়ে উঠল রাজা। সোনার কঙ্কণ পরা ছিল দু’হাতে। নিজে কঙ্কণ খুলে চাষির হাতে পরিয়ে দিল।
দরবারে রাজাকে সাবধান করে দিয়ে এলো চাষি। বেরিয়ে এসে, ধূর্তামি চেপে বসল তার নিজের মাথাতেই। যে পথে এসেছিল, সেদিক মাড়ালই না ফিরতি বেলায়। একজোড়া সোনার বালা! তাও আবার দেশের রাজার হাতের বালা! এ জিনিষের ভাগ কখনও সাপকে দেওয়া যায়? অন্য রাস্তা ধরে বাড়ি চলে গেল।
কিছুদিন গেল। আবার একদিন স্বপ্ন দেখল রাজা। এবার দেখল, খাপখোলা একটা তরোয়াল ঝুলছে ছাদ থেকে।
পরের দিন। মনে চিন্তা নিয়ে, রাজা দরবারে বসেছে। উজির বলল—মুখ ভার কেন?
নাজির বলল—মন খারাপ কেন?
শান্ত্রী বলল—কীসের চিন্তা মাথায়?
রাজা সবাইকে বলল তার রাতের স্বপ্নের কথা। জানতে চাইল—বলো তোমরা, এই স্বপ্নের মানেটা কী?
উজির মাথা চুলকাল—মাথায় কিছু আসছে না।
নাজির মাথা নাড়ল এদিকে ওদিকে—কিছুই বুঝতে পারছি না।
শান্ত্রীর মাথা পাথরের মতো স্থির। সে বলল—আমরা আবোল-তাবোল বকে মরব কেন? হুকুম পেলে, সেই চাষিকে তুলে আনি।
ধড়ে প্রাণ এলো রাজার—তুলে আনো। কিন্তু খাতির করে। অযত্ন না হয় তার। তোমাদের মগজ তো বুঝতে বাকি নাই। এটা মনে রেখো—মগজ যার, খাতির কিন্তু তারই।
রাজার পাইক এসে হাজির চাষির ঘরে—চলো হে, রাজা আবার স্বপ্ন দেখেছে।
শুনে, চাষির বউ তো আনন্দে গদগদ। রাজার স্বপ্ন মানে আবার পুরষ্কার আনবে তার স্বামী। এদিকে স্বামীর মাথায় তো ব্জ্রাঘাত। সাপের কথাতেই তো পুরষ্কার জুটেছিল কপালে। কিন্তু তার সাথেই তো ধূর্তামি করেছে গতবার। আবার তার কাছে গেলে, আর রক্ষা নাই। এক ছোবলেই সব ধূর্তামি শেষ।
এদিকে রাজা পেয়াদা পাঠিয়েছে। না গেলে, বেঁধে নিয়ে যাবে। সোজা শূলে চাপিয়ে দেবে। দু’দিকেই মরণ। অনেক ভেবে, সাপের রাস্তাতেই চলল চাষি। যা হয় হবে।
সেদিনও সাপ শুয়ে আছে রাস্তায়। চাষির বুক ধুকপুক। এই বুঝি ছোবল মারে। সাপ কিন্তু বলল না কিচ্ছুটিই। মুখে বলল—এ তো অতি সহজ কথা। খোলা তরোয়াল মানেই যুদ্ধ। সামনে বিপদ রাজার। সাবধান হতে বলো।
এখন মনে বেশ সাহস তার। ড্যাঙ-ড্যাঙ করে নাচতে নাচতে দরবারে হাজির হোল চাষি। রাজা বলল—কাল রাতে স্বপ্ন দেখেছি। এবার দেখেছি একটা খোলা তরোয়াল। ঝুলেছে আমার মাথার ওপর।
চাষি বলল—খুব সাবধান। মানে হোল, সামনে বিপদ আসছে। যুদ্ধ-টুদ্ধ লেগে যাবে শিগগির। বাহিনী সাজানো দরকার।
রাজা চোখ কোঁচকালো। উজির মুখ বাঁকালো। নাজিরের চোখের কোণে ব্যাঙ্গের হাসি। শান্ত্রী ধমকে উঠল—হতচ্ছাড়া! যুদ্ধের খবর আমি জানলাম না। আর, তুই এলি রাজাকে ভয় দেখাতে?
রাজার অসীম আস্থা লোকটার উপর। সে কিছু বলতে গেল। তখনই হুড়মুড় করে একটা লোক ঢুকে পড়ল দরবারে। দরদর করে ঘাম ঝরছে। ঘোড়া ছুটিয়ে এসেছে অনেক দূর থেকে তো? তাই ঘামের বন্যা।
লোকটাকে দেখে কিছু বুঝবার উপায় নেই। আসলে সে রাজার গুপ্তচর। হাঁফাতে হঁফাতে বলল—ভারি বিপদ আমাদের। পূব দেশের রাজা সেনা সাজাচ্ছে। তৈরি হতে হবে আমাদের।
শান্ত্রী ছুটল সেনা সাজাতে। রাজার মনে কিন্তু বেজায় আনন্দ । গলার মতিহার খুলে, চাষিকে পরিয়ে দিল নিজের হাতে।
এবার কিন্তু চাষি ফিরছে সাপের রাস্তা ধরেই। সাপ বলল—আমার অর্ধেক ভাগ দাও।
চাষি বলল—অবশ্যই। কেন দেবো না? তবে, গজমতির হার পেয়েছি তো। কেটে দু’ভাগ করতে হবে। তবে না তোমাকে দেব? কাস্তে গোঁজা ছিল কোমরে। সেটা বের করে, মস্ত এক কোপ বসাতে গেল সাপকেই।
আঁতকে উঠে, কোন রকমে ছিটকে পালাতে গেল সাপটা। তবে, পুরো রেহাই হোল না তাতে। লেজের খানিকটা কাটা পড়ে গেল বেচারার।
কিছুদিন গেল। আবার রাজার পেয়েদা এসে হাজির চাষির ঘরে। ভয়াণক ঘাবড়ে গেল চাষি। মুখে বলল—আবার কী হোল হে? এবার কী স্বপ্ন?
--আর বোল না। এবার একটা মুণ্ডু কাটা ভেড়া এসেছে স্বপ্নে। পেয়াদা বলল—সে যাই হোক, তুমি বাপু তাড়াতাড়ি চলে এসো।
আকাশের বাজ ভেঙে পড়ল চাষির মাথায়। বেকুবের মতো কাজ হয়ে গিয়েছে। প্রথম বারে পুরষ্কারের ভাগ দেয়নি। সাপ কিন্তু কিচ্ছুটি বলেনি। গতবারে ভাগ দেবে কী, উলটে সাপকেই মেরে ফেলতে গিয়েছিল। অথচ, সাপের জন্যই এত সোনা-দানা মণি-মুক্তো এসেছে তার ঘরে। মরমে মরে যাচ্ছে মানুষটা।
সাপের রাস্তাতেই রওণা দিয়েছে। সাপ কিন্তু পুরাণো কথা তুলল না। বলল—এবারে কী স্বপ্ন?
চাষী বলল, পেয়েদার মুখে যা শুনেছে। সাপ হাসি মুখে বলল—ভারি সোজা কথা। ভেড়া হোল দুনিয়ায় সবচেয়ে শান্তশিষ্ট জীব। বিবাদ নেই কারও সাথে। রাজার এখন সময় ভালো। নিশ্চিন্তে থাকতে পারে।
দরবারে পৌঁছে সাপের কথাগুলো সাত কাহন করে বলে গেল চাষি। সামনে কোন বিপদ নাই। দুষ্টু লোকেদের স্বভাব বদলেছে। প্রজারাও শান্তিতে আছে।
শুনে রাজা আহ্লাদে গদগদ। বেশ নিশ্চিন্তে দিন কাটানো যাবে এবার। এক থালা মোহর ধরে দিল চাষির হাতে। বলল—তুমি আর গাঁয়ের ঘরে পড়ে থাকো কেন হে? এই রাজবাড়িতেই থাকো তুমি। এমন একজন বিচক্ষণ লোক আমার সাথে থাকা দরকার। এখানেই থেকে যাও তুমি।
চাষির তো আছাড় খেয়ে পড়ে যাওয়ার জোগাড়।এখানে থাকলে তো সাপের মরামর্শ নেওয়ার উপায় থাকবে না। তার নিজের যে কতো মুরোদ, সেটা তার অজানা নয়। সে বলল—না, না। চাষিবাসী মানুষ আমি। গাঁয়ের ঘরেই ভালো আছি। দরকার মতো ডাকলেই চলে আসবো। বলে, কোন রকমে সরে পড়ল দরবার থেকে।
সাপের রাস্তাতেই ফিরছে। দেখা হতে, সাপকে বলল—আমাকে ক্ষমা করে দাও, বন্ধু। মাথায় আমার ভূত চেপেছিল। প্রথম বারে তোমার ন্যায্য ভাগ না দিয়ে সরে পড়েছিলাম। গতবারে তোমাকেই মেরে ফেলতে গিয়েছিলাম। নিজের ভুল বুঝতে পেরেছি। শুধরাতে দাও আমাকে। এবার এই এক থালা মোহর পেয়েছি। আদ্ধেকটা নয়। থালাভর্তি মোহর—পুরোটাই তুমি নাও। বলে, মোহরের থালাটা নামিয়ে দল মাটিতে।
সাপ হেসে বলল—মনে কোন দুঃখ বা গ্লানি রেখো না, বন্ধু। তুমি আমি সবাই এই সমাজের জীব। এর বাইরের কেউ নয় আমরা। তখন ধূর্ত, বিশ্বাসঘাতক লোক ছিল রাজ্য জুড়ে। তোমার মধ্যেও ছিল সেসব দোষ। তুমিও তাই অন্যের ন্যায্য পাওনা না দিয়ে, অন্য রাস্তায় সরে পড়েচিলে। গতবারে রাজ্যে ছিল যুদ্ধের পরিস্থিতি। মারামারি, হানাহানি, রক্তপাত। তুমিও সেই পথ ধরেছিলে। মেরে ফেলতে চেয়েছিলে আমাকে। আর, এবার এই রাজ্য জুড়ে শান্তি বিরাজ করছে। সবাই হাঁটছে ভালোমানুষির পথে। তুমিও হাঁটছ সে পথেই। নিজের ভুলের জন্য অনুশোচনা হয়েছে। নিজের সব ভুল শুধরে নিতে চাও। এতেই তো বোঝা যায়, নিজেকে শুধরে নিয়েছ তুমি। নিজেকে শুধরে নেওয়ার চেয়ে বড় কিছু নাই দুনিয়ায়।
চাষির মুখে কথা যোগাচ্ছে না। সাপ হেসে বলল—কিছু বলবার দরকার নাই, বন্ধু। নিশ্চিন্ত মনে বাড়ি যাও। আর হ্যাঁ, যখনই কোন দরকার পড়বে, আমার কাছে চলে এসো।
0 Comments