জ্বলদর্চি

ভোলগা নদীর খোঁজে – ৩৮/বিজন সাহা


লবাচেভস্কির আবক্ষ মূর্তি

ভোলগা নদীর খোঁজে – ৩৮

বিজন সাহা 

আধুনিক তাতারস্তান 

ঘোরার ফাঁকে ফাঁকে কথা হয় দেমিদ আর দিলীপের সাথে। বিভিন্ন প্রশ্ন দিলীপের মনে। যতদূর পারি উত্তর দেই।  কাজান এখন আমার প্রিয় শহরগুলোর অন্যতম। এটা মূলত এখানকার বন্ধুদের কারণে। তাছাড়া অনেক বার আসার ফলে এ শহর সম্পর্কে, এখানকার মানুষদের সম্পর্কে একটা ধারণাও হয়েছে। কথায় কথায় দিলীপ জিজ্ঞেস করল 

তুমি তো এখানকার অতীত সম্পর্কে অনেক গল্প করলে। ইভান গ্রজনির কাজান বিজয়, রানী সিউইউম্বিকে আরও কত কী? বর্তমান সম্পর্কে কিছু বল শুনি। 

আমি আমার অভিজ্ঞতা থেকে এই শহর সম্পর্কে বলি। প্রথম এখানে আসি আমি ২০০৭ সালে। সেবারের ভ্রমণ ছিল ট্র্যাঞ্জিট। এখানে কয়েক ঘণ্টা কাটিয়ে আমরা ইয়ালচিকে গেছিলাম। সে গল্প তো তোমাকে করেছি। তবে যেহেতু এক বা দুই বছর পর পর আসি তাই পরিবর্তনগুলো বেশ চোখে পড়ে। সেই ২০০৭ থেকে আজ পর্যন্ত কাজানের পরিবর্তন নিজের চোখে দেখেছি। সোভিয়েত আমলে যেখানে অধিকাংশ এলাকা কম বেশি উন্নত বা একই রকম ছিল, দেশের প্রায় সমস্ত জনবসতি সভ্যতার আলোয় আলোকিত হয়েছিল, নতুন রাশিয়ায় সবাই সেটা ধরে রাখতে পারেনি। মস্কোর পাশে তভেরের অনেক কালখোজ, সাবখোজ মানে যৌথ খামার বন্ধ হয়ে গেছে। গ্রাম তো বটেই অনেক শহর পর্যন্ত জনশূন্য হয়ে গেছে। যদি ভুলে না যাও সেসব পরিত্যাক্ত খামার আমি তোমাকে পথে দেখিয়েছি। সেদিক থেকে মনে হয় তাতারস্তান, বিশেষ করে কাজান দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে। আর এর পেছনে রয়েছে তাতারস্তানের প্রথম প্রেসিডেন্ট মিন্তিমির শাইমিয়েভ। যদিও স্তালিন বলেছেন কোন লোকই অপরিবর্তনীয় নয়, তবে অনেক ক্ষেত্রে মনে হয় সেটা ঠিক নয়। নব্বুইয়ের দশকের শুরুতে যখন ইয়েলৎসিন বিভিন্ন প্রদেশের নেতাদের বলেন যতটুকু সার্বভৌমত্ব হজম করতে পার নিয়ে নাও, তখন রাশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলের নেতারাই সে পথে চলতে শুরু করেন। এদের অন্যতম ছিলেন চেচনিয়ার জেনারেল দুদায়েভ। এর পরিণাম চেচনিয়ায় দু’ দুটো যুদ্ধ। সে সময় উড়ালের সভেরদলভস্ক বা ইয়েকাতেরিনবুরগ, তাতারস্তান - এসব জায়গায়ও বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন বেশ শক্তিশালী ছিল। ইয়েকাতেরিনবুরগে এমনকি স্থানীয় ব্যাংক নোট পর্যন্ত ছাপানো হয় সেখানকার গভর্নর এদুয়ারদ রোসেলের উদ্যোগে। অর্থাৎ এক ধরণের কেন্দ্রবিমুখী আন্দোলন শুরু হয় বিভিন্ন জায়গায়। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরে রাশিয়ার ভাঙ্গন তখন আর অসম্ভব বলে মনে হয় না। আসলে পশ্চিমা বিশ্ব সে ব্যাপারে নিশ্চিত ছিল, রাশিয়া যে কয়েক খণ্ডে বিভক্ত হবে সে ব্যাপারে তাদের কোন সন্দেহ ছিল না, কবে সেটা হবে এটাই ছিল তাদের মূল প্রশ্ন। তাঁরা এমনকি পুতিনকে সে ব্যাপারে বলেছেন বলে পুতিন কিছুদিন আগে জানিয়েছেন। সেই সময় যে কিছু প্রভাবশালী নেতা রাশিয়াকে ঐক্যবদ্ধ রাখার জন্য দৃঢ় ভূমিকা পালন করেন তাদের একজন ছিলেন মিন্তিমির শাইমিয়েভ। এ ধরণের নেতারা অধিকাংশই ছিলেন বিভিন্ন শিল্পের সাথে জড়িত। যাদের বলা যায় পার্টির আমলাতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নয়, শ্রমিক হিসেবে কাজ করে নিজেদের যোগ্যতা বলে শীর্ষে উঠেছেন। ফলে তাঁরা ভালোভাবেই বুঝতেন রাশিয়ার ভাঙ্গনের সাথে সাথে ভেঙ্গে পড়বে শিল্প, ভেঙ্গে পড়বে অর্থনীতি। রাজনীতি নয়, রিয়াল অর্থনীতি সম্পর্কে প্র্যাক্টিক্যাল জ্ঞান থাকার কারণেই এদের মত নেতারা সার্বিক ভাবে চেষ্টা করেছেন দেশের ঐক্য বজায় রাখতে। তবে এরা কেউই নিজের এলাকার ক্ষতি করে সেটা করেননি, উল্টো কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে নিজ এলাকার উন্নয়নে যতদূর সম্ভব সুবিধা আদায় করে নিয়েছেন। 

কাজানে পুশকিনের মূর্তি

মনে আছে ২০০৯ সালে যখন আমার ক্লাসমেট রুস্তামের সাথে দেখা করি তখন ও রুশদের দখলদার বলে উল্লেখ করে যদিও ছাত্রজীবনে একেবারেই অন্য রকম ছিল। কিন্তু এরপর থেকে অনেক কিছু বদলে গেছে, এরপর বেশ কয়েকবার ওর সাথে দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে, কিন্তু এ ধরণের কথা আর শুনিনি। এর পেছনে মিন্তিমির শাইমিয়েভের বিজ্ঞ রাজনীতি, যিনি তাতারদের বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন যে রাশিয়ার সাথে থেকেই শুধু তারা জাতি হিসেবে নিজেদের পরিপূর্ণ বিকাশ করতে পারবে।

🍂

সোভিয়েত আমলে তো বটেই এখনও রাশিয়া চেষ্টা করে দেশের শিল্প বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিতে। এখন যে নতুন করে এভিয়েশন ইন্ডাস্ট্রি গড়ে উঠছে সেটাও হচ্ছে বিভিন্ন এলাকায়। সোভিয়েত আমলে দেশ ছিল এদিকে স্বয়ংসম্পূর্ণ। যাত্রীবাহী প্লেনের তো বটেই এমনকি যুদ্ধ বিমানের বিভিন্ন পার্টস তৈরি হত ইউক্রেনে। আসলে সোভিয়েত পরবর্তী ইউক্রেনের এভিয়েশন ইন্ডাস্ট্রি সহ প্রায় সব শিল্প ও কৃষি মূলত রাশিয়ায় তাদের প্রোডাক্ট সাপ্লাই দিয়েই টিকে ছিল। যখন থেকে ইউক্রেন রাশিয়ায় বিমানের পার্টস সরবরাহ বন্ধ করেছে, ধীরে ধীরে শিল্প ধ্বংস হয়ে গেছে। আসলে দেশ তো শুধু ভূমি নয়, দেশ তার নদ-নদী, পাহাড় পর্বত, খনিজ সম্পদ, আর সবার উপর মানুষ। এসবের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে জাতি, দেশের অর্থনীতি। আমাদের সব দেশে ধর্মীয় কারণে বিভিন্ন জাতি ও ধর্মের লোকজনের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক তেমন গড়ে ওঠে না। সোভিয়েত আমলে সেটা বলতে গেলে শূন্যের কোঠায় নেমে যায়। কত যে মিশ্র পরিবার গড়ে ওঠে, কত মানুষ যে আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ হয় সেটা কেউ কোন দিন হিসেব করে বের করতে পারবে কিনা সন্দেহ। শরীরে যেমন কোন শিরা উপশিরা ব্লক করলে মানুষের মৃত্যু হয় ঠিক তেমনি পরস্পরের সাথে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত বিশাল শিল্প ব্যবস্থার কোন একটা স্থাপনা অকেজো হয়ে গেলে পুরা ব্যবস্থাই ভেঙে পড়ে। ভেঙে পড়ে সামাজিক বন্ধন। মিন্তিমির শাইমিয়েভ এটা ভালোভাবেই বুঝেছিলেন। তার উপর ছিল চেচনিয়ার অভিজ্ঞতা। আর সেটা বুঝেই তিনি তখন থেকেই কেন্দ্রবিরোধী শক্তিকে শান্ত করেন। বুঝতে দেন যে একমাত্র শক্তিশালী রাশিয়ার ভেতর থেকেই তাতারস্তান উন্নতির শিখরে পৌঁছুতে পারে। আমরা যদি বর্তমান ইউক্রেন বা বাল্টিকের দেশগুলোর দিকে তাকাই তাহলে বুঝতে পারব শাইমিয়েভ কতটা দূরদৃষ্টি সম্পন্ন ছিলেন। কারণ স্বাধীনতা লাভ করলেই হয় না, সেটাকে টিকিয়ে রাখতে হয়। সেজন্য দরকার উৎপাদন,  দরকার কাঁচামাল আর সবচেয়ে বড় কথা বাজার। ইউরোপ ও আমেরিকার উস্কানিতে এসব দেশ রাশিয়ার সাথে সম্পর্ক প্রায় ছেদ করে হারিয়েছে স্বল্প মূল্যে কাঁচামালের আরত আর তৈরি পণ্য বিক্রি করার বাজার। আজ সোভিয়েত আমলে সবচেয়ে উন্নত এলাকা থেকে ইউক্রেন আর বাল্টিকের দেশগুলো পরিণত হয়েছে দরিদ্র্য দেশে যাদের চলতে হয় অন্যদের অনুদানে আর অপেক্ষাকৃত স্বল্প বেতনে ইউরোপের উন্নত দেশগুলোতে শ্রমিক সরবরাহ করে।    

এদের জাতিগত সমস্যা নেই? 


নেই, সেটা বলব না, তবে কেন্দ্র থেকে চেষ্টা আছে সেটাকে নিয়ন্ত্রণে রাখার। সেটা করা হয় শক্তি প্রয়োগ করে নয়, বরং বিভিন্ন জাতিকে বুঝতে দিয়ে যে এটা তাদেরও দেশ। বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে যার বীজ রোপিত হয়েছিল ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে, আর সঠিক ভাবে বললে ১৯৪৮ সালে যখন জিন্নাহ একমাত্র উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে ঘোষণা করেন। সোভিয়েত আমলে প্রতিটি রিপাবলিকে তো বটেই, এমনকি রাশিয়ার বিভিন্ন প্রদেশেও স্থানীয় ভাষায় শিক্ষা দেয়া হয়। বর্তমান রাশিয়ায় সেই পদ্ধতি এখনও সক্রিয়। কেউ চাইলে রুশ স্কুলে পড়তে পারে। রুশ ভাষা সব জায়গায় আছে, তবে সেটা এসব রিপাবলিকে দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে। এটা রাশিয়ার সব মানুষের পরস্পরের সাথে মনের ভাব আদান প্রদানের ভাষা। এখানে দাগিস্তান বলে এক রিপাবলিক আছে, কাস্পিয়ান সাগরের তীরে এই রিপাবলিকে শতাধিক জাতি বাস করে। এমনকি পাশাপাশি দুই পাহাড়ি গ্রামের মানুষ একে অন্যের ভাষা বুঝতে পারত না বলে পরস্পরের সাথে ভাবের আদানপ্রদান করতে পারত না। রুশ ভাষা তাদের সেই সুযোগ দিয়েছে। এসব ছোট ছোট জাতির অনেক কবি সাহিত্যিক রুশ ভাষার বদৌলতে বিশ্বের দরবারে পরিচিতি পেয়েছেন। দাগিস্তানের লেখক রাসুল গামজাতভ তার বড় প্রমাণ। অথবা কিরঘিজিয়ার লেখক চেঙ্গিস আইতমাতভ।   

কাবান হ্রদ

রাস্তায় ঘুরতে ঘুরতে দিলীপকে দেখালাম বিভিন্ন স্থাপনার নেমপ্লেট। সেখানে প্রথমে তাতার, নীচে রুশ ভাষায় লেখা আছে ঠিকানা বা স্থাপনার নাম। একই জিনিস দেখেছিলাম চেবোকসারিতে, প্রথমে চুভাশ আর নীচে রুশ ভাষায় লেখা। দূর থেকে দেখালাম কাজান বিশ্ববিদ্যালয় আর অবজাভেটরি। মস্কো ও সাঙ্কত পিতেরবুরগের পর কাজান বিশ্ববিদ্যালয় সব সময় বেশ নামকরা ছিল। লেনিনের এখানে পড়ার কথা আগেই বলেছি। এখানেই অনেক দিন কাজ করেছেন বিশ্বখ্যাত জিওমিটার বা জ্যামিতিবিদ লবাচেভস্কি। ইউক্লিডের পর তিনিই প্রথম নতুন ধরণের জ্যামিতির কথা বলেন। এখানে কাজ করেছেন পেত্রভ যিনি কাজান বিশ্ববিদ্যালয়ে জেনারেল রিলেটিভিটির উপর রাশিয়ার একমাত্র ডিপার্টমেন্ট স্থাপন করেন। আছে বিভিন্ন রকমের কারখানা। এখানকার আভিয়েশন ইনস্টিটিউট খুবই নামকরা। সবচেয়ে বড় কথা কাজান খুব ডায়নামিক শহর। প্রতিবার এখানে এসে সেই প্রমাণই পাচ্ছি।   

কাজানের ছবি <br><br>

http://bijansaha.ru/albshow.html?tag=85

সংগ্রহ করতে পারেন 👇



Post a Comment

0 Comments