শব্দে গাঁথা মণি-মালা : ৩৭ / সালেহা খাতুন
জীবনটাই একটা পরীক্ষা। এক বিখ্যাত নাট্যকার লিখেছিলেন ‘জীবনটাই নাটক’। আমি একটু বদলে নিয়েছি মাত্র। সারা জীবন ধরে মানুষ পরীক্ষা দিয়ে চলে। কখনও সেই পরীক্ষায় সে একেবারে ফার্স্ট ডিভিশন মার্কস পায় আবার কখনও উত্তীর্ণ হওয়াটাই দায় হয়ে ওঠে। কদাচিৎ পাশ মার্কসও পেয়ে যায়।
আর পড়াশোনা করতে গেলে তো কথাই নেই। শিক্ষার যে ব্যবস্থায় আমরা পড়ি তা একেবারেই পরীক্ষাহীন নয়। যদিও পরীক্ষাহীন পড়াশোনা প্রায় সবারই প্রিয়। তাই চুরানব্বইয়ের মে মাসের শুরুতেই অনার্স পার্ট টু পরীক্ষা শেষ হতেই অন্যরকম দিনযাপন শুরু হলো। মে মাসের ন তারিখ আমার স্যার অধ্যাপক ড. শ্যামল কুমার সেনগুপ্ত ‘হীরক রাজার দেশে’ মুভিটি নিজের বাড়িতে আমাদের তিন ভাইবোনকে দেখানোর ব্যবস্থা করলেন।
এদিকে পরীক্ষা শেষ হয়ে যাওয়ায় বন্ধুরা ছন্নছাড়া হয়ে গেলাম। সাংসারিক কাজকর্মের সঙ্গে সমান তালে চলতে লাগল আমার বইপোকা জীবন। মে মাসেই শেষ করলাম গৌরকিশোর ঘোষের ‘প্রেম নেই’, শ্যামল বসুর ‘সুভাষ ঘরে ফেরে নাই’, জগদীশ গুপ্তের ‘লঘু গুরু’, ‘অসাধু সিদ্ধার্থ’ , ‘নিষেধের পটভূমিকায়’,’দিবসের শেষে’, ‘মহিষী’,’দুলালের দোলা’, ‘উদয়লেখা’,ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের ‘ভূত ও মানুষ’,’মুক্তামালা’, সমরেশ মজুমদারের ‘গর্ভধারিনী’, হ্যানা ক্যাথারিন মুলেন্সের ‘ ফুলমনিও করুণার বিবরণ’, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যাযের ‘বিদিশা’, সমীরণ গুহের ‘ভাল আছি’,জুল ভার্নের প্রসিদ্ধ রোমাঞ্চকর উপন্যাসত্রয়ী ‘Abandoned’, ‘The Mysterious Island’, ‘The Mystery of the Island’ এবং কুলদারঞ্জনের অনুবাদে পড়লাম ‘আশ্চর্যদ্বীপ’। ‘আশ্চর্যদ্বীপ’ হৃদয়ে গেঁথে গেল।সাইরাস হার্ডিং,গিডিয়ন স্পিলেট,পেন ক্রেফট, হারবার্ট, নেব, টপ, আয়ারটন, জাপ,ক্যাপট্যাস গ্রান্ট, হার্ডি,নডিলাস সবাইকে এবং সবকিছুকে স্মৃতিতে গেঁথেছিলাম তখন। আস্তে আস্তে তা ধূসর হয়ে আসছে।
স্যারের সঙ্গে আমরা তিন ভাইবোন ও মেরিনা।
জুন মাসে ভবিষ্যতের পথে আর একধাপ এগিয়ে দিলেন স্যার। কলেজের ইলেকটিভ বেঙ্গলির খাতা দেখতে দিলেন। একটা অন্যরকম অভিজ্ঞতা হতে থাকলো। স্কুলে পড়ার সময় বাবা যখন পরীক্ষার খাতা দেখতেন তখন ইতিহাসের ছোটো প্রশ্নগুলো আমাকে দেখতে দিতেন। এখন বুঝি ছোটোদের ব্যস্ত রাখার একটি কৌশল ছিল এগুলি। গোগ্রাসে বই গেলা জুন মাসেও অব্যাহত ধারায় চলতে লাগলো। সারোয়ার জাহানের পাণ্ডিত্যপূর্ণ আলোচনার বই ‘ বঙ্কিম উপন্যাসে মুসলিম প্রসঙ্গ ও চরিত্র’ পড়লাম। নীহাররঞ্জনের ‘ঘুম নেই’, মঞ্জিল সেনের ‘পাহাড়ি ঝর্না’, কল্যাণ মৈত্রের ‘নিখোঁজ’, লালন ফকিরের গীতিকা, ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কলিকাতা কমলালয়’, রবীন্দ্রনাথ মৈত্রের ‘মানময়ী গার্লস স্কুল’, তারাশঙ্কর তর্করত্নের ‘কাদম্বরী’, টেকচাঁদ ঠাকুরের ‘কলিকাতায় লুকোচুরি’,চন্দ্রনাথ বসুর ‘পশুপতি সম্বাদ’, অক্ষয় বড়ালের ‘রজনীর মৃত্যু’, চন্দ্রশেখর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘জটাধারীর রোজনামচা’ আরো অনেক সমালোচনামূলক বই।
🍂
আরও পড়ুন 👇
কদিন এতো বেশি পড়েছি যে ক্লান্ত অবসন্ন হয়ে পড়লাম। ঠিক করলাম একমাস বাড়ির বাইরে যাবো না। বই একেবারে ছোঁবো না। চুরানব্বইয়ের জুন মাসেই বাড়িতে প্রথম টি.ভি. এলো। বাবাকে প্রচুর জ্বালানোর পর বাবা টি.ভি.কিনতে বাধ্য হন। রেগেও যান। কিন্তু বাবাকে বাড়িতে আটকে রেখে একসঙ্গে ফুটবল বিশ্বকাপ দেখাই আমাদের উদ্দেশ্য ছিল। সে ব্যাপারে আমরা একশো শতাংশ সফল।
বার বার ফিরে ফিরে পড়েছি।
এতো সবকিছুতে নিজেকে ব্যস্ত রাখা সত্ত্বেও রেজাল্টের চিন্তা কুরে কুরে খেতে থাকলো আমায়। ফল আশানুরূপ না হলে কী করবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। শরীর মন ভেঙ্গে পড়তে লাগলো। এবারের ফল উল্টো হলে তো জীবনের সব স্বপ্ন সাধনা একসঙ্গে ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে যাবে। এককালে নিজেকে খুব ভালো স্টুডেন্ট ভাবতাম। আসলে আমি ছিলাম অনেক খারাপের মধ্যে একটু ভালো। সেই গরবে হয়তো মাটিতে পা পড়তো না। কিন্তু না এমন আচরণ তো কোনোদিনও করিনি।
নামাজ রোজা কোরআন শরীফ পড়া কিছুই করছি না শুধু খেলা দেখছি বলে বাবা খুব বকলেন। তখন বয়সটা এমন ছিল যে জোর করে ধর্মে মতি আনা কারোর সাধ্য ছিল না। বিদ্রোহী মন কেউ কিছু বললে উল্টোটাই করতে চাইতো। অথচ এক সময় আমি অত্যন্ত ধর্মভীরু ছিলাম। আল্লার একেবারে কাছাকাছি ছিলাম বলেই মনে করতাম। আর বুদ্ধি যত বাড়ছে জটিলতাও ততো বেশি দেখা দিচ্ছে। একেবারে শয়তান হয়ে উঠছি। আমার খুব বিস্ময় লাগে অত্যন্ত ভক্তদের দেখে আর একেবারে অবিশ্বাসীদের দেখে। তাদের যে শক্তি অনেক। সে শক্তি আমার কোথায়? মধ্যবিত্ত হয়ে সব কিছুই যে সংশয় আর দ্বিধার দোটানায় দোদুল্যমান। কী বেকার বেকার মনে হচ্ছে। বই পড়তেও ইচ্ছে করছে না। মনে হচ্ছে ফল না পেয়ে বই পড়ে কী লাভ? জ্ঞানলাভ তো দৃশ্যগ্রাহ্য নয় ফলটাই সবাই দেখতে পাবে।
(ক্রমশ)
জ্বলদর্চি অ্যাপ ডাউনলোড করুন। 👇
0 Comments