বিস্মৃতপ্রায় সাহিত্যিক সুখময় ভট্টাচার্য
নির্মল বর্মন
শান্তিনিকেতনের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদ্যাভবনের সংস্কৃত শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক সুখময় ভট্টাচার্য , তাঁর প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। সুখময় ভট্টাচার্যের মহাভারত বিষয়ে জ্ঞানের পরিচয় পেয়ে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ তাঁকে মহাভারতের সামাজিক চিরন্তনতাবোধ বিষয়ে গবেষণার কাজে অনুপ্রাণিত ও উৎসাহিত করেছিলেন।সুখময়ের 'মহাভারতের সমাজ' গ্রন্থটি বস্তুতঃ সেই গবেষণার আকর ফসল। প্রাবন্ধিকের শান্তিনিকেতনে শিক্ষণের বিষয় সংস্কৃত, সাহিত্য, অলংকার ও দর্শনশাস্ত্র। অধ্যপক সুখময়ের প্রকাশিত গ্রন্থ "তেরো"টি এবং "দুশো"রও বেশি প্রবন্ধ লিখেছেন। সুখময় রচিত বাংলা গ্রন্থগুলি হল :--
"রামায়ণের চরিতাবলী", "মহাভারতের চরিতাবলী' ও 'সংস্কৃতানুশীলনে রবীন্দ্রনাথ',। "মহাভারতের সমাজ" গ্রন্থটি সেই গবেষণার ফসল।
প্রাবন্ধিক সুখময় ভট্টাচার্যের মহাভারত ও রামায়ণের চরিত্রাবলী গ্রন্থের বিরাট বিশ্লেষণী মনোভূমি দেখতে পাই।
মহাভারত, ভারতের চিরন্তন শাসক ইতিহাস বিপুল এই ভারতের যা সাধনা, যা আরাধনা, যা সংকল্প তারই ইতিহাস লিপিবদ্ধ গ্ৰন্থ রামায়ণ ও মহাভারত। বস্তুতঃ রামায়ণ কাব্য কিন্তু মহাভারত পুরান ইতিহাস খ্যাত। কাব্য হিসাবে রামায়ণ সর্বাগ্রে হলেও মহাভারত কোন অংশে কম নয়। মহাভারতের এমন কিছু ভাবনায় ভারতীয় চিন্তার মধ্যে অলভ্য। সুতরাং মহাভারতের ওজন মহত্ব ও গুরুত্ব বিশাল মহাভারতের আলোচনা অমৃত সমান। তার প্রসঙ্গে শ্রবণ পূণ্যবানের কর্ম সম্পাদনা । ফলতঃ রামায়ণ মহাভারতের মহত্ব ও দুর্বলতা স্বতন্ত্রতা কি সুখময় বিশ্লেষণ করেছেন।
সুখময়ের শান্তিনিকেতনে শিক্ষণের বিষয় মূলতঃ সংস্কৃত সাহিত্য, অলংকার ও দর্শনশাস্ত্র ছিল। প্রাবন্ধিকের প্রকাশিত গ্রন্থ তেরোটি এবং দুশোরও বেশি প্রবন্ধ লিখে বাংলা সাহিত্যের স্থান অধিকার করেছেন।
সুখময় ভট্টাচার্যের রচিত বাংলা গ্রন্থের ভান্ডার হল:-
"'রামায়ণের চরিতাবলী', "মহাভারতের চরিতাবলী" "সংস্কৃতানুশীলনে রবীন্দ্রনাথ" , "মহাভারতের চতুর্বর্গ" "তন্ত্র পরিচয়" , "বৈশেষিক দর্শন", "পূর্বমীমাংসা দর্শন", "মীমাংসা দর্শন", "'মিতাক্ষরা-দায়বিভাগ" ইত্যাদি। অধ্যাপক সুখময় "সংস্কৃতানুশীলনে রবীন্দ্রনাথ" (১৯৮৪) গ্রন্থটির জন্য "রবীন্দ্র পুরস্কার" এ পুরস্কৃত হয়ে যারপরনাই আন্তরিক আনন্দে আত্মহারা। সংস্কৃত সাহিত্য ও রবীন্দ্রনাথ ওতোপ্রোতভাবে যোগ বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়েছে। সুখময় উপলব্ধি করেছিলেন যে , সংস্কৃত সাহিত্যের সমালোচনায় রবীন্দ্রনাথ কোন কোন ক্ষেত্রে মূলভাব ও ভাবনা থেকে সরে এসে কবিজনোচিত কালোত্তীর্ণ ব্যাখ্যা দিয়েছেন, যা যুগজীবনের আলোকে বিশ্লেষণ করে বাংলার সারস্বত সমাজকে উপহার দিয়েছেন।
বস্তুতঃ আবার কোথাও মূল থিমকে অক্ষুণ্ণ রেখে মনুষ্যত্বের পূর্ণ আদর্শের স্বরূপকে বিশ্লেষণী ব্যাখ্যা করেছেন-সেইসব কিন্তু বিশ্লেষণ গ্রন্থটির আকর সম্পদ। ফলতঃ বিশেষ রবীন্দ্রনাথ ও সংস্কৃত সাহিত্যের তুলনামূলক বিচার বিশ্লেষণ সংস্কৃত সাহিত্যের সঙ্গে পাঠককুলের যোগকে উন্মোচিত করেছে।
প্রাবন্ধিক সুখময় ভট্টাচার্য গ্রন্থের 'প্রাক্কথন' অধ্যায়ে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের সংস্কৃত সাহিত্যের প্রীতি সম্পর্কে মন্তব্য গ্ৰহনযোগ্য,যে ---
"তাঁর রচনায় ভারতীয় সাহিত্য ও তার সমালোচনা অজস্র ধারায় প্রবাহিত। ব্রাহ্মণ, সংহিতা, মন্ত্র, উপনিষদ প্রভৃতি বৈদিক সাহিত্য; মন্ত্রাদি, স্মৃতি, তন্ত্র, রামায়ণ, মহাভারত প্রভৃতি ইতিহাস পুরাণ; বেদান্ত দর্শন, কালিদাসাদি মহাকবির কাব্য, সুভাবিতাদি উদ্ভট বচন প্রভৃতি সংস্কৃত সাহিত্য ছাড়াও পালি, প্রাকৃত, অবদান, ভক্ত মাল, মারাঠী এবং প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের আলোচনা ও সাংস্কৃতি মূলক কবিতা তিনি অজস্র লিখে গিয়েছেন। ... রবীন্দ্রনাথের সংস্কৃতমূলক সকল রচনাই যে মূলানুগ বা বিতর্কাতীত, একথা সম্ভবত বলা যায় না। অলৌকিক প্রতিভাচ্ছটাতে কোনো কোনো স্থলে মূলের যথার্থ অর্থ এবং ভাব আচ্ছাদিত হয়ে অন্যরূপ অর্থ প্রকাশ পেয়েছে-এরূপও লক্ষ্য করা যায়। কোনো কোনো স্থলে উপনিষদাদির অঙ্গচ্ছেদ ঘটিয়ে তিনি আপন ইচ্ছানুসারে ব্যাখ্যাও করেছেন, যে সব ব্যাখ্যা মূলকে অনুসরণ করে নি।"
সুখময় ভট্টাচার্য, প্রাবন্ধিক রবীন্দ্রনাথের সংস্কৃত সাহিত্য প্রীতি সম্পর্কিত নানা আলোচনাকে গ্রন্থিবদ্ধ করে রবীন্দ্রনাথের মূল্যায়ন ও দূরদৃষ্টি সম্পন্ন দৃষ্টিভঙ্গিকে বিশ্লেষণ করেছেন। দৃষ্টান্ত -- মহাভারত কেন্দ্রীক আলোচনা রবীন্দ্রনাথ বিভিন্ন প্রবন্ধে, চিঠিপত্রে, কাব্য-কবিতায় কিভাবে নিয়ে এসেছেন তার তথ্য-সমৃদ্ধ সমালোচনা সম্পর্কে প্রাবন্ধিক সুখময় লিখেছেন--
"রবীন্দ্রনাথের মহাভারত-চিন্তা ও বিভিন্ন তাৎপর্য বিশ্লেষণ অপূর্ব। মহাভারতের সংস্কৃতিকে তিনি শুধু আত্মসাৎই করেন নি, অন্যদেরও মহাভারত পাঠে উদ্বুদ্ধ করে, নির্দেশ দিয়ে মহাভারত-আলোচনায় সর্ববিধ সাহায্য করে ধন্য হয়েছেন।"
প্রাবন্ধিকের ভাবনায় রবীন্দ্রনাথের সংস্কৃত চর্চা ও সংস্কৃত জ্ঞানের পরিচয় বৈশেষিক দর্শন। প্রাবন্ধিক সুখময় ভট্টাচার্যের মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য :--
"--তাঁর সাহিত্যে, বিশেষতঃ তাঁর মননমূলক প্রবন্ধে সংস্কৃতের আধিপত্যই সব চেয়ে বেশী। তাঁর সমগ্র রচনার উৎকৃষ্ট অংশগুলির অর্ধেকের মতো সংস্কৃত-নির্ভর এবং সংস্কৃতপন্থী। সংস্কৃত সাহিত্য পড়া না থাকলে কবির সেইসব রচনার রস আস্বাদন কেউ করতে পারেন না, পারবেন না। সম্পূর্ণ রবীন্দ্রসাহিত্য পড়তে হলে সংস্কৃতজ্ঞান অপরিহার্য।"
প্রাবন্ধিক অধ্যাপক সুখময় ভট্টাচার্যের রবীন্দ্রনাথ ও সংস্কৃত সম্বন্ধে এই বিনম্র মূল্যায়ন যথাযথ ও স্বাগত।
অধ্যাপক সুখময় ভট্টাচার্যের পান্ডিত্যের গভীর দূরদৃষ্টির প্রখর বক্তব্য ঋজু, বাচন ও বর্ণা স্টাইল আশ্চর্য রকমের সর্বজনগ্রাহ্য এবং আবালবৃদ্ধবণিতার হৃদয়গ্রাহী। তাই কালজয়ী প্রাবন্ধিক কালের অমোঘ বিধানে পাঠক ও ছাত্র ছাত্রীদের স্মরণ করার প্রয়োজন থাকলেও আজ প্রায় বিস্মৃতপ্রায় সাহিত্যিক হিসেবে চিরস্মরনীয়।
1 Comments
খুব ভালো লেখা পড়লাম। ধন্যবাদ জানাই এই লেখার লেখক ড. নির্মল বর্মনকে।
ReplyDelete