শব্দে গাঁথা মণি-মালা : ৩৪
সালেহা খাতুন
‘দেখো মাটি কত মেহেরবান’ যখন গাইছি তখন সবাই মন দিয়ে একেবারে শুষে নিচ্ছিল গানটিকে। থামার পর হাততালিতে মুখরিত হয়ে যায় সমগ্র এলাকা। আমাদের গ্রামের বর্ষীয়ান মানুষ শ্রীযুক্ত রামচন্দ্র ঘোষ মহাশয় বাবাকে বলেন ‘অদুদ মেয়ের যত্ন নাও। তুমি দেখে নিও একদিন ওর পরিচয়ে তুমি সম্মানিত হবে’।
সেবার আমাদের এলাকায় অনুষ্ঠিত ওম্যান অ্যাওয়ারনেস প্রোগ্রামে আমাকে কিছু প্রশ্ন করার সুযোগ দিয়েছিলেন আয়োজকরা। প্রশাসনিক স্তরের বেশ কিছু মানুষ ছিলেন। আমি রিসোর্স পার্শন এবং উদ্যোক্তাদেরই প্রশ্ন করে বসি, এই যে আপনারা মঞ্চে বসে নারীদের সচেতন করছেন তাদের উন্নয়নের কথা ভাবছেন কিন্তু বুকে হাত দিয়ে বলুন তো ঘরে এবং বাইরে আপনারা কোনোদিন কোনো নারীকে নিপীড়ন করেন নি? মঞ্চে বসে যে কথা বলছেন ঘরে গিয়েই ভুলে যাবেন। তরকারিতে নুন হয়নি বলে স্ত্রীর মুখে তরকারির বাটি ছুঁড়ে মারবেন। আপনারা কথার কথা বলছেন। কাজের কথা বলছেন না। রামচন্দ্র ঘোষ তখনও বলেছিলেন ‘এ মেয়ে প্রশ্ন করে আমাদেরই ঘায়েল করে দিল হে। আমাদের আয়োজন সত্যিই সার্থক হলো’।
ঐ তিরানব্বইয়ের আগস্টেই ‘নারীর মূল্যায়ন’ নামে একটি কবিতাও লিখি -
আমরা বঙ্গনারী
বেশ লোভনীয় বস্তু,
কবিরা বলে গেছেন
হৃদয় আমাদের মধুভরা।
অথচ একটু খুঁজলে
হয়তো পাওয়া যেতো
সমস্ত নারীর
অশ্রু গোপন করা ইতিহাস।
পিছন পানে মুখ ফিরিয়ে
অনেক অনুসন্ধান চালাই,
কোনো নারী কি আছে
যার নেই কোনো আক্ষেপ?
বিশ্বাস করো
একজনকেও পাই নি খুঁজে,
এমনকি আমিও
পড়ি সেই দলে।
যতদিন ভাবনা করার
শক্তি থাকে না
ততদিনই ভালো,
কিন্তু সে তো পশুর জীবন।
তারপর আসে
একরাশ স্বপ্নভরা দিন,
নিঃশেষে মেলে দিয়ে
হয়ে যাও বিলীন;
নতুবা মুক্ত মানুষরূপে
হাহাকারে কাটাও দিন।
উত্তাপ আনন্দ শেষে
ধীরে ধীরে বার্ধক্য আসে
ফুরায় জীবনের
সব লেনদেন।
ভারী বিস্ময় লাগছে! নিজের অবস্থা নিজেই বুঝতে পারছিনা। প্রখর রৌদ্র-আলোকিত মধ্যাহ্নে এ কবিতা লিখে আমার মনটা তালগাছের ঝোড়ো হাওয়ার দোলার সঙ্গে দুলছে। কিন্তু এর স্বরূপ বুঝতে পারছি না। নিজেকেই বড়ো দুঃসহ মনে হচ্ছে। মাঝে মাঝে স্নিগ্ধ বাতাস এসে একটু স্বস্তি দিলেও মাথা থেকে যেন আগুন বেরোচ্ছে। কিছুই বুঝতে পারছি না, এর আবার বিশ্লেষণ কী করবো?
বৃথা এ লেখনীধারণ। আমার কষ্ট লাঘবের বড়ো অস্ত্র এটা। কিন্তু এও পারছে না। মনে হচ্ছে সবাই আনন্দে আছে। বাড়ির আশপাশে সবাই গান শুনছে, তাও যেন আমার কাছে এখন বিরক্তিকর। বইয়ের মধ্যে ডুব দিয়ে সমগ্র জগতকে ভুলে যাওয়া আমি, বইয়ের মধ্যেও খুঁজে পাচ্ছি না শান্তি। এ কী হলো? কা কা রবে ভরে যাচ্ছে মধ্যাহ্নের নির্জনতা। সামনেই খেজুর গাছের ঝমঝম শব্দ শুনতে পাচ্ছি। আর কাঠবেড়ালীর অনর্গল বক্তৃতায় কান ঝালাপালা। আমি কি সমাধিস্থ হবো? ভাবসমাধি ঘটবে আমার? ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটালো এক ঘাড় উঁচু করা মোরগ। তারস্বরে তার সঙ্গিনীকে আহ্বান করে চলেছে। রেলগাড়ির শব্দও আসছে। আর বসে থাকলে চলবে না। তার গতি আমাকে এখন গতি দান করেছে।
ট্রেন ধরেই চলে গেলাম আন্দুল। বন্ধুরা বলেছে একসঙ্গে ‘খলনায়ক’ দেখবো। আমার প্রতিজ্ঞা ছিল সিনেমাহলে কোনোদিন ঢুকবো না। কিন্তু পরে বুঝেছি প্রতিজ্ঞা রক্ষা করা নয়, প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করার মধ্যেই সত্য আছে। বন্দনা চৈতালী শোভন তনুজা আমি চলে গেলাম ‘স্বপ্না’ সিনেমাহলে। মাধুরী দীক্ষিত, জ্যাকি শ্রফ, সঞ্জয় দত্ত অভিনীত চলচ্চিত্র ‘খলনায়ক’। এর আগে টেলিভিশনে বিভিন্ন চলচ্চিত্র দেখেছি। সাহিত্যের সঙ্গে চলচ্চিত্রের একটা যোগ আছে। ‘কড়ি দিয়ে কিনলাম’ উপন্যাস না পড়ে চলচ্চিত্র দেখেই প্লট বা কাহিনি জেনেছিলাম। যদিও চলচ্চিত্র এবং সাহিত্যের মধ্যে অনেক ফারাক আছে।
সিনেমাহলে আমার প্রথম দেখা চলচ্চিত্র ‘খলনায়ক’। পরে ঐ স্বপ্না হলেই ‘বম্বে’ দেখি। আমাদের বাউড়িয়ার ‘সুরশ্রী’হলে অনেক পরে সলমন খান অভিনীত চলচ্চিত্র ‘প্যার কিয়া তো ডরনা কেয়া’ দেখি। উলুবেড়িয়ার ‘নরেন্দ্র’ হলে দেখি ‘জুরাসিক পার্ক’। পরে আরো একবার যাই ‘কহো না প্যার হ্যায়’ দেখতে। উলুবেড়িয়ার ‘ছায়াগীতি’তে দেখি সুচিত্রা সেন অভিনীত ‘সাত পাকে বাঁধা’। যে চলচ্চিত্রের জন্য মস্কো চলচ্চিত্র উৎসবে সুচিত্রা সেন পুরস্কার পান সিলভার প্রাইজ ফর বেস্ট অ্যাকট্রেস। সবথেকে বেশি সংখ্যক চলচ্চিত্র দেখেছি ‘নন্দন’-এ। ‘হিন্দ’ এ দেখেছি ‘হাম আপ কে হ্যায় কৌন’। শিয়ালদহের ‘ছবিঘর’-এ তনুজার সঙ্গে দেখেছি ‘উনিশে এপ্রিল’। বর্ধমানের ‘সংস্কৃতি’ হলে ‘ব্ল্যাক’, মেদিনীপুরের ‘অরোরা’য় বীতশোক ভট্টাচার্য ও কবিতাদির সঙ্গে দেখেছিলাম ‘এক যে আছে কন্যা’। আরো দুতিনটি চলচ্চিত্র ওখানে দেখি। ‘মহুয়া’য় দেখেছিলাম ‘ক্রিস’। শেষমেশ ‘প্রজাপতি’ দেখি খড়্গপুরের বম্বে সিনেপ্লেক্সে। আর এখন সব কিছু অনলাইন প্ল্যাটফর্মে।
(ক্রমশ)
0 Comments