স্বতন্ত্র স্বর আর উচ্চারণে বহুদূরে আমাদের নিয়ে যান কবি
প্রতাপ সিংহ
'চোখের আলোয় চোখের অন্ধকারে,' 'ব্রতকথা', 'তর্জনীর অলঙ্কার নেই' এবং 'চন্দ্রাহত চোরটির কথা'-র পর দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে ২০২০ কলকাতা বইমেলায় প্রকাশিত সত্তর দশকের অন্যতম কবি তাপস ওঝার পঞ্চম কাব্যগ্রন্থ 'স্বরে আর উচ্চারণে এত যে সুদূর' কিছুদিন আগে পড়ার সুযোগ হল। আপাত সরল ও তুচ্ছ বিষয়কে সঙ্গী করেও অনায়াসে তিনি পাঠকের জন্য এক মায়াময় জগৎ রচনা করেন। স্বতন্ত্র সুর আর উচ্চারণে বহুদূরে আমাদের নিয়ে যান এই কবি। তাই শৈশব-কৈশোর-যৌবন অতিবাহিত বীরভূমের জলমাটির সঙ্গে শহর ও নাগরিক জীবনের ক্লান্ত বিমর্ষ অবক্ষয়ের গ্লানিও এই কাব্যের বিভিন্ন কবিতায় ভাস্বর হয়ে উঠেছে। 'নিজস্ব রচনাবলি' কবিতায় কবি নিজের সঙ্গে পাঠককেও প্রশ্নসায়কে বিদ্ধ করেনঃ
'নিয়মটা কী? /আমাকে তরল হতে হবে? /
শব্দগুলি সাজিয়ে দিলাম / তোমার মনের মত করে /... সবকিছু নকল বৈভবে সাজিয়ে দিলাম /... হিরণ্ময় জলভাণ্ড/ আমি ভরে নেব তোমার নিজস্ব শব্দে --/আর আমি প্রকাশিত হব?'
পুরনো চিঠির স্মৃতি, কদমের ছায়া আর দোতারার সঙ্গে উদাসী বাউল বা একলা পথিকও গহন মনের অভ্যন্তরে খুঁজে পায় এক আশ্চর্য দ্বীপের আলো। গাছেরা সংকল্পের কথা বলে বলেই মানুষ ভরসা আর আশ্রয় পায়। অথচ বাঁশঝাড়ে বিপন্ন লন্ঠনের সঙ্গে বহুপ্রসবিনী গাভীর মতোই অতিপ্রভূত লোভ আর লালসার শিকার হয়ে আমাদের জীবনও নিজস্ব আঁধারে দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। তাই বেদনাহত কবিরও মর্মন্তুদ উচ্চারণ --
'তোমার রূপক তোমাকে আড়াল করে -/ তোমাদের যান্ত্রিক কৃষি একদিন তোমাদের সুরগুলি খাবে /তোমাদের ছেড়ে গেছে অলৌকিক আলো' আর সেজন্য 'তোমার গুঞ্জন হঠাৎ মরমে এসে / মনোরম হবে না কখনও (শুধু শুধু বেজে যাবে ড্রাম)। অথচ এরকমই গভীর উচ্চারণমালা নিয়েই 'মানসলোক' পত্রিকার মরমি সম্পাদক আশ্চর্য স্যাটায়ার বা বিদ্রূপের ছলেই এক নিপুণ জাদুকরের মতন যেমন পাঠককে শৈল্পিক অন্তর্জগতে হাজির করেন, পাশাপাশি সংবেদনশীল চিত্রকরের ভূমিকায় সাজিয়ে দেন বিচিত্র ও অভিনব কাব্যশরীর। 'যোগ্য শিষ্য পেল না বলে কাঁদে নিঃসঙ্গ তস্কর'(রাত্রির বিষয়), কাঠের, মাটির, স্বপ্নের--/ সীমাহীন অন্ধকার তখন একটি সেতুর ভাষা খোঁজে /আর খুঁজতে খুঁজতে অনায়াসে অন্য একটি রোদের / স্বতন্ত্র কণ্ঠস্বর শুনতে পায় '( রোদের কারিগর), বাতাসে পাখির গন্ধ --/ যারা উড়ে গিয়েছিল তারা হেরে গিয়ে / অন্ধকারে ডানাগুলি গুটিয়ে রেখেছে।... আমাদের শুধু হেরে যাওয়া মনে থাকে। '( স্মৃতিভ্রষ্ট পাখিদের কথা)
'সাজাবেই যদি মিতাক্ষরে কবিতা সাজাও'(কেন আঁকো বারবার), 'জলে নেমে যাচ্ছে ব্যর্থ শামুক'(আভাসের মতো),
ভিক্ষা চাওয়ার কৌশল আর সরগম / জেনে নিয়েছি আমি ( খারাপ ভিখারিদের কথা), একটি জোনাকির জীবনযুদ্ধ কি রকম / আমি জানি না...'( অন্ধকার গাঢ়তর হয়)। 'বেয়াদব কিছু ফুলগাছ গন্ধ দিয়েছিল বিনামূল্যে '( চেনা ভূতগুলির একজন)। 'কার সাথে আজকাল ওঠাবসা কর/ সব জানে তেমাথার বেচারি দোকান'(আর তুমি ভাবছ)
কবি চান প্রকৃতি ও মানুষের সুচারু সহাবস্থান। তাই তিনি লেখেন--
' আসলে জলের ইতিহাস লিখতে হবে' --যা জলের মতোই সরল অথচ গভীর আবার তরঙ্গের মতো রহস্যময় এক জীবন অন্বেষাও বটে। দু'-চারটি শব্দের মোচড়েই গ্রামনগরের যাপিত জীবন আড়ালপ্রিয় এই কবির কবিতায় আশ্চর্যভাবে উদ্ভাসিত হয়, যা আমাদের মুগ্ধ করে, আমরা আপ্লুত হই।
'পত্তনেরও কিছু নিয়মকানুন থাকে / তোমার ইঙ্গিতে হঠাৎ নির্মাণ হবে, এমনটা নয়-/... তোমার আশ্চর্য রাগে পুড়ে যাবে /
চর্চার বিষয় -- এমনটা নয়/ নৈশব্দ্য সৌজন্যের বিহ্বল প্রতীক --'(যখন বদল হবে)। একেবারে মন্ত্রের মতো সত্য এই উচ্চারণমালা, পাঠকও যে মন্ত্রমুগ্ধ হবেই তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
আবার কবি যখন লেখেন --
' তেমনি একটি মেয়ে / বারবার মানুষ ডেকেছে / # মানুষ ছিল না চারপাশে / এখনও মানুষ নেই এই অন্যবিধ দেশে'(মানুষ ছিল না) --
তখন অবশ্যই কবিচৈতন্যের এই আর্তি - হাহাকার আমাদের স্পর্শ করে গভীরভাবে। সেই অবিশ্বাস, বিষাদ আর অবহেলার দেশে মানুষের অস্তিত্ব বিপন্ন, তাই চতুর্দিকে হাজারো সামগ্রী বিরাজ করে কিন্তু কিছুতেই মানুষের দেখা পাই না।
সবমিলিয়ে ছাপান্নটি কবিতা এই চারফর্মার বইটিতে সংকলিত হয়েছে। দেবাশিস সাহার অপূর্ব প্রচ্ছদের সঙ্গে মুদ্রণের কাজও বেশ ভালো লেগেছে। কিছুক্ষেত্রে স্পেশের ব্যবহার মাত্রাতিরিক্ত বেশি হয়েছে যা কাম্য নয়। এমন নিটোল - সুসংহত ও বৈচিত্র্যময় কবিতার সংকলনে দু'-চারটি কবিতা আরও অন্যরকম হলে ভালো লাগত। তবুও শব্দের দ্যোতনায়, চিত্রকল্পের দ্যুতিতে,রূপক-প্রতীকের অনবদ্য প্রয়োগে এই সহজ কবিতাগুলো বাঙ্ময় হয়ে ওঠে সন্দেহ নেই। মন ও মননের আলোকে উজ্জীবিত এই কবির পরবর্তী কাব্যগ্রন্থের জন্য যে পাঠক অপেক্ষায় থাকবেন তা হলফ করেই বলা যায়।
স্বরে আর উচ্চারণে এত যে সুদূর। তাপস ওঝা।
পাঠক। ১০০ টাকা।
0 Comments