ভোলগা নদীর খোঁজে – ৩১
বিজন সাহা
কাজানের পথে
চেবোকসারি থেকে আমরা রওনা হলাম কাজানের পথে। কাজান – তাতারস্তানের রাজধানী। মস্কো আর দুবনার পরে এটাই রাশিয়ার একমাত্র শহর যেখানে আমি অনেকবার গেছি যদিও সোভিয়েত আমলে কখনই সেখানে যাওয়া হয়নি। তবে কাজান নামটি তখনই পরিচিত ছিল। কারণ এখানেই লেনিন পড়াশুনা করেছিলেন আর রাজনৈতিক কারণে এই কাজান বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই তাকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। তাই যারাই সোভিয়েত ইউনিয়নে পড়াশুনা করেছে তারা সবাই কাজান নামটির সাথে পরিচিত বলেই আমার বিশ্বাস। প্রথমবারের মত আমি কাজান যাই ২০০৭ সালে। আসলে সে সময় কাজান ছিল ট্র্যানজিট। সেবারই আমি প্রথম রাশিয়ান গ্র্যাভিটেশনাল সোসাইটি আয়োজিত কোন কনফারেন্সে অংশগ্রহণ করি। সে সময় আমি ডিএসসি থিসিস লিখছিলাম, তাই এ রকম কনফারেন্সে গিয়ে নিজের গবেষণা সম্পর্কে বিশেষজ্ঞদের অবহিত করার দরকার ছিল, সম্ভাব্য অপনেন্টদের সাথে কথা বলার প্রয়োজন ছিল। তাছাড়া সেখানে আমার পরিচিত অনেকেই ছিল। এখানে আরও অনেকের সাথে বন্ধুত্ব হয়। এর পর থেকে আমি কাজানে গ্র্যাভিটেশন ও কসমোলজির উপরে কোন কনফারেন্স হলেই চলে যাই। এর পেছনে অবশ্য কাজানের বন্ধুদের অবদানই বেশি। এখন ওখানে নিজেকে আর বাইরের বলে মনে হয় না। পরিবেশটা আমাকে বার বার সেখানে যেতে উদ্বুদ্ধ করে। তবে সেবার আমরা কাজান গেছি মাত্র কয়েক ঘণ্টার জন্য। বিভিন্ন শহর বা দেশ থেকে সবাই যখন কাজান এসে পৌঁছে, বাসে করে আমাদের নিয়ে যাওয়া হয়েছিল ইয়ালচিক বলে এক ট্যুরিস্ট স্পটে যা আসলে কাজান ইউনিভার্সিটির সামার ক্যাম্প। ইয়ালচিক নামক এক হ্রদের পাড়ে বনের মধ্যে এই ক্যাম্প। চুভাশ ভাষায় ইয়ালচিকের অর্থ গ্রামের পাশের হ্রদ। ১২০০ থেকে ১৬০০ মিটার দীর্ঘ, ৩৫ থেকে ৩২৫ মিটার প্রশস্ত এই হ্রদের গভীরতা ৩৫ মিটার। কাজান থেকে মাত্র ৫২ কিলমিটার দূরে হলেও গাড়ির রাস্তা ৭৫ কিলোমিটার। পাঁচ দিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত একের পর এক রিপোর্ট শোনা, মাঝে মধ্যে বনে ঘুরতে যাওয়া, সন্ধ্যার পরে সবাই মিলে একসাথে আড্ডা দেওয়া, বিশেষ করে অনেক বিখ্যাত বিজ্ঞানীদের মুখ থেকে তাদের ছাত্রজীবনের ইতিহাস শোনা, সোভিয়েত ইউনিয়নের বিজ্ঞানের ইতিহাস শোনা – সে এক ভিন্ন জগত। এটা শুধুমাত্র ইয়ালচিকের মত জায়গায়ই সম্ভব, কেননা বড় শহরে সবাই যে যার মত বিভিন্ন জায়গায় সময় কাটায়, কিন্তু এখানে ইচ্ছা অনিচ্ছায় সবাইকে একই সাথে সময় কাটাতে হয়। এটা আমাকে ছাত্রজীবনে আমাদের ছাত্র সংগঠনের সম্মেলনের কথা মনে করিয়ে দিত। সে নিয়ে পরে কখনও গল্প করা যাবে।
ইয়ালচিকের আত্মাএর পরে আরও দু’ বার (২০০৯ ও ২০১০ সালে) ইয়ালচিক যাই। এর পর থেকে আমাদের কনফারেন্সগুলো কাজানেই হতে থাকে, ফলে কাজানকে খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ পাই। শুধু বলতে চাই যে প্রথম বার যখন কাজান আসি তখন সেটা ছিল এক বিশাল নির্মাণ ক্ষেত্র, সব জায়গায় ভাঙাচোরা দালান, কোথাও জল জমে আছে, কোথাও বা ময়লা। পরে শুনলাম সে সময় কাজান হাজার বছর পালন করার জন্য সাজছিল। তাই ২০১২ সালে যখন কাজানেই কনফারেন্স হল আর আমরা এখানেই রইলাম, শহরের সৌন্দর্য আমাকে মুগ্ধ করল। সেই সময় আরও যে বিষয়টি খেয়াল করেছিলাম তা হল সেখানকার লোকজন বিশেষ করে তরুণদের আচার ব্যবহার। যদি সেই সময় মস্কোয় ছেলেমেয়েদের পথেঘাটে বিয়ার হাতে দেখা যেত, কাজানে সেটা একেবারেই অনুপস্থিত ছিল। এটা মনে হয় সেখানকার ধর্মীয় কারণে। মানে মস্কোয় যদি অধিকাংশ মানুষ এথেইস্ট বা ক্রিস্টান পরিবার থেকে, কাজানে সেটা ছিল ইসলাম। যদিও মূল কাজানে খ্রিস্টান ও মুসলমান প্রায় সমান সমান আর শহরে গির্জা ও মসজিদের সংখ্যাও প্রায় সমান সমান। এখানে আমি অবশ্য ধর্মের কথা বলছি না, বলছি পারিবারিক ট্র্যাডিশনের কথা। অবশ্য অন্য কারণও থাকতে পারে। তবে দুই শহরের বাহ্যিক পার্থক্যগুলো সহজেই চোখে পড়েছিল তখন।
সেই সময় আমাদের ঘোরাফেরার মূল জায়গা ছিল বাউমেন স্ট্রীট আর ক্রেমলিন। তখন আমরা সবাই জড়ো হতাম পেডাগজিক্যাল ইনস্টিটিউটে। চা বিস্কুট খেয়ে সেখানে জিনিসপত্র রেখে ঘুরতে যেতাম। সে সময় অবশ্য আমাদের সার্বিক অবস্থা তেমন ভালো ছিল না। বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানীরা খুব কষ্টের মধ্য দিয়ে দিন কাটাচ্ছিল। নব্বুইয়ের দশকের ধাক্কা এখনও পুরোপুরি কেটে উঠেনি, আর তখন এসব ক্ষেত্রে বাজেট ছিল খুবই নগণ্য। এখন এসব কথা লিখতে গিয়ে অনেকের কথাই মনে পড়ছে। সেই সময় আমি কনফারেন্সে গেলে সাধারণত সহকর্মী ভিক্তর আমার সঙ্গে যেত। আর যেত বগদান। বগদান দ্মিত্রিয়েভ বুলগেরিয়া থেকে। এর পরেও অনেক দিন রাশিয়ায় ছিল, বর্তমানে সোফিয়ায় কাজ করে। সেই সময়ে অনেকের সাথেই বন্ধুত্ব হয়েছিল। বিভিন্ন শহর থেকে ওরা আসত। মস্কো, পিতেরবুরগ, উলিয়ানভস্ক, তোমস্ক, পেরমি, খারকভ, কিয়েভ, দানিয়েৎস্ক, ইতালী, ফ্রান্স, ব্রাজিল, স্পেন, পর্তুগাল, পোল্যান্ড, স্লোভাকিয়া, রোমানিয়া, বুলগেরিয়া ……। রাশিয়ায় আসার পরে বিভিন্ন দেশের বা বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা ছেলেমেয়েরা যেমন এক ধরণের আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে গেছে, এসব কনফারেন্সে বিভিন্ন সময় অংশগ্রহণকারী লোকজনও এক ধরণের বন্ধুত্বের বাঁধনে আটকে গেছে। ফলে আজকাল যখন এসব কনফারেন্সে যাই তা শুধু বিজ্ঞান নিয়ে কথা বলার জন্যই নয়, বন্ধুদের সাথে দেখা করতেও যাই। মনে পড়ে নব্বুইয়ের দশকের কথা। তখন দুবনায় বিভিন্ন কনফারেন্সের আয়োজন করা হত। সত্যি বলতে কি এখনও দুবনায় প্রতি বছর একটা পর একটা কনফারেন্স লেগেই আছে। তবে তখন ছিল একেবারেই ভিন্ন অবস্থা। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙার পর এদেশ থেকে প্রচুর বিজ্ঞানী বিভিন্ন দেশে চলে গেছিল। কেউ চিরতরে সেসব দেশের নাগরিকত্ব নিয়ে, কেউ বা সাময়িক ভাবে তখনকার অর্থনৈতিক বিপর্যয় কাটিয়ে ওঠার জন্য। এদের একটা বিরাট অংশ মাইগ্রেট করেছিল ইসরাইলে, অনেকে আমেরিকায়, জার্মানিতে, ব্রাজিল বা মেক্সিকোয়। তাই দুবনায় কোন কনফারেন্স হলে তারা চেষ্টা করত অংশগ্রহণ করতে আর তাদের দেখে বুঝতাম তারা শুধু বিজ্ঞান নিয়ে কথা বলতে আসেনি, এসেছে জন্মভুমিতে, এসেছে বন্ধুদের সাথে দেখা করতে।
কুয়াশা ঢাকা ইয়ালচিক
২০০৭ থেকে ২০২৩ এই ১৬ বছরে ভোলগা দিয়ে অনেক জল গড়িয়েছে। সেদিনের ছাত্র বা পিএইচডি স্টুডেন্টরা আজ বড় বড় পোস্টে আবার তখনকার প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞানীদের কেউ কেউ পেনশনে চলে গেছেন বা বয়সের কারণে আর কনফারেন্সে আসতে পারেন না, কেউ কেউ মারাও গেছেন। মনে পড়ছে আলমাজের কথা। এক সাথে ঘুরেছি কাজানের রাস্তায়। ওর জন্মও এখানেই। পরে দানিয়েৎস্ক স্থায়ী ভাবে বাস করতে থাকে। ওর ডিএসসি থিসিসের উপর ওর অনুরোধে একটা রিপোর্ট লিখেছিলাম। এটা ২০১৬ সাল। ডিফেন্ড করেছিল। বছর দুই আগে শুনলাম ইউক্রেন বাহিনীর আক্রমণে গরলভকায় নিজের বাড়িতে মারা যায়। অথবা ভিতালি মেলনিকভ। উনি আমার পিএইচডি থিসিসের অপনেন্ট ছিলেন। সেই ১৯৯৩ সাল থেকেই পরিচয়। ছিলেন রাশিয়ান গ্র্যাভিটেশনাল সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। গত বছর মারা গেছেন। এখানে আমরা যারা আসি সবাই মূলত গ্র্যাভিটেশন ও কসমোলজির উপর কাজ করি। কনফারেন্সে তর্ক বিতর্ক হয়, তবে সব কিছুর পরেও এ যেন আমাদের এক বড় পরিবার। দেশে যেমন বাড়ির ছেলেমেয়েরা বিভিন্ন জায়গায় থাকে, বিভিন্ন এলাকায় কাজ করে আর ঈদ, পূজা, বিয়ে ইত্যাদি উপলক্ষ্যে একত্রিত হয় আমরাও সেভাবে বিভিন্ন জায়গায় কাজ করি, কিন্তু কনফারেন্সের সময় সবাই চলে আসি, যেন সবাই বাড়ি ফিরি। হয়তো একারণেই কাজান আমার কাছে আরও একটা বাড়ির মত হয়ে উঠেছে।
এর আগে আমি সব সময় কাজান এসেছি ট্রেনে। এই প্রথম গাড়িতে যাচ্ছি। অবশ্য চেবোকসারি থেকে। রাস্তায় জনপদ তেমন নেই বললেই চলে, কালেভদ্রে কোন গ্রাম বা ছোট শহরের পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছি আমরা। ইতিমধ্যে দেমিদ থাকার জায়গা ঠিক করে ফেলেছে। আমি আশা করছি কাজানে আমাদের সফর তুলনামূলক ভাবে সফল হবে। কেননা এখানে আমার অনেক বন্ধুবান্ধব। ওরা কেউ না কেউ আমাদের সাহায্যে এগিয়ে আসবে। বিশেষ করে দিলীপ চাইছিল স্থানীয় কোন পরিবারের সাথে দেখা করে তাদের ছবি তুলতে, তাদের জীবন সম্পর্কে কাছ থেকে জানতে। আমার জীবনের কাজান পর্ব শুরু হয়েছে ইয়ালচিক দিয়ে। এই তো গত ২৭ নভেম্বর থেকে ০১ ডিসেম্বর পর্যন্ত আবার কাজানে কাটিয়ে এলাম। বন্ধুদের সাথে ইয়ালচিকের দিনগুলো নিয়ে কথা হল। তাই কাজান নিয়ে কথা হলেও ইয়ালচিকের ছবি দিয়েই সেটা শুরু করব।
ইয়ালচিকের কিছু ছবি
http://bijansaha.ru/album.php?tag=46
0 Comments