জ্বলদর্চি

মনে রাখবার মতো একটি কাব্যগ্রন্থ/সুজিত সরকার


মনে রাখবার মতো একটি কাব্যগ্রন্থ

সুজিত সরকার


প্রতাপ সিংহ আমার পছন্দের কবি। পছন্দের অন্যতম কারণ তাঁর স্বতঃস্ফূর্ততা। 'দুঃখ দুঃখ ফুলের বাগানে' কাব্যগ্রন্থটি পড়ে সেটা আরো একবার অনুভব করলাম। এত সাবলীল এই কবির লিখনভঙ্গিমা যে পড়তে পড়তে কখনও মনে হয় না যে কোনো পংক্তি বা স্তবক ভেবে ভেবে কবিকে রচনা করতে হয়েছে। যেন সাদা পৃষ্ঠায় কলম ছোঁয়াতেই কবিতাটি আপন খেয়ালে এগিয়ে গেছে এবং একসময় নিজে নিজেই থেমে গেছে। এমনকি খুব একটা একটা পরিমার্জনারও বিশেষ প্রয়োজন হয়নি। যেমন, এই কবিতাটি:

ছাদ হয় না, জানলা হয় 

কথা হয় না, শুধু হাসি হয় 

কোনোদিন রাগ হয় না, দুঃখ হয় 

আক্রোশ হয় না, কান্না হয় 

ফুল হয় না, পাতা হয় 

হাজার হাজার পাতায় সারাদিন 

খড়মড় মড়মড় শব্দ হয়

বন্ধন হয় না, শুধু দিনের পর দিন 

আনন্দ হয়

এক আকাশ আনন্দ নিয়ে 

একটা নিঃশব্দ অন্ধকারে উড়তে থাকি।

এমন নয় যে কবির স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশভঙ্গির কথা বলতে চেয়ে আমি বিশেষভাবে এই কবিতাটিকেই নির্বাচন করেছি, গ্রন্থভুক্ত যে কোনো কবিতা সম্পর্কেই এই কথা বলা যেতে পারে। তাইলে, লক্ষ করা যাক, আরো একটি কবিতা:

গভীর জল থেকে ডাঙায় টেনে তুলেছ বলে কেবলই আমাকে মাছ মনে হয়, 

যেন আমার সর্বাঙ্গে এখনও শ্যাওলা লেগে আছে,

এখনও সেই অন্ধকার পিচ্ছিলতা–

বুঝতেই পারছ না পালিয়ে গিয়েও 

আমি বারবার তোমার কাছে ফিরে আসি, 

তোমার জালেই বারবার ধরা দিই।

আসলে আমার যে জাল কেটে পালাবার মতো ত্রিভুবনে আর কোনো পুকুর নেই, 

সেটা বোধহয় তুমি এতদিনে জেনে গেছ।

পাঠক, এতক্ষণে আপনি নিশ্চয়ই বুঝে গেছেন, কেন আমি স্বতঃস্ফুর্ততাকেই এই কবির কবিতার প্রধান গুণ হিসেবে বিবেচনা করেছি। আর, এটা ভেবেও হয়তো অবাক হচ্ছেন, প্রেমের কবিতাও এমন সুন্দর, এমন অন্যরকম হতে পারে!

কিন্তু যদি মনে মনে ভেবে থাকেন গদ্যকবিতার কারণেই এমন স্বচ্ছন্দতা, তাহ’লে জানিয়ে রাখি, ছন্দ-মিলযুক্ত কবিতা রচনার ক্ষেত্রেও এই কবি একইরকম সাবলীল। যেমন, 

চর ছুঁয়ে গেছে একটি আকাশ

আলোর অন্বেষণে, 

রাত ঘনালেই তারা খসে পড়ে 

নৌকোর পাটাতনে। 

কিংবা

এখনও কতকিছু দেখার রয়ে গেল 

দেখিনি কোনোদিন তোমার মুখচোখ, 

হঠাৎ জানালায় আকাশ নেমে এলো–

এখন সারাদিন লেখার কথা হোক।

তবে, এই কবিকে আমি যে বিশেষভাবে পছন্দ করি, তার প্রধানতম কারণটি এবার বলি। এই কবি সে-ই জাদু আয়ত্ব করেছেন যার ফলে একটি কবিতা অশেষ হয়ে যায়, যেন কবিতাটির ভিতরে চিরদিন প্রচ্ছন্ন হয়ে রয়েছে অপার এক রহস্য। সেরকম একটি কবিতা:

বলব কী, বলবার আগেই

হাট করে ছিটকিনি খুলে দিয়েছ। 

আমি হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলেছি, 

আর তুমি আমাকে জব্দ করে 

জড়িয়ে ধরেছ আনন্দে।

ছিটকিনি খুলে দেওয়ার আনন্দ হয়তো 

এইরকমই, মন আলগা হয় বলে 

বুঝতে পারিনি।

আশা রাখি, আগামী দিনগুলিতেও এই কবির কাছ থেকে  এ ধরনের অশেষ কবিতা আমরা কেবলই পেতে থাকবো। 

দুঃখ দুঃখ ফুলের বাগানে। প্রতাপ সিংহ

একুশ শতক/১২৫ টাকা

Post a Comment

0 Comments