বিজ্ঞানের অন্তরালে বিজ্ঞানী — ৯৩
ফাইনম্যান-প্রেম :
পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যা
(১)
অমর প্রেম-কথা : আরলিন গ্রীনবাম ও রিচার্ড ফাইনম্যান :
অক্টোবর ১৭, ১৯৪৬
D'Arline,
হে প্রিয়তমা, তোমাকে বন্দনা করি আমি।
একথা শুনতে তুমি পছন্দ কর – আমি জানি। অবশ্য তুমি পছন্দ কর বলেই আমি কিন্তু শুধু শুধু সেকথা লিখছি না। আমি লিখেছি, কারণ তোমাকে সে-কথা লিখে ভেতর থেকে আমি উষ্ণতা অনুভব করি।
একটা ভয়ঙ্কর সুদীর্ঘকাল! প্রায় বছর দুয়েক আগে শেষ চিঠি লিখেছিলাম তোমাকে। আমাকে তুমি ক্ষমা করবে, জানি। কারণ, আমি কেমন তুমি ভালো মতন জানো। ভীষণ একগুঁয়ে আর খুব বাস্তববাদী আমি; এবং ভেবেছিলাম লেখার কোনও অনুভূতি নেই আমার।
প্রিয়তমা অর্ধনারীশ্বর হে, কিন্তু এখন আমি জানি – যে কাজ সম্পাদন করতে বিলম্ব হয়েছে, তা করার সঠিক সময় এটা। অতীতে অনেক কাজ করেছি আমি। তোমাকে বলতে চাই – আমি তোমাকে ভালোবাসি। ভালোবাসতে চাই তোমাকে। আজীবন তোমাকে ভালোবাসবো আমি।
হয়তো মনের সংগোপনে আমার বুঝতে অত্যন্ত দুস্কর হয়ে যায় – তোমার মৃত্যুর পরে তোমাকে ভালোবাসার কী অর্থ! কিন্তু আমি এখনও স্বস্তি ফিরে পেতে চাই আর তোমার যত্ন নেওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করি। মনেপ্রাণে আমি চাই তুমি শুধু আমাকে ভালোবাসো এবং আমার যত্ন নাও। গুচ্ছ গুচ্ছ সমস্যা তোমার সঙ্গে আলোচনা করতে চাই। এখনও অব্দি এক মূহুর্তের জন্যও আমার বিশ্বাস হয়নি যে আমরা একসঙ্গে সে-গুলো আর করতে পারব না। আমরা কী কী করব? একসাথে আমরা দুজনে কাপড় বোনা কিংবা চীনা ভাষা শেখা শুরু করেছিলাম, মনে পড়ে? অথবা একখানা মুভি প্রজেক্টার তৈরির প্রকৌশল আয়ত্ত করেছিলাম! আচ্ছা, এখন কি কিছু করতে পারি না আমি? নাহ! পারিনি। তোমাকে ছাড়া আমি ভীষণ একা। তুমি ছিলে আদর্শ গৃহিণী আর আমাদের যাবতীয় ঝুঁকিপূর্ণ বন্য অ্যাডভেঞ্চারের সাধারণ উদ্দিপক।
যখন অসুস্থ ছিলে, তুমি খুব দুঃখ পেতে। কারণ, তোমার যা-কিছু তুমি আমাকে দিতে চেয়েছিলে কিংবা ভাবতে হয়তো আমার খুব দরকার, সেসব দিতে পারতে না তুমি। আমি বলতাম, কোনও প্রয়োজন নেই। তুমি উদ্বিগ্ন হয়ো না, প্রিয়ে। এখন কীভাবে বলব যে তোমাকে খুব ভালোবাসতাম আমি! এবং এটা দিনের আলোর মত পরিষ্কার একটা ঘটনা – হয়তো তুমি আমাকে এখন কিছুই দিতে পারবে না; তবুও তোমায় খুব ভালোবাসি আমি, যেহেতু আমার অন্য কাউকে ভালোবাসার পথে শুধু তুমি দাঁড়িয়ে রয়েছ। আমিও চাই – ওই পথে শুধু তুমি দাঁড়িয়ে থেকো। তুমি মৃত, অথচ জীবিত অন্য কারও চেয়ে তুমি অনেক বেশি সুন্দর।
আমি নিশ্চিত জানি, আমাকে নিরাপদে রাখবে তুমি। কারণ, আমি বোকার বেহদ্দ এবং তুমি আমার সম্পূর্ণ মঙ্গল চাও। আমাকে কখনও আমার বোকামির রাস্তায় চলতে দিতে চাওনি। তুমি শুনলে অবাক হবে, বাজি রেখে বলছি, হে প্রিয়ে – দুবছর পরেও তুমি ব্যতিত একজনও মেয়েবন্ধু নেই আমার! কিন্তু ডার্লিং, এই ব্যাপারে – তুমি কিংবা আমি – কেউই কোনরকম হেল্প করতে পারব না। অবশ্য আমি একথা বিশ্বাস করি না। অনেক মেয়ের সঙ্গেই আমার দেখা সাক্ষাৎ হয়েছে। তাদের অনেকেই অসম্ভব সুন্দরী। বুদ্ধিমতী। এবং একলা থাকা আমার পছন্দ নয় ইত্যাদি ইত্যাদি। এত সবের পরেও বড়জোর দুই কিংবা তিনবার সাক্ষাতের পর সবাইকে ধূসর ছাই মনে হয়েছে আমার। আমার পুরো ভূবন জুড়ে শুধু তুমি, শুধুই তুমি ছড়িয়ে রয়েছো। তুমি শাশ্বত। চিরন্তন। তুমি চরম বাস্তব।
আমার প্রিয়তমা অর্ধাঙ্গিনী, আমি তোমাকে পূজা করি।
আমার পত্নীকে আমি খুব ভালোবাসি। অগ্নি সাক্ষী রেখে বিয়ে করা আমার একমাত্র সহধর্মিণী আর বেঁচে নেই!
ইতি
তোমার রিচ
ঠিকানা — আমাকে ক্ষমা কর, প্রিয়ে। চিঠিটা ডাকে পোস্ট করা হয়নি। কিন্তু, আমি যে তোমার নতুন ঠিকানা জানি না, ডার্লিং!"
পত্রলেখক বিশ্ববিশ্রুত বৈজ্ঞানিক রিচার্ড ফাইনম্যান (১৯১৮–১৯৮৮)। ডাক নাম 'ডিক'। সব রিচার্ড-এরই ডাক নাম হয় ডিক, ঠিক যেমন সব কানাইলালের ডাক নাম কানু। ফাইনম্যান ছিলেন অদ্ভুত ফুর্তিবাজ। দুষ্টুমিতে ভরা। একেবারে ছেলেমানুষ। বিভিন্ন রকম ধাঁধা সমাধানে সিদ্ধহস্ত, পাকা মাথা। বিশ্ববিখ্যাত নোবেল লরিয়েট বিজ্ঞানীদের মুখের উপর যখন তখন বলে দিতে পারতেন — 'কী বকছেন স্যার পাগলের মতো!'। 'পাগলের মতো ' শব্দ দুটো ছিল তাঁর প্রতিবাদের বাঁধা স্বর। মুদ্রাদোষ!
এ হেন মার্কিন পদার্থবিজ্ঞানী রিচার্ড ফাইনম্যান কোয়ান্টাম বলবিদ্যার পথ ইন্টিগ্রেল ফর্মুলেশন, কোয়ান্টাম তড়িৎ-গতিবিজ্ঞান তত্ত্ব এবং অতিশীতলকৃত তরল হিলিয়ামের চরমপ্রবাহমানতা ক্রিয়াকৌশল ব্যাখ্যা করেছেন। কণা পদার্থবিজ্ঞানে কাজের জন্য বিশ্ব জুড়ে খ্যাত হয়েছেন। কোয়ান্টাম তড়িৎ-গতিবিজ্ঞান তত্ত্ব আবিষ্কারের স্বীকৃতি স্বরূপ ফিজিক্সে ১৯৬৫ সালে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। মৃত্যুর দীর্ঘ ষোলো মাস পরে স্বর্গবাসী পত্নীকে লেখা ভালোবাসার চিঠিখানা প্রথিতযশা বৈজ্ঞানিক রিচার্ড ফাইনম্যানের অবিনশ্বর প্রেমের জ্বলন্ত উদাহরণ।
🍂
আরও পড়ুন 👇
(২)
দিনগুলি মোর সোনার খাঁচায়...
নিউ ইয়র্কের এক মফস্বল টাউন ফার-রকঅ্যাওয়ে। শান্ত। নিরিবিলি। সাজানো-গোছানো এক শহর। শহরের দক্ষিণ প্রান্তে আটলান্টিক মহাসাগর। বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে সমুদ্র তট। তীর ভূমিতে গুচ্ছের ছোট নৌকা, বোট বাঁধা। এ হেন টাউনের মাঝখানে নুড়ি কাঁকরের উপর রেলগাড়ির পাত বিছানো। লাইনটি ছোট্ট টাউনকে সমান দুটি খণ্ডে ভাগ করেছে। এ হেন শহরে রেললাইনের দুপাশে দুই বন্ধুর বাড়ি। মিনিট পাঁচ কিংবা দশেকের হাঁটাপথ। অভিন্ন হৃদয় দুই বন্ধু রিচি এবং এলমার। রিচির চেয়ে বছর খানেক বড় এলমার। দুজনে ফার-রকঅ্যাওয়ে হাইস্কুলে একই ক্লাসের স্টুডেন্ট। প্রায়শই গণিত নিয়ে দুজনের চুলচেরা বিশ্লেষণ চলে। এদিকে, দীর্ঘ সময় গণিত কিংবা বিজ্ঞান আলোচনায় হাঁপিয়ে ওঠে রিচি। মন ছটপট করে। খেলতে ইচ্ছে হয়। কিন্তু বন্ধু বাড়িতে রিচির খেলার সঙ্গী কে হবে? সাড়ে তিন বছরের ছোট এক ভাই রয়েছে এলমার-এর। নাম জোসেফ। যখন খেলতে ইচ্ছে করত, জোসেফের সঙ্গে 'কিক দ্য ক্যান' খেলায় মেতে উঠত রিচি। মাঝে সাঝে ড্রাম বাজায় দুজনে। ছোট্ট জোসেফ ড্রাম বাজানোয় রীতিমতো ওস্তাদ। জোসেফের কাছেই রিচির ড্রাম বাজানোয় হাতেখড়ি। প্রথম প্রথম হাত দিয়ে, পরে শক্ত কাঠির সাহায্যে। টমটম, টম-ড্রাম, বঙ্গো–হরেক রকমের ড্রাম বাজিয়ে ভীষণ আনন্দ পেত রিচি। তখন থেকেই তারা 'ট্র্যাপ ড্রামারস' (Trap Drummers) নামে খ্যাত। জোসেফ তো বিভিন্ন ব্যান্ড, এমনকি অর্কেস্ট্রাতে ড্রাম বাজাতে সিদ্ধহস্ত। সেই থেকে সুন্দর সময় কাটাত জোসেফ ও রিচি। ছোট ছোট সন্তানদের গাঢ় বন্ধুত্বের ঢেউ আছড়ে পড়ে দুই পরিবারে। পারিবারিক সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। রিচির মা লুসিলি ফাইনম্যান এবং এলমার-জোসেফের মা এভা হেলার-এর মধ্যে জমাট বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে অতঃপর। সময়টা ছিল ১৯২০-র শেষ ভাগ ও ১৯৩০-এর দশক।
মা এভা হেলার-এর সঙ্গে দুই ভাই এলমার ও জোসেফ (বামদিকে)
শহরের এক বহুতল আবাসনে, লোকে তখন বলত 'গুহা' (Den), থাকত রিচির বাবা মেলভিল, মা লুসিলি, বোন জোয়ান এবং সে নিজে। সব মিলিয়ে চারজনের সংসার। দুই কামরার এত অল্প পরিসরে হাঁপিয়ে ওঠে রিচি। সেজন্য কিশোর রিচির দিনের অধিকাংশ সময় কাটত হেলার হাউসে; এলমার ও জোসেফের সান্নিধ্যে। এলমারদের রয়েছে তিন কামরার নিজস্ব বাড়ি। বাড়ির সামনে প্রসস্থ উঠোন। গাছগাছালি ঘেরা চারপাশ। তিন বেডরুমের একটাতে রয়েছে একখানা স্টাডি-ডেস্ক। তার সঙ্গে পড়াশোনার বইপত্র, গুচ্ছের খাতা, কাগজ, কলম ইত্যাদি। সেখানে লেখাপড়ায় মশগুল থাকত এলমার, রিচি ও জোসেফ। প্রায় দিন রাতের খাবার খেয়ে বাড়ি ফেরে রিচি। সে ডিনার সেরে বাড়ি ফিরবে কি না – এ নিয়ে তিনজনে বাজি ধরত এবং খুব মজা পেত। সপ্তাহান্তে সেখানে রাত্রিযাপন করে রিচি; কখনও সখনও। MIT-তে পড়তে গিয়ে তার এ অভ্যাসে ছেদ পড়ে।
আটলান্টিক মহাসাগরের কোলে অপরূপ বিচ সমৃদ্ধ ফার-রকঅ্যাওয়ে শহরের উত্তরে আড়াই মাইল দূরে পাশের টাউন সিডারহার্স্ট। আরলিন গ্রীনবামের বাড়ি সেখানে। কিশোর বয়সে হেলার হাউসে অবাধ যাতায়াত ছিল আরলিনের। মূলত ভ্রাতৃপ্রতিম জোসেফের কাছে নৌকা চালনা শিখতে যেত সে। কিন্তু তারা বোট কোথায় পেত? কীভাবে মিলত সেগুলো?
ফার রকঅ্যাওয়ে বিচের আশেপাশে মাছ ধরার বোট ভাড়া দেওয়ার অনেক জায়গা। সেখানে ডিঙি বোট থেকে নৌকা সস্তায় ভাড়া দেওয়া হয়। বোটগুলো সব স্টিলের তৈরি। বোটে চড়ে লোকজন তীরের আশপাশে অগভীর সমুদ্রে মাছ ধরে বেড়ায়। সমুদ্রে মাছ ধরতে ধরতে একসময় তারা ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পড়ে। ক্লান্ত অবসন্ন লোকগুলো ফিসিং স্টেশনে বোটগুলো ফেরত না দিয়ে তারা বিচে ফেলে রেখে বাড়ি চলে যায়। এলাকার ছেলে ছোকরার দল সেগুলো নিয়ে খেলা করে। সমুদ্রে, বিচে দাঁড় টানে। তীরে ফেলে রাখা এমনই কোনো বোট নিয়ে আরলিনের সঙ্গে সমুদ্রে পাড়ি দেয় জোসেফ। দাঁড় কীভাবে বাইতে হয় শিখিয়ে দেয় বয়সে বড় আরলিনকে। দাঁড় টানতে টানতে একসময় ক্লান্তি ভর করে তাদের। তখন বোটগুলোকে তারা পুনরায় তীরে ফেলে দিয়ে বাড়ি রওনা হয়। রাতের বেলা, আকাশে যখন ঝকমক করে আলোকবর্ষ দূরের তারাগুলি, তখন সেগুলো ফেরত নিয়ে যায় বোট মালিক।
এভাবেই একদিন দাঁড় টানায় পারদর্শী হয়ে ওঠে আরলিন। অবশ্য দাঁড় বাওয়ার নেশা চেপে বসেছিল তার মাথায়।
(৩)
প্রথম দেখা :
সুন্দর পোশাকে ইতস্তত ঘুরে বেড়ায় কচিকাঁচার দল। রঙ বেরঙের আলো আর রঙিন ফুলে ঘরখানা সাজানো গোছানো। ঝাড়বাতি থেকে ঠিকরে বেরোচ্ছে জ্যোতি। বার্থডে ট্যাগ ঝুলছে দেওয়ালে। ঘরের মদ্যিখানে একখানা সুসজ্জিত টেবিল। টেবিলের উপর রাখা কাগজের তৈরি তিন-কোনা-টুপি। পাউন্ড খানেকের টেস্টি কেক। কেকের ওপর লাল চেরি বসানো। আরও কত কী! টেবিল ঘিরে আট থেকে আশির ভীড়। সেই জমায়েতে ষোড়শী আরলিনকে আলাদা নজরে পড়ে। সেদিন তার জন্মদিন। স্বভাবতই খুশিতে ডগমগ সে। জন্মদিনের পার্টিতে হাসি মুখের আরলিনকে সেই প্রথম দেখে রিচি। প্রথম দেখায় আরলিনকে বেশ ভালো লাগে তার। অবুঝ হৃদয়ের গভীরে কখন যে ভালোলাগা ভালোবাসায় বদলে যায়, কে তার খবর রাখে! সেদিনের পর হেলার হাউসে কিংবা ফার-রকঅ্যাওয়ে সি-বিচে তাদের প্রায়শই দেখা হত। তীরে দাঁড় বাইতে গিয়ে দুজনের আলাপ জমে। কথা বার্তা হয়। চোখে চোখ রাখলে মন অস্থির হয়ে ওঠে। এভাবে বেশ কিছু দিন কেটে গেল। তারপর সুযোগ বুঝে একদিন আরলিনকে প্রেমের প্রস্তাবনা দেয় সে। তৎক্ষণাৎ সম্মতি জানিয়ে দেয় কিশোরী কন্যা। দুজনের একসঙ্গে পথচলার সেই শুরু। সুখে-দুঃখে, শত বিপদে-আপদে আমৃত্যু ছিন্ন হয়নি তাদের ভালোবাসার বন্ধন।
হাতে হাত আর চোখে চোখ রেখে তারা একসঙ্গে ঘুরে বেড়িয়েছিল সোনালী বিকেলের অল্প আলোয়, নির্জন সমুদ্র তীরে, শ্বেতশুভ্র বালুকাময় বিচে। ফার-রকঅ্যাওয়ে'তে তাদের দিনগুলো তখন রঙিন ছিল। দুজনের আলাদা স্কুল, তবু দেখা সাক্ষাতে খামতি হয়নি কখনও। স্কুলে লেখাপড়ার পাঠ চুকিয়ে রিচি যখন ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি (MIT)-তে স্নাতক পড়তে গেল, তখন সাময়িক বিরতি নেমে এসেছিল প্রেমে। ছুটিছাটায় কিংবা সপ্তাহান্তে ঘরে ফিরলে মন দেওয়া-নেওয়া যথারীতি অব্যাহত থাকে দুজনের।
একমুখী সময়ের স্রোতে ভাসতে ভাসতে কখন যে অসুখ বাসা বাঁধে শরীরে, কে জানে! এক সময় অসুস্থ হয়ে পড়ে সুন্দরী আরলিন। তখন শরীর বেজায় দুর্বল হয়ে পড়ে। ঘন ঘন জ্বরে পুড়ে ক্লান্তি ভর করে। একনাগাড়ে নয়, মাঝে মধ্যে শরীরের কোনো অংশ ফুলে উঠে অস্বস্তি ও ভয় ধরায়। আপনা থেকে পুনরায় ফোলা ভাব কমে গিয়ে স্বাভাবিক হয় শরীর। দিনকে দিন উপসর্গের বহর বাড়ে বই কমে না। থেকে থেকে অসহ্য যন্ত্রনায় কঁকিয়ে ওঠে গোটা শরীর। ডাক্তার দেখে। ঔষধ দেয়। মেডিক্যাল টেস্টে ধরা পড়ে না অসুখ। ডায়াগনোসিস ভুল হয়ে যায়। তখন ঔষধ পরিবর্তন করে ডাক্তার। কিন্তু রোগের উপসর্গ একফোঁটা কমে না। দিনের পর দিন ভুল ট্রিটমেন্ট চলতে থাকে। সঠিক রোগের হদিস মেলে না। এতকিছুর পরও আরলিনের প্রতি রিচির ভালোবাসা একবিন্দু কমে না। প্রেমিকার জন্য তার ভালোবাসা ও সহানুভূতি দিনকে দিন বেড়ে চলে।
একদিন হাজির কঠিন সময়। অনেক দেরীতে ধরা পড়ল আসল রোগ। সেটা ১৯৪১ সালের শেষের দিকের ঘটনা। বিরল লিম্ফেটিক টিউবারকিউলোসিস রোগে আক্রান্ত আরলিন। অথচ, সেসময় আবিষ্কার হয়নি এ রোগের ঔষুধ। আক্রান্ত রোগীর মরা-বাঁচা কিছু সময়ের অপেক্ষা মাত্র।
(৪)
সাত পাকে বাঁধা :
'এ বিয়ে সম্পূর্ণ অবৈধ!' – রিচির মা লুসিলি দারুণ ক্ষিপ্ত। ওদিকে, ছেলে কারও কথা শুনতে রাজি নয়। মায়ের মনে কু ডেকে ওঠে। ভদ্রমহিলার রাগ হওয়া একেবারে অমূলক নয়, বরং স্বাভাবিক। ১৯৪২-এ ফিজিক্সে ছেলে পিএইচডি হাসিল করেছে। তার সামনে এখন উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে। আর সে কি না এমন এক মেয়েকে বিবাহের জন্য লালায়িত, যার বাঁচার সম্ভাবনা একেবারে নেই বললেই চলে! ডাক্তারের অন্তিম বিধান – বড়জোর বছর দুই। তারপর সব শেষ। নিভে যাবে আরলিনের জীবন প্রদীপ। চিরশান্তির দেশে পাড়ি দেবে সে। ফিরবে না আর কোনদিন।
অথচ, মৃত্যু পথযাত্রী এমন মেয়েকেই বিয়ের জেদ ধরে বসে আছে রিচার্ড ফাইনম্যান। একমাত্র ছেলের এ হেন আচরণে তার মা যারপরনাই বিস্মিত। দিশাহারা অবস্থা মহিলার। মেয়ের মা-বাবাও বোধহয় খানিক কিংকর্তব্যবিমূঢ়! বন্ধু বান্ধব নিমরাজি। আরলিন কী চায় সে-খবর কে জানে! রিচার্ডের দৃঢ় সংকল্প, আরলিন হবে তার জন্মজন্মান্তের জীবন সঙ্গিনী। সে চায়, তার প্রেম পরিণতি পাক। বাড়ির অমতে, এমনকি গোটা পৃথিবীর বিরুদ্ধে গিয়ে আরলিনকে বিয়ে করার সংকল্প তার।
সেদিনটা ছিল সোমবার, ২৯শে জুন ১৯৪২। বিশ্বজুড়ে যুদ্ধের দামামা বেজে চলেছে। থামার লক্ষণ নেই। ইতিমধ্যে আমেরিকার অন্যতম নৌসেনা ঘাঁটি পার্ল হারবারের উপর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের স্মৃতি টাটকা। এমন আবহে আইনত বিবাহ বন্ধনে গাঁথা হল দুটি হৃদয়। আরলিন গ্রীনবাম এবং রিচার্ড ফাইনম্যান। নিউ ইয়র্কের এক কাউন্টি স্ট্যাটেন আইল্যান্ডের সিটি অফিসে তারা পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন। মালাবদলের সময় উলুধ্বনি নেই। শাঁখ বাজেনি। আশির্বাদের মঙ্গল চাল ছোঁড়া হল না। বয়োজ্যেষ্ঠরা অনুপস্থিত। আত্মীয় স্বজন, পরিবার পরিজন ও বন্ধু বান্ধব বর্জিত এ হেন বিয়েতে স্বাক্ষী রইল তারা দুজন। বিয়ের অব্যবহিত পরে, খ্রিস্টান প্রথা অনুযায়ী, বর-বধুর পরস্পরকে দীর্ঘ চুম্বন করাই রীতি। চুম্বনের মাধ্যমে আমৃত্যু ভালোবাসার অঙ্গীকারবদ্ধ হয় তারা। কিন্তু কন্যার অসুস্থতার কথা সর্বজনবিদিত। অসুখজনিত ইনফেকশনের কথা মাথায় রেখে নববধূর চিবুকে নিজের ঠোঁট স্পর্শ করে আজীবন ভালোবাসার স্বীকারোক্তি প্রকাশ করে রিচার্ড। আরলিনের খুশির সীমা পরিসীমা ছিল না। আনন্দে তার অশ্রু ঝরে নিঃশব্দে।
বিয়ের পর হানিমুনে না-যাওয়ার কারণ ম্যানহাটন প্রজেক্ট। রিচার্ড তখন অ্যাটম বোমার গোপন ম্যানহাটন প্রকল্পে সায়েন্টিস্ট পদে নিযুক্ত। লস অ্যালামসে পরমাণু বোমার কাজে যোগ দিতে মন সায় দেয় না। আরলিনকে ছেড়ে দূর বিদেশ বিভুঁইয়ে থাকতে সে নিমরাজি। আরলিনকে কোথায় রেখে যাবে সে? কে তার পরিচর্যা করবে? অগত্যা উপায় কী?
ম্যানহাটন প্রজেক্টের বিজ্ঞান বিভাগের সর্বময় কর্তা রবার্ট ওপেনহাইমার। তার মধ্যস্থতায় একখানা রফা হল। অ্যালবুকারক্যুতে দক্ষিণ-পশ্চিম প্রেসবাইটেরিয়ান স্যানাটোরিয়ামে একখানা রুমের ব্যবস্থা করলেন ওপেনহাইমারের। সেখানকার হাসপাতালে নববিবাহিতার চিকিৎসা চলবে। সময়টা ছিল ১৯৪৩ সালের মার্চ। অসুস্থ স্ত্রীকে নির্দিষ্ট ঠিকানায় পৌঁছে দিয়ে রিচার্ড লস অ্যালামসে ফিরে আসে। ফেরার সময় সে কথা দেয় – সপ্তাহান্তে অন্তত একবার সে হাসপাতালে আরলিনকে দেখতে আসবে। পত্র লিখবে। চিঠির জবাব লিখে পাঠাবে।
নিউ মেক্সিকোর আলবুকারক্যুর দু'শ মাইল দূরে লস অ্যালামসে বৈজ্ঞানিক গবেষণায় ব্যস্ত রিচার্ড। তবু চিঠি লেখার বিরাম নেই। গবেষণার ফাঁকে স্ত্রীকে চিঠি লেখে সে। অধিকাংশ চিঠির বিষয়বস্তু অবোধ্য। সাংকেতিক ভাষায় চিঠিপত্র লেখা অভ্যাসে পরিণত করে ফেলেছে দুজনে। চিঠি লিখতে বসে ধাঁধার আশ্রয় নিত তারা। যেমন স্বামী, তেমন স্ত্রী। ভদ্রমহিলার মাথাও খেলত ধাঁধার সমাধানে। নানান রকম ধাঁধা সমাধানে সময় ব্যয় করতে ভালোবাসতেন দুজনে।
(৫)
"প্রিয় ইডিয়ট,
তোমাকে চারটে খবর জানাচ্ছি। এই চিঠিখানা পড়েই ছিঁড়ে ফেল। আর খবর চারটে বেমালুম গিলে ফেল। হজম করে ফেল। জানাজানি হলেই তোমার চাকরি নট। বুঝলে হাঁদারাম?
এক নম্বর খবর : প্রফেসর ফাইনম্যানের পিটার নামে কোনো পুত্রসন্তান নেই।
দুই নম্বর : পিটার একজন রাশান-এজেন্টের ছদ্মনাম।
তিন নম্বর : মিসেস মোবোটো নামে কোনো চাকরানী ওঁর নিউ ইয়র্কের ডেরায় কোনোদিন ছিল না।
চার নম্বর : চিঠিতে অক্ষরগুলো আদৌ উল্টোপাল্টা করে সাজানো ছিল না। ছিল, স্রেফ উল্টো করে সাজানো। Retep উল্টো করলে হয় Peter; কেমন তো? এবার SBMOB MOTA কথাটি উল্টে নিয়ে বুঝবার চেষ্টা করত মূর্খ-সম্রাট — কথাটা জানাজানি হলে তোমার চাকরি থাকবে কিনা!
ইতি
Guess Who!"
"বলতো কে?"-র নির্দেশ আধাআধি পালন করেছিল পত্র-প্রাপক ম্যাককিলভি। চিঠিখানা ছিঁড়ে ফেলে; কাউকে জানায়নি, কিন্তু খোঁজ নিয়ে জেনেছিল, ওই অজ্ঞাত পত্রলেখকের প্রথম ও তৃতীয় সংবাদ নিছক সত্য! কে এই ম্যাককিলভি?
নিউ-মেক্সিকোর এক জনমানবশূন্য প্রান্তরে অন্তজ জনপদ সান্তা-ফে। সেখান থেকে সোজা পাহাড়ে উঠে গেছে একটা উদাসী পথ। সেই পথের শেষ প্রান্তে সমুদ্র সমতল থেকে সাত হাজার ফুট ওপরে পার্বত্য অরণ্যে রয়েছে লস-অ্যালামস। লোক চক্ষুর আড়ালে ম্যানহাটন প্রজেক্টের আন্ডারে এখানেই গড়ে উঠল প্রথম পরমাণু বোমা তৈরির গোপন ফ্যাক্টরি। তৈরি হল কারখানা-ঘর, স্টাফ-কোয়াটার্স, জলবিদ্যুৎ সরবরাহ ইত্যাদি। সেটা ১৯৪৩ সালের ঘটনা। প্রথম বছরে ওখানে এল ম্যানহাটন প্রজেক্টে কর্মরত বিজ্ঞানী-সিকিউরিটি-শ্রমিক-সেনাবাহিনীর জাঁদরেল অফিসার সমেত সাড়ে তিন হাজার কর্মী। পরের বছর সংখ্যাটি বেড়ে দাঁড়ায় ছয় হাজারে। লস-অ্যালামসে ম্যানহাটন প্রকল্পের সিকিউরিটি ব্যবস্থা অত্যন্ত কড়া। প্রত্যেক বিজ্ঞানীর একেকটি ছদ্মনাম দেওয়া হয়েছে, যাতে বাইরের পৃথিবীসুদ্ধ লোক জানতে না পারে এখানে কী ঘটছে। এত এত বিজ্ঞানী কেন পাহাড় চূড়ায় একসঙ্গে জমায়েত হয়েছে? চরম গোপনীয়তার মোড়কে সেখানে তৈরি হচ্ছে অ্যাটম বোমা। এ হেন ম্যানহাটন প্রকল্পে সিকিউরিটি দপ্তরের সেনসর বিভাগের বড় কর্তা ছিলেন মিঃ ম্যাককিলভি। কারখানায় যাওয়া-আসা সমস্ত চিঠিপত্র সেনসর করতেন তিনি। তো, একবার নিজের স্ত্রীকে চিঠি লিখলেন ফাইনম্যান। উনার পত্নী থাকতেন দুহাজার মাইল দূরে, নিউ ইয়র্কে। ভদ্রমহিলা দারুণ অসুস্থ। সেজন্য নিয়ম করে ফাইনম্যান চিঠি লিখতেন লস-অ্যালামসে বসে। এদিকে, স্ত্রীকে পাঠানো সমস্ত চিঠিপত্র প্রথম আসে ম্যাককিলভির হাতে। চিঠিখানা পড়ে ম্যাককিলভি কোনো সন্দেহজনক মেসেজ না পেলে চিঠি পোস্ট করার জন্য অ্যাপ্রুভাল দেয়। সে যতই জরুরি চিঠি হোক কিংবা প্রেমপত্র! সন্দেহজনক তথ্য পেলেই চিঠি পাস হবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না সংশ্লিষ্ট বাক্য বা শব্দটি চিঠি থেকে বাদ পড়ে। এটাই নিয়ম। কিন্তু নিয়ম নীতির তোয়াক্কা বিজ্ঞানীরা কবে করেছেন? সুতরাং চিঠি আদান প্রদান নিয়ে সিকিউরিটি অফিসারের সঙ্গে ফাইনম্যানের একপ্রস্থ ঝামেলা লেগেই গেল।
সাঙ্কেতিক ভাষা ডি-কোড করা নিয়ে ম্যাককিলভির সঙ্গে একবার খুব বেধে গিয়েছিল ফাইনম্যানের। অপমানিত বোধ করেছিলেন সিকিউরিটি অফিসার। তারপর থেকে দুজনের একদম বনিবনা হয় না। তক্কে তক্কে ছিলেন অফিসার। সুযোগ খুঁজছিলেন অপমানের বদলা দিতে। অযাচিত সে সুযোগ হাজির হল একদিন। স্ত্রীকে লেখা বিজ্ঞানীর একখানা চিঠি ম্যাককিলভির হাতে এল। সেই চিঠি নিয়ে সোজা বৈজ্ঞানিকের কাছে হাজির ম্যাককিলভি।
বললে, এক্সকিউজ মি স্যার। এ চিঠি পাস হবে না।
ফাইনম্যান দেখলেন তাঁর স্ত্রীকে লেখা প্রেমপত্রখানি খামখোলা অবস্থায় নিয়ে এসেছে ম্যাককিলভি। ব্যাপারখানা কী? দেখা গেল — চিঠির এক জায়গায় ফাইনম্যান স্ত্রীকে লিখেছেন, 'সাত হাজার ফুট উঁচুতে থাকায় নিউ মেক্সিকোর গরমটা আমরা টের পাচ্ছি না।'
নোবেলজয়ী মার্কিন পদার্থবিজ্ঞানী ড. রিচার্ড ফাইনম্যান (১৯১৮–১৯৮৮)
'নিউ মেক্সিকো' আর 'সাত হাজার ফুট' এই দুটো শব্দে তীব্র আপত্তি। আপত্তির কারণ, ম্যাককিলভির ধারণা একটা রিলিফ-ম্যাপ খুললে মিসেস ফাইনম্যান সহজেই বুঝে যাবেন সাত হাজার ফুট উঁচুতে নিউ মেক্সিকোর কোথায় বিজ্ঞানী রয়েছেন! সুতরাং এ চিঠি পাস হবে না। দুরন্ত ক্রোধে ম্যাক-এর হাত থেকে চিঠিখানা ছিনিয়ে নিয়ে ফাইনম্যান কুচি কুচি করে ছিঁড়ে ফেলে দিলেন। হাসতে হাসতে ফিরে গেল ম্যাক। পরক্ষণেই আবার তাকে ফিরে আসতে হল ডিক-এর ডেরায়। এবারও তার হাতে ফাইনম্যানের স্ত্রীকে লেখা আরেকটি চিঠি। এইবার ফাইনম্যান লিখেছেন "RETEP" কেমন আছে? SBM OBMOTA এ বছর এসে পৌঁছতে পারবেন বলে মনে হয় না।" পড়ে মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারেনি ম্যাক। RETEP অথবা SBM OBMOTA কারও নাম হয় নাকি? ফ্যাল ফ্যাল করে ফাইনম্যানের দিকে তাকিয়ে রয়েছে সে।
লস অ্যালামসে ফাইনম্যানের ছদ্মনাম মিস্টার হেইলি। তো, প্রফেসর হেইলি বলে উঠলেন – অক্ষরগুলো উল্টোপাল্টা করে সাজানো আছে। আমার স্ত্রী অনায়াসেই বুঝবেন। Retep হচ্ছে Peter, আমার ছেলে। আর Sbm Obmota হচ্ছেন Mrs. Mobota, আমার পুত্রের গভর্নএস; একজন কিউবান মহিলা। ছুটি নিয়ে দেশে গেছেন। এ বছর আর ফিরবেন বলে মনে হয় না।
ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল ম্যাক-এর। পাস হয়ে গেল চিঠি। কিন্তু একটু ভালো করে উল্টো দিক থেকে পড়লে স্পষ্ট বোঝা যায় শেষোক্ত শব্দ দুটিতে লেখা আছে 'Atom Bombs'। সেদিন ফাইনম্যান কী পরিমাণ ঝামা ঘষে দিয়েছিল ম্যাক-এর নাকে, তা দিন তিনেক পরে ম্যাককিলভিকে পাঠানো উপরের টাইপ-করা-চিঠিখানা পড়লেই বোঝা যায়। ভাগ্যিস ঘটনাটি উচ্চ পদস্থ সিকিউরিটি অফিসারদের নজরে আসেনি। অন্যথায়, ম্যাককিলভির জীবনে নেমে আসত গাঢ় অন্ধকার।
এদিকে ফাইনম্যান অত্যন্ত খুশি। এরপর তাঁর প্রেমপত্র সেনসর করার দুঃসাহস দেখায়নি সিকিউরিটি অফিসার।
(৬)
শেষের কবিতা :
শেষমেশ হাজির শেষের সেদিন। ১৬ই জুন ১৯৪৫। শনিবারের সকাল। আরলিনের বাবার ফোন এল লস অ্যালামসে। এমার্জেন্সি! সময় বড্ড কম! তড়িঘড়ি দু'শ মাইল দূরের হাসপাতালে রওনা দেয় রিচার্ড। ঘনিষ্ঠ বন্ধু ক্লাউস ফুকসের চার চাকাটি চেয়ে চিন্তে গ্যারেজে রেখে দিয়েছিল সে যাতে প্রয়োজনের সময় কাজে লাগে। সাদা ধুলো উড়িয়ে গাড়িখানা যখন আলবুকারক্যু পৌঁছে, তখন প্রায় সব শেষ! আরলিনের জীবনের অন্তিম নিঃশ্বাস পড়ছে। হাসপাতালে আরলিনের বেডের পাশে এসে বসল রিচার্ড। মৃত্যু পথযাত্রী স্ত্রীর অশক্ত হাতখানা নিজের দুহাতের মুঠিতে ধরে বসে থাকে অনেকক্ষণ। ঘরের ভেতরে পিন ড্রপ সাইলেন্স। নিস্তব্ধ। নিঃশ্বাসের শব্দ শোনা যায়। আরলিনের বুক ওঠে-নামে। ফ্যাকাসে মুখে শূন্য হাঁসি ফুটে ওঠে। রিচার্ড যখন হসপিটালে প্রবেশ করে, তারপর অল্প ক'ঘণ্টা বেঁচে ছিল আরলিন। একসময় তার চোখের পাতা চিরতরে বন্ধ হল। নিভে গেল তার জীবন প্রদীপ। থেমে গেল হৃৎপিণ্ড। এখন সে শুধুই মাংসের নিথর পিণ্ড।
একজন নার্স ঘরে ঢুকল। ডেথ সার্টিফিকেট তৈরি। সেখানে রিচার্ডের সিগনেচার দরকার। স্বাক্ষর সংগ্রহ করে নার্স বেরিয়ে গেল। নার্সের পেছনে বাকি সবাই। ঘরের ভেতর এখন শুধু দুজন। মৃত আরলিনের সাদা কাপড়ে ঢাকা পার্থিব শরীর এবং বাকশূন্য রিচার্ড। একফোঁটা জল নেই ছেলেটার চোখে। ভাবুক চোখ দুটো স্থির। তার ক্ষীণ দৃষ্টি আটকে গেল বেডের পাশে রাখা হাতঘড়ির ওপর। ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে অতীতের কথা স্মরণে আসে তার। ভাবনারা ভীড় করে অশান্ত মনে। সমুদ্রের লক্ষ লক্ষ জলরাশি আছড়ে পড়ে হৃদয়-সৈকতে।
'বছর সাতেক আগের ঘটনা। অসুস্থ আরলিনকে সে উপহার দিয়েছিল একখানা ডিজিট্যাল হাতঘড়ি। তখনকার লেটেস্ট মডেল। হাত দিয়ে ঘড়ির সংখ্যাগুলো বদলে দিতে হয় প্রয়োজন মত। অসুস্থ আরলিনের বেডের পাশেই সবসময় থাকত সেটি। আজও এর অন্যথা হয়নি। যথারীতি বেডের পাশে রাখা। সেটি হাতে তুলে সামান্য নাড়াচাড়া করে দেখল রিচার্ড। মাঝে মধ্যে যখন ঘড়িটা খারাপ হয়েছে, অবলীলায় সারিয়ে তুলেছে সে। আজ থেকে আর সারানোর প্রয়োজন পড়বে না। ঘড়িটার মালকিন যে-সময় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করল, বন্ধ হওয়ার ফলে ঘড়িতে তখন ৯:২২ রাত্রি; ডেথ সার্টিফিকেট লেখার সময়। নির্মম সময়ের হিসেবটা তার নরম হৃদয়ে চিরটাকাল গেঁথে থাকবে। ঘড়ির সংখ্যাগুলো ক্রমশ অস্পষ্ট হচ্ছে। শবঘরের আলো ক্ষীণ থেকে আরও ক্ষীণ হচ্ছে। ঘন আঁধারে ঢেকে গেল আরলিনের ঘর। বাইরে বেরিয়ে এলেন বিজ্ঞানী। ঝাপসা দৃষ্টি। মনে হাজারো প্রশ্ন। ভেতরে ভেতরে ক্ষয়ে যাচ্ছিল তার পাংশুটে ফুসফুস। বিবেক। চেতনা। মনে মনে প্রশ্ন করে — "হতে পারে, আমি বোকা ছিলাম। কিন্তু ভেবে অবাক হচ্ছি – কীভাবে আমার অনুভূতিগুলো, এমন সিচুয়েশনে লোকের ভাবনা তো স্বাভাবিক, বেদনা হয়ে ঝরে পড়ল না? আমি উৎফুল্ল হইনি ঠিকই; সত্যি বলতে আমার দুঃখ বোধও হচ্ছে না। কেন? তবে কি বিগত সাত বছর ধরে প্রিয়তমার আসন্ন মৃত্যুর একটু একটু প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম আমি?"
"এখনও অব্দি সত্যিই জানি না কীভাবে লস অ্যালামসে বন্ধুদের মুখোমুখি দাঁড়াব আমি! লোকজন এটা নিয়ে দীর্ঘক্ষণ কথা বলুক – এ আমার তীব্র না-পসন্দ।"
"যখন ফিরলাম, সকলের একটাই জিজ্ঞাস্য – 'কী হল?'
'সে মরে গেছে। এদিকের কাজ কেমন চলছে?' — আমি জানতে চাইলাম।
মনে পড়ে মৃত্যুর দশ দিন আগে আরলিনকে লেখা রিচার্ডের চিঠি; যে-চিঠির ছত্রে ছত্রে প্রেয়সীর মৃত্যুর পূর্বাভাসের সম্ভাবনা উস্কে নিজের অক্ষমতা প্রকাশের কী নিদারুণ প্রয়াস!
"আমার প্রিয়তমা স্ত্রী,
সর্বদা আমি খুব মন্থর। চটজলদি বুঝতে না-পারার অক্ষমতার জন্য তোমাকে সবসময় কষ্ট দিয়ে ফেলি। এখন আমি বুঝতে পারি। এখন তোমাকে আনন্দ দেব।
শেষমেশ বুঝতে পারি, তুমি কত কষ্টে রয়েছ। বুঝতে পারি, অপরকে বিড়ম্বনায় না-ফেলার নতুন উদ্যমের কথা এখন তোমাকে জিজ্ঞেস করার সময় নয়। তোমার কাছ থেকে কোনো রকম উদ্যোগ সম্পর্কে প্রশ্ন করার সময় নয় এটা। তোমাকে স্বস্তি দিতে আমি যেভাবে ভাবছি সেভাবে নয়; তুমি যেভাবে পছন্দ কর, সেভাবে তোমাকে আরাম দেওয়ার সময় এখন। তোমার মত করে তোমাকে ভালোবাসার সময় এখন।
আমি সব বুঝি, প্রিয়ে। সবকিছু আমাকে বুঝতে হবে, কারণ এখন আমি জানি তুমি এত দুর্বল যে কোনো কিছু ব্যাখ্যা করার অবস্থায় নেই। আমার ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই। আমি তোমাকে ভালোবাসি। আমি তোমাকে পূজা করি। অবান্তর প্রশ্ন ছাড়া, কেবল অন্তর্দৃষ্টির সাহায্যে আমি তোমার সেবা করব।
শক্ত নির্মেদ যে-পিলার তোমার প্রয়োজন, তা সরবরাহ করতে না পেরে আমি অনুতপ্ত। এখন আমি এমন একটা মানুষ যার উপর তুমি ভরসা করতে পার,আস্থা রাখতে পার। তোমার দারুণ অসুখে তোমাকে ঠকাব না আমি। চাইলে আমাকে ব্যবহার কর। আমি তোমার স্বামী।
এক মহিয়সী অসুস্থ মহিলাকে আমি পূজা করি। দেরীতে তোমাকে বোঝার জন্য আমাকে ক্ষমা কর। আমি তোমার স্বামী। আমি তোমাকে ভালোবাসি।"
লস অ্যালামস থেকে লেখা এটি শেষ হৃদয়-বিদারক চিঠি। সেখান থেকে প্রিয়তমা পত্নীকে চল্লিশখানা চিঠি লিখেছিলেন রিচার্ড ফাইনম্যান।
(৭)
ফাইনম্যান-প্রেম :
পর্ণমোচীর পাতা ঝরিয়ে ফেব্রুয়ারি এলে বসন্ত প্রেম উঁকি মারে প্রকৃতির হৃদয়ে, মনে। পলাশ ফুলে রাঙা হয়ে ওঠে বিবর্ণ মন। বাঙালির সরস্বতী পূজা এবং ভ্যালেনটাইন ডে — দুই প্রেমের দিন এবছর একই দিনে সমাপতিত। ১৪ই ফেব্রুয়ারি। প্রেম নিবেদনের শুভ ক্ষণ। আচ্ছা, দিনক্ষণ আর সময় মেপে প্রেমে পড়া যায় কি? প্রেম কি কেবল দুটি শরীরের মিলন, নাকি, তার চাইতে আরও বেশি কিছু? মরণের পরেও কি ভালোবাসা যায়? ভালোবাসার মানুষের মৃত্যু হলে তার অবিনশ্বর আত্মার কি কখনও মরণ হয়?
প্রেমের সঙ্গে শরীর ও মনের কী সম্পর্ক? রক্ত মাংসের শরীরে যখন প্রেম বাসা বাঁধে, অতিরিক্ত অ্যাড্রিনালিন ক্ষরিত হয় কার নির্দেশে? গোপনে কে জোগান দেয় প্রেমে-পড়া-মানুষের পৃথিবী জয় করার অফুরন্ত শক্তি?
শরীরের মৃত্যু আছে, অথচ সত্যিকারের প্রেম অমর। আসলে প্রকৃত প্রেমের মরণ হয় না কখনও। আত্মার মতো প্রেম অবিনশ্বর। মন প্রাণ ঢেলে যাকে একবার ভালোবাসি, সে-ভালোবাসা চিরন্তন। অবিশ্বাসের চৌকাঠে কিংবা মৃত্যুর সঙ্গে সরাসরি সংঘাতে একদিন পার্থিব প্রেম অন্তর্হিত হয়ে গেলেও কোমল মনের সংগোপনে তা গচ্ছিত থাকে চিরকাল। ফাইনম্যানের পত্নী-প্রেম সেই ধারণায় সিলমোহর লাগায়। প্রিয়তমার মরণের পরে তাঁকে স্মরণ করে ভালোবাসার যে অনন্য ঐশ্বরিক দৃষ্টান্ত ফাইনম্যান স্থাপন করে গেছেন, এককথায় তা নজিরবিহীন। মরনোত্তর সব প্রেমের পরিণতি তাই 'ফাইনম্যান-প্রেম' নামে খ্যাত হোক বিশ্বব্যাপী।
তথ্যসূত্র :
(1) 'Surely You're Joking, Mr. Feynman' book
(2) Interview with Joseph Heller by Shelley Erwin, Laguna Woods, California
(3) Wikipedia, Different Online Articles
বিজ্ঞানের অন্তরালে বিজ্ঞানী — ৯৩
ফাইনম্যান-প্রেম :
পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যা
(১)
অমর প্রেম-কথা : আরলিন গ্রীনবাম ও রিচার্ড ফাইনম্যান :
অক্টোবর ১৭, ১৯৪৬
D'Arline,
হে প্রিয়তমা, তোমাকে বন্দনা করি আমি।
একথা শুনতে তুমি পছন্দ কর – আমি জানি। অবশ্য তুমি পছন্দ কর বলেই আমি কিন্তু শুধু শুধু সেকথা লিখছি না। আমি লিখেছি, কারণ তোমাকে সে-কথা লিখে ভেতর থেকে আমি উষ্ণতা অনুভব করি।
একটা ভয়ঙ্কর সুদীর্ঘকাল! প্রায় বছর দুয়েক আগে শেষ চিঠি লিখেছিলাম তোমাকে। আমাকে তুমি ক্ষমা করবে, জানি। কারণ, আমি কেমন তুমি ভালো মতন জানো। ভীষণ একগুঁয়ে আর খুব বাস্তববাদী আমি; এবং ভেবেছিলাম লেখার কোনও অনুভূতি নেই আমার।
প্রিয়তমা অর্ধনারীশ্বর হে, কিন্তু এখন আমি জানি – যে কাজ সম্পাদন করতে বিলম্ব হয়েছে, তা করার সঠিক সময় এটা। অতীতে অনেক কাজ করেছি আমি। তোমাকে বলতে চাই – আমি তোমাকে ভালোবাসি। ভালোবাসতে চাই তোমাকে। আজীবন তোমাকে ভালোবাসবো আমি।
হয়তো মনের সংগোপনে আমার বুঝতে অত্যন্ত দুস্কর হয়ে যায় – তোমার মৃত্যুর পরে তোমাকে ভালোবাসার কী অর্থ! কিন্তু আমি এখনও স্বস্তি ফিরে পেতে চাই আর তোমার যত্ন নেওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করি। মনেপ্রাণে আমি চাই তুমি শুধু আমাকে ভালোবাসো এবং আমার যত্ন নাও। গুচ্ছ গুচ্ছ সমস্যা তোমার সঙ্গে আলোচনা করতে চাই। এখনও অব্দি এক মূহুর্তের জন্যও আমার বিশ্বাস হয়নি যে আমরা একসঙ্গে সে-গুলো আর করতে পারব না। আমরা কী কী করব? একসাথে আমরা দুজনে কাপড় বোনা কিংবা চীনা ভাষা শেখা শুরু করেছিলাম, মনে পড়ে? অথবা একখানা মুভি প্রজেক্টার তৈরির প্রকৌশল আয়ত্ত করেছিলাম! আচ্ছা, এখন কি কিছু করতে পারি না আমি? নাহ! পারিনি। তোমাকে ছাড়া আমি ভীষণ একা। তুমি ছিলে আদর্শ গৃহিণী আর আমাদের যাবতীয় ঝুঁকিপূর্ণ বন্য অ্যাডভেঞ্চারের সাধারণ উদ্দিপক।
যখন অসুস্থ ছিলে, তুমি খুব দুঃখ পেতে। কারণ, তোমার যা-কিছু তুমি আমাকে দিতে চেয়েছিলে কিংবা ভাবতে হয়তো আমার খুব দরকার, সেসব দিতে পারতে না তুমি। আমি বলতাম, কোনও প্রয়োজন নেই। তুমি উদ্বিগ্ন হয়ো না, প্রিয়ে। এখন কীভাবে বলব যে তোমাকে খুব ভালোবাসতাম আমি! এবং এটা দিনের আলোর মত পরিষ্কার একটা ঘটনা – হয়তো তুমি আমাকে এখন কিছুই দিতে পারবে না; তবুও তোমায় খুব ভালোবাসি আমি, যেহেতু আমার অন্য কাউকে ভালোবাসার পথে শুধু তুমি দাঁড়িয়ে রয়েছ। আমিও চাই – ওই পথে শুধু তুমি দাঁড়িয়ে থেকো। তুমি মৃত, অথচ জীবিত অন্য কারও চেয়ে তুমি অনেক বেশি সুন্দর।
আমি নিশ্চিত জানি, আমাকে নিরাপদে রাখবে তুমি। কারণ, আমি বোকার বেহদ্দ এবং তুমি আমার সম্পূর্ণ মঙ্গল চাও। আমাকে কখনও আমার বোকামির রাস্তায় চলতে দিতে চাওনি। তুমি শুনলে অবাক হবে, বাজি রেখে বলছি, হে প্রিয়ে – দুবছর পরেও তুমি ব্যতিত একজনও মেয়েবন্ধু নেই আমার! কিন্তু ডার্লিং, এই ব্যাপারে – তুমি কিংবা আমি – কেউই কোনরকম হেল্প করতে পারব না। অবশ্য আমি একথা বিশ্বাস করি না। অনেক মেয়ের সঙ্গেই আমার দেখা সাক্ষাৎ হয়েছে। তাদের অনেকেই অসম্ভব সুন্দরী। বুদ্ধিমতী। এবং একলা থাকা আমার পছন্দ নয় ইত্যাদি ইত্যাদি। এত সবের পরেও বড়জোর দুই কিংবা তিনবার সাক্ষাতের পর সবাইকে ধূসর ছাই মনে হয়েছে আমার। আমার পুরো ভূবন জুড়ে শুধু তুমি, শুধুই তুমি ছড়িয়ে রয়েছো। তুমি শাশ্বত। চিরন্তন। তুমি চরম বাস্তব।
আমার প্রিয়তমা অর্ধাঙ্গিনী, আমি তোমাকে পূজা করি।
আমার পত্নীকে আমি খুব ভালোবাসি। অগ্নি সাক্ষী রেখে বিয়ে করা আমার একমাত্র সহধর্মিণী আর বেঁচে নেই!
ইতি
তোমার রিচ
ঠিকানা — আমাকে ক্ষমা কর, প্রিয়ে। চিঠিটা ডাকে পোস্ট করা হয়নি। কিন্তু, আমি যে তোমার নতুন ঠিকানা জানি না, ডার্লিং!"
চিত্র -১
পত্রলেখক বিশ্ববিশ্রুত বৈজ্ঞানিক রিচার্ড ফাইনম্যান (১৯১৮–১৯৮৮)। ডাক নাম 'ডিক'। সব রিচার্ড-এরই ডাক নাম হয় ডিক, ঠিক যেমন সব কানাইলালের ডাক নাম কানু। ফাইনম্যান ছিলেন অদ্ভুত ফুর্তিবাজ। দুষ্টুমিতে ভরা। একেবারে ছেলেমানুষ। বিভিন্ন রকম ধাঁধা সমাধানে সিদ্ধহস্ত, পাকা মাথা। বিশ্ববিখ্যাত নোবেল লরিয়েট বিজ্ঞানীদের মুখের উপর যখন তখন বলে দিতে পারতেন — 'কী বকছেন স্যার পাগলের মতো!'। 'পাগলের মতো ' শব্দ দুটো ছিল তাঁর প্রতিবাদের বাঁধা স্বর। মুদ্রাদোষ!
এ হেন মার্কিন পদার্থবিজ্ঞানী রিচার্ড ফাইনম্যান কোয়ান্টাম বলবিদ্যার পথ ইন্টিগ্রেল ফর্মুলেশন, কোয়ান্টাম তড়িৎ-গতিবিজ্ঞান তত্ত্ব এবং অতিশীতলকৃত তরল হিলিয়ামের চরমপ্রবাহমানতা ক্রিয়াকৌশল ব্যাখ্যা করেছেন। কণা পদার্থবিজ্ঞানে কাজের জন্য বিশ্ব জুড়ে খ্যাত হয়েছেন। কোয়ান্টাম তড়িৎ-গতিবিজ্ঞান তত্ত্ব আবিষ্কারের স্বীকৃতি স্বরূপ ফিজিক্সে ১৯৬৫ সালে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। মৃত্যুর দীর্ঘ ষোলো মাস পরে স্বর্গবাসী পত্নীকে লেখা ভালোবাসার চিঠিখানা প্রথিতযশা বৈজ্ঞানিক রিচার্ড ফাইনম্যানের অবিনশ্বর প্রেমের জ্বলন্ত উদাহরণ।
(২)
দিনগুলি মোর সোনার খাঁচায়...
নিউ ইয়র্কের এক মফস্বল টাউন ফার-রকঅ্যাওয়ে। শান্ত। নিরিবিলি। সাজানো-গোছানো এক শহর। শহরের দক্ষিণ প্রান্তে আটলান্টিক মহাসাগর। বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে সমুদ্র তট। তীর ভূমিতে গুচ্ছের ছোট নৌকা, বোট বাঁধা। এ হেন টাউনের মাঝখানে নুড়ি কাঁকরের উপর রেলগাড়ির পাত বিছানো। লাইনটি ছোট্ট টাউনকে সমান দুটি খণ্ডে ভাগ করেছে। এ হেন শহরে রেললাইনের দুপাশে দুই বন্ধুর বাড়ি। মিনিট পাঁচ কিংবা দশেকের হাঁটাপথ। অভিন্ন হৃদয় দুই বন্ধু রিচি এবং এলমার। রিচির চেয়ে বছর খানেক বড় এলমার। দুজনে ফার-রকঅ্যাওয়ে হাইস্কুলে একই ক্লাসের স্টুডেন্ট। প্রায়শই গণিত নিয়ে দুজনের চুলচেরা বিশ্লেষণ চলে। এদিকে, দীর্ঘ সময় গণিত কিংবা বিজ্ঞান আলোচনায় হাঁপিয়ে ওঠে রিচি। মন ছটপট করে। খেলতে ইচ্ছে হয়। কিন্তু বন্ধু বাড়িতে রিচির খেলার সঙ্গী কে হবে? সাড়ে তিন বছরের ছোট এক ভাই রয়েছে এলমার-এর। নাম জোসেফ। যখন খেলতে ইচ্ছে করত, জোসেফের সঙ্গে 'কিক দ্য ক্যান' খেলায় মেতে উঠত রিচি। মাঝে সাঝে ড্রাম বাজায় দুজনে। ছোট্ট জোসেফ ড্রাম বাজানোয় রীতিমতো ওস্তাদ। জোসেফের কাছেই রিচির ড্রাম বাজানোয় হাতেখড়ি। প্রথম প্রথম হাত দিয়ে, পরে শক্ত কাঠির সাহায্যে। টমটম, টম-ড্রাম, বঙ্গো–হরেক রকমের ড্রাম বাজিয়ে ভীষণ আনন্দ পেত রিচি। তখন থেকেই তারা 'ট্র্যাপ ড্রামারস' (Trap Drummers) নামে খ্যাত। জোসেফ তো বিভিন্ন ব্যান্ড, এমনকি অর্কেস্ট্রাতে ড্রাম বাজাতে সিদ্ধহস্ত। সেই থেকে সুন্দর সময় কাটাত জোসেফ ও রিচি। ছোট ছোট সন্তানদের গাঢ় বন্ধুত্বের ঢেউ আছড়ে পড়ে দুই পরিবারে। পারিবারিক সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। রিচির মা লুসিলি ফাইনম্যান এবং এলমার-জোসেফের মা এভা হেলার-এর মধ্যে জমাট বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে অতঃপর। সময়টা ছিল ১৯২০-র শেষ ভাগ ও ১৯৩০-এর দশক।
চিত্র -২
শহরের এক বহুতল আবাসনে, লোকে তখন বলত 'গুহা' (Den), থাকত রিচির বাবা মেলভিল, মা লুসিলি, বোন জোয়ান এবং সে নিজে। সব মিলিয়ে চারজনের সংসার। দুই কামরার এত অল্প পরিসরে হাঁপিয়ে ওঠে রিচি। সেজন্য কিশোর রিচির দিনের অধিকাংশ সময় কাটত হেলার হাউসে; এলমার ও জোসেফের সান্নিধ্যে। এলমারদের রয়েছে তিন কামরার নিজস্ব বাড়ি। বাড়ির সামনে প্রসস্থ উঠোন। গাছগাছালি ঘেরা চারপাশ। তিন বেডরুমের একটাতে রয়েছে একখানা স্টাডি-ডেস্ক। তার সঙ্গে পড়াশোনার বইপত্র, গুচ্ছের খাতা, কাগজ, কলম ইত্যাদি। সেখানে লেখাপড়ায় মশগুল থাকত এলমার, রিচি ও জোসেফ। প্রায় দিন রাতের খাবার খেয়ে বাড়ি ফেরে রিচি। সে ডিনার সেরে বাড়ি ফিরবে কি না – এ নিয়ে তিনজনে বাজি ধরত এবং খুব মজা পেত। সপ্তাহান্তে সেখানে রাত্রিযাপন করে রিচি; কখনও সখনও। MIT-তে পড়তে গিয়ে তার এ অভ্যাসে ছেদ পড়ে।
আটলান্টিক মহাসাগরের কোলে অপরূপ বিচ সমৃদ্ধ ফার-রকঅ্যাওয়ে শহরের উত্তরে আড়াই মাইল দূরে পাশের টাউন সিডারহার্স্ট। আরলিন গ্রীনবামের বাড়ি সেখানে। কিশোর বয়সে হেলার হাউসে অবাধ যাতায়াত ছিল আরলিনের। মূলত ভ্রাতৃপ্রতিম জোসেফের কাছে নৌকা চালনা শিখতে যেত সে। কিন্তু তারা বোট কোথায় পেত? কীভাবে মিলত সেগুলো?
ফার রকঅ্যাওয়ে বিচের আশেপাশে মাছ ধরার বোট ভাড়া দেওয়ার অনেক জায়গা। সেখানে ডিঙি বোট থেকে নৌকা সস্তায় ভাড়া দেওয়া হয়। বোটগুলো সব স্টিলের তৈরি। বোটে চড়ে লোকজন তীরের আশপাশে অগভীর সমুদ্রে মাছ ধরে বেড়ায়। সমুদ্রে মাছ ধরতে ধরতে একসময় তারা ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পড়ে। ক্লান্ত অবসন্ন লোকগুলো ফিসিং স্টেশনে বোটগুলো ফেরত না দিয়ে তারা বিচে ফেলে রেখে বাড়ি চলে যায়। এলাকার ছেলে ছোকরার দল সেগুলো নিয়ে খেলা করে। সমুদ্রে, বিচে দাঁড় টানে। তীরে ফেলে রাখা এমনই কোনো বোট নিয়ে আরলিনের সঙ্গে সমুদ্রে পাড়ি দেয় জোসেফ। দাঁড় কীভাবে বাইতে হয় শিখিয়ে দেয় বয়সে বড় আরলিনকে। দাঁড় টানতে টানতে একসময় ক্লান্তি ভর করে তাদের। তখন বোটগুলোকে তারা পুনরায় তীরে ফেলে দিয়ে বাড়ি রওনা হয়। রাতের বেলা, আকাশে যখন ঝকমক করে আলোকবর্ষ দূরের তারাগুলি, তখন সেগুলো ফেরত নিয়ে যায় বোট মালিক।
এভাবেই একদিন দাঁড় টানায় পারদর্শী হয়ে ওঠে আরলিন। অবশ্য দাঁড় বাওয়ার নেশা চেপে বসেছিল তার মাথায়।
(৩)
প্রথম দেখা :
সুন্দর পোশাকে ইতস্তত ঘুরে বেড়ায় কচিকাঁচার দল। রঙ বেরঙের আলো আর রঙিন ফুলে ঘরখানা সাজানো গোছানো। ঝাড়বাতি থেকে ঠিকরে বেরোচ্ছে জ্যোতি। বার্থডে ট্যাগ ঝুলছে দেওয়ালে। ঘরের মদ্যিখানে একখানা সুসজ্জিত টেবিল। টেবিলের উপর রাখা কাগজের তৈরি তিন-কোনা-টুপি। পাউন্ড খানেকের টেস্টি কেক। কেকের ওপর লাল চেরি বসানো। আরও কত কী! টেবিল ঘিরে আট থেকে আশির ভীড়। সেই জমায়েতে ষোড়শী আরলিনকে আলাদা নজরে পড়ে। সেদিন তার জন্মদিন। স্বভাবতই খুশিতে ডগমগ সে। জন্মদিনের পার্টিতে হাসি মুখের আরলিনকে সেই প্রথম দেখে রিচি। প্রথম দেখায় আরলিনকে বেশ ভালো লাগে তার। অবুঝ হৃদয়ের গভীরে কখন যে ভালোলাগা ভালোবাসায় বদলে যায়, কে তার খবর রাখে! সেদিনের পর হেলার হাউসে কিংবা ফার-রকঅ্যাওয়ে সি-বিচে তাদের প্রায়শই দেখা হত। তীরে দাঁড় বাইতে গিয়ে দুজনের আলাপ জমে। কথা বার্তা হয়। চোখে চোখ রাখলে মন অস্থির হয়ে ওঠে। এভাবে বেশ কিছু দিন কেটে গেল। তারপর সুযোগ বুঝে একদিন আরলিনকে প্রেমের প্রস্তাবনা দেয় সে। তৎক্ষণাৎ সম্মতি জানিয়ে দেয় কিশোরী কন্যা। দুজনের একসঙ্গে পথচলার সেই শুরু। সুখে-দুঃখে, শত বিপদে-আপদে আমৃত্যু ছিন্ন হয়নি তাদের ভালোবাসার বন্ধন।
হাতে হাত আর চোখে চোখ রেখে তারা একসঙ্গে ঘুরে বেড়িয়েছিল সোনালী বিকেলের অল্প আলোয়, নির্জন সমুদ্র তীরে, শ্বেতশুভ্র বালুকাময় বিচে। ফার-রকঅ্যাওয়ে'তে তাদের দিনগুলো তখন রঙিন ছিল। দুজনের আলাদা স্কুল, তবু দেখা সাক্ষাতে খামতি হয়নি কখনও। স্কুলে লেখাপড়ার পাঠ চুকিয়ে রিচি যখন ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি (MIT)-তে স্নাতক পড়তে গেল, তখন সাময়িক বিরতি নেমে এসেছিল প্রেমে। ছুটিছাটায় কিংবা সপ্তাহান্তে ঘরে ফিরলে মন দেওয়া-নেওয়া যথারীতি অব্যাহত থাকে দুজনের।
চিত্র -৩
একমুখী সময়ের স্রোতে ভাসতে ভাসতে কখন যে অসুখ বাসা বাঁধে শরীরে, কে জানে! এক সময় অসুস্থ হয়ে পড়ে সুন্দরী আরলিন। তখন শরীর বেজায় দুর্বল হয়ে পড়ে। ঘন ঘন জ্বরে পুড়ে ক্লান্তি ভর করে। একনাগাড়ে নয়, মাঝে মধ্যে শরীরের কোনো অংশ ফুলে উঠে অস্বস্তি ও ভয় ধরায়। আপনা থেকে পুনরায় ফোলা ভাব কমে গিয়ে স্বাভাবিক হয় শরীর। দিনকে দিন উপসর্গের বহর বাড়ে বই কমে না। থেকে থেকে অসহ্য যন্ত্রনায় কঁকিয়ে ওঠে গোটা শরীর। ডাক্তার দেখে। ঔষধ দেয়। মেডিক্যাল টেস্টে ধরা পড়ে না অসুখ। ডায়াগনোসিস ভুল হয়ে যায়। তখন ঔষধ পরিবর্তন করে ডাক্তার। কিন্তু রোগের উপসর্গ একফোঁটা কমে না। দিনের পর দিন ভুল ট্রিটমেন্ট চলতে থাকে। সঠিক রোগের হদিস মেলে না। এতকিছুর পরও আরলিনের প্রতি রিচির ভালোবাসা একবিন্দু কমে না। প্রেমিকার জন্য তার ভালোবাসা ও সহানুভূতি দিনকে দিন বেড়ে চলে।
একদিন হাজির কঠিন সময়। অনেক দেরীতে ধরা পড়ল আসল রোগ। সেটা ১৯৪১ সালের শেষের দিকের ঘটনা। বিরল লিম্ফেটিক টিউবারকিউলোসিস রোগে আক্রান্ত আরলিন। অথচ, সেসময় আবিষ্কার হয়নি এ রোগের ঔষুধ। আক্রান্ত রোগীর মরা-বাঁচা কিছু সময়ের অপেক্ষা মাত্র।
(৪)
সাত পাকে বাঁধা :
'এ বিয়ে সম্পূর্ণ অবৈধ!' – রিচির মা লুসিলি দারুণ ক্ষিপ্ত। ওদিকে, ছেলে কারও কথা শুনতে রাজি নয়। মায়ের মনে কু ডেকে ওঠে। ভদ্রমহিলার রাগ হওয়া একেবারে অমূলক নয়, বরং স্বাভাবিক। ১৯৪২-এ ফিজিক্সে ছেলে পিএইচডি হাসিল করেছে। তার সামনে এখন উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে। আর সে কি না এমন এক মেয়েকে বিবাহের জন্য লালায়িত, যার বাঁচার সম্ভাবনা একেবারে নেই বললেই চলে! ডাক্তারের অন্তিম বিধান – বড়জোর বছর দুই। তারপর সব শেষ। নিভে যাবে আরলিনের জীবন প্রদীপ। চিরশান্তির দেশে পাড়ি দেবে সে। ফিরবে না আর কোনদিন।
অথচ, মৃত্যু পথযাত্রী এমন মেয়েকেই বিয়ের জেদ ধরে বসে আছে রিচার্ড ফাইনম্যান। একমাত্র ছেলের এ হেন আচরণে তার মা যারপরনাই বিস্মিত। দিশাহারা অবস্থা মহিলার। মেয়ের মা-বাবাও বোধহয় খানিক কিংকর্তব্যবিমূঢ়! বন্ধু বান্ধব নিমরাজি। আরলিন কী চায় সে-খবর কে জানে! রিচার্ডের দৃঢ় সংকল্প, আরলিন হবে তার জন্মজন্মান্তের জীবন সঙ্গিনী। সে চায়, তার প্রেম পরিণতি পাক। বাড়ির অমতে, এমনকি গোটা পৃথিবীর বিরুদ্ধে গিয়ে আরলিনকে বিয়ে করার সংকল্প তার।
সেদিনটা ছিল সোমবার, ২৯শে জুন ১৯৪২। বিশ্বজুড়ে যুদ্ধের দামামা বেজে চলেছে। থামার লক্ষণ নেই। ইতিমধ্যে আমেরিকার অন্যতম নৌসেনা ঘাঁটি পার্ল হারবারের উপর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের স্মৃতি টাটকা। এমন আবহে আইনত বিবাহ বন্ধনে গাঁথা হল দুটি হৃদয়। আরলিন গ্রীনবাম এবং রিচার্ড ফাইনম্যান। নিউ ইয়র্কের এক কাউন্টি স্ট্যাটেন আইল্যান্ডের সিটি অফিসে তারা পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন। মালাবদলের সময় উলুধ্বনি নেই। শাঁখ বাজেনি। আশির্বাদের মঙ্গল চাল ছোঁড়া হল না। বয়োজ্যেষ্ঠরা অনুপস্থিত। আত্মীয় স্বজন, পরিবার পরিজন ও বন্ধু বান্ধব বর্জিত এ হেন বিয়েতে স্বাক্ষী রইল তারা দুজন। বিয়ের অব্যবহিত পরে, খ্রিস্টান প্রথা অনুযায়ী, বর-বধুর পরস্পরকে দীর্ঘ চুম্বন করাই রীতি। চুম্বনের মাধ্যমে আমৃত্যু ভালোবাসার অঙ্গীকারবদ্ধ হয় তারা। কিন্তু কন্যার অসুস্থতার কথা সর্বজনবিদিত। অসুখজনিত ইনফেকশনের কথা মাথায় রেখে নববধূর চিবুকে নিজের ঠোঁট স্পর্শ করে আজীবন ভালোবাসার স্বীকারোক্তি প্রকাশ করে রিচার্ড। আরলিনের খুশির সীমা পরিসীমা ছিল না। আনন্দে তার অশ্রু ঝরে নিঃশব্দে।
চিত্র -৪
বিয়ের পর হানিমুনে না-যাওয়ার কারণ ম্যানহাটন প্রজেক্ট। রিচার্ড তখন অ্যাটম বোমার গোপন ম্যানহাটন প্রকল্পে সায়েন্টিস্ট পদে নিযুক্ত। লস অ্যালামসে পরমাণু বোমার কাজে যোগ দিতে মন সায় দেয় না। আরলিনকে ছেড়ে দূর বিদেশ বিভুঁইয়ে থাকতে সে নিমরাজি। আরলিনকে কোথায় রেখে যাবে সে? কে তার পরিচর্যা করবে? অগত্যা উপায় কী?
ম্যানহাটন প্রজেক্টের বিজ্ঞান বিভাগের সর্বময় কর্তা রবার্ট ওপেনহাইমার। তার মধ্যস্থতায় একখানা রফা হল। অ্যালবুকারক্যুতে দক্ষিণ-পশ্চিম প্রেসবাইটেরিয়ান স্যানাটোরিয়ামে একখানা রুমের ব্যবস্থা করলেন ওপেনহাইমারের। সেখানকার হাসপাতালে নববিবাহিতার চিকিৎসা চলবে। সময়টা ছিল ১৯৪৩ সালের মার্চ। অসুস্থ স্ত্রীকে নির্দিষ্ট ঠিকানায় পৌঁছে দিয়ে রিচার্ড লস অ্যালামসে ফিরে আসে। ফেরার সময় সে কথা দেয় – সপ্তাহান্তে অন্তত একবার সে হাসপাতালে আরলিনকে দেখতে আসবে। পত্র লিখবে। চিঠির জবাব লিখে পাঠাবে।
নিউ মেক্সিকোর আলবুকারক্যুর দু'শ মাইল দূরে লস অ্যালামসে বৈজ্ঞানিক গবেষণায় ব্যস্ত রিচার্ড। তবু চিঠি লেখার বিরাম নেই। গবেষণার ফাঁকে স্ত্রীকে চিঠি লেখে সে। অধিকাংশ চিঠির বিষয়বস্তু অবোধ্য। সাংকেতিক ভাষায় চিঠিপত্র লেখা অভ্যাসে পরিণত করে ফেলেছে দুজনে। চিঠি লিখতে বসে ধাঁধার আশ্রয় নিত তারা। যেমন স্বামী, তেমন স্ত্রী। ভদ্রমহিলার মাথাও খেলত ধাঁধার সমাধানে। নানান রকম ধাঁধা সমাধানে সময় ব্যয় করতে ভালোবাসতেন দুজনে।
(৫)
"প্রিয় ইডিয়ট,
তোমাকে চারটে খবর জানাচ্ছি। এই চিঠিখানা পড়েই ছিঁড়ে ফেল। আর খবর চারটে বেমালুম গিলে ফেল। হজম করে ফেল। জানাজানি হলেই তোমার চাকরি নট। বুঝলে হাঁদারাম?
এক নম্বর খবর : প্রফেসর ফাইনম্যানের পিটার নামে কোনো পুত্রসন্তান নেই।
দুই নম্বর : পিটার একজন রাশান-এজেন্টের ছদ্মনাম।
তিন নম্বর : মিসেস মোবোটো নামে কোনো চাকরানী ওঁর নিউ ইয়র্কের ডেরায় কোনোদিন ছিল না।
চার নম্বর : চিঠিতে অক্ষরগুলো আদৌ উল্টোপাল্টা করে সাজানো ছিল না। ছিল, স্রেফ উল্টো করে সাজানো। Retep উল্টো করলে হয় Peter; কেমন তো? এবার SBMOB MOTA কথাটি উল্টে নিয়ে বুঝবার চেষ্টা করত মূর্খ-সম্রাট — কথাটা জানাজানি হলে তোমার চাকরি থাকবে কিনা!
ইতি
Guess Who!"
"বলতো কে?"-র নির্দেশ আধাআধি পালন করেছিল পত্র-প্রাপক ম্যাককিলভি। চিঠিখানা ছিঁড়ে ফেলে; কাউকে জানায়নি, কিন্তু খোঁজ নিয়ে জেনেছিল, ওই অজ্ঞাত পত্রলেখকের প্রথম ও তৃতীয় সংবাদ নিছক সত্য! কে এই ম্যাককিলভি?
নিউ-মেক্সিকোর এক জনমানবশূন্য প্রান্তরে অন্তজ জনপদ সান্তা-ফে। সেখান থেকে সোজা পাহাড়ে উঠে গেছে একটা উদাসী পথ। সেই পথের শেষ প্রান্তে সমুদ্র সমতল থেকে সাত হাজার ফুট ওপরে পার্বত্য অরণ্যে রয়েছে লস-অ্যালামস। লোক চক্ষুর আড়ালে ম্যানহাটন প্রজেক্টের আন্ডারে এখানেই গড়ে উঠল প্রথম পরমাণু বোমা তৈরির গোপন ফ্যাক্টরি। তৈরি হল কারখানা-ঘর, স্টাফ-কোয়াটার্স, জলবিদ্যুৎ সরবরাহ ইত্যাদি। সেটা ১৯৪৩ সালের ঘটনা। প্রথম বছরে ওখানে এল ম্যানহাটন প্রজেক্টে কর্মরত বিজ্ঞানী-সিকিউরিটি-শ্রমিক-সেনাবাহিনীর জাঁদরেল অফিসার সমেত সাড়ে তিন হাজার কর্মী। পরের বছর সংখ্যাটি বেড়ে দাঁড়ায় ছয় হাজারে। লস-অ্যালামসে ম্যানহাটন প্রকল্পের সিকিউরিটি ব্যবস্থা অত্যন্ত কড়া। প্রত্যেক বিজ্ঞানীর একেকটি ছদ্মনাম দেওয়া হয়েছে, যাতে বাইরের পৃথিবীসুদ্ধ লোক জানতে না পারে এখানে কী ঘটছে। এত এত বিজ্ঞানী কেন পাহাড় চূড়ায় একসঙ্গে জমায়েত হয়েছে? চরম গোপনীয়তার মোড়কে সেখানে তৈরি হচ্ছে অ্যাটম বোমা। এ হেন ম্যানহাটন প্রকল্পে সিকিউরিটি দপ্তরের সেনসর বিভাগের বড় কর্তা ছিলেন মিঃ ম্যাককিলভি। কারখানায় যাওয়া-আসা সমস্ত চিঠিপত্র সেনসর করতেন তিনি। তো, একবার নিজের স্ত্রীকে চিঠি লিখলেন ফাইনম্যান। উনার পত্নী থাকতেন দুহাজার মাইল দূরে, নিউ ইয়র্কে। ভদ্রমহিলা দারুণ অসুস্থ। সেজন্য নিয়ম করে ফাইনম্যান চিঠি লিখতেন লস-অ্যালামসে বসে। এদিকে, স্ত্রীকে পাঠানো সমস্ত চিঠিপত্র প্রথম আসে ম্যাককিলভির হাতে। চিঠিখানা পড়ে ম্যাককিলভি কোনো সন্দেহজনক মেসেজ না পেলে চিঠি পোস্ট করার জন্য অ্যাপ্রুভাল দেয়। সে যতই জরুরি চিঠি হোক কিংবা প্রেমপত্র! সন্দেহজনক তথ্য পেলেই চিঠি পাস হবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না সংশ্লিষ্ট বাক্য বা শব্দটি চিঠি থেকে বাদ পড়ে। এটাই নিয়ম। কিন্তু নিয়ম নীতির তোয়াক্কা বিজ্ঞানীরা কবে করেছেন? সুতরাং চিঠি আদান প্রদান নিয়ে সিকিউরিটি অফিসারের সঙ্গে ফাইনম্যানের একপ্রস্থ ঝামেলা লেগেই গেল।
সাঙ্কেতিক ভাষা ডি-কোড করা নিয়ে ম্যাককিলভির সঙ্গে একবার খুব বেধে গিয়েছিল ফাইনম্যানের। অপমানিত বোধ করেছিলেন সিকিউরিটি অফিসার। তারপর থেকে দুজনের একদম বনিবনা হয় না। তক্কে তক্কে ছিলেন অফিসার। সুযোগ খুঁজছিলেন অপমানের বদলা দিতে। অযাচিত সে সুযোগ হাজির হল একদিন। স্ত্রীকে লেখা বিজ্ঞানীর একখানা চিঠি ম্যাককিলভির হাতে এল। সেই চিঠি নিয়ে সোজা বৈজ্ঞানিকের কাছে হাজির ম্যাককিলভি।
বললে, এক্সকিউজ মি স্যার। এ চিঠি পাস হবে না।
ফাইনম্যান দেখলেন তাঁর স্ত্রীকে লেখা প্রেমপত্রখানি খামখোলা অবস্থায় নিয়ে এসেছে ম্যাককিলভি। ব্যাপারখানা কী? দেখা গেল — চিঠির এক জায়গায় ফাইনম্যান স্ত্রীকে লিখেছেন, 'সাত হাজার ফুট উঁচুতে থাকায় নিউ মেক্সিকোর গরমটা আমরা টের পাচ্ছি না।'
চিত্র -৫
'নিউ মেক্সিকো' আর 'সাত হাজার ফুট' এই দুটো শব্দে তীব্র আপত্তি। আপত্তির কারণ, ম্যাককিলভির ধারণা একটা রিলিফ-ম্যাপ খুললে মিসেস ফাইনম্যান সহজেই বুঝে যাবেন সাত হাজার ফুট উঁচুতে নিউ মেক্সিকোর কোথায় বিজ্ঞানী রয়েছেন! সুতরাং এ চিঠি পাস হবে না। দুরন্ত ক্রোধে ম্যাক-এর হাত থেকে চিঠিখানা ছিনিয়ে নিয়ে ফাইনম্যান কুচি কুচি করে ছিঁড়ে ফেলে দিলেন। হাসতে হাসতে ফিরে গেল ম্যাক। পরক্ষণেই আবার তাকে ফিরে আসতে হল ডিক-এর ডেরায়। এবারও তার হাতে ফাইনম্যানের স্ত্রীকে লেখা আরেকটি চিঠি। এইবার ফাইনম্যান লিখেছেন "RETEP" কেমন আছে? SBM OBMOTA এ বছর এসে পৌঁছতে পারবেন বলে মনে হয় না।" পড়ে মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারেনি ম্যাক। RETEP অথবা SBM OBMOTA কারও নাম হয় নাকি? ফ্যাল ফ্যাল করে ফাইনম্যানের দিকে তাকিয়ে রয়েছে সে।
লস অ্যালামসে ফাইনম্যানের ছদ্মনাম মিস্টার হেইলি। তো, প্রফেসর হেইলি বলে উঠলেন – অক্ষরগুলো উল্টোপাল্টা করে সাজানো আছে। আমার স্ত্রী অনায়াসেই বুঝবেন। Retep হচ্ছে Peter, আমার ছেলে। আর Sbm Obmota হচ্ছেন Mrs. Mobota, আমার পুত্রের গভর্নএস; একজন কিউবান মহিলা। ছুটি নিয়ে দেশে গেছেন। এ বছর আর ফিরবেন বলে মনে হয় না।
ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল ম্যাক-এর। পাস হয়ে গেল চিঠি। কিন্তু একটু ভালো করে উল্টো দিক থেকে পড়লে স্পষ্ট বোঝা যায় শেষোক্ত শব্দ দুটিতে লেখা আছে 'Atom Bombs'। সেদিন ফাইনম্যান কী পরিমাণ ঝামা ঘষে দিয়েছিল ম্যাক-এর নাকে, তা দিন তিনেক পরে ম্যাককিলভিকে পাঠানো উপরের টাইপ-করা-চিঠিখানা পড়লেই বোঝা যায়। ভাগ্যিস ঘটনাটি উচ্চ পদস্থ সিকিউরিটি অফিসারদের নজরে আসেনি। অন্যথায়, ম্যাককিলভির জীবনে নেমে আসত গাঢ় অন্ধকার।
এদিকে ফাইনম্যান অত্যন্ত খুশি। এরপর তাঁর প্রেমপত্র সেনসর করার দুঃসাহস দেখায়নি সিকিউরিটি অফিসার।
(৬)
শেষের কবিতা :
শেষমেশ হাজির শেষের সেদিন। ১৬ই জুন ১৯৪৫। শনিবারের সকাল। আরলিনের বাবার ফোন এল লস অ্যালামসে। এমার্জেন্সি! সময় বড্ড কম! তড়িঘড়ি দু'শ মাইল দূরের হাসপাতালে রওনা দেয় রিচার্ড। ঘনিষ্ঠ বন্ধু ক্লাউস ফুকসের চার চাকাটি চেয়ে চিন্তে গ্যারেজে রেখে দিয়েছিল সে যাতে প্রয়োজনের সময় কাজে লাগে। সাদা ধুলো উড়িয়ে গাড়িখানা যখন আলবুকারক্যু পৌঁছে, তখন প্রায় সব শেষ! আরলিনের জীবনের অন্তিম নিঃশ্বাস পড়ছে। হাসপাতালে আরলিনের বেডের পাশে এসে বসল রিচার্ড। মৃত্যু পথযাত্রী স্ত্রীর অশক্ত হাতখানা নিজের দুহাতের মুঠিতে ধরে বসে থাকে অনেকক্ষণ। ঘরের ভেতরে পিন ড্রপ সাইলেন্স। নিস্তব্ধ। নিঃশ্বাসের শব্দ শোনা যায়। আরলিনের বুক ওঠে-নামে। ফ্যাকাসে মুখে শূন্য হাঁসি ফুটে ওঠে। রিচার্ড যখন হসপিটালে প্রবেশ করে, তারপর অল্প ক'ঘণ্টা বেঁচে ছিল আরলিন। একসময় তার চোখের পাতা চিরতরে বন্ধ হল। নিভে গেল তার জীবন প্রদীপ। থেমে গেল হৃৎপিণ্ড। এখন সে শুধুই মাংসের নিথর পিণ্ড।
চিত্র -৬
একজন নার্স ঘরে ঢুকল। ডেথ সার্টিফিকেট তৈরি। সেখানে রিচার্ডের সিগনেচার দরকার। স্বাক্ষর সংগ্রহ করে নার্স বেরিয়ে গেল। নার্সের পেছনে বাকি সবাই। ঘরের ভেতর এখন শুধু দুজন। মৃত আরলিনের সাদা কাপড়ে ঢাকা পার্থিব শরীর এবং বাকশূন্য রিচার্ড। একফোঁটা জল নেই ছেলেটার চোখে। ভাবুক চোখ দুটো স্থির। তার ক্ষীণ দৃষ্টি আটকে গেল বেডের পাশে রাখা হাতঘড়ির ওপর। ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে অতীতের কথা স্মরণে আসে তার। ভাবনারা ভীড় করে অশান্ত মনে। সমুদ্রের লক্ষ লক্ষ জলরাশি আছড়ে পড়ে হৃদয়-সৈকতে।
'বছর সাতেক আগের ঘটনা। অসুস্থ আরলিনকে সে উপহার দিয়েছিল একখানা ডিজিট্যাল হাতঘড়ি। তখনকার লেটেস্ট মডেল। হাত দিয়ে ঘড়ির সংখ্যাগুলো বদলে দিতে হয় প্রয়োজন মত। অসুস্থ আরলিনের বেডের পাশেই সবসময় থাকত সেটি। আজও এর অন্যথা হয়নি। যথারীতি বেডের পাশে রাখা। সেটি হাতে তুলে সামান্য নাড়াচাড়া করে দেখল রিচার্ড। মাঝে মধ্যে যখন ঘড়িটা খারাপ হয়েছে, অবলীলায় সারিয়ে তুলেছে সে। আজ থেকে আর সারানোর প্রয়োজন পড়বে না। ঘড়িটার মালকিন যে-সময় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করল, বন্ধ হওয়ার ফলে ঘড়িতে তখন ৯:২২ রাত্রি; ডেথ সার্টিফিকেট লেখার সময়। নির্মম সময়ের হিসেবটা তার নরম হৃদয়ে চিরটাকাল গেঁথে থাকবে। ঘড়ির সংখ্যাগুলো ক্রমশ অস্পষ্ট হচ্ছে। শবঘরের আলো ক্ষীণ থেকে আরও ক্ষীণ হচ্ছে। ঘন আঁধারে ঢেকে গেল আরলিনের ঘর। বাইরে বেরিয়ে এলেন বিজ্ঞানী। ঝাপসা দৃষ্টি। মনে হাজারো প্রশ্ন। ভেতরে ভেতরে ক্ষয়ে যাচ্ছিল তার পাংশুটে ফুসফুস। বিবেক। চেতনা। মনে মনে প্রশ্ন করে — "হতে পারে, আমি বোকা ছিলাম। কিন্তু ভেবে অবাক হচ্ছি – কীভাবে আমার অনুভূতিগুলো, এমন সিচুয়েশনে লোকের ভাবনা তো স্বাভাবিক, বেদনা হয়ে ঝরে পড়ল না? আমি উৎফুল্ল হইনি ঠিকই; সত্যি বলতে আমার দুঃখ বোধও হচ্ছে না। কেন? তবে কি বিগত সাত বছর ধরে প্রিয়তমার আসন্ন মৃত্যুর একটু একটু প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম আমি?"
"এখনও অব্দি সত্যিই জানি না কীভাবে লস অ্যালামসে বন্ধুদের মুখোমুখি দাঁড়াব আমি! লোকজন এটা নিয়ে দীর্ঘক্ষণ কথা বলুক – এ আমার তীব্র না-পসন্দ।"
"যখন ফিরলাম, সকলের একটাই জিজ্ঞাস্য – 'কী হল?'
'সে মরে গেছে। এদিকের কাজ কেমন চলছে?' — আমি জানতে চাইলাম।
মনে পড়ে মৃত্যুর দশ দিন আগে আরলিনকে লেখা রিচার্ডের চিঠি; যে-চিঠির ছত্রে ছত্রে প্রেয়সীর মৃত্যুর পূর্বাভাসের সম্ভাবনা উস্কে নিজের অক্ষমতা প্রকাশের কী নিদারুণ প্রয়াস!
"আমার প্রিয়তমা স্ত্রী,
সর্বদা আমি খুব মন্থর। চটজলদি বুঝতে না-পারার অক্ষমতার জন্য তোমাকে সবসময় কষ্ট দিয়ে ফেলি। এখন আমি বুঝতে পারি। এখন তোমাকে আনন্দ দেব।
শেষমেশ বুঝতে পারি, তুমি কত কষ্টে রয়েছ। বুঝতে পারি, অপরকে বিড়ম্বনায় না-ফেলার নতুন উদ্যমের কথা এখন তোমাকে জিজ্ঞেস করার সময় নয়। তোমার কাছ থেকে কোনো রকম উদ্যোগ সম্পর্কে প্রশ্ন করার সময় নয় এটা। তোমাকে স্বস্তি দিতে আমি যেভাবে ভাবছি সেভাবে নয়; তুমি যেভাবে পছন্দ কর, সেভাবে তোমাকে আরাম দেওয়ার সময় এখন। তোমার মত করে তোমাকে ভালোবাসার সময় এখন।
আমি সব বুঝি, প্রিয়ে। সবকিছু আমাকে বুঝতে হবে, কারণ এখন আমি জানি তুমি এত দুর্বল যে কোনো কিছু ব্যাখ্যা করার অবস্থায় নেই। আমার ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই। আমি তোমাকে ভালোবাসি। আমি তোমাকে পূজা করি। অবান্তর প্রশ্ন ছাড়া, কেবল অন্তর্দৃষ্টির সাহায্যে আমি তোমার সেবা করব।
শক্ত নির্মেদ যে-পিলার তোমার প্রয়োজন, তা সরবরাহ করতে না পেরে আমি অনুতপ্ত। এখন আমি এমন একটা মানুষ যার উপর তুমি ভরসা করতে পার,আস্থা রাখতে পার। তোমার দারুণ অসুখে তোমাকে ঠকাব না আমি। চাইলে আমাকে ব্যবহার কর। আমি তোমার স্বামী।
এক মহিয়সী অসুস্থ মহিলাকে আমি পূজা করি। দেরীতে তোমাকে বোঝার জন্য আমাকে ক্ষমা কর। আমি তোমার স্বামী। আমি তোমাকে ভালোবাসি।"
লস অ্যালামস থেকে লেখা এটি শেষ হৃদয়-বিদারক চিঠি। সেখান থেকে প্রিয়তমা পত্নীকে চল্লিশখানা চিঠি লিখেছিলেন রিচার্ড ফাইনম্যান।
(৭)
ফাইনম্যান-প্রেম :
পর্ণমোচীর পাতা ঝরিয়ে ফেব্রুয়ারি এলে বসন্ত প্রেম উঁকি মারে প্রকৃতির হৃদয়ে, মনে। পলাশ ফুলে রাঙা হয়ে ওঠে বিবর্ণ মন। বাঙালির সরস্বতী পূজা এবং ভ্যালেনটাইন ডে — দুই প্রেমের দিন এবছর একই দিনে সমাপতিত। ১৪ই ফেব্রুয়ারি। প্রেম নিবেদনের শুভ ক্ষণ। আচ্ছা, দিনক্ষণ আর সময় মেপে প্রেমে পড়া যায় কি? প্রেম কি কেবল দুটি শরীরের মিলন, নাকি, তার চাইতে আরও বেশি কিছু? মরণের পরেও কি ভালোবাসা যায়? ভালোবাসার মানুষের মৃত্যু হলে তার অবিনশ্বর আত্মার কি কখনও মরণ হয়?
প্রেমের সঙ্গে শরীর ও মনের কী সম্পর্ক? রক্ত মাংসের শরীরে যখন প্রেম বাসা বাঁধে, অতিরিক্ত অ্যাড্রিনালিন ক্ষরিত হয় কার নির্দেশে? গোপনে কে জোগান দেয় প্রেমে-পড়া-মানুষের পৃথিবী জয় করার অফুরন্ত শক্তি?
শরীরের মৃত্যু আছে, অথচ সত্যিকারের প্রেম অমর। আসলে প্রকৃত প্রেমের মরণ হয় না কখনও। আত্মার মতো প্রেম অবিনশ্বর। মন প্রাণ ঢেলে যাকে একবার ভালোবাসি, সে-ভালোবাসা চিরন্তন। অবিশ্বাসের চৌকাঠে কিংবা মৃত্যুর সঙ্গে সরাসরি সংঘাতে একদিন পার্থিব প্রেম অন্তর্হিত হয়ে গেলেও কোমল মনের সংগোপনে তা গচ্ছিত থাকে চিরকাল। ফাইনম্যানের পত্নী-প্রেম সেই ধারণায় সিলমোহর লাগায়। প্রিয়তমার মরণের পরে তাঁকে স্মরণ করে ভালোবাসার যে অনন্য ঐশ্বরিক দৃষ্টান্ত ফাইনম্যান স্থাপন করে গেছেন, এককথায় তা নজিরবিহীন। মরনোত্তর সব প্রেমের পরিণতি তাই 'ফাইনম্যান-প্রেম' নামে খ্যাত হোক বিশ্বব্যাপী।
তথ্যসূত্র :
(1) 'Surely You're Joking, Mr. Feynman' book
(2) Interview with Joseph Heller by Shelley Erwin, Laguna Woods, California
(3) Wikipedia, Different Online
0 Comments