মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ৯১
কিশোরীপতি রায় (স্বাধীনতা সংগ্রামী, জাড়া)
ভাস্করব্রত পতি
প্রখ্যাত সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর উপন্যাস 'কীর্তিহাটের কড়চা'তে মেদিনীপুরের স্বাধীনতা সংগ্রামের কুশীলবদের উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করে লেখেন -- "ক্ষুদিরামের দেশ মেদিনীপুর। সত্যেন বোসের বাড়ি, হেম কানুনগোর বাড়ি; এখানে অম্বিকানগর প্রথম লক্ষ্যভেদের স্থান। দুর্দান্ত মেদিনীপুর। পাইক বিদ্রোহের দেশ। নাড়াজোলের রাজা দেবেন্দ্রলাল খাঁ, বীরেন্দ্রনাথ শাসমল, সাতকড়িপতি রায়, কিশোরীপতি রায়, তরুণ নেতা সতীশ সামন্ত, রামসুন্দর সিং -- নামগুলি এক নিঃশ্বাসে মনে পড়ে গেল"। এই কিশোরীপতি রায় হলেন যোগেশচন্দ্র রায়ের বড় ছেলে। তাঁর ভাই ছিলেন আরেক স্বাধীনতা সংগ্রামী সাতকড়িপতি রায়। জাড়া জমিদার বংশের সন্তান তাঁরা।
১৮৭৩ সালে জন্মগ্রহণ করেন কিশোরীপতি রায়। নিজের গ্রামের স্কুল থেকে এন্ট্রান্স পাস করে মেদিনীপুর কলেজ থেকে এফ. এ. এবং কলকাতায় বি. এ. ও আইন পরীক্ষায় পাস করেন। ১৯০৪ সালে (১৩১১বঙ্গাব্দ) বি. এল. পরীক্ষায় কৃতকার্য হয়ে মেদিনীপুর জেলা আদালতে ওকালতি শুরু করেন। বিয়ে করেন খানাকুলের হরিশ্চন্দ্র ভট্টাচার্যের কন্যা ননীবালা দেবীকে।
ওকালতি করতে করতেই বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে সামিল হন। ১৯০৫ এর অক্টোবর মাসে (১৩১২ এর ১০ ই কার্তিক) নিজের গ্রাম জাড়াতে স্বদেশী গান গাইতে গাইতে পরিক্রমা করেন। ঐ বছর ১১ এবং ১২ ই চৈত্র পরপর দুদিন কিশোরীপতির নেতৃত্বে প্রতি বাদ সভায় বক্তব্য রাখেন বরিশালের কংগ্রেস নেতা চন্দ্রকান্ত চক্রবর্তী এবং কার্তিকচন্দ্র বর্মন দাস। ১৯২১ সালের ২০ শে সেপ্টেম্বর মেদিনীপুরে গান্ধীজি এলে অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেন কিশোরীপতি রায়, মন্মথনাথ দাস, জহরলাল বক্সী, অতুলচন্দ্র বসু প্রমুখ উকিলগণ। এই আন্দোলনে ৩৭ হাজার স্বেচ্ছাসেবকের অধিনায়ক ছিলেন তিনি। এরপর তিনি মেদিনীপুর জেলা কংগ্রেস কমিটির সম্পাদক হন। সভাপতি হন বীরেন্দ্রনাথ শাসমল। সেসময় কিশোরীপতির সহায়ক ছিলেন রামসুন্দর সিংহ, নারায়ণ দাস সরকার, শৈলজানন্দ সেন, যতীন্দ্রনাথ দাস প্রমুখ।
মেদিনীপুরে এসে ১৯২১ এর ২০ শে সেপ্টেম্বর মহাত্মা গান্ধী ছিলেন এই কিশোরীপতি রায়ের বাড়িতে। যা এক মহা উল্লেখযোগ্য ঘটনা। সেসময় অন্যান্যদের মধ্যে ছিলেন চিত্তরঞ্জন দাশ, মৌলানা আবুল কালাম আজাদ, বীরেন্দ্রনাথ শাসমল প্রমুখ। ১৯২২ এর জানুয়ারিতে নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির অধিবেশনে যোগদানের জন্য গ্রেফতার হন কিশোরীপতি রায়। এরপর আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে রাখা হয় তাঁকে। সেসময় তিনি আলিপুর জেলে সুভাষচন্দ্র বসু, বীরেন্দ্রনাথ শাসমল, চিত্তরঞ্জন দাশ, আবুল কালাম আজাদদের সঙ্গেই ছিলেন।
১৯২১ থেকে ১৯৩০ সাল পর্যন্ত কিশোরীপতি রায়ের মেদিনীপুরের বাড়িতে বিপ্লবী কর্মকান্ড বজায় ছিল জোরকদমে। ননিবালা দেবীর নেতৃত্বে এখানেই বসত মহিলা সমিতির বৈঠক। এই বাড়িই ছিল কংগ্রেস কার্যালয়, তাঁতশালা, মহিলা কংগ্রেসের বৈঠক কেন্দ্র, জাতীয় বিদ্যাপীঠ ইত্যাদি। ১৯২২ এ চৌরিচৌরার ঘটনায় গান্ধীজি সাময়িকভাবে অসহযোগ আন্দোলন স্থগিত রাখেন। এই পর্যায়ে তাঁর ভূমিকা নিয়ে বীরেন্দ্রনাথ শাসমল তাঁর 'স্রোতের তৃণ' তে লেখেন, 'তাঁর মত সৎ ধীর বিজ্ঞ ও ত্যাগী মহাজনের সহায়তা না পেলে মেদিনীপুর জেলায় যে সকল কাজ সংসাধিত হয়েছে, তার সিকি কাজ কেউ সংসাধন করতে পারতেন কিনা সন্দেহ'।
১৯২৫ এ কিশোরীপতি রায়ের বাড়িতে আসেন কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। এরপর ১৯২৬ এ আসেন সরোজিনী নাইডু। ১৯২৭ এর ৮ ই জুলাই কিশোরীপতি রায় জেলা বোর্ডের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ১৯৩০ সাল পর্যন্ত এই পদে আসীন ছিলেন তিনি। জেলাশাসক পেডী এবং ডগলাস হত্যার পর ব্রিটিশ পুলিশ গোলকুঁয়াচকে কিশোরীপতি রায়ের বাড়ি দখল করে সেখানে 'পিটুনি পুলিশ ক্যাম্প' চালু করে। বসানো হয় 'পিটুনি কর' বা 'পিউনিটিভ ট্যাক্স'। ফলে বাড়ি থেকে স্ত্রী ও নাবালক পুত্র সহ উচ্ছেদ হতে হয় তাঁকে। যদিও ১২ ই জুন এই 'পিটুনি পুলিশ' বন্ধ করে দেয় ব্রিটিশ সরকার। এই ধরনের ট্যাক্স ও পুলিশী ব্যবস্থা জেলার অন্যত্র তথা কাঁথি, তমলুকেও করা হয়। বাড়ি থেকে বিতাড়িত হওয়ার প্রায় এক বছর বাদে অবশ্য পুনরায় নিজের বাড়ি ফিরে পান কিশোরীপতি রায়।
পেডী ও ডগলাস হত্যার পরের বছর ১৯৩৩ এর ২ রা সেপ্টেম্বর ফের মেদিনীপুরের জেলাশাসক বার্জ হত্যার ঘটনা ঘটে মেদিনীপুর শহরে। তখন নতুন জেলাশাসক কিশোরীপতি রায়কে জেলা থেকে বহিষ্কারের নির্দেশ দেন। তিনি তখন হাওড়ায় গিয়ে ওকালতি চালিয়ে দিন গুজরান করতে শুরু করেন। বার্জ হত্যার মামলায় গ্রেপ্তার হন তাঁর ছেলে সনাতন রায়। বিচারে আন্দামান সেলুলার জেলে যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর দেওয়া হয়। ১৯৩৭ সালে ঘাটাল ঝাড়গ্রাম যুগ্ম কেন্দ্র থেকে প্রাদেশিক নির্বাচনে তিনি কংগ্রেস প্রার্থী হিসেবে জয়ী হন সরকারি প্রার্থী ঝাড়গ্রামের রাজা নরসিংহ মল্লদেবকে হারিয়ে। কিশোরীপতি রায় খুব তামাক খেতেন। এই নির্বাচনে তাই তিনি তাঁর প্রতিকচিহ্ন হিসেবে 'হুঁকো' রেখেছিলেন। ১৯৪৩ সালের ডিসেম্বরে ক্যান্সার মারণব্যাধীতে আক্রান্ত হয়ে জীবনদীপ নির্বাপিত হয় মেদিনীপুরের এই মানুষ রতনটির।
🍂
0 Comments