কাঠের তৈরি ত্রইস্কায়া গির্জা
ভোলগা নদীর খোঁজে – ৩৬
বিজন সাহা
সভিয়াঝস্ক
দ্বীপ-শহর সভিয়াঝস্কের পুরো নাম রাষ্ট্রীয় ঐতিহাসিক, স্থাপত্য ও শিল্প যাদুঘর এবং সংরক্ষিত এলাকা দ্বীপ-শহর সভিয়াঝস্ক। ঐতিহাসিক গ্রাম সভিয়াঝস্ক কাজান থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। চেবকসারি থেকে কাজান যাওয়ার পথে ভোলগা নদীর তীরে অবস্থিত এই গ্রামটি রাশিয়ার ইতিহাসে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ভোলগা, সভিয়াগি ও শুকা নদীর সঙ্গমস্থলে ইভান গ্রজনি এক দুর্গ গড়ে তুলেন কাজান আক্রমণের পূর্বে। খুব অল্প সময়ের মধ্যে এখানে দুর্গ নির্মাণের কাজ সম্পন্ন হয় আর তার কিছুদিন পরেই কাজান মস্কোর অধীনে চলে আসে।
কাজান ক্রেমলিনের সিউইউম্বিকে টাওয়ার সম্পর্কে বলতে গিয়ে আমরা ইভান গ্রজনির কাজান বিজয় সম্পর্কে বলেছি। সভিয়াঝস্ক থেকেই তিনি ১৫৫২ সালে কাজান অবরোধ করেন। সেই সময়ে নদী যেকোনো রাজ্যের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত। আসলে তখন নদী পথই ছিল ব্যবসা বানিজ্যের জন্য, রাজ্যের অর্থনীতিকে চলমান রাখার জন্য একমাত্র না হলেও অন্যতম প্রধান অবলম্বন। ইভান গ্রজনি কাজানের এই দুর্বলতা সুকৌশলে ব্যবহার করেন। উল্লেখ করা যেতে পারে যে এর আগেও রুশ রাজন্য বর্গ বিভিন্ন সময় কাজান খানতে দখলের চেষ্টা করেন। তবে মস্কোর জার ইভান গ্রজনি কাজান অভিযান করেন ১৫৪৭-৪৮ ও ১৫৪৯-৫০ সালে।
উসপেনস্কি মনাস্তিরমস্কো সেনাবাহিনী ১৫৪৫ সালে প্রথম কাজান অভিযানে অংশ নেয়। তবে সেই অভিযানকে কাজান দখল না বলে শক্তি প্রদর্শন বলা চলে। এর ফলে কাজানে মস্কোপন্থীদের অবস্থান দৃঢ় হয়। এরা ১৫৪৫ সালে কাজানের খান সাফা-গিরেয়াকে বিতাড়িত করে মস্কোপন্থী শাহ আলীকে সিংহাসনে বসায়, তবে ক্রিমিয়ার তাতারদের সহায়তায় সাফা-গিরেয়া অচিরেই সিংহাসন পুনরোদ্ধার করতে সমর্থ হন।
ইভান গ্রজনি ১৫৪৭ সালের ২০ ডিসেম্বর মস্কো থেকে কাজানের উদ্দেশ্যে রওনা হন। এটা ছিল তাঁর প্রথম কাজান অভিযান। কিন্তু নির্ধারিত সময়ের আগে বসন্ত চলে আসায় প্রচুর গোলাবারুদসহ আরটেলারি নিঝনি নভগোরাদের ওখানে ভোলগায় ডুবে যায়। ফলে জার ইভান গ্রজনি নিঝনি নভগোরাদে ফিরে যান। এদিকে অগ্রগামী দল কাজানে পৌঁছে যুদ্ধ শুরু করে। যুদ্ধে পরাজিত হয়ে কাজানের খানের সেনাবাহিনী ক্রেমলিনের ভেতরে আশ্রয় নেয়। কিন্তু সময় মত আরটেলারি তাদের সাহায্য করতে না পারায় আগ্রগামী বাহিনী কাজান ক্রেমলিনের অবরোধ উঠিয়ে নেয়। ইভান গ্রজনি ১৫৪৮ সালের ৭ মার্চ মস্কো প্রত্যাবর্তন করেন।
কাজানের দ্বিতীয় অভিযান শুরু হয় ১৫৪৯ সালের হেমন্তে। ১৫৪৯ সালের মার্চে সাফা-গিরেইয়ার অকস্মাৎ মৃত্যুর পর কাজানে থেকে দূত আসে শান্তি চুক্তির প্রস্তাব নিয়ে। ইভান গ্রজনি শান্তির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে সৈন্য সংগ্রহে লিপ্ত হন। ২৪ নভেম্বর মস্কো থেকে যাত্রা শুরু করে সম্মিলিত সেনাবাহিনী নিঝনি নভগোরাদে মিলিত হয়। ১৪ মার্চ ১৫৫০ সালে এই বাহিনী কাজান ক্রেমলিন অবরোধ করে। কিন্তু এবারও কাজান বিজয় সম্পন্ন হয়নি। তবে কাজান খানদের প্রভূত ক্ষতি সাধন করতে সমর্থ হয় রুশ বাহিনী। ফেরার পথে ইভান গ্রজনি কাজানের অদূরে সভিয়াঝস্ক দ্বীপে, ভোলগা, সভিয়াগি ও শুকা নদীর সঙ্গমস্থলে দুর্গ নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন। সে সময় উগলিচ ছিল রুশ সাম্রাজ্যের অন্যতম প্রধান নদী বন্দর। আমরা উগলিচ সম্পর্কে এর আগে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। এই উগলিচেই তৈরি হয় সভিয়াঝস্কের ভবিষ্যৎ দুর্গ। দুর্গের প্রতিটি কাঠ চিহ্নিত করা হয়। বর্তমানে রেডিমেড আসবাবের মত সভিয়াঝস্কের কর্মীদের কাজ ছিল নম্বর অনুযায়ী কাঠগুলো একের পর এক জোড়া দেয়া। ফলে ১৫৫১ সালে মাত্র চার সপ্তাহে দুর্গ তৈরি সম্পন্ন হয়। আর এ কারণেই দুর্গের নাম হয় সভিয়াঝস্ক যার অর্থ সংযুক্ত করা। পরবর্তী কাজান অভিযানে এই দুর্গ মূল সরবরাহ কেন্দ্রের দায়িত্ব পালন করে। উড়িষ্যার উদয়গিরি ভ্রমণের সময় শুনেছি সেখানে যুদ্ধের আগে সম্রাট অশোক রাস্তা তৈরি করেন যাতে হস্তিবাহিনী নির্বিঘ্নে সেখানে আসতে পারে। তাই যুদ্ধ শুধু ধ্বংস নয়, সৃষ্টিও।
১৫৫১ সালের আগস্টে শাহ আলী আবার কাজানের সিংহাসনে আরোহণ করেন। কিন্তু শক্তিশালী বিরোধী দলের সাথে পেরে না উঠে কাজান ত্যাগ করেন। কাজান শাসনের জন্য আস্ত্রাখানের যুবরাজ ইয়াদিগার মুহাম্মদকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। ১৫৫২ সালে ইভান গ্রজনি ১৫০ টি বৃহৎ আরটিলেরি অস্ত্র সহ ১৫০ হাজার সেনা নিয়ে কাজান বিজয়ে অগ্রসর হন। কিন্তু এ সময় ক্রিমিয়ার তাতার বাহিনী রাশিয়ার দক্ষিণ সীমান্ত আক্রমণ করে। তুলার উপকন্ঠে তাতার বাহিনী পরাজিত হয়ে ক্রিমিয়ায় পালিয়ে যায় আর ইভান গ্রজনি শক্তিশালী বাহিনী নিয়ে সুরক্ষিত কাজানের দিকে যাত্রা করেন।
১৫৫২ সালের ২৩ আগস্ট রুশ বাহিনী কাজান অবরোধ করে। ইভান গ্রজনি শুইস্কিকে তাতার বাহিনীর দুর্গ ধ্বংস করার নির্দেশ দেন। এরপর তিনি রুশ বাহিনীকে খানদের দুর্গের দুই তোরণের মাঝামাঝি টাওয়ার তৈরির আদেশ দেন, যেখানে প্রচুর অস্ত্র সরক্ষিত করা হয়। সেখান থেকে অনবরত গুলি চালাতে শুরু করলে তাতার বাহিনী কাউন্টার অ্যাটাক করে। ১৫৫২ সালে ২ অক্টোবর কাজানের পতন ঘটে। ১১ অক্টোবর রুশ বাহিনী মস্কো ফেরার সিদ্ধান্ত নেয়। কাজানে রেখে আসে শুইস্কির নেতৃত্বাধীন গ্যারিসন। কাজান বিজয়ের ফলে ইভান গ্রজনির সামনে আস্ত্রাখান বিজয়ে পথ খুলে যায়। এভাবেই সমস্ত ভোলগা এলাকা মস্কোর অধীনে আসে।
সভিয়াঝস্ক আমি প্রথম যাই ২০১৪ সালের ০২ জুলাই। আমরা গিয়েছিলাম কনফারেন্সের অংশ হিসেবে। বাসে করে। আগে এখানে শুধু নৌপথে যাওয়া যেত। এখন একটা বাঁধের মাধ্যমে দ্বীপটি মূল ভুমির সাথে সংযুক্ত। ফলে লোকজন গাড়িতে করেই এখানে আসতে পারে। এতে করে ট্যুরিস্টদের সংখ্যা নিঃসন্দেহে বেড়েছে। যদিও হাঁটা পায়ে প্রায় ৪০ মিনিটে দ্বীপটা পরিদর্শন করা যায়, কয়েকটা ঘোড়ায় টানা গাড়িও সেখানে পর্যটকদের সেবা দান করে। আছে ক্যাফে, আছে বিভিন্ন স্যুভেনিরের দোকান। আর আছে অনেক গির্জা ও মনাস্তির। প্রথমবার আমরা অবশ্য হেঁটে হেঁটেই ঘুরেছি পুরো দ্বীপটা। তবে এটা ঠিক যে সবগুলো মিউজিয়াম ভালো করে দেখতে গেলে সারাদিনেও সেটা শেষ করা যাবে না।
সভিয়াঝস্কের প্রধান আকর্ষণ উসপেনস্কি মনাস্তির। ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের অন্তর্ভুক্ত এই মনাস্তিরের দেয়াল দুর্গের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। ৫০০ বছর আগের তৈরি এই মনাস্তির এখনও সক্রিয় মানে এখনও এখানে উপাসনা করা হয়। উসপেনস্কি সাবর ও নিকোলস্কায়া গির্জা ষোড়শ শতকে পস্কভ- নভগোরাদ স্টাইলে নির্মাণ করা হয়। এরপর বিভিন্ন সময়ে কিছু কিছু পরিবর্তন আনা হলেও এখনও দেখার মত।
সভিয়াঝস্কের ইয়ান্নো-প্রেদতেচেনস্কি মনাস্তিরে তিনটে গির্জা অবস্থিত যা বিভিন্ন স্টাইলে তৈরি। এদের একটা ত্রইস্কায়া গির্জা। কাঠের তৈরি এই গির্জা সভিয়াঝস্কের গোড়াপত্তনের সময় থেকেই এখানে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। আছে ১৬০৪ সালে প্রতিষ্ঠিত সেরগেই রাদোনেঝের শ্বেত গির্জা। এই দুই গির্জার মধ্যে অবস্থিত “সব শোকার্তদের জন্য আনন্দ” নামে ঈশ্বর মাতা আইকনের সাবর।
তবে শুধু ধর্মীয় উপাসনালয়ই নয়, এখানে এখনও বিভিন্ন স্থাপনা বিদ্যমান – যেমন বনিকদের বাড়িঘর, সেনানিবাস, অগ্নি নির্বাপক টাওয়ার, স্কুল, ব্যবসায়িক ও আবাসিক বাড়িঘর। বর্তমানে এখানে ২৫০ জন লোক বসবাস করে। এদের অনেকেই পর্যটনের সাথে জড়িত।
প্রথমবার আমাদের ছিল বিরাট এক গ্রুপ। বিভিন্ন দেশের। পর্তুগাল, ইতালী, ফ্রান্স, ব্রাজিল, ইউক্রেন, বেলারুশ। অনেকের সাথেই পরে আর দেখা হয়নি, অনেকেই এখন জীবিত নেই। খুব নির্জন পরিবেশ। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখার মত।
সামোভার নিয়ে চা বিক্রেতা
দিলীপের সাথে আমরা যখন যাই তখন একটা গাড়ি ভাড়া করি। অল্প বয়সী এক ছেলে। তবে দ্বীপের ইতিহাস বেশ ভালোই জানে। অন্য শহর থেকে এসেছে। দ্বীপের প্রতি আকর্ষণ থেকেই রয়ে গেছে। ওর মুখে অনেক ইতিহাস শুনলাম। আসলে গাইডের মুখ থেকে এমন অনেক তথ্য পাওয়া যায় যা গাইড বুকে থাকে না। ও আমাদের নিয়ে এলো এক চায়ের দোকানে। এক মহিলা চা তৈরি করে খাওয়াচ্ছিলেন। বেশ মিশুক। বিশাল সামোভারের সামনে পোজ দিলেন, দিলীপের এটা খুব কাজে আসবে। পাশেই একজন হাতে তৈরি বিভিন্ন জিনিস বিক্রি করছিলেন। সময় পেলে মাছ ধরেন, এগুলো প্রসেস করে বিক্রি করেন। আমরা সারা দ্বীপ ঘুরে ফিরে এলাম উসপেনস্কি মনাস্তিরের সামনে। এসে ওকে টাকা দিলাম। আসলে টাকা ছিল না, অনলাইনে কাজ সারলাম। সেটা অবশ্য বেশ কাজে এসেছিল। কেননা, আমি দেমিদের হাতে ক্যামেরার ব্যাগ দিয়ে ছবি তুলতে নেমে গেছিলাম। ধারণা ছিল দেমিদ ব্যাগটা নিয়ে নামবে। ছবি তুলে আমি যখন ক্যাফেতে ঢুকে দেমিদকে কাছে ব্যাগের কথা জিজ্ঞেস করলাম, দেখা গেল ও ব্যাগটা আনেনি। কি করা? আমি দৌড়ে বাইরে গিয়ে দেখি ছেলেটি নেই। হয়তো অন্য কোন ক্লায়েন্ট নিয়ে চলে গেছে। ওখানে আমার দুটো লেন্স। তাহলে উপায়? দেমিদ বলল, তুমি তো এই মাত্র পে করলে ওর নম্বরে। তোমার ব্যাংকে ওর নম্বর আছে। ওখানে দেখে ফোন কর। ফোন করার সাথে সাথে ও ধরল। নিজেও খেয়াল করেনি। কয়েক মিনিট পরেই ফিরে এসে ব্যাগ দিল। আমি ওকে ধন্যবাদ দিলাম। স্থানীয় ক্যাফেতে দুপুরের খাওয়া সেরে আমরা ধীরে ধীরে রওনা হলাম কাজানের পথে।
সভিয়াঝস্কের কিছু ছবি
http://bijansaha.ru/album.php?tag=100
ভিডিও
https://www.youtube.com/watch?v=PMJFsyA73I4&t=69s
0 Comments