ছোটোবেলা বিশেষ সংখ্যা ১৬১
সম্পাদকীয়,
মৃণাল আঙ্কেলের পাঠানো প্রচ্ছদের ছবিটির ছোটবন্ধুটির শীত লেগেছে। কিন্তু ওর কি মন খারাপ? মনখারাপ যাদের তাদের চুপিচুপি বলে রাখি মাত্র তিনদিন বাদেই অট্টহাস্য দিবস। কে বলল? দোলনচাঁপা আন্টি। তোমরা খুব জোরে সেদিন হেসো কিন্তু। আমি অবশ্য সবসময়ই খুব জোরে জোরেই হাসি। হা হা করে, হো হো করে। হি হি করে হাসতে আমার একদম ভালো লাগে না৷ ফিক ফিক হাসি আমি হাসিই না। মুখ টিপে হাসে বড়োরা। মেপে হাসে আরো বড়োরা। হাসি চাপে কেউ? জানি না বাবা। হাসি পেলেই তাই হো হো করে হেসে নেবে। তবে লাচুঙের এবারের গল্পটা পড়ে আমার হাসি উড়ে গেল। শ্রীকান্ত আঙ্কেলকে জানিও তোমাদের কেমন লাগল। বাসবদত্তা আন্টি ফিলাডেলফিয়া শহর বেড়াচ্ছে। আমরাও তারসঙ্গে বেড়াচ্ছি। কি তাই তো? তবে এটা তো জানো বেশি হাসলে শেষে কাঁদতে হবেই। অতনু আঙ্কেলের অসাধারণ নিবন্ধটি পড়ে তাই চোখে জল চলে এল। অতনু আঙ্কেলের লেখা পড়ে কার কেমন লাগলো জানিও। কত নতুন গল্প উঠে এল অসাধারণ নিবন্ধটি থেকে। নিবন্ধটি পড়ো সবাইকে পড়াও। কেমন? --- মৌসুমী ঘোষ।
নিবন্ধ
বিপন্ন শৈশব ও অন্য এক আফগানিস্তান
অতনুকুমার বসু
নীলনদকে মিশরের প্রাণ বলা হয়। মিশরীয়রা বিশ্বাস করত নীলনদকে সারা বছর সন্তুষ্ট রাখতে পারলে কৃষির জন্য পর্যাপ্ত জলের কোনো অভাব হবে না।সমগ্র দেশ ফসলের প্রাচুর্যে ভরে উঠবে এবং তার সুফল ভোগ করবে প্রত্যেক মিশরীয়। আর এই সন্তুষ্টির পদ্ধতি ছিল বিচিত্র। নারীর প্রজনন ক্ষমতাকে উর্বরা শক্তির প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করে নদের সঙ্গে এক সুন্দরী কুমারীর বিয়ে দেওয়া হত এবং শেষপর্যন্ত নদের জলে সেই কুমারীকে ভাসিয়ে দিয়ে সেই নিবেদন সম্পূর্ণ করা হত। ফ্রেজার বলেছেন " Tradition runs that the olden custom was to deek a young virgin in gay appear to throw her into the river as a sacrifice to obtain a pheniful inundation. Wheather that was so or not, the intention of the practice appears to have been to marry the river. Conceive as a male power to his bride the cornland, which was so soon to be fertilised by the water. " ইতিহাস ঘেঁটে যেটা জানা যায় যে ৬৪২ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত মিশরে এই প্রথার প্রচলন ছিল।
উত্তর আফগানিস্তানের সাংচারাক প্রদেশের সার-ই- পোল অঞ্চলে পাশাপাশি দুটি স্কুল নাসওয়ান-ই- কাবোদ আব আর নাসওয়ান-ই-ফয়জাবাদ। তালিবানি ফতোয়া অমান্য করে দুটি স্কুল মিলিয়ে ৭৭ জন ছাত্রীকে স্কুলের চৌকাঠে পা দেওয়ার জন্য শাস্তি দিতে তাদের ক্লাস রুমের বাতাসে বিষ ছড়িয়ে দেওয়া হয়। স্বভাবতই ক্লাসে প্রবেশ করে সমস্ত ছাত্রীই অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং শেষপর্যন্ত প্রাণ বাঁচাতে স্কুল কতৃপক্ষ তাদেরকে স্থানীয় হাসপাতালে ভর্তি করতে বাধ্য হন। তালিবানি ফরমান অনুযায়ী ষষ্ঠ শ্রেণীর পর আর মেয়েদের পড়াশুনা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার এক্তিয়ার নেই। ইরান বা আফগানিস্তানে এর আগেও ছাত্রীদের উপর ফতোয়া কার্যকর করতে খাবারে বিষপ্রয়োগ করা হয়েছিল।ধর্ম বা সংস্কৃতি মানুষকে যদি ক্রমশ সংস্কৃত না করে যুক্তি, বুদ্ধি, চিন্তা, বিবেককে বন্ধক রেখে কোনো অন্ধ, বোবা, অযৌক্তিক অনুশাসনকে শুধু মিথ্যা অনুসরণের পথ দেখায়, সেটা সভ্যতার কাছে একটি অসুস্থ সমাজব্যবস্থার বিজ্ঞাপনই তুলে ধরে। প্রজন্মের পর প্রজন্মকে ধর্মের নামে অশিক্ষা-কুশিক্ষার অন্ধকূপে ছুঁড়ে ফেলা আসলে আফগান নামক একটা জাতির সামগ্রিক বিপন্নতারই ইতিহাস।
এই বাংলাতেও পুণ্য অর্জনের আশায় একসময় সাগরে সন্তান বিসর্জনের রেওয়াজ ছিল। প্রথম সন্তানকে বা বহুদিন পরে কোনো নারী সন্তান ধারণ করলে মানত হিসেবে দেবতাকে সন্তুষ্ট করতে সন্তানকে সাগরে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হত। মূলত মকর সংক্রান্তির দিন অথবা পৌষ বা মাঘী পূর্ণিমার দিনকে এই পুণ্য অর্জনের দিন হিসেবে বেছে নেওয়া হত। মনে পড়ে যায় রবীন্দ্রনাথের "দেবতার গ্রাস" কবিতার কথা। "ফুটন্ত তরঙ্গ মাঝে মেলি আর্ত চোখ / ' মাসি' বলি ফুকারিয়া মিলালো বালক / অনন্ত তিমিরতলে। শুধু ক্ষীণ মুঠি / বারেক ব্যাকুল বলে ঊর্ধ্বপানে উঠি / আকাশে আশ্রয় খুঁজি ডুবিল হতাশে।" আর শুধু বাংলা কেন, পাঞ্জাবের বেদী সম্প্রদায়ের মধ্যে এবং ওড়িশা ও অন্ধ্রপ্রদেশের কন্ধ আদিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যেও দেবতাদের উদ্দেশ্যে কন্যা সন্তান জন্মানোর পর পরই তাকে নিবেদন করা পবিত্র সামাজিক রীতি হিসেবেই বহু বছর ধরে অনুসৃত হয়ে আসছে।
১৯৭৯ থেকেই আফগানিস্তানের ভিতরের ছবিটা অল্প অল্প করে বদলাতে থাকে। সোভিয়েত ইউনিয়নের সৈন্যরা দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে, প্রত্যক্ষ করে যে যুদ্ধ বিধ্বস্ত শহর, গ্রাম, মৃতদেহের স্তূপ সরিয়ে দলে দলে মানুষ দেশ ছাড়তে শুরু করেছে আর গ্রামাঞ্চলগুলিতে অন্য এক শাসন ব্যবস্থা কায়েমের প্রস্তুতি পর্ব শুরু হয়েছে। আফগানিস্তানে ক্ষমতার ভারকেন্দ্র সেইসময় থেকেই অল্প অল্প করে মুজাহিদদের দিকে কেন্দ্রীভূত হতে থাকে। ভয় বা ভয়জনিত ভক্তি যেকারণেই হোক না কেন সেই থেকেই ক্রমে এই কাবুলিওয়লাদের দেশে ধর্ম নামক একটি আপাত নিরীহ শব্দ হঠাৎ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। সমাজের উন্নয়ন-বিকাশ, শিক্ষা-স্বাধীনতা সমস্তকেই এক প্রাগৈতিহাসিক চিন্তা, ভাবনা, স্বেচ্ছাচারিতার বর্মে আবদ্ধ করে দেশ জুড়ে আধিপত্য বিস্তার করতে থাকে প্রবল এক নৈরাজ্য। এই চোরা অধোগতির স্রোতে ভেসে যায় দেশটির আপাত সুস্থিত সমস্ত মোলিক পরিকাঠামোগুলি। পরিবর্তে আফগানিস্তান উপহার পায় অজস্র রুগ্ন শরণার্থী শিবির আর সর্বত্র ধর্মীয় অনুশাসন নিয়ন্ত্রিত অস্থির রক্ষণশীল এক সমাজব্যবস্থা। আর সেই তীব্র ঘুটঘুটে অন্ধকারেই সম্প্রতি হাতবদল হয় মুজাহিদ থেকে তালিবানে। বলাবাহুল্য নারী শিক্ষার প্রতি এই চরম বিদ্বেষ ধর্মীয় মৌলবাদীদের সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির উগ্র বহিঃপ্রকাশের সামান্য একটি উদাহরণ মাত্র।
মাংস প্রায় প্রত্যেক বাড়িতেই শুকিয়ে রাখা হয় যাকে স্থানীয় ভাষায় বলে 'লান্দাই'। প্রকৃতির চূড়ান্ত খামখেয়ালিকে সঙ্গে করে এই মরু-বরফের দেশের স্বনির্ভর গ্রামীণ অর্থনৈতিক কাঠামো এখন দুমড়ে মুচড়ে একাকার। তাই রোজার সময় অপেক্ষা করে থাকতে হয় পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে আমদানিকৃত দ্রব্যের উপর। গরীবের নিত্য প্রয়োজনীয় কেরোসিন, ডিম, আলু, মুরগীর মাংস, পরিধানের জন্য কয়েক গজ কাপড়, জ্বালানি কাঠ, ডেটল,মলম বা সিরাপের মতো কিছু সামান্য ওষুধ ক্রমশ সাধারণের আয়ত্তের বাইরে চলে যাচ্ছে। ক্রমশ এক অদৃশ্য থাবার কাছে মাথানত করছে সহজ সরল প্রকৃতি লালিত গ্রাম্য মরু জীবন। আফগানি টাকার দাম প্রায় তলানিতে ঠেকেছে। মিষ্টি মৌসুমী বায়ুর দেশ সারা বছর আচ্ছন্ন এখন বারুদের উগ্র গন্ধ আর ধোঁয়ায়।
দীর্ঘ আট বছর আফগানিস্তানে বসবাস করার অভিজ্ঞতা থেকে সুস্মিতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন
"আফগানিস্তানে যা ঘটতে দেখেছি তা ধর্মের বিকৃত ব্যভিচার। যা ইসলামের পবিত্রতা ও মহত্বকে ধুলোয় টেনে নামিয়েছে। কোরান শরীফের মনগড়া অপব্যাখ্যা করেছে। মানবতার অপমান করছে।... মোট কথা, আফগানিস্তান একটা আতঙ্কের দেশ।" এই আতঙ্কের তীব্রতা বেড়েছে বৈ কমেনি। ধর্মকে সামনে রেখে আড়াল থেকে ধর্মকে ব্যবহার করে কায়েম হয়েছে এক ধর্মীয় অনুশাসনকেন্দ্রিক নিয়ন্ত্রিত সমাজব্যবস্থা। আর সেই বিশেষ ভাবে নিয়ন্ত্রিত সীমারেখা বা ফতোয়া লঙ্ঘন করার নূন্যতম প্রচেষ্টার খেসারত মাঝে মধ্যেই জীবন দিয়ে চোকাতে হয়। সমাজের আপামর সবাইকে প্রায়শই মনে করিয়ে দেওয়া হয় যে অদৃশ্য কোনো এক কালানিশকভের নিশানার আওতায় তারা সবাই বিরাজ করছেন।
আফগানদের মধ্যে একটা সামাজিক রীতি আছে। দেখা হলে কাউকে স্বাগত জানাতে বলা হয় "সাঙ্গারাইয়ে" অর্থাৎ কেমন আছো? এর উত্তরে সাধারণত বলা হয় "ক্ষাইয়াম" অর্থাৎ ভালো আছি, "জোরাইয়াম" অর্থাৎ সুস্থ আছি। একটা অসুস্থ সমাজব্যবস্থার উপর দাঁড়িয়ে রোজ এই মিথ্যালাপের যন্ত্রণা বিশ্বের প্রত্যেক আফগান নাগরিককেই প্রবল রক্তক্ষরণের মধ্য দিয়ে রোজ বহন করে নিয়ে যেতে হয়।
উৎসব মরশুমে আমেরিকাতে
বাসবদত্তা কদম
পর্ব ৬
স্টেশন থেকে বাইরে বেরনোর আগে স্টেশনের ভিতরটাকে দেখে নিলাম আরেকবার। শুধু যে বড় আর ঝকঝকে তা তো নয়। স্টেশন চত্তর আলো আর বিভিন্ন রকম রঙিন শিকলে সাজানো হয়েছে অপূর্ব। যদিও তখন নভেম্বর মাস। বড়দিন বা খ্রিসমাস আসতে বেশ খানিক দেরি রয়েছে কিন্তু উৎসব যেন এসে গেছে এমনই হাব ভাব সে স্টেশনের।
স্টেশনের বাইরে এসে দাঁড়ালাম। এখান থেকে বাস বা ট্যাক্সি ধরে আমাদের যেতে হবে ফিলাডেলফিয়া ভিসিটরস সেন্টার।
এক সময়ের আমেরিকার রাজধানী ফিলাডেলফিয়া শহর থেকে স্থানান্তরিত হয়ে চলে গেছে ওয়াশিংটন ডিসিতে সেই ১৮০০ সালে।
কিন্তু এ শহরে রয়ে গেছে সেই সময়ের গন্ধ। রয়ে গেছে অজস্র পুরনো নিদর্শন। দেখার লিস্টে আছে লিবার্টি বেল, ইন্ডিপেন্ডেন্স হল, মিউজিয়ম অফ আর্ট, মিউজিয়ম অফ আমেরিকান রেভলিউশন এরকম আরো বেশ কিছু জায়গা। সময় পেলে অবশ্যই আরো কিছু যেমন ফিলাডেলফিয়ার বিখ্যাত সাউথ স্ট্রিট, ম্যাজিক গার্ডেন। ফিলাডেলফিয়া জু বা চিড়িয়াখানাও খুব বিখ্যাত কিন্তু তা দেখার সময় আমাদের ছিল না।
ফিলাডেলফিয়া শহর, চিত্রগ্রাহক - বাসবদত্তা।
এ শহরের ভিসিটরস সেন্টার থেকেই পাওয়া যাবে সব খবর। সে জায়গা তৈরীই হয়েছে আমাদের মতো মানুষজনকে সাহায্য করবার জন্য।
অতএব চালাও পানসি বেলঘরিয়া। থুড়ি ভিসিটর সেন্টর। সেখানে পৌঁছতে দেখলাম সেখানকার লোকজন সত্যিই আমাদের মতো ভ্রমণার্থীদের সাহায্য করার জন্যই বসে আছেন। মুশকিল আমার, আমি আমেরিকান ইংরেজি প্রায় কিছুই বুঝতে পারি না আর তারাও আমার ভারতীয় ইংরেজি শুনে ফটফটিয়ে বলা থামিয়ে একটু সময় চোখ গোল গোল করে দেখেন। একটা দুটো শব্দ উদ্ধার করে তার উত্তর দেন।
খানিক কথাবার্তার পর হাতে ধরিয়ে দিলেন একগাদা ব্রোসিওর। অর্থাৎ কিনা কোথায় কোথায় যাবো এবং কেন যাবো তার বিবরণ। এ একরকম ভালো। আমেরিকান ইংরেজি কানে শুনে বুঝতে যতটা অসুবিধে, পড়ে ততটা নয় এটা দেখলাম। বুঝতে পারা গেল, আমাদের জন্য বাস আছে। সে বাস আমাদের ঘুরিয়ে দেখাবে। বাসে একজন গাইড ঠাকবেন, তিনি সেই জায়গার মাহাত্ম্য বর্ননা করবেন। বাসে বিভিন্ন ধরণের টিকিট হয়। টিকিট একদিন বা দুদিনের হিসেবেও কিনতে পারা যায়। আমাদের মেয়াদ এক দিনের তাই টিকিটও নেওয়া হলো একদিনের মেয়াদেই।
মূল কথা দুটো, এ জায়গা আমরা একেবারেই চিনি না কিন্তু যতটুকু সম্ভব দেখতে হবে। ব্রোসিওর দেখে বোঝা গেল, বিভিন্ন ধরনের বাস আছে আমরা সেই সব বাসে, যে কোনো জায়গায় নেমে সেই জায়গা দেখে আবার পরের বাসে উঠে পড়তে পারি একই টিকিটে।
প্রধান প্রধান দেখার জায়গাগুলো দেখে নিতে হবেই এই একটুখানি সময়ের মধ্যেই। লাভের কথা এটাই ওই ভিসিটরস সেন্টারের আশে পাশেই আমাদের দেখার বেশ কয়েকটা জিনিস রয়েছে, তাই সময় খানিকটা হলেও বেঁচে যাবে।
ভিসিটরস সেন্টর থেকে পাঁচ দশ মিনিটের মধ্যেই রয়েছে লিবার্টি বেল আর তার পাশেই আছে ইন্ডিপেনডেন্স হল।
স্থির করলাম প্রথমেই যাবো লিবার্টি বেল দেখতে। এই বেল আমেরিকার স্বাধীনতার ইতিহাসের একটি প্রধান চিহ্ন হিসাবে বিবেচিত হয়। তারপর ইন্ডিপেন্ডেন্স হল, যেখানে আমেরিকার স্বাধীনতা চুক্তি সাক্ষরিত হয়েছিল শুনেছি।
শুরু হলো ফিলাডেলফিয়া শহরকে দেখার পালা।
(ক্রমশ)
ধারাবাহিক উপন্যাস
লাচুঙের নেকড়ে
পর্ব ৩০
শ্রীকান্ত অধিকারী
মানুষ যা ভাবে হয় আর এক। ভেবেছিল ছুটি ক’টা দিন পাহাড়ের মধ্যে থেকে বরফ রডডেন্ড্রন আর নানা প্রজাতির গাছ পাখিদের সঙ্গে থেকে বেশ হুল্লোড় করে কাটিয়ে দেবে। কিন্তু হল আর এক।
গাড়ি হু হু করে এগিয়ে যাচ্ছে। ওরা এখন ইয়ূংথাঙের পথে। যদি দরকার হয় তাহলে ইয়ুংথাং কভার করে আরও ওপরে উঠে যাবে। জিরো পয়ন্ট পর্যন্ত যেতে হতে পারে। সেরগিল সাহেব আগেই জানিয়ে রেখেছে। তবে তারপর আর যাবার জায়গা নেই। অন্তত ভারতে নেই। কারণ ওপারে তিব্বত যা চীনের দখলে। কতগুলো বরফের মুকুট পরা অলৌকিক বিশালাকার আদিপুরুষ! যেখান আছে রুপকথার দক্ষিণ দুয়ার। সেই দুয়ার টপকানো যায় না, প্রবেশ করাও যায় না। এখানেই লাচুং সহ সারা সিক্কিম পুলিশের ভয়। খুনিরা বা আতঙ্ক সৃষ্টিকারীরা দক্ষিণ দুয়ারের ওপারে নয় তো!
একটু আগেই সেরগিল সাহেবের সঙ্গে একই গাড়িতে লাচুঙের হেলিপ্যাড ঘুরে এসেছে। হেলিপ্যাড যাওয়ার রাস্তাটা একটু এঁকে বেঁকে হলেও গাড়ি দ্রুত যাওয়ার পক্ষে সুগম। এই হেলিপ্যাড অবশ্য মাঝে মধ্যে বর্ডার ফোর্সও ব্যবহার করে। সেখান থেকে আসা মেসেজ অনুযায়ী হেলিপ্যাডের সেফটির জন্য সরেজমিনে লাচুঙ পুলিশের হেড অফিস ভিজিট করে এলেন। অবশ্য ভেতরে অন্য উদ্দেশ্য আছে কিনা প্রকাশ্য নয়।
পুলিশ স্টেশন থেকে লাচুং হেলিপ্যাড প্রায় সাড়ে চার কিলিমিটার। উত্তর পূর্ব দিকে এগিয়ে কাটাও পর্বত। বেশ দুর্গম। সেখান থেকেও বিপদ যে আসতে পারে না তা একবারেই উড়িয়ে দিচ্ছে না সিক্কিম পুলিশ এবং ভারতীয় সেনাবাহিনী। সেদিকে যদি এই ধারনা সত্যি হয় তাহলে বেশ বড় রকমের দুর্ঘটনা ঘটার সমূহ সম্ভাবনা থেকেই যায়। আর তাহলে ৬২ সালের মত বেশ ভয়ঙ্কর কিছু ঘটে যেতে পারে। অরুনাচল প্রদেশ সহ ‘অকসাই চীন’ নাম নিয়ে সীমান্ত সমস্যা শুরু হয় তা কীসের জন্য কারও অজানা নয়। তারপরেও তো থামা নেই। ৬৭ সালে শুরু হয় আবার নাথুলা এবং চো লার যুদ্ধ। পিপলস লিবারেশন আর্মি নাথুলাতে ঢুকে আক্রমণ করে। কিংবা চুম্বি উপত্যকায় চীনা সেনা বাহিনীর শক্তি প্রয়োগ কম বিপদের কথা নয়। এমনিতেই বহু কাল ধরে ভারতবর্ষ নেপাল এবং ভুটানের সঙ্গে তিব্বতের মধ্যে এই চুম্বি উপত্যকা নিয়ে গোল বেধেই থাকত। মূলত ব্যবসা বাণীজ্যের জন্য এই উপত্যকা অত্যন্ত সুগম পথ বলে পরিচিত ছিল। শোনা যায় ১৯০৪ সালে ইয়ং হ্যাসব্যাণ্ড লাসা গিয়েছিলেন এই পথ ধরেই। এবং তখন এই উপত্যকা ব্রিটিশরা করায়ত্ত করে। তবে আবার বছর চারেক পর দাবী দাওয়া মিটে গেলে তিব্বতকে ফিরিয়ে দেয়। কিন্তু মজার ব্যাপার হল এত কিছু করার সময় এদেশের মানুষ ওদেশে এবং ওদেশের মানুষ এ দেশে লুকিয়ে আসতে শুরু করে। শুধু মাত্র চড়া দামে ওদের বানানো প্রোডাক্ট যেমন লেপার্ড বা বিয়ারদের চামড়া লেজ, লোমের এবং দাঁতের জিনিস বিক্রি করতে লাগল। তাতে লাভ কী হল? অনুপ্রবেশ বাড়ল।-ধীরে ধীরে নিচু স্বরে দীপকবাবু রামসির মাকে বলছিলেন। বলছিলেন,-এইখানে এই সব কাণ্ডে কেন্দ্র সরকারের লাল আদেশ ছাড়া কোনো কিছুই সম্ভব নয়।
🍂
আরও পড়ুন 👇
এমনিতে উড়ানের এই এলাকা প্রোটেক্টেড। সহজে কেউ ঢুকতে পারে না। সমতলেই কড়া নিরাপত্তা পাহাড়ে তো কথায় নেই। বেশিক্ষণ ছিল না ওরা। সেরগিল সাহেব একবার অফিসের মধ্যে গিয়ে আবার ফিরে আসেন। ততক্ষণে ওরা গাড়ির ভিতরেই বসে ছিল। দীপকবাবু অবশ্য সমানে ফোনে কথা বলে যাচ্ছিলেন। বাংলায় নয় ইংরাজিতে। ঠিক তখনই সেরগিল সাহেব ভাঙা ভাঙা বাংলায় বলেন,-শুনছেন দীপকবাবু নর্থ ইষ্ট বর্ডার লাইন পর পহেলে সে ক্রাইসিস চল রাহা হ্যায়। লগভগ সাত সিস্টার্স স্টেট আসাম মেঘালয় ত্রিপুরা অরুনাচল প্রদেশ মিজোরাম মণিপুর অউর নাগাল্যাণ্ড মে টেনশন জারি হ্যায়। এক আসাম মে চার চার সেপারেশন মুভমেন্ট গড়ে তোলে অসমিয়ারা,--আলফা, এন ডি এফ বি, বোড়ো লিবারেশন টাইগার ফোর্স, কামতাপুরি। অলগ অলগ স্টেটের জন্য ডিমান্ড কর রাহা হ্যায়। নাগাল্যাণ্ড অউর ত্রিপুরা টাইগার ফোর্স ভি ডিমাণ্ড…
রামসির বড় মামি বড্ড বিরক্ত হয়ে বলে, এ সব জেনে কি হবে! ডিমান্ড তো আমাদেরও আছে। সেটা কে দেখবে। হাম লোগো কা ডিমান্ড পুরি করো নয়তো আন্দোলন করেগা। আভি এইখানে না খেয়ে মরেগা। বড় মামির গলা ধরে আসে। কথাগুলো শুনে কেউ হাসল না বরঞ্চ বড় মামির ওইভাবে প্রায় চিৎকার করে ডিমান্ড জানাতে গাড়ির সবার চোখে জল এসে যায়।
বড় মামি বিড়বিড় করে,-ছেলে দুটো কোথা যে গেল! বাঘে খেল না ভালুকে, ভগবানই জানে!
পাহাড়ি নৈশব্দ্য ছেয়ে আছে চারিদিকে। গাড়ি কিছু দূর যেতেই অমর লেপচা জড়ানো গলায় বলে,-ভ্যালি আনে কে লিয়ে আভি লগভগ ঢের ঘণ্টা চল না হোগা। ইধার প্রকৃতি কা নজারা দেখিয়ে। ১২০০০ ফুট ওপরে তখন লাচুং নদী লাফাতে লাফাতে নেমে যাচ্ছে। শীতল ঝোড়ো বাতাস জানলার ফাঁক দিয়ে ঢুকে পড়ছে।
কেউ কোনো কথা বলে না। গাড়ির ভেতরে গুমোট ভাব। হঠাৎ সেরগিল সাহেবের রিংটোন বেজে ওঠে। কল ধরতেই সেরগিল সাহেবকে বেশ উত্তেজিত মনে হল। খুব জোরে জোরেই কাকে যেন অর্ডার দিল,- সিল কর আভি। জানে না পায়। ফোর্স ভেজ রাহা হুঁ।
ফোন বন্ধ করেই ঘাড় ঘুরিয়ে বলে,- মর্টার,গ্রেনেড,আর্টালারি,মেশিনগান ভর্তি লরি আটক কিয়া মেরা ফোর্স। দেখনা হ্যায় কোয় সুরাগ মিলেগা কি নেহি!
মন খুব খারাপ। রামসির মায়ের কিচ্ছু ভাল লাগে না। জানলার বাইরে মাঝে মাঝে জমাট গাছেদের দিকে বিষণ্ণ মনে তাকিয়ে তাকিয়ে ভাবছিল, এবার না এলেই ভাল হত।
অদূরে সাদা পাহাড়ের সারি। মাঝে মাঝে ধোঁয়ার মত মেঘগুলো পাহাড়গুলোকে ঢেকে দিচ্ছে। আবার ফরসা হয়ে নীল আকাশ বেরিয়ে পড়ছে। হঠাৎ রামসির মা সোজা হয়ে বসে। বাইরের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ। সামনের পাহাড়ের চূড়োর গায়ে কতগুলো বড় আকারের কুকুরের দল! সঙ্গে মানুষও। জোরে চিৎকার করে বলে,-সেরগিল সাব, উধার! উধার!
স্মরণীয় দিবস
বিশ্ব অট্টহাস্য দিবস (১০ই জানুয়ারি)
কলমে-দোলনচাঁপা তেওয়ারী দে
১০ই জানুয়ারি 'বিশ্ব অট্টহাস্য দিবস'।
অট্টহাসি শব্দের আক্ষরিক অর্থ হলো, অতি উচ্চস্বরে বা বিকট হাসি।অট্টহাস্য নামটা শুনলেই যেন প্রাণ খোলা হা- হা করে হাসির কথাই মনে হয়।
'বিশ্ব অট্টহাস্য দিবসে'র উদ্দেশ্য হলো, হাসির মাধ্যমে সৌভ্রাতৃত্ব এবং বন্ধুত্বের বিশ্বজনীন সচেতনতা সৃষ্টি ও বৃদ্ধি করা।
এই দিবসটি প্রথম শুরু হয়, ১৯৯৮ সালের ১০ইমে তারিখে। মুম্বাইতে প্রথমবার বিশ্বব্যাপী হাস্যযোগ আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা ডক্টর মদন কাটারীয়া এই দিবস উদযাপন করেছিলেন। ফেসিয়াল ফিডব্যাক হাইপোথিসিস দ্বারা তিনি অনুপ্রাণিত হয়ে, লাফটার যোগ বা হাস্যযোগ আরম্ভ করেছিলেন।
ফেসিয়াল ফিডব্যাক হাইপোথিসিস ধারণা অনুসারে, একজন মানুষের মুখের অভিব্যক্তি তার আবেগকে প্রভাবিত করতে পারে। সাধারণত জনস্থানে হাসার উদ্দেশ্যে মানুষ একত্রিত হয়ে পালন করেন এই দিবসটি।
বর্তমানে সমগ্র বিশ্বের প্রায় ১১৫ টি দেশ লাফিং ক্লাব বা লাফটার যোগ আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত।
বিশ্ব অট্টহাস্য দিবসের ইতিহাস সম্পর্কে বলা যায় যে, এই দিবসের প্রতিষ্ঠাতা ডঃ মদন কাটারিয়া ভারতের একজন পারিবারিক ডাক্তার, তিনি প্রথম মুখের প্রতিক্রিয়া অনুমান দ্বারা হাসি যোগ আন্দোলন শুরু করতে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন, যা অনুমান করে যে, একজন ব্যক্তির মুখের অভিব্যক্তি তাদের আবেগের উপর প্রভাব ফেলতে পারে।
বিশ্ব অট্টহাস্য দিবস উদযাপন, বিশ্ব শান্তির জন্য একটি ইতিবাচক প্রকাশের মাধ্যম বলা যেতে পারে, যেমন হাসির মাধ্যমে ভ্রাতৃত্ব ও বন্ধুত্বের বৈশ্বিক চেতনা গড়ে তোলা এর অন্যতম উদ্দেশ্যে। এটি প্রায়শই একমাত্র হাসির উদ্দেশ্য নিয়ে সার্বজনীন স্থানের মানুষের সমাবেশের মাধ্যমে উদযাপিত হয়।
১০ ই জানুয়ারি 'বিশ্ব অট্টহাস্য দিবস', এই নির্দিষ্ট দিনটিতে বিশ্ব অট্টহাস্য দিবস উদযাপনের সাধারণ নিয়ম অনুসারে লাফটার ক্লাবের সদস্যবৃন্দ পরিবার এবং বন্ধু-বান্ধবদের সাথে শহরের কোন এক গুরুত্বপূর্ণ স্থানে, যেমন সরকারি উদ্যান অথবা প্রেক্ষাগৃহে একত্রিত হয়ে, প্রত্যেকে উচ্চস্বরে হা-হা করে হাসতে থাকেন। শুধু তাই নয়, সেদিন তারা বিশ্ব শান্তির জন্য প্রার্থনা করেন এছাড়াও ডক্টর কাটারিয়া বিশ্ব শান্তির বার্তা পড়েন।
আমাদের শরীর এবং মন মাঝেমধ্যেই অসুস্থ হয়ে পড়ে, সেই অসুস্থতা থেকে বেরিয়ে আসতে ওষুধ যেমন প্রতিষেধকের কাজ করে ঠিক সেই রকম হাসিও আমাদের জীবনে প্রতিষেধকের কাজ করে। তাই বলতে পারি, আমরা যদি মনের দিক থেকে সুস্থ থাকি অর্থাৎ মন খুলে হাসতে পারি তাহলে হয়তো অন্তত মানসিক রোগ গুলো আমাদের থেকে দূরে থাকবে।
বর্তমানে সমগ্র বিশ্বে হাজার- হাজার লাফটার ক্লাব রয়েছে। সব থেকে বড় কথা,এখন 'অট্টহাস্য দিবস' বিশ্বব্যাপী পালিত হয়।
1 Comments
নতুন ফরমাটের জন্য ধন্যবাদ।অত্যাধুনিক।🙏
ReplyDelete