জ্বলদর্চি

প্রথম মহিলা স্নাতক ও ফিজিশিয়ান কাদম্বিনী গাঙ্গুলি /পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যা

বিজ্ঞানের অন্তরালে বিজ্ঞানী — ৯২
প্রথম মহিলা স্নাতক ও ফিজিশিয়ান কাদম্বিনী গাঙ্গুলি 

পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যা


ঊনবিংশ শতাব্দীর ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতবর্ষে পুরুষ শাসিত সমাজে পর্দার আড়ালে থাকা একজন নারীর শিক্ষালাভ সত্যিকার হাঁসের সোনার ডিম পাড়ার মতো ঘটনা ছিল। সমাজের রক্তচক্ষু এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অপ্রতুলতার বেড়া টপকে যে-ক'জন নারী নিজের সিদ্ধিলাভে সফল হয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন প্রথম প্রজন্মের সফল নারী ডা. কাদম্বিনী গাঙ্গুলি।‌ তিনিই ভারতের প্রথম মহিলা ফিজিশিয়ান। লক্ষ লক্ষ পর্দানবিস নারীর অনুপ্রেরণা। আদর্শ। 

ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি (অধুনা, বিহার)-এর অন্তর্গত ভাগলপুরে এক বাঙালি কায়স্থ পরিবারে তাঁর জন্ম ১৮ জুলাই ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দে। বাবা ব্রজকিশোর বসু ছিলেন একজন ব্রাহ্মসমাজ সংস্কারক। চাকরির সূত্রে তাঁর ভাগলপুরে আসা। ভাগলপুর হাইস্কুলে প্রধান শিক্ষক ছিলেন ব্রজকিশোর বাবু। কর্মক্ষেত্রের আশেপাশে বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডে সরাসরি যুক্ত হয়েছিলেন তিনি। ভাগলপুরে নারীমুক্তি আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল মূলত অভয়চরণ মল্লিক এবং তাঁর হাত ধরেই। যৌথ উদ্যোগে তাঁরা গড়ে তোলেন ব্রিটিশ ভারতের প্রথম মহিলা সংগঠন 'ভাগলপুর মহিলা সমিতি', ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে। কিন্তু কাদম্বিনী দেবীর বড় হয়ে ওঠা অধুনা বাংলাদেশের বরিশালে। তাঁদের আদি নিবাস ছিল বরিশালের চাঁদসি'তে। 

উচ্চ বর্ণের বাঙালি কায়স্থ সম্প্রদায়ে কাদম্বিনী দেবীর জন্ম। অথচ ভাগ্যের কী করুণ দশা – উচ্চ বিত্ত সমাজেও অবহেলিত একজন নারীর শিক্ষালাভ। যদিও শত সামাজিক প্রতিবন্ধকতা দূরে সরিয়ে রেখে তিনি আপন লক্ষ্যে অবিচল। অভীষ্ট লক্ষ্য সাধনে অসীম তাঁর মনের জোর। এ হেন কাদম্বিনী দেবীর ইংরেজি লেখাপড়ার হাতেখড়ি হয়েছিল ঢাকা'র 'ব্রাহ্ম ইডেন ফিমেল স্কুল'-এ। অল্প দিনের ব্যবধানে তাঁর পরিবার ভাগলপুর থেকে কলকাতায় চলে আসে। সেখানকার বালিগঞ্জ হিন্দু মহিলা বিদ্যালয়ে তাঁর পড়াশুনা চলতে থাকে। বিদ্যালয়টির নাম পরিবর্তন করে 'বঙ্গ মহিলা বিদ্যালয়' রাখা হয় ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে। দু'বছর পর, ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে, সেটি বেথুন স্কুলের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়। প্রথমে বঙ্গ মহিলা বিদ্যালয় এবং পরে বেথুন স্কুলে তাঁর লেখাপড়া চলতে থাকে। পড়াশুনার পাশাপাশি অন্যান্য বিষয়ে তাঁর যথেষ্ট আগ্রহ। স্কুলে পড়ার সময়, ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে, মাত্র সতেরো বছর বয়সে কাদম্বিনী দেবী কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশিকা পরীক্ষায় দ্বিতীয় শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হন। বেথুন কলেজে মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত এফএ (ফার্স্ট আর্টস) কোর্স পড়া শুরু করলেন তিনি। এফএ কোর্সটি মূলত মহিলাদের কলেজে নিয়মিত কোর্সে ভর্তির পাসপোর্ট। তাঁর অদম্য জেদ এবং নাছোড় প্রচেষ্টার স্বীকৃতি স্বরূপ বেথুন কলেজ মহিলাদের জন্য সর্বপ্রথম এফএ এবং স্নাতক কোর্স চালু করে। ১৮৮০ সালে এ হেন এফএ পরীক্ষায় সাফল্যের সঙ্গে কৃতকার্য হলেন তিনি। একই সময়ে চন্দ্রমুখী বসুও এফএ পরীক্ষায় সফল হন দেরাদুন নেটিভ ক্রিস্টিয়ান স্কুল থেকে। এফএ পরীক্ষায় পাশ করার পর কাদম্বিনী দেবী বেথুন কলেজ থেকে ১৮৮৩-তে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করলেন। সেবছর বেথুন কলেজ থেকে তিনি এবং চন্দ্রমুখী বসু প্রথম গ্র্যাজুয়েট হয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, গোটা দেশে তাঁদের দুজনই ছিলেন প্রথম মহিলা গ্র্যাজুয়েট। ভারতবর্ষের ইতিহাসে ওই দুই মহিলার নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে।
      
স্নাতক ডিগ্রি লাভ করে তাঁর পাখির চোখ ডাক্তারির উপর পড়ল। তাঁর দৃঢ় সংকল্প ডাক্তারি পড়বেন। যেমন ভাবা, তেমন কাজ। ডাক্তারি পড়া এক প্রকার মনস্থির করে ফেলেছেন এমন সময় তাঁর জীবনে অকস্মাৎ এক ঘটনা ঘটে। তাঁর বিবাহের পাকা কথা সারা হয়ে গেছে। ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দের ১২ জুন। ওইদিন তাঁর বিবাহ সম্পন্ন হয়েছিল দ্বারকানাথ গাঙ্গুলীর সঙ্গে। দ্বারকানাথ গাঙ্গুলী একজন প্রথিতযশা সাংবাদিক, বিখ্যাত সমাজসংস্কারক এবং মানবদরদী ব্যক্তিত্ব। ব্রাহ্মসমাজে তাঁর দারুণ নামডাক। বঙ্গ মহিলা বিদ্যালয়ে কাদম্বিনী দেবীর শিক্ষক ছিলেন তিনি। বিয়ের সময় কনের বয়স যেখানে মাত্র একুশ বছর, পাত্রের বয়স প্রায় দ্বিগুণ – ৩৯ বৎসর। তার উপরে পাত্র বিপত্নীক। আগের পক্ষের পত্নীর তিন সন্তানের পিতা। এদিকে অসম বয়সী নরনারীর এমন আজব বিবাহ নিয়ে মহা ঝামেলার সূত্রপাত ব্রাহ্মসমাজে। রীতিমতো হুলুস্থুলু কাণ্ড। ব্রাহ্মসমাজ দ্বিধাবিভক্ত। সমস্যার সূত্রপাত পাত্রপাত্রীর বয়সের বিস্তর ফারাক। বেশিরভাগ ব্রাহ্ম মানুষ এই বিবাহের বিপক্ষে। তাই, বিবাহের জন্য গুপ্ত স্থান নির্বাচন জরুরি হয়ে পড়েছিল। শেষ বেলায় কলকাতার এক গোপন আস্তানায় তাঁদের দুজনের শুভ বিবাহ নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হয়েছিল।

🍂
বাঙলার সমাজ ব্যবস্থায় সদ্য বিবাহিত একজন নারীর বিবাহান্তে উচ্চ শিক্ষা লাভের আশা ডুমুরের ফুলের মত দশা। অধিকাংশ ক্ষেত্রে অসম্ভব একটি স্বপ্ন। শ্বশুরবাড়ির হস্তক্ষেপে অযাচিত ছেদ নেমে আসে পড়াশুনায়। গৃহস্থের চারদেয়ালের মাঝে অরণ্যে রোদন করা ব্যতিত বিকল্প উপায় নেই বিবাহিতার। অথচ কাদম্বিনী দেবীর চওড়া কপাল। সমস্ত সামাজিক প্রতিবন্ধকতা হেলায় দূরে সরিয়ে রেখে স্বামীর ঐকান্তিক সমর্থনে বিয়ের এগারো দিনের মাথায় কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে ডাক্তারির ক্লাস শুরু করেছিলেন তিনি। যদিও ঘটনাটা বেশ কাকতালীয়, তবুও মজার ব্যাপার হলো – ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ মহিলাদের জন্য সর্বপ্রথম ভর্তির দরজা খুলে দেয় এবং কাদম্বিনী দেবীর কাছে এক অভাবনীয় সুযোগ এসে হাজির হল। পরিবার পরিজনদের সম্মতিক্রমে ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে তাঁর ডাক্তারি পড়াশুনা শুরু হল। তিন বছর পর 'গ্র্যাজুয়েট অফ বেঙ্গল মেডিক্যাল কলেজ' শীর্ষক ডাক্তারির খেতাব মেলে। এ হেন খেতাবের সৌজন্যে ফাইনাল পরীক্ষার আগেই ডাক্তারি প্র্যাকটিসের ছাড়পত্র পেলেন তিনি। যদিও আরও দুবছর ধরে চলে তাঁর ডাক্তারি পড়াশুনা। তিনি ছিলেন প্রথম ভারতীয় মহিলা, যে কিনা পাশ্চাত্য চিকিৎসা-রীতিতে চিকিৎসা করার অনুমতি পেয়েছিলেন। 
 ‌‌       
মেডিক্যাল কলেজে পড়াকালীন তিনি একখান স্কলারশিপ পেয়েছিলেন। মাসিক কুড়ি টাকা বৃত্তি। একে মহিলা , তায় বৃত্তি প্রাপক। প্রফেসর আর সি চন্দ্র-এর নেক নজরে পড়ে গেলেন কাদম্বিনী দেবী। প্রফেসর চন্দ্র-এর মনে দারুণ প্রতিশোধ স্পৃহা। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে বিশেষত মহিলা পড়ুয়া অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে নিমরাজি প্রফেসর। মহিলা স্টুডেন্ট ভর্তির ব্যাপারে তাঁর বিরোধ ছিল চরমে। হৃদয় থেকে অধ্যাপকের অন্তরাত্মা কখনও সায় দেয়নি নারী শক্তির জাগরণে। সেজন্য মহিলা ডাক্তারি পড়ুয়াদের মাসিক কুড়ি টাকা বৃত্তি ঘোষণায়‌ তিনি যারপরনাই ক্ষুব্ধ। তাঁর ক্ষোভ এত চরমে পৌঁছেছিল যে ডাক্তারির ফাইনাল পরীক্ষায় প্র্যাকটিক্যালের একটি পেপারে কাদম্বিনী দেবীকে তিনি অকৃতকার্য করে দিয়েছিলেন। তাই ডাক্তারিতে স্নাতক হলেও তাঁর সম্মুখে উচ্চ শিক্ষার দরজা চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়। আকস্মিক ছন্দপতন ঘটে তাঁর আশা। অধরা থেকে যায় তাঁর স্বপ্নের 'ব্যাচেলর অব মেডিসিন' ডিগ্রি। 

১৮৮৬-তে গ্র্যাজুয়েশন করার সঙ্গে সঙ্গে ড. আনন্দী গোপাল জোশি'র সঙ্গে যৌথভাবে প্রথম মহিলা ভারতীয় ডাক্তার হয়েছিলেন তিনি। বিগত পাঁচ বছর মেডিক্যাল কলেজে পড়াশুনা চালিয়ে, ১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দে, অল্প সময়ের জন্য কাদম্বিনী দেবী 'লেডি ডাফরিন মহিলা হাসপাতাল'-এ চিকিৎসার কাজে নিজেকে নিয়োজিত হয়েছিলেন তিনি। মাসিক তিন শত টাকা বেতন। এক বছর পরের ঘটনা। ১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দে বোম্বে শহরে (অধুনা, মুম্বাই) জাতীয় কংগ্রেসের পঞ্চম অধিবেশন বসে। সেখানে প্রথম বার যে-ছয়জন মহিলা প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছিলেন, কাদম্বিনী দেবী তাঁদের মধ্যে একজন। সেই সময় তাঁর সঙ্গে অ্যানি বেসান্তের পরিচয় হয়। তিনি যোগ দেন স্বাধীনতা আন্দোলনে। পরের বছর ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় বসে জাতীয় কংগ্রেসের ষষ্ঠ অধিবেশন। সেখানে বক্তব্য রেখেছিলেন তিনি। কাদম্বিনী দেবী ছিলেন জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম বক্তা। তিনি গান্ধীজীর সহকর্মী হেনরি পোলক প্রতিষ্ঠিত 'ট্রান্সভাল ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন'-এর প্রথম সভাপতি হয়েছিলেন তিনি। ১৯০৭ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত মহিলা সম্মেলনের সদস্য নিযুক্ত ছিলেন।
     
পুরনো হিন্দু রক্ষনশীল সমাজের দ্বারা বারবার আক্রান্ত হয়েছেন তিনি। ১৮৯১ সালের ঘটনা। রক্ষনশীল একখানা বাংলা পত্রিকা 'বঙ্গবাসী'। পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন মহেশচন্দ্র পাল। এ হেন পত্রিকায় পরোক্ষভাবে কাদম্বিনী দেবীকে অত্যন্ত অশ্লীল ভাষায় আক্রমণ শানায় পত্রিকা সম্পাদক। রূঢ় ভাষায় সম্বোধন করা হয়েছিল তাঁকে। বঙ্গবাসী কাগজে তাঁর মাথা নত করে দেওয়ার জন্য একটি কার্টুন প্রকাশিত হয়। কার্টুনে দেখা যায়, কাদম্বিনী দেবী তাঁর স্বামী দ্বারকানাথ গাঙ্গুলীর নাকে দড়ি বেঁধে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন। তার নীচে নানান কুরুচিকর মন্তব্য লেখা। পত্রিকায় ব্যবহৃত কটু ভাষা শালীনতার সমস্ত মাত্রা লঙ্ঘন করেছিল। ক্ষুব্ধ কাদম্বিনী দেবীর অসম্ভব মনের জোর। দাঁতে দাঁত চেপে তিনি 'বঙ্গবাসী' পত্রিকার বিরুদ্ধে মামলা রুজু করেন। স্বভাবতই সেই মামলায় একজন নারীর জিত হয়। বঙ্গবাসী পত্রিকার সম্পাদক মহেশ চন্দ্র পাল'কে একশো টাকা জরিমানা এবং ছয়‌ মাসের হাজত বাসের সাজা ঘোষণা করা হয়। একটি মেয়ের এ হেন সাহস রীতিমত তোলপাড় ফেলে দেয় সমাজে।

দারুণ ব্যস্ত কাদম্বিনী দেবী। সংসার ও ডাক্তারি সামলে একগুচ্ছ সামাজিক কর্মকাণ্ডে তাঁর অবাধ চলাচল। দেশমাতৃকার সেবায় নিজেকে সঁপে দিয়েছেন তিনি। জাতীয় রাজনীতির অঙ্গনে ধীরে ধীরে তাঁর উজ্জ্বল প্রবেশ। হাজার একটা কাজের ভীড়েও তাঁর মাথায় সর্বক্ষণ ঘুরপাক খায় উচ্চতর বিদ্যার্জনের অভীপ্সা। লক্ষ্য বিলেতের ডাক্তারি ডিগ্রি হাসিল করা। তার জন্য চাই নিরিবিলি পরিবেশে কঠোর অধ্যবসায়। কিন্তু ক্ষুদ্র সাংসারিক পরিসরে তা মেলা সত্যিই দুস্কর। তবে আপন লক্ষ্যে অবিচল থাকলে পার্থিব বাধা বিপত্তিগুলো অটোমেটিক দূরে সরে যায়। তখন অসম্ভব মনে হয় না ডুমুর গাছের ফল। শেষমেশ নিজের ইস্পাতকঠিন মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ ঘটে তাঁর প্রত্যয়ে। বিলাতি ডাক্তারি ডিগ্রি হাসিল করতে তাঁর জুড়ি মেলা ভার। সেটা ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দের ঘটনা। শেষমেশ ইংল্যান্ডগামী জাহাজে চেপে বসলেন কাদম্বিনী দেবী। বিলেতে পৌঁছে চষে বেড়িয়েছেন সারা ইউরোপ ভূমি। একের পর এক ডিগ্রি হাসিল করেছেন অবলীলায়। স্কটল্যান্ডের রাজধানী এডিনবার্গ থেকে LRCP (Licentiate of the Royal College of Physician), গ্ল্যাসগো থেকে LRCS (Licentiate of the Royal College of Surgeons) এবং আয়ারল্যান্ড-এর ডাবলিন থেকে GFPS ডিগ্রি লাভ করে দেশে ফিরে আসেন তিনি। স্বদেশে প্রত্যাবর্তন অব্দি তাঁর নিঃশ্বাস ফেলার ফুরসৎ নেই। 
 ‌    
একগুচ্ছ সামাজিক ও রাজনৈতিক কাজে তাঁর অবাধ ব্যপ্তি। নিজেকে বেঁধে ফেলেছেন হাজার একটা কাজে। ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি কলকাতায় সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেছিলেন। এ হেন অধিবেশন আয়োজন করা হয়েছিল মহাত্মা গান্ধীর সম্মানে। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে আসামের চা-বাগানের শ্রমিকদের দুর্দশার সীমা পরিসীমা ছিল না। কাদম্বিনী দেবী চা-শ্রমিকদের শোষণের বিষয়ে অবগত ছিলেন। এক্ষেত্রে তাঁর স্বামীর দৃষ্টিভঙ্গি হুবহু তাঁর মতামতের সঙ্গে মিলে গেল। আসামের চা-বাগানের শ্রমিকদের যে পদ্ধতিতে কাজে লাগানো হয়েছিল, তার তীব্র নিন্দা করেছিলেন দ্বারকানাথ গাঙ্গুলী। স্বামীর প্রতিবাদে জোরালো আওয়াজ তুলে ঝাঁপিয়ে পড়লেন সমাজসেবায়। কবি কামিনী রায়-এর সঙ্গে তিনি বিহার এবং উড়িষ্যা গিয়েছিলেন ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে। সেখানকার নারী শ্রমিকদের দুরাবস্থা তদন্তের জন্য সরকার দ্বারা নিযুক্ত হয়েছিলেন তাঁদের দুজনে।

অতিরিক্ত পরিশ্রমে তাঁর শরীর আর সঙ্গ দিচ্ছিল না। সেদিনটা ছিল ৩রা অক্টোবর ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দ। জরুরি কয়েকটি অপারেশন সেরে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরেছিলেন তিনি। সামান্য বিশ্রাম নিয়ে ক্লান্ত অবসন্ন দেহে স্নানঘরে ঢোকেন। সেখানেই তাঁর সেরিব্রাল অ্যাটাক হয়। আর চোখ খোলেননি। মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন কাদম্বিনী দেবী। মৃত্যু কালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৬২ বৎসর।

তিনি ছিলেন আট সন্তানের জননী। নিজের পেটের পাঁচ সন্তান এবং আগের পক্ষের তিন সন্তান নিয়ে তাঁর ভরা সংসার। মেডিক্যাল কলেজে ডাক্তারি পড়বার সময়ে তাঁর দুটি সন্তান জন্মায়। অথচ সন্তান প্রসব কিংবা বাচ্চা মানুষ করতে গিয়ে ন্যূনতম ছুটির আশ্রয় নিয়েছেন তিনি। এই কারণে তাঁর ডাক্তারি পড়াশুনা খুব বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়নি। উত্তর পূর্ব এশিয়ায় ইউরোপীয় চিকিৎসা শাস্ত্রে ডাক্তারি পড়া প্রথম মহিলা ফিজিশিয়ান হয়েছিলেন এই বিদুষী নারী। সংসার, ডাক্তারি, রাজনীতি ও সামাজিকতা সবকিছু সফল ভাবে সামলে চেনা বৃত্তের বাইরে দূর আকাশের তারা মনে হয় অসম্ভব ব্যক্তিত্বময়ী কাদম্বিনী দেবীকে। তিনি সূচিশিল্পেও নিপুণা ছিলেন। বিখ্যাত আমেরিকান ইতিহাসবিদ ডেভিড কফ তাই লিখেছেন — 
"গাঙ্গুলীর স্ত্রী কাদম্বিনী ছিলেন তার সময়ের সবচেয়ে সফল এবং স্বাধীন ব্রাহ্ম নারী। তৎকালীন বাঙালি সমাজের অন্যান্য ব্রাহ্ম এবং খ্রিস্টান নারীদের চেয়েও তিনি অগ্রবর্তী ছিলেন। সকল বাধার ঊর্ধ্বে উঠে মানুষ হিসেবে নিজেকে জানার তার এই ক্ষমতা তাঁকে সাধারণ ব্রাহ্মসমাজে নারীর অধিকার নিয়ে কথা বলা জনগোষ্ঠীর কাছে অনুপ্রেরণার উৎসে পরিণত করে।"

তথ্যসূত্র :
‌* Women Scientists in India — Anjana Chattopadhyay
* বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা, দৈনিক নিউজ পেপার
* উইকিপিডিয়া

সংগ্রহ করতে পারেন 👇

Post a Comment

0 Comments