সংগীতশিল্পী শুভেন্দু মাইতি
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বিনোদ মন্ডল
"স্বপ্ন দেখার সাহস করো। /স্বপ্ন ছাড়া মানুষ বাঁচে নাকি। /স্বপ্ন ছাড়া কেমন করে গান গাইবে পাখি। /স্বপ্ন আর ফুলের জন্য / মরতে হলেও মরো। "
এই অবিনাশী পংক্তিমালার স্রষ্টা প্রবীণ শিল্পী শুভেন্দু মাইতি। নিজেকে 'গান-মজদুর' অভিধায় অভিহিত করতে ভালোবাসেন। গান লেখা, সুরারোপ, পরিবেশনা, গম্ভীরার বর্ণময় মঞ্চায়ন ছাড়াও সংস্কৃতির প্রায় প্রতিটি অঙ্গনে তাঁর ছয় দশকের স্বচ্ছন্দ পদচারণা। এখন ব্যস্ত আছেন তামাম ভুবনগ্রামের তেত্রিশ কোটি বাঙালির মনন- আশ্রয় 'পান্থপাদপ' রচনার কাজে। জ্বলদর্চি পত্রিকার পক্ষে তাঁর সাথে কথা বলেছেন তাঁর অনুজপ্রতিম সহযোদ্ধা গল্পকার বিনোদ মন্ডল।
বিনোদ মন্ডল : নন্দীগ্রামের ভূমিপুত্র আপনি। জ্বলদর্চি পরিবারের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা জানাই। আপনার জন্মতারিখ কত?
শুভেন্দু মাইতি : জন্মেছি ১৯৪৫ এ। তবে সরকারিভাবে জন্মতারিখ ১৯৪৬ এর ৪ নভেম্বর।
বিনোদ : বাবা, মা, বৌদি, ছেলেমেয়ের কথা....
শুভেন্দু : বাবা-মা দুজনেই প্রয়াত হয়েছেন। বাবা উপেন্দ্রনাথ, মা যোগমায়া। স্ত্রী শিবানী। আমাদের ছেলে অনির্বাণ টালিগঞ্জে থাকে। ফিল্ম এডিটর। মেয়ে তানিয়া।
বিনোদ : আপনার গানের গুরু ?
শুভেন্দু : ছোটোবেলা থেকে অনেকের কাছে তালিম পেয়েছি। তবে আমার প্রথম গুরু বাউন্ডুলে জীবনের উদ্দীপক শ্রী হৃষিকেশ সাউ। পূর্ব মেদিনীপুরের কাণ্ডপসরায় বাড়ি।
বিনোদ : গণনাট্য আন্দোলনে কীভাবে যুক্ত হলেন?
শুভেন্দু : ১৯৬৭ সালে নির্বাচনের সময়, প্রথম গণসংগীত পরিবেশন শুরু করি। CPI নেতাদের সংস্পর্শে আসি। বিশেষত কমরেড গীতা মুখার্জীর সাহচর্যে বাম আদর্শে পথচলা শুরু। সেবার ভোটের প্রচারে বাঁকুড়ায় পাঠানো হয় আমাকে। অতুল্য ঘোষের মত তাবড় কংগ্রেস নেতা সেবারে বামপ্রার্থী জে. এম. বিশ্বাসের কাছে পরাস্ত হন। পরে কলকাতায় ফিরে ১৯৭২ সালে গণনাট্যের সাম্প্রতিক শাখায় যোগ দিই। তারপর হলদিয়ায় গিয়ে রাজনীতির মূলধারায় চলে এলাম। গণনাট্য আন্দোলনে যুক্ত হলাম। অবিভক্ত মেদিনীপুরে তখন কৃষ্টিসংসদ ছাড়া হাতে গোনা কয়েকটি মাত্র শাখা। হলদিয়াতে The Tempest বলে একটা শাখা ছিল। তার নাম পরিবর্তিত করে আমরা মুক্তধারা রাখি।
বিনোদ : তখন তো কমিউन জীবন.....
শুভেন্দু : ঠিক। হলদিয়ার শ্রমিক ভবনে। আরো কয়েকজন সপরিবারে থাকতেন। আমিও থাকতাম। সারা রাজ্যে ঘুরে বেড়াতাম। লোকশিল্পীদের খোঁজে। সতেরো বছর কাটিয়েছি কমিউনে।
বিনোদ : পার্টিতে থাকতে পারলেন না কেন ?
শুভেন্দু : ১৯৯২ সালে আমিই প্রথম লক্ষ্মণ শেঠের চৌর্যবৃত্তির বিরুদ্ধে পার্টিকে লিখিত জানাই। এখন তো সব জলের মতো পরিষ্কার।
বিনোদ : বেশ কিছু কালজয়ী গণসংগীত রচনা করেছেন। সুর দিয়েছেন। পছন্দের কয়েকটি উল্লেখ করুন।
শুভেন্দু : স্বপ্ন দেখার সাহস করো, মইনুদ্দিন কেমন আছো ?, পরশ পাথর কি সত্যি আছে গো..... ইত্যাদি।
বিনোদ : আজ যখন 'টুম্পা সোনা ' বাজে, কেমন লাগে?
শুভেন্দু : হাস্যকর লাগে। বালখিল্য মনে হয়। কত বিচিত্র সৃষ্টি সম্ভার রয়েছে আমাদের... যা আজও প্রাসঙ্গিক।
বিনোদ : আপনি তো অনেক মঞ্চ-সফল নাটক লিখেছেন। ছোটদের জন্যেও। কিছু কিছু নানা পত্রপত্রিকায় ছাপাও হয়েছে। সংখ্যাটা কতো ?
শুভেন্দু : খান তিরিশেক।
বিনোদ : মানুষ, শুভেন্দু মাইতিকে কেন মনে রাখবেন ?
শুভেন্দু : প্রথমতঃ, CPI(M)-এ আমিই প্রথম দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছি। দ্বিতীয়তঃ আমার গায়ে আজ পর্যন্ত কোনো দুর্নীতির দাগ নেই। তৃতীয়তঃ, সংস্কৃতি আন্দোলনে এই বাংলায় নতুন ধারার প্রবর্তন করেছি। চতুর্থতঃ বাংলা নগর সংগীতের ভগীরথ আমি।
বিনোদ : তা ঠিক। সুমন, নচিকেতা, অঞ্জন, কাজী কামাল নাসেরদের সৃষ্টি বাজারে আসার আগে গণনাট্য দপ্তরে আপনার গলায় শুনে রোমাঞ্চিত হয়েছি। হাল ছেড়ো না, ছেড়ো না বন্ধু...
বিনোদ : একই সাথে দুটো ধারাকে লালন করেছি নিরন্তর। কত রাত কেটে গেছে বাউলদের আখড়ায়। হাত ধরে HMV- র দরজায় নিয়ে গেছি নতুন ধারার আধুনিক বাংলা গানের শিল্পীদের....
বিনোদ : আজকালে উত্তর সম্পাদকীয় লিখতেন, একসময় ....
শুভেন্দু : হ্যাঁ, আজকাল প্রকাশন থেকে সেসব 'নানা লেখা' নামে মলাটবন্দী হয়েছে।
বিনোদ : বামপন্থীদের মতাদর্শ প্রচারের দিকটি কি আজ অবহেলিত বলে মনে হয় ?
শুভেন্দু : তা তো বটেই। তাত্ত্বিক পড়াশুনো এবং তার প্রচার ও প্রসারে কমিউনিস্ট পার্টিকে আরো যত্নশীল ও মনোযোগী হতে হবে। এখন মতাদর্শ প্রচারের লোক কোথায়? ছিলেন বুদ্ধবাবু, তাঁকেও মুখ্যমন্ত্রী করে দেওয়া হল। তারপর তো সব ইতিহাস।
বিনোদ : জোটের ভবিষ্যৎ?
শুভেন্দু : আমার মতে, বিরোধী অবস্থানে কিছুদিন থাকুক, পার্টি। ডাকা হোক প্লেনাম। চুলচেরা বিশ্লেষণ করা হোক পরিবেশ, পরিস্থিতির।
বিনোদ : আপনি তবু তো বামপন্থীদের নানা কর্মসূচিতে আজকাল যোগ দেন, দেখি.....
শুভেন্দু : লোক নেই। তাই তাঁরা ডাকেন। আমিও অন্য কোথাও যাইনি। তাই এখানেই যাই। ফিতে কাটি। অভিজ্ঞতার কথা বলি। নতুন প্রজন্মকে বলি – প্রশ্ন করো। প্রশ্ন তোলো। পার্টির প্রতি সপ্রশ্ন আনুগত্যই পারে কমিউনিস্ট পার্টিকে অগ্নিশুদ্ধ রাখতে। প্রাণবন্ত করতে।
🍂
বিনোদ : মমতা সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন ?
শুভেন্দু : মমতাকে বামপন্থীরা বরাবর অবমূল্যায়ন করে এসেছে। সেই চুরাশিতে (১৯৮৪) যে আটপৌরে লড়াকু মেয়েটি সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়-এর মতো জাঁদরেল প্রার্থীকে হারিয়েছিলেন, তাঁর মূল্যায়নে পুরোপুরি ব্যর্থ আমরা। তাঁর উচ্চারণ, উল্টোপাল্টা তথ্য দিয়ে আমজনতার মন জয় করবার কৌশল নিয়ে শুধু খিল্লি করা হয়।
বিনোদ : বর্তমান সময় নিয়ে দু এক কথা বলুন...
শুভেন্দু : কী আর বলব? এখন চুরি, জোচ্চুরির সামাজিকীকরণ হয়ে গেছে। সততা, স্বচ্ছতা, গণতান্ত্রিক অধিকার নিয়ে মাথা ঘামান ২১% মানুষ। বাকী ৭৯% মানুষ ব্যস্ত জীবিকার জন্যে। শাসক শ্রেণি জাতপাত, ধর্ম, বর্ণ- শ্রেণির সমীকরণ মাথায় রেখে তাস খেলছে। দেখলে না, কুড়মী ও আদিবাসীদের পরস্পরের বিরুদ্ধে খেপিয়ে তোলা হচ্ছে।
বিনোদ : আপনি কবিতা লিখেছেন বেশ কিছু। আপনার গান-- গণসংগীত হয়েও কাব্যসুষমায় অটুট। লিখেছেন - স্বপ্ন দেখার সাহস করো...। তা এখন কী স্বপ্নে বুঁদ হয়ে আছেন ?
শুভেন্দু : বীরভূমের বোলপুরে, বাঁধ নবগ্রামে ১৬ বিঘা জায়গা জুড়ে শুরু করেছি বিশাল কর্মযজ্ঞ। সারা পৃথিবীর নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা তেত্রিশ কোটি বাঙালির সাংস্কৃতিক আশ্রয় 'পান্থপাদপ' নামে মাথা তুলছে। সেখানে কয়েকজন সমমনোভাবাপন্ন বন্ধু এগিয়ে এসেছেন। আমার ছেলে অনির্বাণও সরাসরি যুক্ত এই কাজে। এই 'পান্থপাদপ' আমার জীবনের সবচেয়ে বড় কাজ হবে। এটাই বলতে পারো আমার শেষ স্বপ্ন। গড়া হচ্ছে চল্লিশখানা কটেজ। মুক্তমঞ্চ, সংরক্ষণ শালা, সেমিনার হল, পাঠাগার, গবেষণাকেন্দ্র, ওয়েবপোর্টাল। জেলায় জেলায় সহৃদয় বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে। তোমাদের মেদিনীপুর শহরেও একদিন যেতে চাই। এতো একার কাজ নয়।
বিনোদ : আপনার লালন আকাদেমি.....
শুভেন্দু : নৈহাটিতে লালন আকাদেমি তো আছেই। ভালো কাজ হচ্ছে। প্রচুর নতুন প্রতিভা উঠে এসেছেন।
বিনোদ : বামপন্থীদের কি একজোট হওয়া সম্ভব, এদেশে?
শুভেন্দু : চেষ্টা তো করতেই হবে। বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়ে ভাবতে হবে। দার্জিলিং-এর কমলালেবু কি মেদিনীপুরের লালমাটিতে চাষ করা সম্ভব? মার্কসবাদকে আমাদের সমাজের নিরিখে প্রয়োগ করতে হবে। কথা প্রসঙ্গে আজিজুল হকও সেদিন পরামর্শ দিলেন সকলকে এক জোট হতে হবে।
বিনোদ : সংস্কৃতির অঙ্গনে বামপন্থী সংগঠন সমূহের সমন্বয়ের কাজ করছেন, নাকি ?
শুভেন্দু : "পান্থপাদপ' তো সেই লক্ষে গড়ে তোলা। তোমরা যে যেখানে আছো, সবাইকে নিয়ে এই স্বপ্ন সফল করতে চাই। এই লেখার পাঠকদের মধ্যেও যারা আগ্রহী তাদের নিয়েও বুক বাঁধতে চাই নতুন আশায়। সবাই স্বাগত।
বিনোদ : কথা বলে ভালো লাগলো। ভালো থাকুন।
শুভেন্দু : তোমরাও খুব ভালো থাকো।
------
0 Comments