পশ্চিমবঙ্গের লৌকিক উৎসব, পর্ব -- ১০৪
পাটাই ষষ্ঠী
ভাস্করব্রত পতি
এক দেশে এক বিধবা বামনী ছিল। তাঁর একটি সুন্দর বউমা ছিল। তাঁকে নিয়েই বসবাস করতো। কিন্তু বউটির বড় লোভ। সবসময় খাই খাই করতো। সে। সে ঠাকুর দেবতা কিছুই মানতো না। ঠাকুরের নৈবেদ্য থেকে ফলমূল, মিষ্টি তুলে খেতো। সেই পাপে তাঁর ছেলে মেয়ে হয়ে হয়ে মরে যেতো। শাশুড়ী মনে মনে পরিকল্পনা করল যে, এবারের পৌষ মাসে বউকে দিয়ে পাটাই ব্রত করাবে। সেই মোতাবেক বউমাকে সাত সকালে বাড়ির অনেক ময়লা হাতে তুলে দিয়ে পুকুর ঘাটে কাচতে পাঠিয়ে দিল।
এদিকে বামনী শাশুড়ী বাড়িতে পাটাই ব্রতের আয়োজন করলো। বাড়ির উঠোনে একটা পুকুর কাটা হল। বেনা গাছের পাটাই সেই পুকুর ধারে পোঁতা হল। তারপর পুরুতকে আসনে বসিয়ে বউমার জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলো।
এদিকে সন্ধ্যা নেমে এলো। বউমাটি কাপড় কাচতে কাচতে চারিদিকে শাঁখ বাজার শব্দ শুনতে পেল। বউয়ের তখন মনে পড়লো যে আজ পাটাই ব্রত পালনের দিন। ফলে নিশ্চয়ই বাড়িতে অনেক রকম সুস্বাদু খাবার তৈরি হচ্ছে। অথচ সে খেতে পাবে না! এটা ভেবেই তাঁর খুব রাগ হল। তখন সব জামা কাপড় পুকুর ঘাটে ফেলে হন হন করে দৌড় লাগালো বাড়ির দিকে।
বউমা সারা দিনই কিছুই খায়নি। পুকুর থেকে অনেকটা পথ দৌড়ে দৌড়ে আসতে তাঁর কষ্ট হল। তবুও সে খাওয়ার খাবার লোভে সব কষ্ট ভুলে গিয়ে ছুটতে লাগলো। কিন্তু রাস্তায় যেতে যেতে বেনা গাছে পা জড়িয়ে গেল তাঁর। সেখানে পড়ে গিয়ে মূর্ছা গেল সে।
পাটাই ব্রতের একথানি নৈবেদ্য দেওয়া হয় ধোপা বউকে। সেই ধোপাবউ তা নিতে আসছিল তখন। পথে দেখতে পেল যে বউমা অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। তা দেখে খুব তাড়াতাড়ি গিন্নীকে গিয়ে জানালো। সঙ্গে সঙ্গে বামনী এসে বউমাকে বাড়িতে নিয়ে গেল। তারপর তাঁকে স্নান করিয়ে গা মুছিয়ে পাটাই ব্রত পালন করালো। ব্রতের শেষে বামনী বউকে বলল, 'ভক্তিভরে মা ষষ্ঠীকে প্রণাম করে বর চাও। এটাই চাও যে, বছরের মধ্যে যখনই ছেলের মুখ দেখতে চাই, তখন যেন পাই। আর আমার যেন কোনো রকম দুঃখ কষ্ট না হয়'।
তখন বউ শাশুড়ির কথাই অক্ষরে অক্ষরে পালন করল। সেই ঘটনার পর থেকে বউমাটি প্রতিবছর পাটাই ব্রত করতে লাগলো। এরফলে তারপর থেকে তাঁর ছেলে মেয়ে আর কখনও মরতো না। এই পাটাই ষষ্ঠীর মাহাত্ম্য প্রচারিত হতে লাগলো চারদিকে। ধীরে ধীরে তা সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ল।
'পাটাই' বা 'পিঁড়ি' হল সাধারণত বসার জন্য কাঠের তৈরি একপ্রকার ক্ষুদ্র ও নিচু আসন বা পাটা। কোথাও কোথাও একে পিঁড়ে বা পিড়িও বলে।
পাটা > পাটাই
পৌষ মাসের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠী তিথিতে এই ব্রত পালন করার রীতি। বাড়ির মহিলারাই এই ব্রত পালন করে থাকে। এই পাটাই ষষ্ঠীর ব্রত পালনে দরকার হয় আতপচালের ৫ টি নৈবেদ্য, ফল ও মিষ্টি। এই পাঁচটি নৈবেদ্যের মধ্যে একটি বরাদ্দ থাকে বাড়ির ধোপা বউয়ের জন্য। আর একখানা বাড়ির জন্যে। বাকি তিনখানা তিন এয়ো মহিলার জন্য বরাদ্দ রাখা থাকে। এই পাটাই ষষ্ঠীর ব্রতের মাধ্যমে গৃহস্থের ছেলে মেয়ে ও আত্মীয় স্বজনের অকাল মৃত্যু ঘটেনা।
0 Comments