জ্বলদর্চি

ভোলগা নদীর খোঁজে – ৩২/বিজন সাহা

বাউমান স্ট্রীটের চালক বিহীন শকট

ভোলগা নদীর খোঁজে – ৩২

বিজন সাহা 

বাউমান স্ট্রীট   


এখানে প্রায় প্রতিটি শহরেই কিছু কিছু রাস্তা আছে যাকে বলে প্যাডেস্ট্রিয়ান স্ট্রীট বা পথচারী রাস্তা। রাশিয়ার সবচেয়ে বিখ্যাত এমন রাস্তার নাম আরবাত। মস্কোর কেন্দ্রে ক্রেমলিন থেকে দুই কিলমিটার দূরে এই রাস্তা কী মস্কোবাসী, কী দেশী – বিদেশী, সব ধরণের অতিথিদের অন্যতম প্রিয় জায়গার একটি। রাস্তা তো নয় যেন মেলা। সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত চলে এই উৎসব। যদিও সকালটা আপেক্ষিক – মানে বেলা বারোটা। শিল্পীরা বসে ছবি আঁকছে, কেউ ছবি তুলছে, কেউ বিক্রি করছে বই, কেউ ডাকছে ক্যাফেতে। বিশাল বিশাল জানালা দিয়ে উঁকি দিচ্ছে রঙ বেরঙের স্যুভেনির। এক কথায় এখানে আসা মানেই মন ভালো হয়ে যাওয়া। মনে আছে ছাত্র জীবনে হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করলেই আরবাতে চলে যেতাম। চারিদিকে শত শত মানুষ তুমি কাউকে চেন না, কেউ তোমাকে চেনে না – এ যেন জন অরণ্যে হারিয়ে যাওয়া। আর পাশের নতুন আরবাতে বিখ্যাত বইয়ের দোকান দম কনিগি আর ক্যামেরার দোকান জুপিটার। কাজানে ঠিক এরকম একটা রাস্তার নাম বাউমান স্ট্রীট। এখানেও দুই ধারে সারি সারি দোকানপাট, খাবার দোকান, বিভিন্ন রকমের মনুমেন্ট, পুরানো স্থাপত্যের বাড়িঘর আর হাজার হাজার মানুষ। রিং নামে এক জনপ্রিয় সুপার মার্কেট থেকে শুরু হয়ে এই রাস্তা শেষ হয়েছে কাজান ক্রেমলিনের পাশে। অর্থাৎ এই রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে অনায়াসে পৌঁছে যাওয়া যায় কাজান ক্রেমলিনে। 

শিল্পী বসে আছে মডেলের অপেক্ষায়

বাউমান নামটি আমার খুব পরিচিত। সোভিয়েত আমলে মস্কোর বেশ কিছু নামকরা ইনস্টিটিউটের একটি ছিল বাউমান ইনস্টিটিউট। সে সময় এই ইনস্টিটিউটের দ্বার আমাদের মত বিদেশীদের জন্য বন্ধ ছিল, কেননা এখানে যুদ্ধাস্ত্র তৈরির নকশা করা হত। এখন অবশ্য সেই বাধানিষেধ আর নেই। আমি নিজেও সেখানে বিভিন্ন কনফারেন্সে অংশ নিই। তাই জানতাম বাউমান কোন বিখ্যাত মানুষ ছিলেন আর ছিলেন বিপ্লবের সাথে জড়িত। তবে কোন দিনই এ নিয়ে জানার আগ্রহ দেখাই নি। এখন লিখতে বসে ভাবলাম – আরে একটা রাস্তা নিয়ে লিখছি অথচ যার নামে রাস্তা তিনি কে সেটা জানি না! নিকোলাই এরনেস্তভিচ বাউমান ১৮৭৩ সালে জন্মগ্রহণ করেন। খুব অল্প বয়সেই বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত হন। বলশেভিক পার্টির সদস্য ছিলেন। কাজান থেকে ভেটেনারিতে লেখাপড়া শেষ করে কাজ শুরু করেন, কিন্তু বিপ্লবী কাজ করতে গিয়ে পুলিশের চোখে পড়লে পিতেরবুরগে চলে যান। ১৯০৫ সালে মস্কোয় মৃত্যুবরণ করেন। যদিও সংক্ষিপ্ত জীবন, তারপরেও সোভিয়েত আমলে তাঁর বিপ্লবী কাজকর্মকে সম্মান করে একটা বিখ্যাত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তাঁর নামে নামকরণ করা হয়েছিল। কাজানের অন্যতম প্রধান রাস্তার একটি তাঁর নামে। 

বাউমান স্ট্রীটে ঢুকলে প্রথমেই যেটা চোখে পড়বে তা হল এক সুউচ্চ টাওয়ার। আশেপাশের সমস্ত স্থাপনাকে হেলায় ছাড়িয়ে গেছে – যেন তাল গাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে সব গাছ ছাড়িয়ে উঁকি মারে আকাশে। এর পেছনেই বগোইয়াভলেনস্কি সাবর। আর পাশে কনসেরভাটরি বা ক্ল্যাসিক্যাল মিউজিক শেখার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। কথিত আছে মাক্সিম গোর্কি ও ফিওদর শালিয়াপিন একই বছর সেখানে ভর্তি পরীক্ষায় বসেন। সেই পরীক্ষায় গোর্কি উত্তীর্ণ হন আর শালিয়াপিন ব্যর্থ হয়ে ফিরে যান। কিন্তু নিয়তির কি পরিহাস – পরবর্তী জীবনে মাক্সিম গোর্কি হন বিশ্ববিখ্যাত লেখক আর শালিয়াপিন গায়ক। তবে এ বছর যখন একটা সিটি ট্যুরে গেলাম সেখানে গাইড বললেন, ওটা আসলে  ঠিক নয়। এরা দুজনেই একই সাথে গির্জার কোরাসে গাওয়ার জন্য পরীক্ষায় বসেন, তবে সে সময় শালিয়াপিনের গলা বসা ছিল, তাই তিনি উত্তীর্ণ হতে পারেননি। উল্লেখ করা যেতে পারে যে শালিয়াপিনের জন্ম কাজানে, তিনি এই রাস্তার পাশেই এক বাসায় থাকতেন। তখন এই রাস্তার নাম ছিল বলশায়া প্রালোমনায়া। এটা ইভান গ্রজনি কাজান দখল করার সময় এখানকার দেয়াল ভাঙ্গেন বলে এই নাম। এর আগে খানদের আমলে এর নাম ছিল নগাইস্কায়া। এর ইতিহাস কয়েক শ' বছরের পুরানো। বর্তমানে হোটেল নগাই সেই পুরানো দিনের কথাই মনে করিয়ে দেয়। 

ধনের প্রতীক ব্যাঙ

আগেই বলেছি যে এই রাস্তার শুরু রিং নামে এক দোকানের ওখানে। আগে সেখানে ট্রাম লাইন ছিল, সেই থেকেই  এই সুপার মার্কেটের নাম রিং। একটা ঘড়ি দিয়ে শুরু হয় বাউমান স্ট্রীট, যেখানে ডায়াল তাতার ভাষায় লেখা। ব্রোঞ্জের তৈরি এই ঘড়িটি স্থাপন করা হয় ১৯৯৯ সালে। এর উপরে আছে তিনটে মূর্তি – একজন কবি, তাঁর মিউস আর ডানাওয়ালা ঘোড়া। এটা এখন সাক্ষাতের জায়গা, মানে লোকজন ডেটিং করার জন্য এখানে এসেই অপেক্ষা করে। একটু এগুলে শালিয়াপিন গ্রান্ড হোটেল আর তার সামনে শালিয়াপিনের স্ট্যাচু। এর পরেই সেই সুউচ্চ টাওয়ার আর গির্জা। এরপর রাস্তার দুই ধারে প্রচুর পুরানো স্থাপনা। বিভিন্ন হোটেল, রেস্টুরেন্ট, ব্যাংক, স্যুভেনিরের দোকান। একের পর এক দেখা যাবে বিভিন্ন স্ট্যাচু। জেরো পয়েন্টে কাজান থেকে মস্কো, পিতের, লন্ডন, প্যারিস, নিউ ইয়র্ক, টোকিও, উত্তর মেরু, দক্ষিণ মেরু ইত্যাদি জায়গার দূরত্ব উল্লেখ করা কম্পাস। আছে ঘোড়া বিহীন পুরানো দিনের শকট যেখানে উঠে ছেলে বুড়া সবাই ছবি তুলে। মনে আছে প্রথম যখন কাজান আসি আমরা নিজেরাও তখন এই শকটে বসে বেশ কিছু ছবি তুলেছিলাম। আর তা তুলতে রীতিমত লাইনে দাঁড়াতে হয়েছিল। আছে চারটে ব্যাঙের মূর্তি যাকে এখানে ধন সম্পদের প্রতীক মনে করা হয়। উল্লেখ করা যেতে পারে যে চীনের বিখ্যাত তিন পেয়ে ব্যাঙের জায়গায় এদের ব্যাঙের চার চারটি পা। এবার যখন কাজান গেলাম আরও ভালো করে সেটা দেখে এলাম। একটা রথ অথবা ছাঁদওয়ালা সিংহাসনে গা হেলিয়ে বিশ্রাম করছে এক ভুঁড়িওয়ালা বিড়াল আর সেই ছাঁদের উপর বসে আছে দুষ্ট এক ইঁদুর। এক দোকানের সামনে সিগারেট মুখে দাঁড়িয়ে আছে দাড়া দেখাচ্ছি মজা নামক বিখ্যাত কার্টুনের ভালুক আর আছে বিশ্বাস নামে এক স্থাপনা যেখানে এক বাচ্চা ছেলে তারচেয়েও ছোট এক মেয়েকে টেনে তুলছে। কোথাও শিল্পী বসে আছে কাজান বেড়াতে আসা অতিথিদের ছবি আঁকতে। কোথাও গিটার হাতে কেউ গাইছে গান। আর রাস্তার দু দিক থেকে উঁকি দিচ্ছে দেশ বিদেশের খাবারের দোকান। এছাড়া আছে মুদ্রণ ঘর, রুস্কি বলশই থিয়েটার, নিকোলো-নিসস্কায়া গির্জা। এই রাস্তার সমান্তরাল ভাবে একে একে চলে গেছে বেশ কয়েকটি রাস্তা – যাদের অন্যতম ক্রেমলভস্কায়া, আছে অস্ত্রোভস্কি রাস্তা, তবে সেটা ইস্পাতের লেখক নিকোলাই অস্ত্রোভস্কি নাকি নাট্যকার আলেক্সান্দর অস্ত্রোভস্কির নামে সেটা বলে পারব না। একটু নীচের দিকে চলে গেছে বুলাক নামে একটি কানাল যা কাবান হ্রদ ও কাজানকা নদীকে সংযুক্ত করেছে। এই কানাল থেকে ক্রেমলভস্কায়া রাস্তা পর্যন্ত উঠতে মনে হয় পাহাড়ে উঠছি। মাঝে মধ্যে এইসব রাস্তা ভেদ করে করে গেছে আরও অনেক রাস্তা। এভাবে দুই দিকে বিপ্লব পূর্ববর্তী বিভিন্ন স্থাপনা দেখতে দেখতে এক সময় পৌঁছে যাওয়া যায় ক্রেমলিনে। সামনে কাঁচের পিরামিড, সার্কাস, কাজানের এক হাজার বছর উপলক্ষ্যে সজ্জিত হাজার বছরের স্কয়ার। আর বাউমান স্ট্রীটের শুরুতে রিং পার হয়ে সামনের দিকে হাঁটলে চোখে পড়বে নতুন এক রাস্তা। এটা কাজানের হাজার বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে সাঙ্কত পিতেরবুরগের উপহার। তাই এটাকে ছোটখাটো পিতের বলে ভুল হতে পারে। এখানে সেখানে সেরকম স্তম্ভ, বেঞ্চ ইত্যাদি। এখনও মনে পড়ে প্রথম যখন আসি মানে ২০০৭ সালে এখানে এসব কিছুই ছিল না, ছিল শুধু বিশাল কর্মযজ্ঞ। তবে এটা ঠিক পিতেরবুরগ রাস্তা ততটা জনপ্রিয় নয় যতটা বাউমান স্ট্রীট। এই রাস্তার শুরুতেই আছে লেভ গুমিলেভের স্ট্যাচু। লেভ গুমিলেভ বিখ্যাত রুশ কবি নিকোলাই গুমিলেভ ও আন্না আখমাতভার সন্তান, বিখ্যাত ইতিহাসবিদ। তাঁর লেখা রাশিয়ার ইতিহাস একটু ভিন্ন ধরণের, মূলত এটনোগ্রাফি বা জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে। যদি মেইন স্ট্রীম রশ ইতিহাস তাতার মঙ্গোলদের সাথে রুশদের বিরোধিতার ভিত্তিতে রচিত, গুমিলেভ সেখানে এদের মধ্যে শুধু শত্রুতা নয়, বিভিন্ন ক্ষেত্রে পরস্পরের সহযোগিতার উপস্থিতি দেখতে পান। মনে হয় এ কারণেই গুমিলেভকে এখানে বিশেষ সম্মানের চোখে দেখা হয়।                  

কাজানের কিছু ছবি  

http://bijansaha.ru/albshow.html?tag=200


Post a Comment

0 Comments