জ্বলদর্চি

লোকমাতা রানি রাসমণি —৩৫/সুমিত্রা ঘোষ


লোকমাতা রানি রাসমণি —৩৫

সুমিত্রা ঘোষ

রানি রাসমণিও শ্রীরামকৃষ্ণদেবকে মন্দিরে জীবন্ত বিগ্রহরূপে দেখতে পেতেন। রানি রাসমণি শ্রীরামকৃষ্ণদেবের গান শুনতে খুব ভালবাসতেন। তাঁর গান শুনে অভিভূত হয়ে যেতেন রানি। এমনই ভাব ছিল শ্রীরামকৃষ্ণদেবের। আবার নরেনের গান শুনে ঠাকুর নিজে অভিভূত হতেন। নরেন্দ্রনাথ দত্ত যেদিন প্রথম ঠাকুরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এসেছিলেন দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে সেদিন নরেন্দ্রনাথ গান করেছিলেন-'মন চল নিজ নিকেতনে...' ঠাকুর গান শুনে খুব খুশি হয়েছিলেন। রানি রাসমণি ভবতারিণী মন্দিরে এসে ঠাকুরকে গান করতে বলতেন- ঠাকুর যখন গাইতেন - 'কোন হিসাবে হরহৃদে দাঁড়িয়েছে মা পদ দিয়ে' অথবা 'ব্রহ্মান্ড ছিল না যখন, মুন্ডমালা কোথায় পেলি?'_ এই সব গান রানির অতিপ্রিয় ছিল। ঠাকুর পুজোর আসনে বসে থাকতেন নির্বিষ্ট মনে আর অনতিদূরে রানি মালা হাতে বসে আছেন সে এক দুর্লভ মুহূর্ত বলা যায়। ঠাকুর গান করতেন সেই সময় দুজনে ভাবসাগরে ডুব দিতেন।
🍂
 দক্ষিণেশ্বরে গোবিন্দ মন্দিরে গোবিন্দর যখন পা ভেঙে যায় তখন ঠাকুর পরম স্নেহভরে গোবিন্দর পা মেরামতি করে দিয়েছিলেন। দেবতাকে প্রিয়জন মনে না করলে এমন কাজ করা কখনও সম্ভব হয় না। রানি বুঝেছিলেন ঠাকুরের সঙ্গে দেবতার মেলবন্ধন আছে যাকে বাস্তবে পারিবারিক সম্পর্ক বলা যায়। ঈশ্বরকে শুধুমাত্র মাটির প্রতিমা মনে করলে তাঁর সঙ্গে  সম্পর্ক স্থাপন করা যায় না। ঈশ্বরকে নিজের আপনজন মনে করে তাঁর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করতে পারলে ধ্যান, জপ, পূজা, প্রার্থনা সব সফল হয় আর তাঁকে নিজের মনে করতে না পারলে সব ব্যর্থ। তাঁকে অন্তরের অন্তরতম একজন আপনজন ভেবে জপ-ধ্যান পুজো করতে হয়। তিনি ভক্তের ভগবান একথা মনে রাখার দরকার। মথুরামোহন যেমন বিষয় আশয় ছেড়ে শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে শুধুমাত্র ভাবসমাধি চেয়েছিলেন, রানি রাসমণি তেমন বিষয় সম্পত্তি থেকে চট করে মুক্তি পেতে চাননি। ছেলেবেলা থেকে রানি ঈশ্বরে বিশ্বাসী এবং নানাভাবে ঈশ্বরীয় মহিমা উপলব্ধি করলেও বিষয় আশয় থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায় খোঁজেন নি।
এ ব্যাপারে শ্রীরামকৃষ্ণদেব তাঁকে পথ দেখিয়েছেন। শ্রীরামকৃষ্ণদেব জানতেন রানি রাসমণি জগন্মাতার অষ্টসখীর এক সখী। তাঁকে বিষয়-আশয় থেকে মুক্ত হতেই হবে। নইলে তিনি জগন্মাতার কোলে আশ্রয় পাবেন কিভাবে? রানির মেজোজামাই মথুরামোহনের অবস্থা এমনই হয়েছিল বিষয় সম্পত্তির আসক্তিতে আকণ্ঠ ডুবে ছিলেন।  তা সত্ত্বেও তিনি শ্রীরামকৃষ্ণদেবের কাছ থেকে ভবিসমাধি চাইলেন। ঠাকুর তাঁকে ভাবসমাধি দিলেন। ভাবসমাধি পেয়ে মথুরামোহন  দক্ষিণেশ্বর থেকে জাননাজারে ফিরে গেলেন। এখানে এসে মথুরামোহনের মাথায় বিষয় চিন্তা এলেও সে চিন্তা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। হঠাৎ এক সকালে তাঁর মনে হলো- কার বিষয় ? কিসের বিষয়? অনেক হয়েছে। মামলা-মকদ্দমা নিয়ে মথুরামোহন আর চিন্তা ভাবনা করতে পারছেন না, এইসব কাজের জন্য সেরেস্তায় যেতে হয় তা-ও যান না। পরিবার-পরিজনেরা ভাবলেন তাঁর শরীর খারাপ হয়েছে। মথুরামোহন চুপচাপ বসে থাকেন, কারো সঙ্গে কথা বলছেন না। দক্ষিণেশ্বরের মা ভবতারিণীর মূর্তি মথুরামোহনের চোখের সামনে ভাসতে থাকে। যেহেতু ঠাকুরের কাছ থেকে ভাবসমাধি পেয়েছেন তাই ভাবে মায়ের সঙ্গে কথা বলেন মথুরামোহন। তাঁর চোখ দুটো জবা ফুলের মতো লাল।  নাওয়া -খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন। মন চাইছে সর্বদা কৃষ্ণ কথা শুনতে। এদিকে মামলার দিন এসে গেছে, নবদ্বীপ-এ যেতে হবে। এভাবে সব কিছু ত্যাগ করে নীরবে চোখের জল ফেলে চলেছেন। স্ত্রী জগদম্বা দক্ষিণেশ্বরে খবর পাঠিয়ে শ্রীরামকৃষ্ণদেবকে জানবাজারে আনালেন । শ্রীরামকৃষ্ণদেব জানবাজারের বাড়িতে এসে মথুরামোহনের সামনে দাঁড়িয়ে মুচকি মুচকি হাসছেন,আর বলছেন, কিগো মেজোকর্তা। ঠাকুরকে পেয়ে মথুরামোহন তাঁর পা জড়িয়ে ধরে বললেন,বাবা ঘাট হয়েছে, আজ তিনদিন ধরে এই অবস্থা চলছে।

সংগ্রহ করতে পারেন 👇

 

Post a Comment

0 Comments