জ্বলদর্চি

শব্দে গাঁথা মণি-মালা : ৩৩ / সালেহা খাতুন

সাক্ষরতা অভিযান কর্মসূচিতে  মাস্টার ট্রেনার রূপে অংশ নিতে এই স্কুলেই ট্রেনিং নিই।

শব্দে গাঁথা মণি-মালা : ৩৩ / সালেহা খাতুন 

যে জীবনের মালা গাঁথা শুরু করেছি তা দেখছি আস্তে আস্তে উপন্যাস হয়ে উঠছে। পাঠকদের আলাপ করার, বিচরণ করার, প্রেমে পড়ার প্রবেশ-দ্বার খুলে যাচ্ছে। ছোটোগল্পের মতো বলছে না পাঠক যথেষ্ট দেখলে আর দেখতে চেয়ো না। আসলে জীবন ও আর্ট মিলে এক অবিচ্ছিন্ন সম্পূর্ণতা। যেন জীবন হচ্ছে আর্ট আর আর্ট হচ্ছে জীবন। নিজের জীবনপ্রবাহে ডুব দিয়ে দেখতে গিয়ে দেখছি উঠে আসছে বহু মণিমুক্তা।

ঐ তিরানব্বই আমাকে যেন খাঁটি করে গড়ে নিচ্ছিল। তখন অতোটা বুঝিনি। বাবা যুক্ত করে দিলেন লিটারেসি ড্রাইভ প্রোগ্রামে। অর্থাৎ সাক্ষরতা অভিযান কর্মসূচিতে। ১৯৮৮-তে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী জাতীয় সাক্ষরতা কর্মসূচির ঘোষণা করেন, যেখানে ১৯৯৫ এর মধ্যে ভারতের জনগণকে একটি নির্দিষ্ট লক্ষমাত্রায় কার্যকরী সাক্ষর করে তোলার কথা লক্ষ্য হিসেবে নির্দিষ্ট করা হয়। বয়স্ক শিক্ষা, দূরাগত শিক্ষা, প্রাথমিক শিক্ষা প্রভৃতি তার মধ্যে ছিল। উনিশশো তিরানব্বইয়ে ভারত সরকার সাক্ষরতা কর্মসূচির মূল্যায়নে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁরা সরকারকে সুপারিশ করেন - এক. সমগ্র উদ্যোগের ব্যাপারে দৃঢ় রাজনৈতিক অঙ্গীকারে বদ্ধ হতে হবে। দুই. প্রথা বহির্ভূত শিক্ষা কর্মসূচিসমূহের সঙ্গে সাক্ষরতা অভিযানের সংগতি সাধন করতে হবে। তিন. দরজায় দরজায় ঘুরে নিরক্ষরতার সমীক্ষা সম্পাদন করতে হবে। চার. কর্মসূচিসমূহের স্বেচ্ছামূলক প্রকৃতির উপর গুরুত্ব আরোপ করতে হবে।

 এই সাক্ষরতা অভিযান কর্মসূচিতে গ্রামে গ্রামে স্বেচ্ছাসেবকদের ট্রেনিং দেওয়ার জন্য আমাকে এম.টি. ট্রেনিং নিতে হয়েছিল। হাওড়া জেলার পাঁচলা থানার অন্তর্গত এলাকার  আশপাশের বেশ কিছু শিক্ষিত যুবশক্তিকে এ কাজে লাগানো হয়ে ছিল। সপ্তাহ খানেক ধরে পাঁচলা আজিম মোয়াজ্জম হাইস্কুলে মাস্টার ট্রেনিং নিলাম অনেক মান্যগণ্য ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে। আমি তখন অনার্স পড়ছি। সবার থেকে বয়সে ছোটো। কিন্তু আমার চিন্তাভাবনা কথাবার্তা তাঁদের কাছে বেশ গুরুত্ব পাচ্ছিল। ডাক্তার, মেডিক্যাল অফিসার,শিক্ষক আরো নানান প্রশাসনিক ব্যক্তি এক একদিন আমাদের ট্রেনিং দেন। গাববেড়িয়া হাসপাতালের এক মেডিক্যাল অফিসারের বক্তব্য আজো মনে আছে।

বাড়ি থেকে ট্রেনিং নিতে ভায়াকাকুর সাইকেলে যেতাম। তিনিও ট্রেনিং নিচ্ছিলেন। তাঁর বাড়ি সাহাপুর শিবতলায়। বাবা তো তখন বিপরীত রাজনৈতিক দলে, অথচ ভায়া কাকু ভালো নাম শ্রীকান্ত কাকু, বামপন্থী রাজনীতিতে বিশ্বাসী। তবুও বাবাকে খুব শ্রদ্ধা করেন। আমাকে বাবার অনুরোধেই ট্রেনিংয়ে অতি যত্নে পৌঁছে দিতেন। ফেরার পথেও ত্রাতার ভূমিকা নিতেন। আমার বন্ধু তনুজার বড়দিও ঐ ট্রেনিং নেন। দিদির সঙ্গে ঘনিষ্টতা বাড়ে। পরে তনুজার মেজদি এবং বোন তহমিনার সঙ্গেও আলাপ গভীর হয়। ঐ ট্রেনিংয়ে গায়ত্রীদিকেও পাই। গায়ত্রীদি আমাকে উই শ্যাল ওভারকাম গানটা পুরো শিখিয়ে দেয় ঐ ট্রেনিংয়ে। গায়ত্রীদি চাকরি পেতে বায়না করেছিলাম (মজা করে) আমাকে শাড়ি দিতে হবে। এক ইদে গায়ত্রীদি সত্যিসত্যিই একটি নীল রঙের শাড়ি উপহার দেয়। আর আমার জ্যাঠতুতো দাদা হাকিম তাতে সুন্দর অ্যাপ্লিকের কাজ করে দেয়।
বেগুনি রঙে আমার গ্রাম সাহাপুর

মাস্টার ট্রেনিং নেওয়ার পর সাহাপুর খাঁ পাড়ার একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভি.টি.দের ট্রেনিং দিই এক সপ্তাহ ধরে। সঙ্গে ভায়াকাকুও ছিলেন। ওখানে আমার থেকে বয়সে বড়োদেরও ট্রেনিং দিই। বয়স্কদের শেখানোর জন্য কীভাবে বাক্য থেকে শব্দ, শব্দ থেকে বর্ণে পৌঁছতে হবে তার বিশেষ টেকনিক শিখিয়ে দিলাম। রিক্রিয়েশন-এর জন্য ওদের গান গেয়েও শোনাই। ছোটোবেলায় যেটি মায়ের কাছে শিখেছিলাম। সাহাপুরের ঐ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশ দিয়েই পড়াশোনার জন্য ছবছর বেলডুবি হাইস্কুলে যাতায়াত করেছি। ফলে সবাই চেনেন। এলাকার বয়স্ক ব্যক্তিরা আশীর্বাদ করতে থাকেন। বাবার এক ছাত্রীর বাড়িতে একদিন দুপুরে লাঞ্চের ব্যবস্থা হলো। সুন্দর ডাইনিং টেবিলে ভাত পরিবেশিত হলো ডাল ও শুঁটকি মাছের তরকারি সহযোগে। চেটেপুটে খেলাম।

এলাকার যতগুলো কেন্দ্রে ভি.টি. মানে স্বেছাসেবক ট্রেনিদের প্রশিক্ষিত করা হয় তাদের একত্র করে সরকারিভাবে খয়জাপুরের মাঠে বিশাল এক সম্মেলন হয়। অনেক বড়ো বড়ো মানুষজন, বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষকরা, সরকারি আধিকারিক সব উপস্থিত ছিলেন। আমার বাবাও ছিলেন। একটি ঘোষণায় বাবা অবাক হয়ে যান। ভয়ও পান। ঘোষণাটি হলো – এবার গান গাইবে সালেহা খাতুন। বাবা জানেন আমি গানের গ ও জানি না। হারমোনিয়ামে হাত দিইনি কোনোদিন। আমিও ভাবিনি আমাকে গাইতে হবে! ওই যে ভায়াকাকু ভি.টি.দের ট্রেনিং দেওয়ার সময় আমাকে গান গাইতে দেখেছেন। তিনি মনে মনে প্ল্যান করেই রেখেছিলেন আমাকে দিয়ে গাওয়াবেনই। আসলে গানটি ছিল মাটির কাছাকাছি। গানটি ছিল সম্প্রীতির --

     দেখো মাটি কত মেহেরবান 
     আনন্দে আজ গাইছি গান।
     আমরা আছি পাশাপাশি
     হিন্দু মুসলমান ।

     হিঁদুর বাড়ি নিমন্ত্রণ
     চাচা তোমার আমন্ত্রণ 
     পায়েস দিব পিঠা দিব
     সবাই আপনজন।

     (ক্রমশ)

Post a Comment

0 Comments