জ্বলদর্চি

লোকমাতা রানি রাসমণি —২৮/সুমিত্রা ঘোষ


লোকমাতা রানি রাসমণি —২৮

সুমিত্রা ঘোষ

মা ভরতারিণী দেবীর মন্দির তৈরি শুরু হল কিন্তু ছয়, সাত বছর হতে চলল মন্দির নির্মাণ শেষ হয়নি।মন্দির সংলগ্ন স্থানে দ্বাদশ  শিবের মন্দির তৈরি করা হল।  কারণ মা ভবতারিণী যেখানে বসবাস করবেন সেখানে ভৈরবনাথকে তো থাকতেই হবে। মন্দিরের কাছে রাধামাধবের মন্দির তৈরি হল। একই সঙ্গে সমস্ত নির্মাণকার্য হতে লাগল। মন্দির তৈরি হওয়া সময়ে রানি রাসমণি মা ভবতারিণীর নির্দেশে মায়ের মূর্তি তৈরি শুরু করালেন। মা ভবতারিণী স্বপ্নে দেখিয়েছেন তাঁর মূর্তি কেমন হবে। তখনকার দিনে নবীন ভাস্কর নামে একজন শিল্পীর খুব নাম-ডাক ছিল দেবী মূর্তি তৈরির ব্যাপারে। নবীন ভাস্করকে জানবাজারের বাড়িতে ডেকে পাঠানো হল। নবীন এসে রানি রাসমণিকে কয়েকটি শর্ত দিলেন যেমন তিনি রাজবাড়ির বারমহলে এমন একটি ঘরে থাকবেন যেখানে নিরিবিলিতে বসে মায়ের মূর্তি তৈরি করা যাবে। যতদিন মূর্তি তৈরি শেষ না হয় ততদিন জানবাজারের বাড়ি থেকে প্রভাতে গঙ্গাস্নান করে এসে মায়ের মূর্তি তৈরির কাজে হাত লাগাবেন। খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে অতি শুদ্ধাচার পালন করবেন। রানি রাসমণি নবীন ভাস্করের কথায় রাজি হয়ে গেলেন, বললেন ঠিক আছে তুমি যা ভাল মনে করবে সেইভাবে কাজ করবে, আমার কোন আপত্তি নেই। জানা যায় নবীন ভাস্কর প্রথম যে মূর্তি তৈরি করলেন সেই মূর্তি মন্দিরের গর্ভগৃহের উপযোগী না হওয়ায় আবার মায়ের মূর্তি তৈরি শুরু করেন। কেউ কেউ বলেন নবীন দু-দুবার মূর্তি তৈরি করেন, একবার মায়ের আদল না হওয়ায় কারুর পছন্দ হয়নি, দ্বিতীয়বার মায়ের মূর্তি মন্দিরে গর্ভগৃহের মাপ অনুযায়ী ছোট হয়ে যায়। এই ব্যাপারে নবীন ভাস্কর খুবই ভেঙে পড়ে কারণ এযাবৎ তিনি যত মূর্তি তৈরি করেছেন কোনটা বাতিল হয়নি। যাইহোক সকলের সুপরামর্শে নবীন তৃতীয়বার মা-ভবতারিণীর মূর্তি তৈরি করেন এবং সাফল্য লাভ করেন। রানিমা খুশি হয়ে মাকে একটা বড় কাঠের বাস্কে যত্ন সহকারে রাখার ব্যবস্থা করলেন।

এদিকে মায়ের মন্দির তৈরি হতে দেরী হয়েছে দেখে রানির মনে হতে লাগল মন্দির প্রতিষ্ঠার কাজ তাড়াতাড়ি শেষ না হলে তিনি হয়তো দেখে যেতে পারবেন না। এদিকে দেবী মূর্তি নির্মিত হয়ে একটি বাক্সে বন্ধ করে রাখা আছে, মা ভবতারিনী স্বপ্নে রানিকে বললেন, আমাকে আর কতদিন ওইভাবে আবদ্ধ করে রাখবি, আমার খুব কষ্ট হচ্ছে, যত তাড়াতাড়ি পারিস আমাকে প্রতিষ্ঠা কর। মন্দির তৈরি শেষ হল অনেক বাধাবিপত্তির মধ্য দিয়ে। নীচু জাতের বিধবা মহিলা মন্দির প্রতিষ্ঠা করবে এমন কাজ তখনকার সমাজে নিন্দনীয় ছিল। নিন্দনীয় বললে কম বলা হয়, জঘন্য অপরাধ ছিল। যাই হোক অনেক ঝড় মাথায় নিয়ে রানি মন্দির তৈরি করতে পারলেন এবং মাকে প্রতিষ্ঠা করতে হবে সাড়ম্বরে এমন চিন্তাভাবনা করতে লাগলেন।
দক্ষিণেশ্বরে ভবতারিনীর মন্দির প্রতিষ্ঠা করতে প্রায় নয় লক্ষ টাকা খরচ হয়েছিল বলে জানা যায়। সময় লেগেছিল প্রায় ৬/৭ বৎসর। মন্দির তৈরির পর রানি রাসমণি দু'লক্ষ ছাব্বিশ হাজার টাকায় ত্রৈলোক্যনাথ ঠাকুরের কাছ থেকে দিনাজপুর- ঠাকুরগাঁ মহকুমার অন্তর্গত শালবাড়ি পরগণাটি দেবসেবার জন্য দানপত্র লিখে দিয়েছিলেন। রানি রাসমণির জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি দক্ষিণেশ্বরে মন্দির স্থাপন। বাংলার ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে তাঁর নামটি লিখিত হল। দক্ষিণেশ্বরে মন্দির প্রতিষ্ঠা যেন এক অলৌকিক কাহিনি, স্বয়ং জগন্মাতা প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত তাঁর প্রিয় ভক্তকে স্বপ্ন দিয়ে এই কাজ শেষ করালেন। অনুমান ১৮৪৭ সালে রানির বাসনা হল, কাশীতে গিয়ে বিশ্বেশ্বর দর্শন করবেন কিন্তু রানিকে কাশী যেতে হল না বিশ্বেশ্বর স্বয়ং তাঁর ঘরণীকে নিয়ে দক্ষিণেশ্বরে চলে এলেন। মা রানিকে নিয়ত স্বপ্ন দিতে লাগলেন মন্দির প্রতিষ্ঠার জন্য এবং এই কাজে সমস্ত বাধা বিপত্তি মা নিজে দূর করেছেন। মন্দির প্রতিষ্ঠার পর সুদিন দেখে মাকে মন্দিরের গর্ভগৃহে প্রতিষ্ঠা করতে হবে কিন্তু কাছাকাছি তেমন সুদিন ছিল না, যাতে করে মাকে প্রতিষ্ঠা করা যায়।
ক্রমশ  

Post a Comment

0 Comments