জ্বলদর্চি

প্রাঙ্গণে মোর শিরীষ শাখায়/পঞ্চম পর্ব /আবীর ভট্টাচার্য্য চক্রবর্তী

প্রাঙ্গণে মোর শিরীষ শাখায়
পঞ্চম পর্ব

আবীর ভট্টাচার্য্য চক্রবর্তী


প্রতিটি সকালই আপন বৈশিষ্ট্যে সুন্দর। পাখির ডাকে, পুষ্প প্রস্ফুটনে যে অপরূপ সৌন্দর্য্য প্রকাশিত হয়,তার রসাস্বাদনে অনুভবী মনে শান্তির প্রলেপ পড়ে। কুয়াশালীন হেমন্তবেলার নতুন খেজুর গুড়ের সম্মোহনী স্বাদের মতোই সে যেন টানে জীবন বিলাসী মানুষজনেদের। 
সারারাত্রি জাগরণ-অস্বস্তির পরে এই যে হিমেল স্নিগ্ধতা অহনার মনপ্রাণ জুড়িয়ে দিচ্ছিলো, তা এক অনির্বচনীয় সুধাপরশে তার পার্থিব গ্লানি দূর করে দিচ্ছিলো যেন। 
বাইরে তখন ধীরে ধীরে সূর্য উঠছে, আকাশটি লালে লাল। শীতার্ত অবসন্নতা ভেদে উষ্ণতার আলিঙ্গনে জেগে উঠছে জীবন। 
 সুস্হতার আকাঙ্ক্ষায় জেগে উঠছে চক্রবর্তী পরিবারও।
আঙিনা জুড়ে রোদ পড়েছে, সোনালীরঙা আনন্দময় রোদ। কেটলীতে ও চায়ের কাপে তৃপ্তির টুংটাং… 
বাচ্চারা উঠোনময় ছুটে বেড়াচ্ছে, ওদের পড়াশোনা নিয়ে বকাবকি করার আজ কেউ নেই। বৌয়েরাও রান্নাশালে উনুনে আগুন দিচ্ছে, গতদিন রান্নাবান্না প্রায় কিছুই হয়নি, আজ কিছু মাছ ভাতের সামান্য আয়োজন করা প্রয়োজন। সর্বত্র ছড়িয়ে টুকিটাকি অনিন্দ্য জীবনায়ন… 
ওদিকে, পিসিমারও জ্ঞান ফিরছে, অতি ধীরে হলেও ওষুধের ক্রিয়ায় সাড়া দিচ্ছে শরীর, চেতনে-অবচেতনে ফিরে আসছে অতীত, কখনও বা বর্তমান। 
শিথিল দেহে বৃদ্ধার আধো ঘুম, আধো জাগরণে যেন খেলা করে যায় স্মৃতি ও বর্তমান। 
কবে যেন এমনই কোন শীতের সকালে জ্যাঠাইমার মুড়ি ভাজার উনুনের পাশে বসে আগুন পোহানোর কথা মনে পড়ে…
টাটকা মুড়ির গন্ধ;কুচিকাঠির নাড়াচাড়া,গরম বালুর মধ্যে ভাজা চাল ফেলে তুড়বুড়িয়ে মুড়ি হয়ে ওঠা…অবাক হয়ে দেখতো মেয়েটি। কাজ শেষে ঘেমে ওঠা মুখে জ্যাঠাইমার ডাক, 
-’ও তারা! কুসুমবীজ ক’টি এগিয়ে দে মা’!
গুটি গুটি কুসুম বীজের ঝুড়িটি এগিয়ে দিয়েও মাতৃহারা নাবালিকার দ্বিধান্বিত কন্ঠ, 
-’কুসুমবীজগুলো কার জন্য ভাজবে গো জ্যাঠাইমা!’
এখনও মনে পড়ে, ওর কথাক’টি শুনে জ্যাঠাইমার ফর্সা মুখটিও যেন হেসে উঠতো হলুদ মাখানো কুসুম বীজের মতো। ক্লান্তি ভুলে আদর করে বলতেন, -’বল দেখি, কার জন্য?’
ইতিমধ্যে খোলায় বীজ ফুটে উঠতো, সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়তো সারা রান্নাশালায়।বুকে সে সুগন্ধ ভরে তারা বলে উঠতো, 
-’আমার জন্য…আমার জন্য…’ 
এক অদৃশ্য স্নেহ বন্ধনে ভরে উঠতো মাতা-পুত্রী দুজনেরই অন্তর। 
🍂
তবে শুধু কুসুম বীজই নয়, জ্যাঠাইমা ভেজে দিতেন কাঁঠাল বীজ, কুমড়ো বীজ এমন কি তেঁতুল বীজও ওর আবদারে… 
তবে বাড়িতে দুধ মুড়ি খেয়ে বেরিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে কাঁচা তেঁতুল খেয়ে তুমুল বমি করলে আবার সেই জ্যাঠাইমার কাছেই বেধড়ক মার খাওয়ার কথাও মনে পড়ছে… উঃ!সে কি নৃশংস মার! মনে পড়ছে, মনে পড়ছে…জলছবির মতো ভেসে উঠছে সব। 

ইতিমধ্যে বিছানার পাশে এসে বসেছে আবার সেই স্নিগ্ধ ছায়া, যার উপস্থিতিতে বৃদ্ধা বিরজাসুন্দরী পাচ্ছিলেন জ্যাঠাইমার স্নেহ ঘ্রাণ। ঠিক বুঝতে পারছিলেন না, তবে কেউ যেন আবছা গলায় বললো কিছু কথা, হাতে গলায় স্পর্শ করলো কোমলভাবে, মুখে ঢেলে দিলো ওষুধ; কপালে জলপটি। 
ধীরে ধীরে চেতন ফেরে। শোনেন ভাইপো-ভাইপো বৌ, নাতিপুতিদের উদ্বেগ, ডাকাডাকি; ডাক্তারবাবুর গলা… কিছু বলতে ইচ্ছে হয়; কিন্তু বলার আগেই তলিয়ে যান কোন অতলে। 
আবার অন্য কোথাও পাখি ডাকে, ফুল ফোটে, গরমের দুপুরে হুটোপুটি খেলায় মাতে গ্রামের সব ছেলেমেয়েরা… কি কি যেন তাদের নাম, কি কি যেন তাদের পরিচয়… ঐ তো, কুমু, রেবা, তিলুদের সাথে খেলনাবাটি খেলছেন তারা;ছোট্টো ছোট্টো হাঁড়ি-কুড়ি-হাতা-খুন্তি-তাওয়া; মেলা থেকে কিনে দিয়েছেন জ্যাঠাইমা। আবার কখনও অগ্রহায়ণ মাসের রবিবার রবিবার ইতুপুজোয় নেমেছেন সকলে। সক্কাল সক্কাল স্নান সেরে ইতুখোলায় জল ঢেলে সুর করে সেই মন্ত্র উচ্চারণ…
'অষ্টচাল অষ্ট দূর্বা কলস পত্র ধরে 
ইতু কথা এক মনে শুন প্রাণ ভরে
 ইতু দেন বর, ধনে জনে বাড়ুক ঘর’

সেসব আওড়াতে আওড়াতে খেসারি ক্ষেতে, ছোলাক্ষেতে কড়াই ছিঁড়ে যাওয়ার গল্পও গুনগুনিয়ে চলতো, নদীপারে ইতু উদযাপনের দিন ফিষ্টির গল্পও হোত; বড়োরা বুঝতেও পারতো না। 
তবে এই সব শক্তপোক্তো কাজে কখনো কখনো ছেলেদেরকেও নিতে হতো, পটিয়ে পাটিয়ে;কারন অতো গায়ের জোর তো মেয়েদের ছিলো না। তবে মনে পড়ে, এখনকার মতো তাঁদের ছোটবেলায় শিশুরাও লিঙ্গবৈষম্য স্বীকার করতো, ছেলেরা সাধারণত মেয়েদের সঙ্গে মিশতো না।
 তবে একমাত্র ব্যতিক্রম ছিলো বিশু। হো’লই বা ছেলে, তার নাকি ওদের সঙ্গে খেলতে, ওদের সঙ্গে মিশতে খুব ভালো লাগতো। পরে জেনেছিলেন,তার কারণ ছিলো ভিন্ন;তবু সেই সব আলো আলো দিনে, কড়াই ক্ষেতে শুঁটি ছিঁড়তে, পেয়ারা পাড়তে,ঝড়ের রাতে আম কুড়োতে, খেলনা বাটি খেলার জল এনে দিতে, ফিষ্টির কাঠকুটো জুটিয়ে দিতে, পুতুলের বিয়ের সময় জিনিসপত্র বয়া-বয়ি করতেও তো একজনকে লাগে। তাই ও থাকতো;খেলনাপাতিতে ও ছিলো ‘আব্বুলিস’। এমনকি, সবাই মিলে কবাডি বা বৌ-বসন্ত খেলার সময়েও ও মেয়েদের দলেই থাকতো। ও তাদের বেশ ভরসার, বেশ প্রিয় বন্ধু ছিলো ছোটবেলায়। পরে বড়ো হওয়ার পরে, বিয়ে হওয়ার পরে, বিশুর সঙ্গে ভাবসাব কমে যায়। শুধু একবার, তখন ‘ব্যাধবা’ হয়ে বাপের ভিটেতে ফিরেছেন বেশ কয়েকবছর হলো, এক দুপুরে পুকুরঘাটে তরুণী বিরজার হাত জড়িয়ে কিছু বলতে চেয়েছিলো, আমল দেননি ব্রাহ্মণ বাড়ির বিধবা;তার পরে কোথায় যেন হারিয়ে যায়… মনে রাখেননি তাকে। শুনেছিলেন কানাঘুষোয়, বৌয়ের সঙ্গে নাকি তার বনিবনা হয়নি, ঝগড়াঝাটি;সে নাকি ঠিকঠাক পুরুষই ছিলো না… ওদিকে পাড়ার মেয়ে-বৌরা অন্য মন্দ কথা বলতো বিশুর নামে। 
সে যাই হোক, বিরজাসুন্দরীর সেসময় ওসবে সময় নষ্ট করার মতো সময় ছিলো না, তাঁর হাতে ছিলো নতুন পুতুল। ছোট দাদার বৌটি পরপর দুটি ছেলের মা হয়ে পড়াতে ছোটটিকে নিয়ে ব্যস্ত থাকতো। মেজ বাচ্চাটির দায়িত্ব নিয়েছিলেন তিনি। সবার চোখ বাঁচিয়ে ছোটদের বরাদ্দ দুধ-সাবুসেদ্ধর মধ্যে আরও একটু বেশি দুধ মিশিয়ে, পুকুর থেকে গেঁড়ি-গুগলী তুলে-ছেঁচে-সিদ্ধ করে খাইয়ে, হাঁস পুষে উঠোনপারের ধানসেদ্ধ উনুনে তা সিদ্ধ করে দুবলা বাচ্চাটাকে খাইয়ে আবার স্নান সেরে আসতে আসতেই তাঁর দিন কখন পেরিয়ে যেত মনেও পড়েনা। আসলে, তাঁর নিরর্থক জীবনটি কখন যে কতো অকাজে অথবা ভালো কাজে কিভাবে কেটে গেল, তার হিসেব মেলা ভার… 
শুধু দিনশেষে মনে পড়ে, দুপুরের খাওয়া দাওয়ার অবসরে, দাওয়ার শিরীষ গাছটির পেকে যাওয়া হলুদ ঝিরি ঝিরি পাতাগুলি যখন আলগোছে ঝরে পড়তো বৃদ্ধা বিরজাসুন্দরীর মাথায় গায়ে, মনে পড়তো অনেক, অনেক দিন আগে এখানেই একদল বাচ্চা ছেলেমেয়ে খেলতো, 
‘এলাটিং বেলাটিং আইলো, কিসের খবর আইলো
রাজামশাই একটি বালিকা চাইলো,
কোন বালিকা চাইলো? ‘... সারিবদ্ধ খেলা গান। 
 আসলে, ব্যর্থ হোক, সফল হোক, জীবনভ’র মানুষ হয়তো এভাবেই তার শৈশবকে মনে রাখে;অমলিন,সুন্দর,অবিকৃত শৈশব…

সংগ্রহ করতে পারেন 👇

Post a Comment

0 Comments