জ্বলদর্চি

প্রাঙ্গণে মোর শিরীষ শাখায় /আবীর ভট্টাচার্য্য চক্রবর্তী

প্রাঙ্গণে মোর শিরীষ শাখায়
আবীর ভট্টাচার্য্য চক্রবর্তী

দ্বিতীয় পর্ব

'সে তুমি যাই বলো ঠাকুরঝি, মেয়েটা বড়ো বেহায়া! আমাদের বাড়িতে সুন্দরী বৌ কি আগে আর কখনও আসেনি,আমরাও কি নয়াবৌ ছিলাম না কখনো? এমন ছিষ্টিছাড়া ছিলাম না কখনও!... ‘
সেদিন দুপুরে নারকেল পাতা থেকে কাঠি তুলতে তুলতে মেজবৌদিদির সঙ্গে এই নিয়েই কথা হচ্ছিলো বিরজার। মেজবৌদিদি মানুষটি সাধাসিধে,মনে তার তেমন মারপ্যাঁচ নেই। দাদার ধমকে চমকে আরও ম্রিয়মান সারাজীবন। বরং ছোটদাদার বৌটি তার তুলনায় অনেক বেশী মেজাজসই, সমাজে মানানসই। তবে প্রথম থেকেই সমবয়সী এই বৌদিদির সঙ্গেই আড়ি-ভাব, টক-ঝাল রইসই বিরজার বেশি…একসঙ্গে সংসারের কলহ-খুনসুটি, দাদাদের লুকিয়ে যাত্রা দেখতে যাওয়া ইত্যাদি ইত্যাদি অপকর্মে সবসময়েরই এ তাঁর জুড়িদার।
ছোটদাদার সঙ্গে ছোটবেলায় ভাব বেশি থাকলেও তার বৌটির সঙ্গে বিরজার তেমন বনে না। তার কারণও অবশ্য ভিন্ন;সে গল্প হবে নাহয় পরে একদিন। 
আসলে, জীবন বড়ো বিচিত্র খেলা খেলে কখনো কখনো। আমাদের ভাবনার অতীত তা,বলা যায় ব্যাখ্যাতীত। তার টানে আমরা কখনও ভাসি, কখনও ডুবি। 
এই যে বিরজার জীবন: মেজবৌদিদি বলে, সে নাকি বেশ আছে, কেউ তার মালিক নয়, অগাধ সম্পত্তি, দাদারা সব আদরে আদরে হাতে তুলে রাখে;তার নাকি খুব সুখ। এদের সব ঝগড়াঝাটি, অশান্তি,ঝামেলা দেখে বিরজাও মাঝেমধ্যে তাইই ভাবেন। কিন্তু আবার একা থাকেন যখন, কখনও কখনও বিরজার যে বড়ো একাও লাগে। যে মানুষটার মুখটাও মনে নেই, তার সঙ্গে পুতুল খেলা বিয়ের মাসুল দিতে গিয়ে সারাজীবন তাঁর নষ্ট হয়ে গেছে ভেবে আফশোষও হয়;নতুন পথে পা বাড়াতে চেয়েও ফিরে আসতে হয়েছে বলে রাগ হয়; এগুলোও তো সত্য। কাজেকর্মে থাকলে ভুলে থাকেন, একা হলে, কেন কে জানে, আজকাল এসব কথা পাঁকপুকুরে বুজকুড়ি ওঠার মতো বিড়বিড় করে জমে মনে। 
কিছু তো করার নেই, মেনে নিতে হয়, তবে মনেও হয়। 

দুপুরের খাওয়া দাওয়া মিটলে, এমন সব দুপুরবেলায় কোন কোন দিন তাঁরা জা-ননদেরা মিলে পাতা ছিলতে বসেন। পরে সেগুলি ঝাঁটা বানিয়ে ঘরের কাজে ব্যবহার করা হয়। সঙ্গে চলে গল্পগাছা… 
তো সেদিনের গল্পের বিষয়বস্তুও যথারীতি ছিলো নতুন বৌমা এবং তার কার্যকলাপ। 
সত্যিই, একে নিয়ে বিরজা পড়েছেন মহা ঝামেলায়। যতই তাকে আগলাতে যান, মেয়েটি ততই নিত্যনতুন সমস্যা তৈরি করে এবং তারপরে এমন সরল আনাড়ি মুখে তাকায়, তিনি তাকে দূরে ফেলতে পারেন নানা;আবার কাছে ডাকেন, শেখান ঘরকন্নার খুঁটিনাটি… 
কেমন করে আনাজ কাটতে হয়, ডানলার আনাজ আর চচ্চড়ির আনাজ কাটার রকমফের, পোস্ত বাটনা আর আদা বাটার সময়ে শিল নোড়া পেশাইয়ের তারতম্য, দুপুরবেলার অবসরে মাছ ধরতে গিয়ে মাছ টোপ গিললে কিভাবে ফাতনা নড়ে ওঠে, ছিপ খেলিয়ে বঁড়শির ডগা গেঁথে কিভাবে মাছ তুলতে হয়, পানে ঠিক কতোটা চুন দিলে স্বাদ বাড়লেও জিভ পুড়ে না… এই সব পুতুলখেলা সংসারের নৈমিত্তিক শিক্ষানবিশীতে বেশ কেটে যাচ্ছে দিন। এতদিন রক্তের ধনেদের আদর দেওয়া মায়ের মনে কেমন যেন অন্য একটা তৃপ্তির আভাস পাচ্ছিলেন তিনিও।
 
তবে সেদিন হঠাৎ সন্ধ‍্যেয় পাটিসাপটা শেখানোর ফাঁকে চোখ পড়ে গিয়েছিলো ওর ঘাড়ের তলার লালচে ক্ষতে….ওটা যে কিসের ক্ষত,বুঝতে ভুল হয়নি জীবনের অনেক ঘাটে জল খাওয়া অভীজ্ঞ তাঁর। চোখটা কেমন যেন জ্বলে উঠেছিলো,অনেকদিন আগের ফেলে আসা কোন অতীত স্মৃতি যেন উথলে উঠেছিল মনের উজানে…মনে পড়ে গিয়েছিল কতো কথা। 
এবং সেই মুহুর্তেই আনাড়ি হাতে পাটিসাপটা পুড়িয়ে ফেলেছিলো নতুন বৌ। ব্যাপারটা একেবারেই অস্বাভাবিক নয়, পিঠেপুলি বানানোর জন্য অনেক অণুশীলন এবং দক্ষতা লাগে জেনেও কেন কে জানে, ধমক দিয়েছিলেন মেয়েটিকে।
🍂
আসলে, সারাদুপুর ধরে নারকেল কুরিয়ে,ছাঁই বানিয়ে, চাল বেটে গোলনা তৈরি করেছেন শুধুমাত্র আদরের ভাইপো ভালোবাসে বলেই, শেখাতেও চেয়েছেন তার বৌটিকে….আর মেয়ের কান্ড দেখ, বর বাড়ি এসেছে বলে রান্নাঘরে মন উচাটন! আরে, রান্না না ভালো জানলে পুরুষ মানুষের মন জয় করা যায় নাকি! কে বোঝাবে একে! এরজন্যই নাকি বুড়োবয়সে বাড়ি শুদ্ধ সবাই তাঁকে দোষ দিচ্ছে!
অকারণেই রেগে উঠেছিলেন,
-"কোন মন নেই কেন কাজে তোমার?সেবা যত্ন না করতে শিখে শুধু ছলাকলা দেখালে হবে?"
অনভ‍্যস্ত কাঠের জ্বালে রাঙা ব‍্যথাহত অবাক করুন মুখটি দেখেও মায়া হয়নি সেদিন,কেন কে জানে!....

সে রাতে ঠিকঠাক ঘুমও আসেনি বিরজার,সময়টা কাত্তিকের শেষাশেষি হলেও গুমোট গরম লাগছিলো বিছানা,ভোর রাতে ঘরের আগল ভেঙে দাওয়ায় বেরিয়ে এসে দেখেন,সামনের দোলনায় দুজনে বসে আছে ঘনিষ্ঠ হয়ে,ছেলে মানভঞ্জনের চেষ্টা করছে নববধূর….
ঐ ভোরবেলাতেও রাগে সর্বশরীর জ্বলে গিয়েছিলো তাঁর। কটকট করে তাকাতেই লজ্জায় ছেলে চলে গেল,কিন্তু বেহায়া বৌটার বুঝি লজ্জা নেই, ঠিকই বলে মেজবৌদিদি। আজকালকার মেয়েদের শরম ধরম কম;নাকি! কই,বড়ো বৌমা তো কখনও এমন করেনি, তারসঙ্গেও তো নয় নয় করে বছর দশেক ঘর করা হয়ে গিয়েছে তাঁদের।
এসব ভেবে, সকালটা বিরক্তিতেই ভরে গিয়েছিলো বিরজার,আর তারপর থেকেই যেন মেয়েটার ওপরে রাগ বেড়েই চলেছে;বেড়েই চলেছে তাঁর।

আবার কয়েকদিন পরে,ঘটেছিলো একই ঘটনা… দুপুরবেলায় পুকুরঘাটে বাসন মাজতে মাজতে  কখন যেন হঠাৎ অকারণে আনমনা হয়ে যায় বৌটি, উদাস দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে দূরে মাঠের পারে,চোখে জল টলটল… "বড়ো মনখারাপ লাগছে ওর জন্য পিসিমা"
মাতৃসমা হলেও,অন‍্যায় হলেও ওকে বড়ো হিংসে হচ্ছিলো তাঁর… 
মনেমনে গালি দিচ্ছিলেন, কিন্তু শরৎচন্দ্রের প্রায় সবকয়টি লেখা পড়া বিরজা টের পাচ্ছিলেন তাঁর মনের অসূয়া।
যে মানুষটি সারাটা জীবন কাটিয়ে ফেললেন নিঃস্বতায়,বেলাশেষে তাঁর কেন যে এমন মনকেমন হচ্ছে,মনে পড়ে যাচ্ছে ভুলে যাওয়া কবেকার কোন স্বল্পকালীন স্মৃতি, না পাওয়ার কষ্টেই যে এমন বিরূপ আচরণ করছেন তা বেশ বুঝতে পারছেন বিরজা। এবং তাই হয়তো উল্টে রাগ করছেন,বিরক্ত হচ্ছেন,শরীর খারাপ করছে…
এই শীতের রাতেও কেমন যেন দমবন্ধ লাগছে,নিঃশ্বাস কমে আসছে,বুকে তীব্র ব‍্যথা….কাউকে ডাকতে ইচ্ছে করছে,গলা শুকিয়ে কাঠ…(ক্রমশ)

আরও পড়ুন 
বিজ্ঞাপনের বিকল্প বিজ্ঞাপনই || ঋত্বিক ত্রিপাঠী 

Post a Comment

0 Comments