জ্বলদর্চি

প্রাঙ্গণে মোর শিরীষ শাখায়-৩/আবীর ভট্টাচার্য্য চক্রবর্তী

প্রাঙ্গণে মোর শিরীষ শাখায়
আবীর ভট্টাচার্য্য চক্রবর্তী

তৃতীয় পর্ব

সেদিন রাতে জম্পেস ঠান্ডা পড়েছে। এমনিতেই গ্রামের দিকে শীত পড়ে বেশী,তায় সেবার কি যেন এক ঝঞ্ঝা না শীতপ্রবাহ এসেছে,তারজন্য যেন দিনের বেলাতেও হাড় হিম হয়ে যাচ্ছে ঠান্ডায়। সবাই যে যার মতো কাজকর্ম মিটিয়ে শুতে চলে গেছে, হয়তো ঘুমিয়েও পড়েছে। ঘুম আসেনি শুধু অহনার।
 একে তো নতুন জায়গা,চুপচাপ শান্ত নির্জন। তায় জীবন চলে এখানে বড্ডো ঢিমেতালে। সারাদিনের পরিচিত গাড়িঘোড়া,মানুষের ব‍্যস্ততা,চেঁচামেচি,কোলাহল কিছুই নেই,রাত বাড়লে নিজের ছায়া দেখেও ভয় পায়,এমন অবস্থা। জন্মাবধি একা শোওয়ার অভ‍্যাস ছিলো না। কিন্তু হঠাৎ করে ঠিক হয়ে যাওয়া বিয়ের পরে এখন এখানেই থাকতে হয় অহনাকে…
মানিয়ে চলার চেষ্টা চলে দিন-দিন। শুধু রাতে একা শুতে বড়ো ভয় হয়। তাছাড়া এখানে কারেন্টও থাকেনা সবসময়,মিজমিজে লন্ঠনের আলোয় বই পড়া যায় না। ওবাড়িতে ঘুমোবার আগে প্রতিদিনই খানিকক্ষণ গল্পের বইপড়ার অভ‍্যাস করিয়েছিলেন বাবা। এবাড়িতে এমন অভ‍্যাস কারো নেই,বৌ বা মেয়েদের তো নেইই। তাই যে দিনগুলোয় কত্তামশাই থাকেন না,বড়ো ফাঁকা লাগে…শুধুমাত্র দাম্পত্য আদর সোহাগই নয়,সঙ্গও যে বড়ো জরুরী যাপনের জন্য,বিয়ে হওয়া ইস্তক তা বেশ টের পায় মেয়েটি।
মাঝেমধ্যে বড়ো রাগ হয় মায়ের ওপর। কি দরকার ছিলো বাবা মারা যাওয়ার পরে পরেই এতো তাড়াতাড়ি তার বিয়ে দিয়ে দেওয়ার!আর দিলো তো দিলো,একটু খোঁজখবরও নিলোনা! এত্তো গ্রামে মানুষ থাকতে পারে!
যে পরিবেশে সে বড়ো হয়েছে,এবাড়ির পরিবেশ তার থেকে একেবারেই আলাদা। এখানে মেয়েদের সবই বারণ। জোরে হাসা, জোরে কথা বলা,এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়ানো…সব বারণ। শুধু সারাদিন ঘোমটা দিয়ে রান্নাঘরে থাকা,গেরস্থালি কাজকম্মো,ব্রত-আচার শেখা…এইসব।
🍂
ও যে শহরের ভালো স্কুলে বা কলেজে পড়া মোটামুটি মেধাবী কন‍্যা,গানে পারদর্শী; পিসিমা ছাড়া সেকথা এবাড়ির কেউই হয়তো মনে রাখে না… শুধু খুঁত ধরে,খুঁত ধরে।এটা পারোনা,ওটা পারো না…

 ইদানিং পিসিমাও কেন কে জানে,বড়ো রেগে যাচ্ছেন তার ওপরে….কারণ জিজ্ঞেস করতেও ভয় লাগছে, এদিকে কত্তামশাইয়েরও অফিসে নাকি কাজের বড়ো চাপ চলছে,বাড়ি আসতে পারছেন না বেশ কিছুদিন। এদিকে প্রায় পনেরো দিন হলো, অহনার পিরিয়ড মিসিং… কি হচ্ছে, কেন হচ্ছে, কি করা উচিত কিচ্ছু বুঝতে পারছে না সে। 
সব মিলিয়ে মন খুব খারাপ,নতুন বিয়ের ভালোলাগা ছাপিয়ে বিষন্নতা অথবা বিহ্বলতা যেন তাকে ঘিরে ফেলছে ক্রমাগত। বাবা বলতেন,কখনও কোন পরিস্থিতিতেই নিজের ওপরে আস্হা না হারাতে,ও সেই চেষ্টাই করে। কিন্তু ওকে ঘিরে যা চলছে, তা থেকে মু্ক্তির উপায়ও যে ওর জানা নেই। 
জানলার পাশের ঝোপে একটানা ঝিঁঝির ডাক শুনতে শুনতে,মশারীর চালের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে এসব কথা ভাবতে ভাবতেই কখন যে দুচোখে ঘুম নেমে এসেছিলো,টের পায়নি অহনা। ঘুম ভাঙলো যখন, বন্ধ জানলার ফাঁক দিয়ে রোদের আলোর রেখা এসে পড়েছে মুখে,আবছা কানে যেন শুনতে পেলে বাইরে তুমুল চেঁচামেচি।
একদৌড়ে খাট থেকে নেমে দরজা খুলতেই দেখে উঠোনময় লোকারণ‍্য। পাড়া প্রতিবেশী অনেকেই ভীড় করেছে,সবার মুখে উদ্বেগ।
ঘটনাটা কি জানতে এগিয়ে যাওয়ার মুহূর্তেই মনে পড়লো,এমন বাসীকাপড়ে সবার সামনে গেলে আবার সবাই রাগ করবে। কিন্তু ঘটনাটা কি জানার প্রবল ইচ্ছায় দরজার চৌকাঠে দাঁড়িয়েই এদিকে ওদিকে তাকালো সে, ওদের মাঝে কিশোর ভাসুরপুত্রটির দিকে চোখ পড়লো।
পিসিমা ছাড়াও এই বারো বছরের ছেলেটি বিয়ে হওয়া ইস্তক অহনার পছন্দের জন। তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকতেই ভীড়ের মধ্যে থেকে তার কাছে এসে সে খবর দিলে,

-'পিসি ঠাকুমা কাল রাতে বিছানা থেকে পড়ে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে গেছে।সকালবেলা মা গোঙানি শুনে সবাইকে ডেকেছে,ডাক্তার বলছে অবস্থা ভালো না।সবাইকে খবর দিতে।'

হঠাৎ কি যেন এক অনির্দেশ‍্য বেদনায় থরথরিয়ে কেঁপে উঠলো অহনার মন; নিজের কাছে নিজেকেই না বুঝতে পারা মনে খুব দ্রুত কাপড়চোপড় ছেড়ে এতদিনকার যুক্তিবাদী তরুণী আগে গেল ঠাকুরঘরে, যেখানে পিসিমা প্রতিদিন সকালে এবং বিকেলে আসতেন পুজোয়। ঠাকুরের কাছে ঐকান্তিক করজোড়ে প্রার্থনা করলে পিসিমার আরোগ‍্য … মন খানিক শান্ত হলে, ফিরে এসে বসলে তাঁর বিছানার পাশে।
নিস্তেজ শরীরটিতে তখন স্হানীয় ডাক্তারবাবু স‍্যালাইন দেওয়ার ব‍্যবস্হা ক‍রছেন,রোগীকে একেবারে না নড়িয়ে আলগোছে বুঝিয়ে দিতে চাইছেন স‍্যালাইন চালাবার কৌশল,প্রয়োজনে অন্য কোন অ্যটেনডেন্ট রাখার কথা; কারণ নাকি এইসব ক্ষেত্রে বেশী নড়াচড়া করালেই দ্বিতীয় ম‍্যাসিভ অ্যটাকের সম্ভাবনা থাকে।

 বাবার অসুখের সময় স‍্যালাইন চালাবার অভিজ্ঞতা ওর ছিলো।বাড়ির সবার ভয়ার্ত মুখ এড়িয়ে অহনা তাই ডাক্তারবাবুর সামনে এগিয়ে এসে জানালে,
-'আমি পারবো ডাক্তারবাবু।আমি জানি।'
খানিক অবাক হলেও ডাক্তারবাবু তাকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে গেলেন। তারপরে সারাদিন কেটে গেল রোগীর শুশ্রূষায়। 
সকাল গড়িয়ে দুপুর হলো, ক্রমে সন্ধ্যা… 
অবস্হার উন্নতি হলো না। বাড়ির সবাইকার শত অনুরোধেও অহনা নড়তে পারেনি পিসিমার অসুস্থ শয্যার পাশ থেকে। 
ইতিমধ্যে বাড়ির দুই প্রবাসী পুত্র খবর পেয়ে ফিরে এসেছেন কর্মস্থল থেকে, ডাকা হয়েছে কাছের শহরের হৃদরোগ বিশেষজ্ঞকেও। বাড়িতে আলোচনা চলছে রোগীকে হাসপাতালে দেওয়ার, স্হানীয় ডাক্তারবাবুও প্রায় হতাশ; 
এমন সময়েই যেন অস্ফুট গোঙানির মতো কিছু শোনা গেল,অল্প একটু নড়ে উঠলো কি পিসিমার ঠোঁটদুটি! অধীর আগ্রহে অহনা ডাকলো,
-'পিসিমা!পিসিমা!'
অজান্তেই দুহাত কপালে উঠলো নমস্কারের ভঙ্গিতে,এতক্ষণের প্রার্থনা তবে সার্থক হলো!

ডাক্তার পূর্ণ উদ‍্যমে আবার অসম যুদ্ধে নামলেন,ওষুধপত্র দেখে শহরের ডাক্তারও তাঁর চিকিৎসায় আশ্বস্ত হলেন। 
পূর্ণ জ্ঞান যদিও ফেরেনি,তবু লড়াই চালাবার রসদটুকু পাওয়া গেছে,এই আশাতেই বাড়িশুদ্ধ মানুষ সেই শীতের রাতে নিজস্ব বিছানা ছেড়ে একসাথে সেই অপরিসর ঘরটিতে আধো ঘুমে আধো জাগরণে কাটিয়ে দিয়েছিলো একাত্ম মঙ্গল আকাঙ্ক্ষায়। আজীবন শহরে বড়ো হওয়া,'কমফোর্ট জোনে' অভ‍্যস্হ অহনা সেদিন নতুনভাবে শিখেছিলো,
জীবনপথে বিপদ অসুখ তো আছেই,তবু এমন সব অসহ দিনে আত্মীয়তা যেন আরও গভীর হয়,'আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি…'
পরে ভেবে অবাক হয়েছে, বাবার বাড়ির সেই আদুরী মেয়েটি, যে কিনা ক্ষিদে-তেষ্টা একেবারেই সহ্য করতে পারতো না, সে কিভাবে একটানা প্রায় আঠারো ঘন্টা কিচ্ছুটি না খেয়ে বসেছিলো! কিসের টানে! কবে এরা সবাই তার এতো আপনার হয়ে উঠলো! তবে কি ঠাকুমার কথাই সত্যি… যে মেয়ে বিয়ের পিঁড়িতে বসে, আর যে ওঠে;তারা দুজন এক মেয়ে নয়! কে জানে!...(ক্রমশ)

Post a Comment

0 Comments