জ্বলদর্চি

বিস্মৃতপ্রায় সাহিত্যিক ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় / নির্মল বর্মন

বিস্মৃতপ্রায় সাহিত্যিক ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় 
         
নির্মল বর্মন 

প্রাবন্ধিক ধূর্জটি প্রসাদ মুখোপাধ্যায় ঔপন্যাসিক , প্রাবন্ধিক ও সমালোচক হিসেবে জনপ্রিয়তার শীর্ষে পাক্কা আসন লাভ করেছিলেন । প্রাবন্ধিক ধূর্জটি প্রসাদ মুখোপাধ্যায় ৫ই অক্টোবর ১৮৯৪ এ চাতরা শ্রীরামপুরে বাবা ভূপতিনাথ ও মাতা এলোকেশী দেবীর ঘরে জন্ম গ্ৰহন করেন।বাবা বারাসত কোর্টের আইনজীবী ছিলেন। ধূর্জটি প্রসাদ মুখোপাধ্যায় ওরফে ডি.পি.মুখার্জী নামে সমধিক পরিচিত।পত্নী ছায়া দেবী। অধুনা সুরেন্দ্রনাথ কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে এম.এ ও অর্থনীতি তে এম.এ পাশ করেন।বঙ্গবাসী কলেজে প্রথমে অধ্যাপক ছিলেন।ঔপন্যাসিক ধূর্জটি প্রসাদ লেখালেখির পাশাপাশি সংগীতচর্চাতেও মনোনিবেশ ছিলেন। প্রাবন্ধিকের মাতা  এলোকেশী দেবী টপ্পা ও উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের সুগায়িকা হিসেবে পরিচিত পেয়েছিলেন। ধূর্জটি প্রসাদের 'সুর ও সঙ্গতি' পুস্তকটি সঙ্গীত কেন্দ্রীক পত্রালাপের সংকলন হওয়ার জন্য বাংলার সারস্বত সমাজে চিরস্মরণীয়।  এছাড়াও দেশ বিদেশের সাহিত্য,সংস্কৃতি, সমাজ,রাজনীতি ও শিল্প সম্পর্কে তাঁর দায়বদ্ধতার মূল্যায়ন বহু প্রবন্ধ নিবন্ধের মাধ্যমে বিভিন্ন পত্রিকায় স্থান পেয়েছে । বস্তুতঃ  প্রাবন্ধিক 'সবুজ পত্র' ও 'পরিচয়' পত্রিকা গোষ্ঠীর সঙ্গে  ওতোপ্রোতভাবে কয়েক বছর যুক্ত ছিলেন। ঔপন্যাসিক ধূর্জটি প্রসাদের "বঙ্গবাণী", "দিগন্ত","পূর্বাশা", "দেশ" পত্রিকায়  নিয়মিত প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল।
প্রাবন্ধিক  এম. এ. ( অর্থনীতি) পাশ করে  বহুস্থানে 'অর্থনীতি' ও 'সমাজতত্ত্ব' বিষয়ে লব্ধপ্রতিষ্ঠিত অধ্যাপনায় নিযুক্ত হয়েছিলেন। অধ্যাপক ধূর্জটি প্রসাদ 'লক্ষ্ণৌ বিশ্ববিদ্যালয়' , 'আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়'  বেশ কয়েকবছর অধ্যাপনায় নিযুক্ত ছিলেন। বিদেশে বিশেষত হল্যান্ডের হেগ শহরে ইনস্টিটিউট অফ সোশ্যাল স্টাডিজের   সমাজতত্ত্ব বিভাগের  ভিজিটিং প্রফেসর  হিসেবে সুযশের অধিকারী হতে পেরেছিলেন । ৫ই ডিসেম্বর ১৯৬১ এতে কলকাতা তে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
প্রাবন্ধিক ও অধ্যাপক ধূর্জটি প্রসাদ মার্কসীয় নন্দনতাত্ত্বিক পুরোধা পুরুষ ছিলেন।১৯৩৭-৪০ অবধি গোবিন্দ বল্লভ পন্থ নেতৃত্বাধীন উত্তরপ্রদেশ সরকারের ডিরেক্টর অফ ইনফরমেশনের  পদ অলংকৃত করেছিলেন।১৯৫২ এ ইকনমিক ডেলিগেট হয়ে রাশিয়া যান।
প্রাবন্ধিক গবেষক ও অধ্যাপক ধূর্জটি প্রসাদের প্রবন্ধগ্রন্থ ও সংকলনগ্ৰন্থ গুলি হল:-- 
"আমরা ও তাঁহারা"(১৯৩১),"চিন্তয়সি"(১৯৩৩),"অন্তঃশীলা" "সুর ও সঙ্গীত" (১৯৩৭), "কথা ও সুর" (১৯৩৮), "মনে এলো" (১৯৫৬), "বক্তব্য"(১৯৫৭), "ঝিলিমিলি"(১৯৬৫), মোহনা (১৯৩৪),"Basic concepts of sociology", "Diversities" , "Personality and the Social Science","Indian Music,An Introduction", "Modern Indian Culture", "Sociological Study", "Problems of Indian Youth","Views and Counterviews", "On Indian History"    ও "Realist"প্রভৃতি। 
                        অধ্যাপক  মুখোপাধ্যায় "যুধিষ্ঠির দাস" ছদ্মনামেও অজস্র প্রবন্ধ রচনা করে বাংলার সারস্বত সমাজে সাড়া ফেলেছিলেন।
বস্তুতঃ প্রবন্ধের বিষয়বস্তু সাহিত্য, সঙ্গীত, শিল্প, ইতিহাস অর্থনীতি ও বাণিজ্য এবং সমাজতত্ত্ব। প্রাবন্ধিক মার্কসীয় দৃষ্টিতে সমাজভাবনার বিষয়টি বিভিন্ন প্রবন্ধ নিবন্ধ ছাপাক্ষরে লিপিবদ্ধ ।  
                  ঔপন্যাসিক ধূর্জটি প্রসাদের 'মার্কসবাদ ও মানবধর্ম' (বক্তব্য) প্রবন্ধে মার্কসবাদের বিপক্ষে বহুল প্রচারিত বিষয়গুলো খণ্ডন করে মার্কসবাদের জনকল্যাণকর দিকগুলি উন্মোচন  করেছেন। দৃষ্টান্তস্বরূপ:-
১. "মোদ্দা কথা এই মার্কসবাদ সেই বস্তু পুরাতন মনুষ্যধর্মের আধুনিক সংস্করণ"। 
২. “মার্কসবাদের অন্য গলদ থাকতে পারে; তবে ব্যক্তিত্ব নামক কল্পিত বস্তুর বিশেষ রকমের উন্নতিবিধানের স্থান, কিংবা জল্পনা কল্পনা মার্কসবাদে নেই বলে তার সমালোচনা চলে না; কারণ, তা হলে সমগ্র মানবপ্রচেষ্টার গতির বিপক্ষে যেতে হয়; জ্ঞানের ইতিহাসকে অপমান করা হয়। মার্কসবাদের সঙ্গে মানবধর্মের সম্বন্ধ পুরুষতত্ত্বের (Personalism) ভেতর দিয়ে, ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যের মারফৎ নয়"! 
আধুনিক ভাবনার যুগপুরুষ ধূর্জটি প্রসাদ মার্কসবাদের প্রয়োগের উপর গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। অধ্যাপক মানুষটি নিছক রাজনীতির আলোচনায়  পক্ষপাতী ছিলেন না, বরং প্রগতিশীল মনোভাবকে পাথেয় করে  বুদ্ধিবৃত্তির প্রকাশকে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন। সমাজ ও রাজনীতি বিষয়ক নিবন্ধগুলিতে সাবলীল প্রমাণ । সামাজিক সাংস্কৃতিক প্রগতি যে মানসিকতার উদারতায়  কেবল মাত্র সম্ভব তা তিনি মনেপ্রাণে অনুভব করতেন।
           অধ্যাপক মুখোপাধ্যায়ের সাহিত্য সমালোচনার ক্ষেত্রে নির্মল  স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গির অকাট্য প্রমাণ জলের মতো স্বচ্ছ "বর্তমান সাহিত্যের মূলকথা"প্রবন্ধে প্রমানিত। 
একদা 'রবীন্দ্রসাহিত্যকে যে বুর্জোয়া সাহিত্য' বলা হত তার প্রবল প্রতিবাদ জানিয়ে প্রবন্ধে লিখে ফেললেন। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক ধূর্জটি প্রসাদের মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য:--
 ‌        "আমার মনে হয় রবীন্দ্র-সাহিত্যকে বুর্জোয়া সভ্যতা ও শ্রেণীর প্রতিভূ বলার মধ্যে বিচারের অভাব রয়েছে। বিষয় ও প্রতিজ্ঞা-subject ও theme, তথ্য ও মূল্য, অর্থাৎ fact ও value, অধুনা ও বর্তমান, এই প্রত্যয়গুলির পার্থক্য না বুঝলে সাহিত্যালোচনায় বড় বিপদে পড়তে হয়।"

প্রবন্ধিক রবীন্দ্রসাহিত্য ও রবীন্দ্রোত্তর সাহিত্যের পার্থক্যটি প্রণিধানযোগ্য :--
"প্রগতিশীল সাহিত্যিকরা অন্য প্রত্যয় ও প্রতিজ্ঞা সমষ্টি স্থাপনা করতে যাচ্ছেন, কিন্তু তাঁদের সৃষ্ট সাহিত্যে প্রত্যয়ের চেয়ে প্রতীতি এবং প্রতিজ্ঞার চেয়ে প্রতিশ্রুতিটাই স্পষ্ট। আমার একান্ত বিশ্বাস, রবীন্দ্রোত্তর বর্তমান বাংলা সাহিত্যের আদি- প্রত্যয়, প্রতিজ্ঞা, বিষয়, ইমেজ-ব্যবহার ও অন্যান্য আঙ্গিকের সূক্ষ্ম বিশ্লেষণের সময় এসেছে।"
            প্রাবন্ধিক ধূর্জটিপ্রসাদের সর্বপ্রথম প্রকাশিত প্রবন্ধ গ্রন্থ 'আমরা ও তাঁহারা' বাড়ির আড্ডার মেজাজে বিশ্ব ও বিশ্বজীবনের নানান জটিলতায় জ্বালানো বিষয় স্থান লাভ করেছে ।  প্রাবন্ধিক সূচনালগ্নে জানিয়েছেন:--
           "একদিকের বক্তা আমি, অন্যদিকের বক্তা তাঁহারা। ... শিক্ষাভিমানী বুদ্ধিজীবীকে এবং শহরের অন্য শ্রেণীর বন্ধুদেরকে প্রতীক হিসেবে নিতে হয়েছে। শ্লেষ-বিদ্রুপের মধ্য দিয়ে দুই শ্রেণীরই দোষগুণের ইঙ্গিত করেছি।" 
প্রাবন্ধিক ধূর্জটি প্রসাদের "আমরা ও তাঁহারা" গ্রন্থ  কিছু তথ্য উদ্ধৃত করা যেতেই পারে:--
"তাঁহারা-স্ত্রী-সাহিত্য ও পুরুষ-সাহিত্য দুটো আলাদা বস্তু নয় কি? আমি—বস্তু হয়ত একই। কিন্তু মানুষে যখন লেখে-জীবন দেবতা কিংবা daemon-এ যখন লেখে না, তখন লেখার রূপ ভিন্ন হতে বাধ্য। সাহিত্যে রূপের ভাগটাই বেশি চোখে পড়ে, তাই পার্থক্যটাই প্রধান কথা হয়তো সবসময়ে নয়। আমাদের দেশের মেয়েদের লেখা নিয়ে পুরুষদের মন্তব্য পড়লে জনগণের dancing dog-এর ওপর মন্তব্যের কথা স্মরণ হয়। মেয়েরা আমাদেরকে গভীরভাবে নিচ্ছেন, এই দেখলেই হৃদয় আনন্দে ও কৃতজ্ঞতায় এতটাই পরিপ্লুত হয় যে, প্রকাশভঙ্গি এবং বক্তব্য নিয়ে বিচার করাই অমানুষিকতা ও অসভ্যতা বলে ঠেকে।" 
"চিন্তয়সি" গ্ৰন্থেতে রয়েছে প্রাবন্ধিকের বৈজ্ঞানিক জ্ঞান ও মননের বস্তনিষ্ঠপরিচয়। স্বদেশ, সাহিত্য ও মানুষ মিলেমিশে  একাকার হয়ে সুন্দর দৃষ্টিভঙ্গি গঠিত-যা এই প্রবন্ধে উদ্‌ঘাটিত । ধূর্জটি প্রসাদের "আত্মনিষ্ঠ" প্রবন্ধ হিসেবে  'মনে এলো' ও 'ঝিলিমিলি' কালজয়ী। 
       বস্তুতঃ 'মনে এলো' গ্রন্থের ভূমিকলগ্নে প্রাবন্ধিক গবেষক সাহেব জানিয়েছেন যে:--- "একলা খাবার টেবিলের ধারে বসে নিজের সঙ্গে যা কথোপকথন করেছি এ খানিকটা তাই।"
প্রাবন্ধিক, গবেষক , ঔপন্যাসিক ও অধ্যাপক ধূর্জটিপ্রসাদ বিষয়বৈচিত্র্যে, পাঠক জনপ্রিয়তার অভিজ্ঞতার সমাহারে, উদার ও উন্নত মনোভঙ্গির সুপ্রকাশে, পরিশীলিত মনন ও চিন্তাপদ্ধতির  আধুনিক প্রয়োগে এবং বাংলা ভাষা ব্যবহারে যে পিনন্ধ মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়ে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকলেও কালের বেড়াজালে আজ প্রায় বিস্মৃতপ্রায় সাহিত্যিক হিসেবে পরিগণিত।

Post a Comment

1 Comments

  1. ভালো লাগলো পড়ে

    ReplyDelete