মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ৮৪
সুব্রত মহাপাত্র (শিক্ষারত্ন, কুলটিকরি, ঝাড়গ্রাম)
ভাস্করব্রত পতি
একসময় বাড়িতে অভাব ছিল নিত্যসঙ্গী। দিনে দুবেলা পেটের ভাত জোগাড়ে গরু চরাতেও হয়েছিল। না, লড়াই থেমে যায়নি নাকুফুড়ি মহাপাত্রের। কঠিন যুদ্ধে তিনি জয়লাভ করেছেন অচিরেই। নয় ছেলেমেয়েদের নিয়ে ভেসে যাননি অশিক্ষায়। আজ তাঁরা সমাজে প্রত্যেকেই প্রতিষ্ঠিত। এঁদেরই একজন সুব্রত মহাপাত্র। বাড়ির সবচেয়ে ছোট ছেলে। নিজের ইচ্ছাশক্তি আর কিছু করে দেখানোর আগ্রহে তিনি আজ 'শিক্ষারত্ন' প্রাপ্ত শিক্ষক।
১৯৭২ এর ২৪ শে নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন ঝাড়গ্রামের প্রত্যন্ত কুলটিকরিতে। এখানকার বালিগেড়িয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রাথমিক শিক্ষার পর কুলটিকরি এস সি হাইস্কুল থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক উত্তীর্ণ হন। এরপর গোপীবল্লভপুরের সুবর্ণরেখা মহাবিদ্যালয় থেকে ভূগোল বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করেন। সেবার কলেজের সব বিভাগের মধ্যে স্নাতক স্তরে সর্বোচ্চ স্থানাধিকারী হয়ে পেয়েছিলেন রৌপ্যপদক। সবশেষে কানপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তরে প্রথম শ্রেণী লাভ করেন। ২০০১ সালে বেলিয়াবেড়া কৃষ্ণচন্দ্র স্মৃতি উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সহশিক্ষকের চাকরিতে যোগদান করেন। এরপর এখানেই ২০০৯ তে সহকারী প্রধানশিক্ষক পদে আসীন হন। সহ প্রধান শিক্ষক থাকাকালীন নিজের স্কুলের পরিকাঠামোর উন্নতির জন্য শিক্ষা দফতর ও প্রশাসনের মাধ্যমে ৩০ লক্ষ টাকার কাজ করেছেন বিদ্যালয়ে।
শিক্ষাক্ষেত্রে অসাধারণ অবদানের জন্য ২০২৩ এ সুব্রত মহাপাত্র পেয়েছেন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের দেওয়া 'শিক্ষারত্ন' সম্মান। এছাড়াও কলকাতার একটি নামি ট্রাস্টের 'শিক্ষকরত্ন' সম্মান পান ২০১৯ এ। এবছরই আন্তর্জাতিক মহাবঙ্গ সাহিত্য উৎসবে সমাজসেবামূলক কাজের জন্য 'মহাত্মা গান্ধী স্বর্ণপদক' পান। এছাড়াও ইন্ডিয়ান সলিডারিটি কাউন্সিলের এ পি জে আব্দুল কালামের নামাঙ্কিত 'এডুকেশন এক্সেলেন্স অ্যাওয়ার্ড', 'চুনি কোটাল স্মৃতি জঙ্গলমহল গৌরব সম্মান', তথ্য প্রযুক্তি সংস্থার 'শান্তি সম্মাননা', 'তুমি অনন্য' সম্মান, 'ড. সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন অ্যাওয়ার্ড' তাঁর নামের পাশে জ্বলজ্বল করছে। এইসব সামান্য পুরস্কার হয়তো তাঁর কাজের নিরিখে অনেক কম পরিচয় দেয়। কিন্তু তিনি চান সবসময় কাজের মধ্যে জড়িয়ে থাকতে। পুরস্কারের আশায় নয়, সকলের মঙ্গলের নেশায় ভরপুর তাঁর জীবনের দিনরাত।
তাঁর যেখানে বাড়ি বা তিনি যেখানে চাকরি করেন সেখানে জ্ঞানের আলো কম। তাছাড়া মানুষের মধ্যে সচেতনতার চূড়ান্ত অভাব সেখানে। ফলে ১৮ বছর হওয়ার এর আগেই বাচ্চা বাচ্চা মেয়েদের বিয়ে হয়ে যাচ্ছিল। পেটের টানে কম বয়সী ছেলেরা ভিন রাজ্যে চলে যাচ্ছিল কাজের খোঁজে। এসব দেখে কষ্ট পেতেন তিনি। জাগতেন বিনিদ্র রাত। ভাবলেন, কিছু করা উচিত এইসব চাঁদপানা মুখগুলোর জন্য। নিজের স্কুলেই ২০১৭ তে তৈরি করেন 'কন্যাশ্রী ব্রিগেড'। সেই ব্রিগেড হয়ে ওঠে ছাত্রীদের ত্রাতা। কারোর কম বয়সে বিয়ে হওয়ার তোড়জোড় শুরু হলেই অন্য ছাত্রীরা তৎক্ষণাৎ সে খবর পৌঁছে দেয় স্কুলে। আটকে যায় বিয়ে। ইতিমধ্যে ঠেকিয়ে দিয়েছেন আটটি Under Age বিয়ে। শুধু এটা নয়, জঙ্গলমহলের এইসব এলাকায় মদের নেশায় বহু মানুষ বিভোর। তাঁদের সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে নিজের গাঁটের কড়ি খরচ করে দশ হাজার পোষ্টার ছাপিয়ে গ্রামে গ্রামে সাঁটিয়েছেন নিজেই। মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির এই উদ্যোগ সফলতা পেয়েছেও।
শিক্ষারত্ন সুব্রত মহাপাত্রের নেতৃত্বেই গোপীবল্লভপুর ২ ব্লকে প্রথম মহিলা ফুটবল টিম গঠিত হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের প্রথম কন্যাশ্রী পাঠাগার ও রিডিং রুম স্থাপনের মূল কাণ্ডারী তিনি। ২০১৮ সালে বেলিয়াবেড়ায় চালু করেন এই 'কন্যাশ্রী পাঠাগার'। দুঃস্থ পড়ুয়াদের কাছে এই পাঠাগার হয়ে ওঠে পাঠ্য বই সহ নানা সহায়িকা বই বিনামূল্যে পড়ার অন্যতম কেন্দ্র। তাঁদের আর কষ্ট করে বই কিনতে হয়না। ফলে বইয়ের অভাবে পড়া বন্ধ হওয়ার ঘটনাও ঘটে না। কলেজের বইও মেলে এখানে। স্কুল ছুটির পর (সপ্তাহে তিন দিন বাড়ি না ফিরে) গ্রামে গ্রামে সাইকেল চালিয়ে পোষ্টার হাতে থ্যালাসেমিয়া ও চোলাই মদ নিয়ে সচেতনতা অভিযান করেছেন। কোভিড পিরিয়ডে আটটি বাল্য বিবাহ ঠেকিয়েছেন। তাঁদের ফের স্কুলের আঙিনায় আনতে পেরেছেন। ঝাড়গ্রাম জেলায় সর্বপ্রথম (২০১৭) বাল্যবিবাহ রোধে পঞ্চম শ্রেণীতে ভর্তির সময় (মেয়েদের) অভিভাবকদের কাছ থেকে মুচলেকা বা অঙ্গীকারপত্র নিয়েছেন। মুচলেকাটি হল -- "আমি আমার কন্যারত্নটিকে ১৮ বছরের আগে বিবাহ দেবো না। তাঁকে উচ্চ শিক্ষার সুযোগ প্রদান করিব"। বাল্যবিবাহ রোধে স্কুলের কন্যাশ্রী মেয়েদের নিয়ে পথনাটিকা তৈরি করে ঝাড়গ্রাম জেলার বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি অনুষ্ঠানে প্রদর্শিত হয়েছে তাঁরই আগ্রহে।
নানা ধরনের সমাজসেবামূলক কাজে আদ্যোপান্ত জড়িয়ে রেখেছেন নিজেকে। তাঁর এই কাজে সবচেয়ে বেশি আদর পায় ছাত্র ছাত্রীরা। তাঁদের পঠনপাঠন এবং সামাজিক উন্নয়নের ভাবনায় নিজেকে সবসময় জারিত রাখেন। শুধু কি তাই? সরকারি নানা প্রকল্পের রূপায়নেও তিনি নিজেকে সঁপে দিয়েছেন অকাতরে। এহেন মানুষটি আজ তাই 'মেদিনীপুরের মানুষ রতন'। অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার শিক্ষক সমাজে তিনি আলোর দিশা। অনুকরণযোগ্য এক চরিত্র। অভিনয় ক্ষেত্রেও তিনি সমানভাবে বিরাজমান। মেদিনীপুরের বিখ্যাত যোদ্ধা রাণী শিরোমনিকে নিয়ে তৈরি 'রাণী শিরোমণি' নামের স্বল্পদৈঘ্যের চলচ্চিত্রে ডাকাত সর্দার গোবর্ধন দিকপতির চরিত্রে তাঁর অভিনয় ছিল নজরকাড়া। বর্ণময় চরিত্রের অধিকারী এহেন মানুষটির ধ্যান জ্ঞান ছাত্র ছাত্রীদের সামাজিক এবং বৌদ্ধিক উন্নয়ন।
জেলা প্রশাসনের 'রিপাবলিক ডে' উদযাপন অনুষ্ঠানে পরপর দু'বার বেলিয়াবেড়া ব্লকের ট্যাবলো ঝাড়গ্রাম জেলার মধ্যে সেরার সেরা ট্যাবলোর পুরস্কার পায়। এ পরিকল্পনা ছিল তাঁর। স্কুলের ছাত্র ছাত্রীদের নিয়েই তাঁর পথচলা। ২০১৯ এ ট্যাবলোর থিম ছিল 'কন্যাশ্রী'। আর ২০২০ সালে ছিল 'কৃষক বন্ধু'। অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার পশ্চিমবঙ্গ মধ্যশিক্ষা পর্ষদের ভূগোল বিষয়ের মুখ্য রিসোর্স পার্সন তিনিই। কিভাবে ছাত্র ছাত্রীদের মধ্যে আরও বেশি করে ভূগোলকে জনপ্রিয় করে তোলা যায়, তা নিয়ে তাঁর ভাবনা নিরন্তর। সেইসাথে 'পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য শিশুশিক্ষা মিশনে'র জেলা রিসোর্স পার্সন পদেও রয়েছেন। শিশুশিক্ষা কেন্দ্র (এস এস কে) এবং মাধ্যমিক শিক্ষা কেন্দ্রের (এম এস কে) সম্প্রসারক সম্প্রসারিকা এবং পার্শ্ব শিক্ষকদের পাঠদানের প্রশিক্ষণও তিনিই দেন।
তিনি বিশ্বাস করেন শিক্ষাকে ছাত্র ছাত্রীদের দুয়ারে পৌঁছে দিতে হবে। এজন্য স্কুল কলেজ নিজেই পৌঁছে যাক ছেলেমেয়েদের বাড়ির কাছে। একসময় বেলিয়াবেড়া ব্লকে ছিলনা কোনও মহাবিদ্যালয়। ফলে পড়ুয়াদের গোপীবল্লভপুর বা ঝাড়গ্রামের কলেজে পড়তে যেতে হত। অনেকেই পড়াশোনার উৎসাহ হারিয়ে ফেলতো এই সময়। বন্ধ হয়ে যেত পড়াশোনা। সেইসময় ব্লকের অন্যত্র একটি কলেজ তৈরির পরিকল্পনা হচ্ছিল। কিন্তু তিনি বুঝেছিলেন কলেজ হোক সদর ব্লকের কাছাকাছি। এতে কলেজের ভারিক্কি বাড়বে। উৎসাহ বাড়বে। ছাত্র ছাত্রীদের আগ্রহ বাড়বে। উচ্চ মাধ্যমিক পাসের পর কলেজে ভর্তির ক্ষেত্রে ছাত্র ছাত্রীদের আর অনীহা বাড়বে না। সেই মোতাবেক বেলিয়াবেড়া স্কুলের পাশেই কলেজ তৈরির তোড়জোড় শুরু করেন অন্যান্যদের সাথে নিয়ে। ২০১৪ তে স্কুলের পরিচালন কমিটি তাতে সম্মতি দেয়। স্কুলের পাঁচ একর জমিতেই কলেজ গড়ার সিদ্ধান্ত হয়। তখন জেলাশাসক ছিলেন সুরেন্দ্র গুপ্তা। সেই মোতাবেক প্রয়োজনীয় জমি সরকারকে হস্তান্তর করা হয় কলেজ তৈরির জন্য। স্কুলের দেওয়া সেই জমিতেই স্থাপিত হয়েছে বেলিয়াবেড়া মহাবিদ্যালয়। যা আজ বেলিয়াবেড়ার গর্ব। এলাকার ছেলে মেয়েদের উচ্চশিক্ষার সোপান। এই কলেজ স্থাপনের ইতিহাসে আজ তাই তাঁর নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা হয়ে গেছে। তাঁর কথায়, এখনও বহু কাজ বাকি। যতদিন বেঁচে থাকার সুযোগ মিলবে ততদিন তিনি নিজেকে জড়িয়ে রাখবেন সমাজের পাশে, মানুষের পাশে।
0 Comments