জ্বলদর্চি

দূর দেশের লোকগল্প— প্যালেস্টাইন (এশিয়া)ঢন-ঢন ঢন-ঢন /চিন্ময় দাশ

দূর দেশের লোকগল্প— প্যালেস্টাইন (এশিয়া)
ঢন-ঢন ঢন-ঢন  
চিন্ময় দাশ

এক গ্রামে এক মহিলা ছিল। অভাবের জীবন। তবে, তাতে কোন খেদ নাই তার মনে। খেদ একটাই। কোন ছেলেপুলে নাই তার। 
মসজিদে যায় । সিন্নি চড়ায়। কিন্তু ঐ পর্যন্তই। কিছুতেই কিছু হয় না। একদিন কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগল—হায় আল্লা! কী এমন অপরাধ করেছি আমি? এত নির্দয় কেন আমার ওপর? ঠিক আছে, বলছি শোন। বেশি কিছু চাই না আমি। অতি সামান্য কিছু একটা দাও তুমি আমাকে। যাকে আমি ভালো বাসবো। যে আমাকে আম্মা বলে ডাকবে। 
একটু থেমে বলল—ঠিক আছে। নেহাৎ আমার রান্নাঘরেরই একটা কিছু দাও। ধরো, থালা, বাটি, গ্লাস, মসলা রাখবার কৌটো—এসবেরই একটা কিছু দাও আমাকে। তোমার হাত দিয়ে পেলে, সেটাকেই নিজের সন্তান হিসাবে ভেবে নেব আমি। 
সকাল হতেই দেখে, দাওয়ায় একটা কৌটো! কাঁসার জিনিষ। উপরে একটি ঢাকনা দেওয়া। আর, কী দারুণ নকশা কাটা। গায়ে নকশা, মাথায় নকশা। ঢাকনায় নকশা। ভারি সুন্দর দেখতে। চোখ ফেরানো যায় না, এতো সুন্দরটি। 
কিন্তু এ জিনিষ তো তার নয়! এখানে এলো কোথা থেকে? অবাক হয়ে ভাবতে লাগল। তখনই মনে পড়ে গেল, কাল রাতে নিজেই আল্লাকে ডেকে বলেছিল—কৌটো-বাটি যা হোক কিছু একটা দিতে। এ জিনিষ নিশ্চয় আল্লাই দিয়েছেন করুণা করে।
অমনি আহ্লাদে গলে গিয়ে, বিড়বিড় করে মোনাজাত করে বলল—খোদা, তুমি সত্যিই মেহেরবান।!
আর, কথা শেষ না হতেই, এক অবাক কাণ্ড। কে যেন ডেকে উঠল—আম্মা। 
চমকে গিয়ে দেখে, তাকে আম্মা বলে ডাকল এই নতুন কৌটোটাই। শুনে তো আহ্লাদে গলে একেবারে জল হয়ে গেল মেয়েটি। কৌটোটা তুলে বুকে জড়িয়ে ধরল। হিজাবের কোণা দিয়ে কৌটোটা মুছতে লাগল আলতো হাতে। অমনি আবার সেই চমক—আম্মা গো, আম্মা আমার। খুব ভালোবাসি আমি তোমাকে।
দু’চোখ দিয়ে টপ টপ করে জল গড়িয়ে পড়তে লাগল মেয়ের। কিছুতেই আটকানো যায় না। কোন রকমে বলল—আমিও তোকে খুব ভালোবাসি, বাছা আমার। 
কৌটোটা কিছুতেই তার মার পিছু ছাড়ে না। মা সংসারের কাজকর্ম করছে। কৌটো ঘুর ঘুর করছে পায়ে পায়ে। ঘুরছে আর দেওয়ালে ঠোক্কর খচ্ছে। ঠোক্কর খায়, আর শব্দ ওঠে-- ঢন-ঢন, ঢন-ঢন।
এইভাবে দিন যায় দুজনের। বেশ আনন্দেই আছে তারা দুটিতে।
একদিন কৌটো বলল—আম্মা, আমি হাটে যাবো। 
মা বলল—না, না। একা একা মোটেই না। এখনও বড় হোস্পনি তুই। ভালো-মন্দ বুঝবার বয়স হয়নি এখনও তোর।
--না, না। আমি জানি, কীভাবে অন্যের সাথে কথাবার্তা বলতে হয়। কোন অসুবিধা হবে না আমার। 
মা কিছুতেই রাজি হবে না। এদিকে ছেলে নাছোড়বান্দা। কী আর করে? অগত্যা মাকে রাজি হতে হোল— কোন একদিন তো বেরোতেই হবে তোকে। দেখতে হবে বাইরের জগৎটাকে। জানতেও হবে। ঠিক আছে। যা তাহলে।
ঢন-ঢন ঢন-ঢন। রাস্তা দিয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে চলেছে কৌটোটা। গড়াতে গড়াতে বেশ বড়সড় এক দোকানে এসে হাজির। 
দোকানি বেশ বড়লোক। সে বলে উঠল—আরে, ভারি সুন্দর দেখতে তো কৌটোটা! এটা বাড়ি নিয়ে যাব। 
কৌটোটা তুলে রেখে দিল দোকানি। নিজের মনেই বলল—খালি কৌটো নিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না। বরং এক কৌটো মধু নিয়ে যাই। বউ খুশি হবে খুব। 
একথা শুনে কৌটো তো ভারি খুশি। মনে ভাবল—ভালোই হোল। মধু জিনিষটা বেশ ভালো। আমিও মধু ভালোবাসি। আমার মায়েরও ভালো লাগবে।
বাড়ি পৌঁছে কৌটো দেখে দোকানির বউ বেশ খুশি—ভালোই হোল। দূপুরের খাওয়াটা মধু দিয়ে বেশ ভালোই জমবে আজ।
কৌটো শুনেছে কথাটা। সে ভাবল—ওটি হচ্ছে না। এক ফোঁটা মধুও আমি কাউকে দেব না। এ মধু আমার মায়ের। কৌটোর ঢাকনাটা শক্ত করে লাগিয়ে নিল সে। 
খাবার টেবিলে বসেছে দুজনে। মধু নেবে পাতে। ঢাকনা খুলতে গেল বউ। কিন্তু পারছে না। ঢাকনা টানে। ঢাকনা নাড়ে। ঢাকনা কিন্তু খোলে না। 
দোকানি বলল—আমাকে দাও। খুলে দিচ্ছি। দোকানিরও এক অবস্থা। ঢাকনা টানে। ঢাকনা নাড়ে। ঢাকনা কিন্তু খোলে না। 
দু’-তিন বার চেষ্টা করেও কোন ফল হোল না। বিরক্ত হয়ে জানালা দিয়ে বাইরে ছুঁড়ে ফেলল কৌটোটাকে। কৌটো ভাবতে লাগল—কী মজা! কী মজা! আম্মার জন্য আজ মধু নিয়ে যাব আমি।
ঢন-ঢন ঢন-ঢন। গড়িয়ে গড়িয়ে ঘরে ফিরে এলো কৌটো। মাকে বলল—আম্মা, ঢাকনা খোল। 
ঢাকনা খুলে, মা তো ভারি খুশি। আহারে, বাছা আমার। মধু এনেছিস আমার জন্য! দোকানি মানুষটিও নিশ্চয় খুব দয়ালু। মধু উপহার দিয়েছে আমাদের!
কৌটো কোন জবাব দিল না কথার।
পরদিন আবার কৌটো বলল—আম্মা, আমি হাটে যাবো।
-আহহা। আর পারি আমি তোকে নিয়ে। মা বলল—তোর কি মনে হয়, যথেষ্ট বড় গিয়েছিস? আজ আবার হাটে যেতে চাইছিস।
--আমি যাবো। আমি যাবো। আমি যাবোই। ছেলের জেদ দেখে, মা আর কী করে? দরজা খুলে যেতে দিল ছেলেকে। 
ঢন-ঢন ঢন-ঢন । গড়িয়ে গড়িয়ে এগিয়ে চলল কৌটো। 
সেদিন আর হাটের পথে গেল না। আরও এগিয়ে, হাজির হোল রাজার বাড়িতে। সোজা দরবারে গিয়ে ঢুকে পড়েছে। রাজা বললেন—আরে, কী সুন্দর জিনিষটা। খুব পছন্দ হবে আমার বিবির। 
এবার অন্দরে জেনানা মহলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে কৌটোকে। রানি তো খুব খুশি। এমন কারুকাজ করা কৌটো তার নিজের প্রাসাদেও নাই। রাজাকে বলল—ভারি সুন্দর নিহলা (উপহার) এনেছ আজ। আমার দামী গয়নাগুলো রাখব এতে। 
হীরে মুক্তো বসানো যত গয়না কোটোটাতে ভরে রাখা হোল।
গোসল (স্নান) সেরে এসে, গয়না পরতে বসল রানি। কৌটোর ঢাকনা খুলতে গিয়ে পারছে না। -- হায় আল্লাহ! এ যে খুলছে না।
রানি ঢাকনা টানে। ঢাকনা নাড়ে। ঢাকনা কিন্তু খোলে না। নাজেহাল হয়ে, হুকুম করল—যা, এখনই রাজাকে ডেকে নিয়ে আয়। 
বাঁদি ছুটল দরবারে। রাজাও ছুটতে ছুটতে জেনানা মহলে এসে হাজির হোল। কিন্তু একই অবস্থা। রাজা ঢাকনা টানে। ঢাকনা নাড়ে। ঢাকনা কিন্তু খোলে না।
রাজা চেঁচিয়ে বলল—কী আহাম্মকের কাজ করলাম আমি এটাকে ঘরে এনে। এক্ষুনি আমার চোখের সামনে থেকে দূর করে দে এটাকে। 
বলতে বলতে নিজেই বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দিল কৌটোটাকে। রানি হায় হায় করে উঠল—করো কী, করো কী? আমার গয়না আছে যে ওটাতে। 
বাঁদি ছুটল কৌটো কুড়িয়ে আনতে। কিন্তু ফেলে দিলে কী আর ফিরে পাওয়া যায়? ঢন-ঢন ঢন-ঢন। গড়িয়ে গড়িয়ে বাড়ির পথে রওণা দিয়েছে কৌটো। মুখে বলছে—রাজা রানি বড্ড বোকা। গয়নাগাঁটি কৌটোয় রাখা।।
ঘরে পৌঁছে মাকে বলল—আম্মা দেখো, আজ কী পেয়েছি। 
কৌটো খুলে, মা তো পড়ল আকাশ থেকে। উপহার হিসেবে মধু কেউ দিতেই পারে। কিন্তু সাত রাজার ধন এমন সব দামি হীরা-মুক্তা আবার কেউ দেয় না কি? নিশ্চয় কিছু গোলমাল করে এসেছে তার ছেলে। 
--এসব নিশ্চয় কেউ উপহার দেয়নি তোকে। তুই নিজেই কিছু একটা করেছিস। আজ থাক, কাল দুজনে গিয়ে যার জিনিষ তাকে ফিরিয়ে দিয়ে আসব। 
বকাঝকা যেন থামে না মায়ের—আমি বলেই ছিলাম না। ভালো-মন্দ শেখার বয়স হোক, তখন বাইরে যাবি?
কৌটোর মুখে কোন জবাব নাই। চুপটি করে আছে। 
পরদিন মা বিছানা ছেড়ে উঠবার আগেই, বেরিয়ে গেল কৌটো। ঢন-ঢন ঢন-ঢন। গড়িয়ে গড়িয়ে চলেছে। মনে ভাবছে, দেখা যাক, আজ কী জোটে কপালে।
বেশি দূর যেতে হোল না। প্রথম দিনের দোকানির চোখে পড়ে গেল। --আরে, এটাই তো সেই কৌটো। আমার মধু নিয়ে পালিয়ে গেছল। চল, রাজার কাছে নিয়ে যাই তোকে। বিচার হবে তোর। এভাবে ছোট্ট একটা কৌটো চুরি-জোচ্চুরি করে বেড়াবে, এটা চলবে না। 
রাজা দেখেই চিনে ফেলেছে। রানিও বলল—হ্যাঁ, এটাই তো!
রাজা বলল—আজ উচিত শিক্ষা দেব এই হতভাগাকে। জীবনে আর কোনদিন বদমায়েসি করবে না। 
কোটোটাকে পশুশালায় পাঠানো হোল। ফিরে এলো খানিক বাদে। রাস্তায় গড়িয়ে দিয়ে, রাজা বলল— তোর যা ন্যায্য প্রাপ্য, ভরে দিয়েছি আজ। এবার ঘরে ফিরে যা। ঘরে ফিরে বুঝবি, আজ কী নিয়ে ফিরলি।
ঢন-ঢন ঢন-ঢন। গড়িয়ে গড়িয়ে বাড়ি ফিরে এলো কৌটো। বুঝতে পারেনি কী পেয়েছে আজ। তবে, একটা কটু গন্ধ কিন্তু নাকে লাগছে। 
মা সারাটা দিন বেশ ভাবনায় ছিল। না বলেই বেরিয়ে গিয়েছে বাড়ি থেকে। কাল এমন কাজ করেছে। আজ বেচারার কী না কী হয়!
ছেলে বাড়ি ফিরে এসেছে দেখে, বেশ নিশ্চিন্ত হয়েছে মা। কিন্তু ঢাকনা খুলে, মুখে কোন কথা নাই মায়ের। একটা বোঁটকা গন্ধে চারদিক ছেয়ে গেছে।
ওয়াক ওয়াক করে উঠল মেয়েটি। কৌটোটা ছাগলের নাদিতে ভরে দিয়েছিল রাজা। অন্যের জিনিষ হাতিয়ে নেওয়ার সাজা।
মা বলল—নিশ্চয় ধরা পড়ে গিয়েছিলি আজ। উপযুক্ত শাস্তিই দিয়েছে সেই লোক। এবার নিশ্চয় শিক্ষা হয়েছে তোর। এবার ভালো-মন্দ ফারাক করতে শিখলি তো? যা তোর নিজের নয়, তাতে লোভ করতে নেই কোনদিন। 
সেদিন থেকে একলা কখনও বাইরে বেরোয়নি কৌটোটা। সেও বুঝেছে, কোন কাজটা ভালো, আর কোনটা মন্দ!

[গল্পটি সংগ্রহ করেছিলেন প্যালেস্টিনীয় লেখক ইব্রাহিম মুহায়ি এবং সমাজবিদ্যা ও নৃতত্ত্বের অধ্যাপক শরিফ কানানা। গল্পটি তাঁরা শুনেছিলেন, ফাতমে আব্দেল কাদের নামে, গ্যালিলী প্রদেশের আররাবে গ্রামের এক অধিবাসীর মুখ থেকে। ১৯৮৯ সালে, “Speak, Bird, Speak Again : Palestinian Arab Folktales” গল্পগ্রন্থে “Tunjur Tunjur”  নাম দিয়ে, গল্পটি প্রকাশ করেন তাঁরা। 
আরবি ভাষায় Tunjur হোল, কোন ধাতব পাত্রের গড়িয়ে যাওয়ার কল্পিত শব্দ।]

Post a Comment

0 Comments