জ্বলদর্চি

বাঁশী ছেড়ে দণ্ড হাতে /উনবিংশতি পর্ব /দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী

বাঁশী ছেড়ে দণ্ড হাতে
উনবিংশতি  পর্ব

দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী      

প্রথম ভাগ - বৃন্দাবন পর্ব
বৃন্দাবনের দোল 

    
মোহান্তজীর কাছে ইমলিতলার ঘাট মাহাত্ম্য জানতে পেরে আমরা শ্রী রাধাকৃষ্ণ এবং শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর সম্বন্ধে সবিশেষ জ্ঞাত হলাম। মোহান্তজীকে প্রণাম জানিয়ে আমরা আশ্রম থেকে বেরোলাম। ইমলিতলা মন্দির দেখে বেরিয়ে আসার পরে ডান দিকে যে রাস্তাটি গেছে, সেই রাস্তায় কয়েক পা গেলেই বামদিকে বংশীবট মন্দির। চৌরাশী ক্রোশ ব্রজধাম পরিক্রমা পথে এই মন্দিরগুলি পড়ে। আজ থেকে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার বৎসর পূর্বে বালক কৃষ্ণ এই বট গাছের তলায় এসে বাঁশির সুর তুলতেন। সেই সুরে আকৃষ্ট হয়ে রাধারানী সহ গোপরমণীরা তাঁর দর্শনের আশায় নিজেদের সংসার ধর্ম ত্যাগ করে ছুটে আসতেন এবং শ্রীকৃষ্ণ তাঁদের নিয়ে নিষ্কাম স্বর্গীয় প্রেমের রাসলীলা করতেন বংশীবটের তলায়। শ্রীকৃষ্ণ গোপীনাথ মূর্তিতে এসে রাধারানীর সাথে মিলিত হবার পরে গোপরমণীগণকে নিয়ে শারদ পূর্ণিমার রাত্রিতে রাসলীলা করতেন। রাসলীলার সময় শ্রীকৃষ্ণ সহসা অন্তর্হিত হয়ে যেতেন। তাঁর অদর্শনে গোপীদের চোখে অন্ধকার নেমে আসত। তাঁরা চতুর্দিকে শ্রীকৃষ্ণকে খুঁজে না পেয়ে যখন একান্তমনে তাঁর ভজনা করতেন তখন তিনি পুনরায় তাদের সাথে এসে রাসনৃত্য করতেন। এইভাবে শ্রীকৃষ্ণ গোপিনীদের অন্তরের নিষ্কাম প্রেম ও ভালোবাসা পরীক্ষা করতেন। সেই মহারাসলীলায় তিনি প্রত্যেক গোপিনীর সাথে পৃথক পৃথকভাবে নৃত্য করতেন। সকলেই ভাবতেন গোপীনাথ কেবলমাত্র তাঁর সাথেই রাসলীলা করছেন। কিন্তু তিনি এক হয়েও বহুধা বিভক্ত হয়ে সেই রাসলীলা করতেন। 

পাঠকের স্মরণে আছে গোলকধাম থেকে শ্রীদামের অভিশাপে শ্রীরাধাকে মর্ত্যধামে মনুষ্যযোনিতে জন্মগ্রহণ করতে হয়েছিল। ভাগবতের রাস পঞ্চাধ্যায়ে রাধার নাম কিন্তু কোথাও পাওয়া যায়নি। এমনকি মহাভারত, হরিবংশপুরাণ বা বিষ্ণু পুরাণেও রাধার উল্লেখ নাই। রাধাকে আমরা প্রথমে দেখতে পাই ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে। সেখানে উল্লেখ আছে শ্রীকৃষ্ণের জন্মের কয়েক বৎসর পূর্বে শ্রীরাধার জন্ম এবং বিধি-বিধান অনুসারে রাধার সাথে শ্রীকৃষ্ণের বিবাহ হয়েছিল। ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ অনুসারে রাধাই বৈষ্ণব ধর্মের 'একমেবাদ্বিতীয়ম্' নায়িকা। পরবর্তীকালে দ্বাদশ শতাব্দীতে কবি জয়দেব রচিত গীতগোবিন্দ কাব্যগ্রন্থে এবং তারপরে বিদ্যাপতি, চান্ডীদাসের কাব্যে সেই ধারাই চলে এসেছে। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের শ্রীকৃষ্ণ জন্মখন্ডের পঞ্চদশ অধ্যায়ে যে সমস্ত শ্লোক আমরা পেয়েছি তার ভাবার্থ এই রূপ। "শ্রীকৃষ্ণের পালক পিতা নন্দবাবা একবার শিশু কৃষ্ণকে সঙ্গে নিয়ে বৃন্দাবনের ভান্ডীরবনে গোচারণের উদ্দেশ্যে গিয়েছিলেন। অকস্মাৎ শিশু কৃষ্ণ মায়ার সাহায্যে মেঘের সঞ্চার করে ধারা বরিষণ ও বজ্রপাতের সৃষ্টি করেন। এই সময়ে নন্দবাবা ভীত হয়ে চিন্তা করলেন এই শিশুকে দুর্যোগের মধ্যে কিভাবে রক্ষা করে গোধন নিয়ে গোকুলে ফিরে যাবেন। এমন সময় সেখানে শ্রীরাধার আবির্ভাব হল। রাধাকে দেখে নন্দবাবা তার হাতে কৃষ্ণকে অর্পণ করে বললেন "আমি মহর্ষি গর্গের কাছে শুনেছি তুমি পদ্মা থেকেও শ্রীহরির অধিক প্রিয়, আর আমার এই পুত্র নির্গুণ, অচ্যুত, মহাবিষ্ণু। এক্ষনে এই শিশুকে রক্ষা করে তোমার মনোবাঞ্ছা পূরণ করে আমার পুত্রকে পুনরায় আমার কাছে ফেরত দিও"। এই কথা বলে নন্দবাবা গো-গনকে নিয়ে গোকুলে ফিরে গেলেন। এরপরে রাধা কৃষ্ণকে কোলে করে কিছুটা দূরে যেয়ে রাসমন্ডল স্মরণ করতে সেখানে মনোহর বিহার ভূমি সৃষ্টি হল। শিশু কৃষ্ণ কিশোর মুর্তি ধারণ করে রাধাকে বললেন "যদি গোলকের কথা স্মরণ হয় তাহলে আমি যা স্বীকার করেছিলাম তা এখন পূর্ণ করব"। এই বলে তাঁরা প্রেমালাপে মত্ত হলেন। এমন সময় ব্রহ্মা রাসমন্ডলীতে উপস্থিত হয়ে কন্যাকর্তারূপে যথাবিহিত বেদ-বিধি অনুসারে রাধিকাকে কৃষ্ণহস্তে সমর্পন করে তাঁদের দুজনকে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করলেন। ব্রহ্মবৈবর্তপুরানে রায়ান ঘোষের সাথে রাধার বিবাহের উল্লেখ কোথাও নাই। এই রাধা শব্দের অর্থ যিনি কৃষ্ণের আরাধিকা তিনিই রাধা বা রাধিকা। রাধা শব্দের আরেকটি অর্থ আছে। ২৭টি নক্ষত্রের মধ্যে বিশাখা নক্ষত্রের আরেক নাম রাধা নক্ষত্র। কৃত্তিকা থেকে বিশাখা চতুর্দশতম নক্ষত্র এবং তারপরে আরো ১৩টি নক্ষত্রের অবস্থান। অর্থাৎ বিশাখা বা রাধা যেমন নক্ষত্রমন্ডলীর মধ্যবর্তী অংশে বিরাজিত, রাসমণ্ডলেও তেমনি শ্রীরাধাকে মাঝখানে রেখে রাসলীলা অনুষ্ঠিত হয়েছিল।

ভগবান শ্রীকৃষ্ণ রাধারানী ও গোপরমণীদের সাথে শারদ পূর্ণিমার রাতে যে রাসলীলা করেছিলেন সে সম্বন্ধে নাস্তিক ও তথাকথিত শিক্ষিত ব্যক্তিরা তার মধ্য যে আদিরসের গন্ধ পান এবং অশ্লীল মনে করে নাসিকা কুঞ্চন করেন তার মধ্যে কোন সারবত্তা নেই। এই রাসলীলার প্রকৃত তাৎপর্য বুঝতে গেলে শ্রদ্ধাবনতচিত্তে শ্রীমদ্ভাগবতে এ সম্বন্ধে যা' বলা হয়েছে তা উপলব্ধি করতে হবে। রাসলীলায় শ্রীকৃষ্ণ অসংখ্য গোপরমণীগনের সঙ্গে যখন রমণ করেছেন তখন তার বয়স সাত থেকে আট বছর মাত্র। এই বয়সের বালকের শরীরে কোনরূপ কামভাবের উদ্রেক হয় না। তাহলে তিনি কিভাবে রমণ করলেন এবং তার গুঢ়তত্ত্ব কি? এই রমণে বিষয় সম্বন্ধ বা দেহেন্দ্রিয় প্রীতির সঙ্গে কোন সম্বন্ধ নেই। শ্রীকৃষ্ণ যখন রমণ করার জন্য তাঁদের কাছে উপস্থিত হলেন তখন তিনি সাক্ষাৎ মন্মথ মন্মথ। অর্থাৎ যে মন্মথ বা কামদেবের প্রভাবে জগতের জীবগন নানা কামভোগে আসক্ত হয়ে থাকে শ্রীকৃষ্ণ তখন সেই মন্মথেরও মন্মথ হয়ে বিরাজ করছেন। তখন তিনি সাধারণ জীবের মত ভোগী ন'ন তখন তিনি আত্মারাম। আত্মারাম কথাটির অর্থ যিনি আত্মায় রমণ করেন। যিনি আত্মারাম তার রমণের জন্য গোপীগনের সঙ্গে মিলনের কোনো প্রয়োজন নাই। রাসলীলায় যে শৃঙ্গারের কথা বলা হয়েছে সেখানে প্রবৃত্তির পরিবর্তে নিবৃত্তির পূর্ণ সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কামাভিভূত জীবগনের কাম জয় করার উপায় দেখাবার জন্য স্বয়ং রাসবিহারী রাসস্থলে অসংখ্য গোপিনীদের সঙ্গে রাসলীলা করে জগতকে দেখিয়েছিলেন অজেয় কামকে কেউ যদি জয় করতে আগ্রহী হয় তাহলে তাঁর শ্রীচরণে তা'কে আশ্রয় নিতে হবে। যারা প্রেমপরিপ্লুত হৃদয়ে শ্রী ভগবানের সেবা করে নিবৃত্তির লালসা নিয়ে এগিয়ে যেতে পারবেন তারাই এই রাসলীলার মর্মার্থ বুঝতে পারবেন। শ্রীমদ্ভাগবতে যে রমন কথাটির উল্লেখ আছে, তার অর্থ কাম ক্রীড়া নয়, তার অর্থ আত্মস্বরূপানন্দ আস্বাদন। পদ্মপুরানে 'শ্রীরাম শতনাম স্তোত্রে' বলা হয়েছে 'যোগীগণ যে অপরিসীম সচ্চিদানন্দ তত্ত্বে রমন করেন ‘রাম’ শব্দে সেই পরব্রহ্মই অভিহিত হয়ে থাকেন। 'রমণ' শব্দের অর্থ আনন্দ আস্বাদন। বিষয়াসক্ত জীবের আনন্দ আস্বাদন হয় বিষয়ভোগে, কিন্তু অনাসক্ত জীবের আনন্দ আস্বাদন              
হয় আত্মসাক্ষাৎকারে এবং ঈশ্বরের আনন্দ হয় স্বরূপানন্দ বিতরনে।                                    
                                                   
পরবর্তী অংশ বিংশতি পর্বে

সংগ্রহ করতে পারেন 👇

Post a Comment

1 Comments