জ্বলদর্চি

অপরাজিতা /ভাস্করব্রত পতি

বাংলার ঘাস পাতা ফুল ফল, পর্ব -- ৫
অপরাজিতা

ভাস্করব্রত পতি

'পরাজিতা তুই সকল ফুলের কাছে,
তবু কেন তোর অপরাজিতা নাম?
বর্ণ সেও ত নয় নয়নাভিরাম।
ক্ষুদ্র অতসী, তারো কাঞ্চন-ভাতি ;
রূপগুণহীন বিড়ম্বনার খ্যাতি!
কালো আঁখিপুটে শিশির অশ্রু ঝরে—
ফুল কহে — মোর কিছু নাই কিছু নাই,
ফুলসজ্জায় লজ্জায় যাই নাক,
বিবাহ বাসরে থাকি আমি ম্রিয়মাণ।
মোর ঠাঁই শুধু দেবের চরণতলে,
পূজা শুধু পূজা জীবনের মোর ব্রত ;
তিনিও কি মোরে ফিরাবেন আঁখিজলে' —  
(অপরাজিতা, যতীন্দ্রমোহন বাগচী) 

অপরাজিতা ফুলের গাছ গ্রাম বাংলায় প্রচুর পরিমানে দেখা যায়। একে নীলকন্ঠও বলে। তেলুগুতে বাল নীলগুটুনা, তামিলে ককোনম্, হিন্দিতে বিষ্ণুক্রান্তি, নীলীকোয়ল, সফেদ, কোয়ল, সংস্কৃতে অস্কোত, অশ্বরা, মারাঠীতে গোকর্ণী, পণঢরী, কণ্ঠী, গুজরাটীতে গরনী বলে। এছাড়া অপরাজিতাকে বলা হয় অশ্বখুরী, অশ্বাবাদিখুরী, বিষহন্ত্রী, সুপুত্রী, ভদ্রা, গর্দভী, নগপর্যায়কর্মী, মিতপুষ্পী, কটভী, শ্বেতা, আস্ফোতা, গিরিকনী, বিষ্ণুক্রান্তা, গবাক্ষী, শ্বেতভন্ডা, গবাদনী, শ্বেতস্পন্দা, দধিপুষ্পিকা, অদ্রিকর্ণী ইত্যাদি। লতানো গাছ এটি। নীল, সাদা ও বেগুনী রঙের ফুল হয়। ইংরেজিতে বলা হয় Butterfly Pea, Mussel Shell Climber, Blue Pea Vine, Pigeon Wings ইত্যাদি। 

অপরাজিতা ফুলের উৎপত্তি হয়েছে মালাক্কা দ্বীপপুঞ্জের টারনেটি (Ternete) থেকে। তাই বিজ্ঞানসম্মত নামে রয়েছে 'টারনেটি' শব্দটি। অপরাজিতার বিজ্ঞানসম্মত নাম হল Clitoria ternatea (Linn)। ভগাঙ্কুর বা ক্লিটোরিসের মতো অবয়বের জন্য অপরাজিতার গণের নাম Clitoria। এটি Papilionaceae পরিবারভুক্ত। কাজী নজরুল ইসলামের গানেও মেলে অপরাজিতার উপস্থিতি -- 'আমি বিজন বনের অপরাজিতা, আমার কথা কহি গানে...।'

পশ্চিমবাংলার বুকে তিন রঙের অপরাজিতা ফুল ফুটতে দেখা যায়। নীল, সাদা এবং বেগুনি। কোনওটি এক পাঁপড়ি যুক্ত, আবার কোনওটি দুই পাঁপড়ি যুক্ত। ফুলের ভেতরটা সাদা বা ঈষৎ হলুদ বর্ণের হয়। মোটামুটি প্রায় ২০ ফুট দীর্ঘ হয়। বহুবর্ষজীবী লতানে উদ্ভিদটি যেকোনো অবলম্বন পেলেই তরতরিয়ে জড়িয়ে বেড়ে ওঠে। নীল অপরাজিতার গাছ সাদা অপরাজিতার তুলনায় দ্রুত শাখা প্রশাখা ছড়াতে পারে। অপরাজিতা গাছে সারা বছর ধরেই ফুল পাওয়া যায়। রূপকথার গল্পে পরীদের আংটিতে অপরাজিতা ফুলের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। 

যজুর্বেদে (৩০/১১) পাই— ‘অনুত্তমাতে মঘবন্ নকি নু ন ত্বাবাহপরাজিতা। / ন জায়মানা নশতে ন জাপ যানি করিষ্যাকুহি প্রবৃদ্ধঃ'। নবপত্রিকার সাথে শ্বেত অপরাজিতা লতার বন্ধন দিতে হয়। এই সমষ্টি আসলে মা দুর্গার প্রতিনিধি। নবপত্রিকার নয়টি চারার অধিষ্ঠাত্রী একজন করে দেবী থাকেন। তবে অপরাজিতা অবশ্য সরাসরি নবপত্রিকার উদ্ভিদ নয়। 

স্কন্দপুরাণেও পাই অপরাজিতার নাম। সেখানে দেবী দুর্গার মূর্তির অন্য নাম ‘অপরাজিতা’। কথিত আছে যে আশ্বিনের শুক্লাদশমীতে দেবীকে ঈশান কোণে রেখে অপরাজিতা ফুল দিয়ে পূজা করলে যাবতীয় মনোবাসনা পূরণ হয়। তাই আজও শারদোৎসবে দুর্গাপূজার শেষকৃত্য সম্পন্ন হয় অপরাজিতা লতার বেষ্টনী বা বেড়ি এবং ফুলের দ্বারা। এসময় একে দেবীজ্ঞানে ডানহাতে বেঁধে রাখা হয়। শুশ্রুত সংহিতা, চরক সংহিতায় সাদা অপরাজিতার বিবরণ রয়েছে। এছাড়াও হারীত সংহিতা ও শার্ঙ্গধর সংহিতায় অপরাজিতার নানা ধরনের ব্যবহারের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। অথর্ববেদের রাজকল্পে উল্লিখিত হয়েছে অপরাজিতার কথা। কবি জীবনানন্দ দাশ লিখেছেন --  'অপরাজিতার মতো নীল হয়ে, আরো নীল হয়ে .... আমি যে দেখিতে চাই'। 
'অপরাজিতা' একটি বিদ্যার নাম এবং লতারও নাম। দু ধরনের অপরাজিতাবিদ্যা প্রচলন করেন তন্ত্রসাধকরা। একটি আধিভৌতিক এবং অন্যটি আধিদৈবিক। প্রথমটি হল 'নিদুলি' দেওয়া তথা গেরস্থকে ঘুম পাড়িয়ে দেওয়া। আর দ্বিতীয়টি হল কবচ, মাদুলি দেওয়া। শত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষা করার এক শিখাবন্ধনবিদ্যা বিশেষ হল -- 'অপরাজিতা'। শঙ্কর পাণ্ডুরঙ্গ পণ্ডিত সম্পাদিত 'বিক্রমোর্ব্বশীয়'তে (১৯০১)  পাই, 'অপরাজিতাং নাম শিখাবন্ধনবিদ্যাম্'। একপ্রকার যোগিনীর নামও অপরাজিতা। চতুর্দ্দশাক্ষরপাদ ছন্দের নামও অপরাজিতা। মহাকবি কালীদাসের 'শকুন্তলা'র সপ্তম অঙ্কের ২০ তম শ্লোকে মেলে অপরাজিতাবিদ্যা ও অপরাজিতা ফুলের কথা। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের 'অভিজ্ঞানশকুন্তলম্' এ আছে, "অপরাজিতা নাম ওষধি"। কৃত্তিবাসী রামায়ণে রয়েছে, "অতসী অপরাজিতা, যাতে দুর্গা হরষিতা"। যাইহোক, শ্মশানকালী পূজার উপকরণ হিসেবেও এই অপরাজিতা (নীল) গাছের তৈরি ‘বেড়ি’ প্রয়োজন হয়। মূল ঘটস্থাপনের ক্ষেত্রে এই অপরাজিতার তৈরি বেড়ির ওপরেই বসানো হয়। মুর্ছা রোগ, গলগণ্ড, ভূতোন্মাদ, স্বরভঙ্গ, খোস পাঁচড়া, গলক্ষত, মেধা বৃদ্ধি, ঘন ঘন প্রস্রাব, শুষ্ক কাশি, আধকপালি যন্ত্রনা, সম্ভোগ সমস্যা, ফাইলেরিয়া রোগের উপশমকারী হিসেবে অপরাজিতা লতার চাহিদা রয়েছে।


Post a Comment

0 Comments